নবপূর্ণিমা পর্ব-০৬

0
5

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৬

আজ যেন রিমঝিম একটু বেশিই অবাক। গোসল শেষে চুল শুকাতে শুকাতে রুমে ফিরতেই দেখে,সালমান খাটের ওপর তার প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে রাখছে। জামাকাপড়, ব্যাগ, স্কার্ফ-সব সাজানো। রিমঝিম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ এমন পরিবর্তন?
নাকি… তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে দিতে চাইছে?
এটা ভেবেই হঠাৎ বুকটা ধক করে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো-না, এমনটা ভাবা উচিত না। হয়তো সত্যিই সালমান শুধরাতে চাইছে।

এমনিও আজ রিমঝিম নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাপের বাড়ি যাওয়ার। কাউকে না জানিয়েই, কারও অনুমতি বা অনুমোদনের অপেক্ষা না করে। বহুদিন ধরে এই বাড়িতে তার ইচ্ছের কোনো দাম নেই। প্রতিবার যেতে চাইলে তাকে অনেক আগেই জানাতে হতো, তাও মাত্র দুদিনের জন্য অনুমতি মিলত।
কিন্তু আজ, অবাক করা ব্যাপার-সালমান নিজেই যেন পথ করে দিচ্ছে তার জন্য।
রিমঝিম চুপচাপ নিজের হাতের ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়।
ধীরে বোরকা পরে নেয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। পিছন থেকে সালমানও অফিসের পোশাকে তৈরি হয়ে নেয়।
তাকে দেখে মনে হয়, যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।
রিমঝিম আড়চোখে দু-একবার তাকায়। নিজের ব্যাগটা তুলতে যায়, তখনই সালমান চুপচাপ এগিয়ে এসে ব্যাগটা তুলে নেয়।

রিমঝিম কিছু বলে না। এখন এসব নিয়ে কথা বাড়ানোর মানে নেই। সে সোজা এগিয়ে গিয়ে হালিমা বেগমের সামনে দাঁড়ায়। চুপচাপ পায়ের কাছে বসে সালাম করে।

হালিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

রিমঝিম একটুও বিস্মিত হয় না। আঘাত পেলেও, অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন।
যে কারণে একসময় সে পায়ে না পড়লে ‘বেয়াদব’ আখ্যা পেত, আজ সেই একই সালামের জবাবে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। সে জানে-এই বাড়িতে তার যেকোনো কাজেই খুঁত ধরা হবে। সে থাকলেও ভুল। না থাকলেও হয়তো ভুল।
তবু আজ, নিজের তুচ্ছ জায়গাটা রিমঝিম ছেড়ে যাচ্ছে সাময়িক শান্তির আশায়।

রিমঝিম পা ছুঁয়ে সালাম করতেই হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা সালমান সেটা স্পষ্ট দেখল। সে চুপ করে থাকতে পারলো না। তার ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো।
সে মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“মা, রিমঝিম কয়েক দিনের জন্য বাপের বাড়ি যাচ্ছে।”

হালিমা বেগম মুখ শক্ত করে বললেন,
“যাচ্ছে তো ভালো কথা। কিন্তু অনুমতি তো কেউ নিলো না!”

সালমান অবাক হলো না মোটেও। সে প্রতুৎত্তর করলো,
“আশ্চর্য মা! ওর বাপের বাড়িতে ও যাবে, তাও আবার এতজনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে?”

হালিমা বেগম ভ্রু কুঁচকে শুধালেন,
“এতজন মানে? তুই আমার কথাই বলছিস বুঝি?”

সালমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ মা। আমি আর তুমি-এখানে আলাদা করে অনুমতির কিছু দেখি না। বিয়ে করার পরেও যদি একটা মেয়ে তার নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য ফর্মালিটি মেইনটেইন করে, তাহলে তো সে এখনো এখানে অতিথিই রয়ে গেলো!”

হালিমা বেগম ছেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। এমন প্রতিবাদী কথা সালমানের মুখে কখনো শোনেননি তিনি।
তবু নিজেকে সামলে নিয়ে রাগ চেপে বললেন,
“তোমার বউয়ের কি এখানে কদর নেই বুঝি? এখানে যত্ন পাবে না? একটু অসুস্থ হলেই বাপের বাড়ি ছুটছে-এই হচ্ছে এখনকার বউ!”

রিমঝিম পাশে দাঁড়িয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, যত্ন তো অনেকই পাই এখানে। এতটা যে, বাঁচার জন্যই এখন একটু দূরে যেতে হচ্ছে।”

সালমান শুনেও কিছু বলল না। সে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“রিমঝিমের মতো করে যত্ন তো আর তুমি দিতে পারবে না, মা। তুমি বয়স্ক হচ্ছ। আর মা তো মা-ই—তার নিজের মা নিশ্চয়ই ওকে ভালো করে দেখবে। হয়তো তুমিও বিয়ের পর এমনটিই চেয়েছিলে!”

শেষ কথাটা বলতে না বলতেই হালিমা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখে এক অদ্ভুত ছায়া নেমে এলো।
মনে পড়ে গেল পুরোনো দিনের কিছু দৃশ্য।
বিয়ের পর যখন বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা উঠত, তখন তাকে জনে জনে বলে অনুমতি নিতে হতো। যতদিনের জন্য যেতেন, ততদিনের রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সব আগেভাগেই সেরে যেতে হতো।
অনুমতি পেতেন দুই দিনের, কিন্তু প্রথম দিনের কাজ শেষ করতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত।
তখন শাশুড়ি বলতেন,
“বাড়ির বউ সন্ধ্যার পর বেরোয় না।”
আর সেই সন্ধ্যায় আর যাওয়া হতো না। পরেরদিন, অল্প কিছু সময়ের জন্য বাপের বাড়ি গিয়ে, মায়ের আঁচলে একটু মাথা রাখতেই আবার ফিরতে হতো শ্বশুরবাড়ির দায়ে, দায়িত্বে।
চোখের পলকে সেই শান্তির মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেত।
হাসিমাখা মুখে থাকত গভীর হাঁসফাঁস আর অতৃপ্তির চাদর।
কখনো কাউকে বলেননি, কিন্তু বুকের মধ্যে জমে থাকা হতাশাগুলো আজও ঝরে পড়ে দীর্ঘশ্বাসে।

হালিমা বেগম মনে মনে স্বীকার করলেন,তিনি বিয়ের পর স্বস্তিময় জীবন পাননি, শান্তি পাননি। তাই তার ছেলের বউকেও সেই সুন্দর স্বস্তি জীবন সে চাইলেও দিতে পারবে না। কারণ ছেলে বৌমার সুন্দর মুহূর্ত দেখলে তার আফসোস হবে, বুক হাহাকার করে উঠবে।
হ্যাঁ, এটা অন্যায়—সে জানে। কিন্তু তিনি বদলাতে পারবেন না।
কারণ, যেটা তিনি পাননি, সেটা কাউকে দিতে চাইলেও দিবেন না। তিনি নিজেও নিজেকে খারাপ জানেন, তবুও নিজের খারাপত্ব আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকবেন। তবু নিজেকে আফসোস করতে দিবেন না।

হালিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নেন। তার চোখেমুখে একরকম অস্বস্তি। আর ঠিক তখনই সালমান হালকা হেসে বলল,
“যাই হোক মা, নিজের মায়ের মতো তো কেউ হয় না।
যেমন তুমি আমার জন্য সব করো, ঠিক তেমনি তো তোমার মা তোমার জন্য করতেন, আর দাদু – আমার বাবার জন্য। যেমনটা ঠিক এখন আমার জন্য করছো তুমি! তাই না মা?”

সালমানের কণ্ঠে ছিল না কোনো অভিযোগ, ছিল কেবল র দীর্ঘশ্বাস মেশানো সত্যের আর্তি।
হালিমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। শেষকথাটা যেন তার ছেলে তাকে ইচ্ছে করেই বলেছে।
আজ তার ছেলের কথা, আচরণ, এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিটাও যেন তার বোধের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এই ছেলে তো তার চেনা সেই ছেলেটা নয়- যে ছোট্ট একটা কথায় সব ভুলে গিয়ে মায়ের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে যেত, যে কখনো স্ত্রীর পক্ষ নিত না!

তিনি মনে মনে ফুঁসলেন।
‘গেলেই যাক, কয়েকটা দিনের মধ্যেই ছেলেকে তিনি আবার নিজের করে নিবেন। যেমনটা তার শাশুড়ি স্বামীকে করতো। ঠিক তেমন করে তিনিও ছেলেকে হাত করে নিয়ে নিবেন।’
তিনি মনে মনে ঠিক করলেন,আগে যেভাবে মুখ করে তাকে নিজের পক্ষে নিয়ে এসেছেন, আবারো তাই করবেন।

সালমান মায়ের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলেন।
তার চোখে যেন এক নরম উপলব্ধি,এই মুহূর্তে রিমঝিমকে বাপের বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্তটা ঠিকই হয়েছে।
উভয়েরই সময় দরকার। একটু নিজের মতো করে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দরকার। যাতে দুদিকেরই উপলব্ধি আসে।

রিমঝিম পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। শুনছে সব,বুঝে নিচ্ছে সবটাই। সে কিছু বলে না। কারণ এ তো এখন তার চিরচেনা অভ্যাস। কিন্তু সালমানেরটা তাকে ভাবিয়ে তুললে।
সে চোখ নামিয়ে নিয়ে চুপচাপ দরজার দিকে পা বাড়ায়।

রিমঝিম গাড়িতে উঠে বসে।
চোখে মুখে কোনো ভাব প্রকাশ নেই। পাশে এসে বসে সালমান, গাড়ি স্টার্ট দেয়।
শব্দ করে কিছু না বললেও রিমঝিমের ভিতরটা অদ্ভুত এক কৌতূহলে ছটফট করছে।
এই সালমানকে সে যেন চিনতেই পারছে না।
প্রতিদিনকার পরিচিত রুক্ষ, একরোখা স্বামীটি যেন আজ অন্য কারো মতো আচরণ করছে।
এত সহজে তাকে যেতে দিচ্ছে! তাও আবার নিজ হাতে ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে তুলে—এতটা নম্র আচরণ তার কল্পনাতেও ছিল না। তার উপর মাকে এতো এতো কথা!

গাড়ি চলছে, আর রিমঝিম চুপচাপ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে।
মনে মনে সে ভাবে,তার ইচ্ছে ছিল চুপিচুপি চলে আসবে। কোনো বিদায় নয়, কোনো ব্যাখ্যা নয়। এই সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে বহুদিন ধরে জমে উঠেছিল তার মনে।
কিন্তু মেয়েদের সংসার ফেলে যাওয়া এতো সহজ নয়।

একটা সংসার মানেই শত বাঁধনের টান।
শুধু মানুষ না, জড়িয়ে থাকে স্বপ্ন, অভ্যাস, শিকড়—আর সমাজ নামের কঠিন এক দেয়াল।
যদিও সমাজের মুখগুলোকে সে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু তার মা? মায়ের কান্না, মায়ের উপদেশ, আর সেই মায়ের ইচ্ছার সামনে সে বারবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
আর এই সংসার…
কতটুকুই বা না জড়িয়ে পড়েছে সে!
শুধু রান্নাঘরের গন্ধ নয়, ঘরের প্রতিটা কোণ যেন তার হাতে গড়া।

তাই সে ভাবছিল, কয়েকটা দিন দূরে গেলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা নরম হবে, সালমান ভাববে, বুঝবে।
কিন্তু সালমান এমন করে নিজেই তার জন্য পথ করে দেবে—এইটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল।

সে কিছু বলে না।
চোখ শুধু বাইরের দৃশ্যে আটকে থাকে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার ভিতরটা ফুঁড়ে উঠছে একটাই প্রশ্ন—
এই বদলে যাওয়া সালমান, আজকে কি সত্যিই তাকে বুঝেছে? নাকি সবটাই শুধুই সাময়িক এক শান্তির ছায়া? নাকি এসেই আবার সেই আগের সালমানকেই পাবে! যে শুধুই তার শাশুড়ির ছেলে। তার স্বামী নয়!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে