নবপূর্ণিমা পর্ব-০১

0
38

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১

“এতো বড়ো মাছ বাপের ঘরে কোনোদিন দেখেছো?যে-পিস নিয়ে নিয়ে লাট সাহেবের মতো প্লেট নিয়ে খেতে বসে গেছো?”
শাশুড়ির কথায় রিমঝিমের চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে প্লেটের ধারে। মুখে তোলা প্রথম লোকমাটা মাঝপথেই থেমে যায়।

“কী হলো? মুখে কুলুপ এঁটেছো ক্যান!”

হালিমা বেগমের কণ্ঠে কাটা বাঁশের মতো খচখচে সুর। উনার শব্দগুলো রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে।

রিমঝিম ঠায় নিশ্চুপ বসে থাকে। শাশুড়ির এই কথাগুলো আজকের নতুন কথা নয়। বিয়ের দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
এবং এরপর থেকেই নিয়ম করে পেটে খাবার না পড়লেও এরকম অনেক ‘কথা’ তার গলার কাঁটা হয়ে জড়িয়ে থাকে।
তৃপ্তির বদলে কষ্টে পেট টইটুম্বুর হয়ে যায়।

“কী হলো? কথা কানে যায় না? সবাই খাওয়ার সাথে সাথে এভাবে লাট সাহেবের মতো খেতে বসে গেছো ক্যান?”
আরও একবার বিদ্ধ করা হয় বাক্যবাণে।

রিমঝিম কাঁপা কণ্ঠে বলার চেষ্টা করে,
“এভাবে বলছেন কেন আম্মা?”

হালিমা বেগম চোয়াল শক্ত করে জবাব দেন,
“বলবো না তো কি করবো? বলি, বাড়ির বউরা খাবে সবার পরে। আমরা ছিলাম একরকম। আর তুমি হইছো ভিন্ন! যেদিন ভালো মন্দ খাবার হবে সেদিনের কথা তো বাদই দিলাম।”

রিমঝিম মুখ নিচু করে বলে,
“আমিও তো মানুষ, আম্মা… আমারও তো ক্ষুধা লাগে।”

“হো! যেদিন ভালোমন্দ রান্না হবে, সেদিনই বেছে বেছে তোমার ক্ষুধা লাগবে?”
হালিমা বেগম থেমে টিটকারির সুরে যোগ করেন,
“অবশ্য লাগবেই বা না কেন! বাপের জন্মে কোনোদিন এমন খাবার দেখেছো? নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থাও তো ছিল না!”

এতক্ষণ মুখ বুজে থাকা রিমঝিম আর চুপ থাকতে পারলো না। তার পরিবারকে নিয়ে অপমান শুনে শরীরের রক্ত টগবগ করে ওঠে।
সে মাথা তুলে কড়া গলায় বলে,
“যাই থাকুক না কেন। আমার পরিবার আপনার মতো ছোটোলোকি কোনোদিন করেনি!”

এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর…হুট্ করেই এগিয়ে এসে রিমঝিমের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরলো হালিমা বেগম।
ব্যথায় তার শরীর কুঁকড়ে উঠলো, চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল।
রিমঝিম আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। অশ্রুভেজা চোখে তাকালো স্বামীর দিকে,একটি আশার শেষ ঠিকানায়। কিন্তু সালমান নিরুত্তাপ। মুখে একফোঁটা স্পন্দন নেই। কোনো বিস্ময়ই নেই। তাকে যেন এই দৃশ্য ক্লান্ত করে তুলেছে কেবল।
মাথা তুলে চোখাচোখি করল না, শুধু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আহ আম্মা, ছেড়ে দাও। খেতে বসেও তোমাদের এসব নাটক দেখতে ইচ্ছে করছে না।”

সালমানের কথায় কোনো আবেগ নেই। শুধু কিছু উদাসীনতা বেছে আছে।
রিমঝিম বুঝতে পারলো – এই বাড়িতে তার শরীরের ব্যথা কাউকে না কাঁদালেও, স্বামীর অবহেলা তাকে নিঃশব্দে মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে।
চুল টেনে ধরাতে হয়তো চোখে জল এসেছিল, কিন্তু স্বামীর এই এক চিলতে তাচ্ছিল্য – তাতে চোখের ভেতরের সব কান্না একসাথে ঝরে পড়লো।

হালিমা বেগম চুল ছেড়ে দিতেই রিমঝিম কিছু বললো না। শুধু ধীর পায়ে সামনে থাকা প্লেটটা ঠেলে উঠে দাঁড়াল।
প্লেটটা যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেল।
তাপমাত্রা কমে আসা ভাতের ধোঁয়া তখনও উপরের দিকে উঠছে। ভাতের উপর একটুকরো মাছ আর কিছু বাসি সবজির ঝোল, যা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জুটেছিল! কিন্তু আর খাওয়া হয়ে উঠেনি।

রিমঝিম একটুও আর কারোর দিকে ফিরে তাকালো না। শুধু নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে গেল।
পেছনে পড়ে রইলো কিছু অসমাপ্ত লোকমা, কিছু ব্যথিত নিঃশ্বাস, আর একটুকরো ভালোবাসাহীন সংসার।

——-

রাত গড়িয়ে এলো। চুপচাপ ঘরে একা বসে রইলো রিমঝিম। অন্ধকারে ঠাসা রুমটা যেন তার মনটাকেও আরও গাঢ় কালোয় রাঙিয়ে দিল। বালিশে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।
কিন্তু কেউ এলো না। না শাশুড়ি, না স্বামী, না সেই সংসারের কেউ – একটি লোকমার জন্যও তাকে জোর করে ডাকলো না।
একটু পরে দরজার সামনে হালকা পায়ের শব্দ পেল সে।
ছোট ননদ, সামিয়া। এই বাড়িতে রিমঝিমের একমাত্র ভরসা। পায়ে পায়ে হেঁটে দুয়েকবার রুমের সামনে পায়চারি করলো সে। কিন্তু হালিমা বেগমের তিরস্কারের সুর ভেসে এলো,
“তোর আবার কি দরকার এখানে?”
“ভাবিপু তো খায়নি।”
সামিয়ার নরম সুরের কথায় হালিমা বেগম বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুধায়,
“ওসব নাটক দেখতে হবে না তোকে। যা, ঘুমা গিয়ে!”

সামিয়া আর কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। হয়ত চুপচাপ চলে গেল। এরপর আর ফিরে আসেনি।

রুম থেকে রিমঝিম সব শুনলো। দরজার ওপাশের প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি হয়ে বিঁধছিল তার বুকে। তবু সে চুপ। শুধু কাঁদতেই থাকলো।
ননদ তো অনেক দূরের ব্যাপার। যেখানে স্বয়ং স্বামী?
সে তো আরও বহু আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সেই দুপুরের পরে একবারও জানতে চায়নি – সে খেয়েছে কি না, কিংবা… ক্ষুদা লাগলো কিনা!

রিমঝিম হাসলো। এতদিন পরেও আর কী-ই বা আশা করা যায়! হয়তো এটাই তার কপালে লেখা ছিল।
এই নিঃসঙ্গতা, এই অবহেলা, এই গিলতে না পারা কান্নাগুলোই…

রাত গড়াচ্ছে। এই পুরোটা সময় রিমঝিমের পেটে একটা দানাও পড়েনি। অপমানে আর রুম থেকে বের হওয়া হয়নি। এখন বের হলেও রিমঝিম জানে, তার জন্য কোনো খাবার অবশিষ্ট রাখবে না । ক্ষুধায় পাক খেতে খেতে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে। কিন্তু রুমে কোথাও কোনো শুকনো খাবার নেই যে একটু মুখে দেবে।

রিমঝিম চুপচাপ বসে থাকে বিছানার এক কোনায়। দেয়ালে ছায়া পড়ছে জানালার পাশের গাছের পাতার – সেই ছায়াগুলোও যেন আজ তার মতোই কাঁপছে।
ক্ষণে ক্ষণে হেঁচকি উঠছে। ভেজা চোখে বালিশ চেপে ধরেছে বুকে।
একসময় দরজার আড়ালে শব্দ হয়। সালমান এসে দাঁড়ায়।
চোখে বিরক্তির ছাপ, মুখে ক্লান্তি।
রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“এই সামান্য কারণে এত কান্নাকাটি করছো কেন?”

রিমঝিম ধীরে মাথা তোলে। চোখে কেবল একরাশ বিষণ্ণতা আর মলিন দৃষ্টি। সে কণ্ঠ ভারী করে বলে,
“তোমার কাছে এটা সামান্য? আমি খেতে বসে মার খেয়েছি আজ।”

সালমান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
“মার খাওয়ার মতো আচরণ করলে তো খাবেই। মা একটু বদমেজাজি, তা তো জানো। এসব মেনে চলতে শেখো। মুখে মুখে তর্ক করো কেন?”

রিমঝিম বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সালমানের দিকে,
“তোমার কাছে আমার কথাগুলো তর্ক মনে হয়েছে? আর তোমার মা যা বললেন, করলেন, সেগুলো?”

সালমান এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“এই তেজটাই তোমার সর্বনাশের কারণ। এখনো দেখো, আমার সাথেও মুখে মুখে করেই যাচ্ছো।”

রিমঝিম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বুক ভেঙে কান্না আসে, কিন্তু সে আর কিছু বলে না। কী বলবে! এই মানুষগুলোর সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাও যে মরে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এতক্ষনে ধরে চেপে রাখা কান্নাগুলো আরো বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন! নিজেকে সামলাতে পারলো না সে।

রিমঝিমের হিচকি তোলা দেখে সালমান বিছানার পাশের ল্যাম্প নিভাতে নিভাতে বলে,
“ফ্যাচফ্যাচ করো না তো কানের পাশে। সকালে অফিস আছে আমার, ঘুমাতে দাও।”

এই কথাগুলো আর একফোঁটা আলো নিভে যাওয়া – সব মিলে একসাথে যেন আঁধার নামিয়ে আনে রিমঝিমের ভেতরটায়। সে চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। নিরব পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বারান্দায়।
অন্ধকার রাত। কোনোদিকে পূর্ণিমার আলো ছিটেফোঁটাও নেই। রাতের হাওয়া এসে তার চুল উড়িয়ে দেয়, তবু সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।

এই ঘর, এই মানুষগুলো, এই সম্পর্কগুলোতে – হয়তো তার সময় ফুরিয়েছে। সে তো চেয়েছিল টিকে থাকতে। ভুল করে ভালোবাসতে চেয়েছিল। কিন্তু যাকে ‘মা’ বলে ডাকতে চেয়েছিল, সেই হালিমা বেগম তাকে কোনোদিনই মেনে নেননি। দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
তবু তিনি এখনো সেই একই অবজ্ঞা, একই আঘাত পুষে রেখেছেন।
রিমঝিম জানে, সে এই বাড়ির এক কোণাও নিজের করে পায়নি। সালমান – যাকে ভালোবেসে সব ভুল মেনে নিয়েছিল, তিনিও আজ কেবল মুখ ফিরিয়েই নয়, তাকে ছোট করতে দ্বিধা করেন না।
সে চোখের জল মুছে নেয় ধীরে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদটা লুকিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে পূর্ণিমার মতো আলো ছড়াতে চাচ্ছে আবার ঢেকে যাচ্ছে।
আর সে জানে – এই চাঁদের মতো বাঁচাই এখন তার জীবন।

ভুল তো সে শুরুতেই করেছিল। ভুল মানুষকে আঁকড়ে ধরেছিল, আর সেই ভুলের মাশুল এখন গিলে নিচ্ছে নিঃশব্দে, প্রতিটা রাতে… প্রতিটা নিঃশ্বাসে।
এই ‘বাড়ি’টাই হয়তো তার জন্য সঠিক ছিল না।
নাকি, এই সংসারটা কখনোই তার ছিলই না?

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে