সৌরকলঙ্ক পর্ব-১১+১২

0
2

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১১

ঔষুধের প্রভাব কাটিয়ে জাহানারার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সে উন্মাদ প্রায়।কাউকে চিন্তে পারছে না,কাউকে সহ্য করতে পারছে না।নিজের নাম পরিচয় আর অবস্থান নির্ণয়ে চিৎকার চেঁচামেচিতে অস্থির করে তুলছে চারপাশ। জাহানারার কে সামলে ওঠা মুশকিল হল।তার অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হলো সকলে।বাধ্য হয়ে অল্প পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ প্রয়োগ করা লাগলো তার শরীরে।জাহানারার মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট আসলো পরেরদিন বিকেলে।রাকিব রিপোর্ট দেখে ভারী কণ্ঠে জানালো সে যে ভয় পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে। জাহানারা রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়া আক্রান্ত হয়েছে। এবং তার মধ্যে কমপ্লিট রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার আভাস দেখা গেছে।এ কথা শুনে জায়েদ এবার চিন্তিত হলো।আকিব ভেবে পেল না কি করবে।শাহেদ এই মুহূর্তে এসে পাশে দাঁড়ালো তাদের।রাকিবের সাথে কথা বলে আশরাফের সাথে পরামর্শ করে জাহানারা যত দ্রুত সম্ভব উন্নত চিকিৎসার আওতাধীন নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।

আদিব মায়ের সাথে মেজ খালার বাড়ি গিয়েছিল বেড়াতে যে জন্য জাহানারার শারীরিক অবস্থার খবরটা তার কানে পৌঁছাতে দুই দিন লাগলো।খবরটা শুনে জাহানারার জন্য দুঃখ হলো তার।সবে মাত্র মা-কে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠেছিল মেয়েটা আর তারমধ্যেই এমন একটা দুর্ঘটনা হলো যে সে নিজের অতীত সহ নিজের অস্তিত্ব টাই ভুলে বসলো। দিপ্তীর কাছ থেকে জাহানারার বেপরোয়া ব্যবহার আর পাগলামির কথা শুনে আদিবের খুব খারাপ লাগলো।হঠাৎ করে আবার ,সেদিন রাতে জাহানারার বলা কথাটা কানে বেজে উঠলো।সাথে সাথে বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো আদিবের ,গলা বুক শুকিয়ে গেল। দিপ্তীর সাথে কোন রকমে কথা শেষ করে ফোন লাগালো সে সজীব কে। সজীবের থেকে জাহানারার অবস্থা জানতে পেরে তার মনে হলো খুলনা ফেরার আগে মেয়েটাকে একবার চোখের দেখা দেখে গেলে মন্দ হয় না।মা কে জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে গাড়ি ছাড়াই নানা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আদিব।

আদিব যখন হাসপাতালে পৌঁছাল সময় তখন সন্ধ্যা সাতটার আশেপাশে। জাহানারার কেবিনের সামনে এসে থমকালো আদিব।কেবিনের ভেতর থেকে জাহানারার চিৎকার চেঁচামেচির আ‌ওয়াজ ভেসে আসছে।সেই সাথে রাকিবের শান্ত কণ্ঠ।মেয়েটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে রাকিব তবে সফল হচ্ছে না। জাহানারা পাগলের মতো বারবার এক কথা বলে যাচ্ছে,ওকে ডাকুন,ওকে ডাকুন,আমার হ্যাজবেন্ড কে,আমার হ্যাজবেন্ড কে ডাকুন,আমার হ্যাজবেন্ড কে ডাকুন, প্লিজ,আমার কেমন কেমন লাগছে লাগছে,ওকে ডাকুন প্লিজ,প্লিজ ওকে ডাকুন।

এক কথার পুনরাবৃত্তি।আদিব এগিয়ে গেল সামনে। দাঁড়ালো কেবিনের দরজার মুখে।দরজা খোলাই ছিল।জাহানারার অশ্রু সিক্ত চোখ মুখ,সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া মাথা,আকুতি ভরা কণ্ঠে বলা প্রতিটা কথা অদ্ভুত লাগলো আদিবের কাছে।সে স্থবিরের নেয় এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জাহানারার দিকে।তার যেন বিশ্বাস‌ই হলো না এই সেই জাহানারা যার গোছানো কথা আর দাপুটে মেজাজে তটস্থ থাকে তার আশে পাশের মানুষ।প্রায় এগারো বছর আগে এক পড়ন্ত বিকেলে আদিব যে অসহায় জাহানারা কে নিজের সামনে দেখেছিল সেই জাহানারার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো যেন এই জাহানারার মধ্যে।সে থমকালো।

রাকিব তখনো ধৈর্যের সাথে জাহানারা কে শান্ত করার চেষ্টা করছে।তবে জাহানারা তার কথা কানে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।সে এক কথা বারবার আওড়াচ্ছে,”ওকে ডাকুন,ওকে ডাকুন।”অস্থির ভাবে এক কথা বলতে বলতে একসময় কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়লো জাহানারা। অসুস্থ শরীর জিদের কাছে আর সাঁই দিল না হয়। শক্তি হারালো।ঢলে পড়লো পিছনে দিকে।জাহানারার পাশে থাকা নার্সটা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল। ধরলো তাকে।যত্ন নিয়ে আস্তে করে শুইয়ে দিল বালিশে।রাকিব তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল।চোখের সামনে থেকে রাকিবের চ‌ওড়া শরীরটা সরতেই দরজার বাইরে চোখ পড়লো জাহানারার। অশ্রু শিক্ত চোখ গিয়ে আটকালো আদিবের মুখে। অশ্রু ভেজা চোখে মুখে সাথে সাথে খেল গেল প্রাপ্তির হাঁসি। জাহানারা তার উৎফুল্ল ধিমী কণ্ঠে বলে উঠলো,

-তুমি এসেছো,তুমি এসেছো,তুমি এসেছ…!

কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো জাহানারা। স্তব্ধ হলো উপস্থিত সবাই।কেবিনের বাইরে থাকা সজীব,শাহেদ,এগিয়ে এলো কেবিনের দিকে।আদিব কে দেখে জাহানারার বলা কথায় হুঁশ ফিরলো তাদের।বুঝতে পারলো বিগত দুই দিন ধরে জাহানারা কার কথা তাদের বোঝাতে চায়ছিল।
জাহানারা কথায় তড়িৎ পিছনে ফিরে তাকালো রাকিব।আদিব কে দেখতেই ভ্রূ তে ভাঁজ গাঢ় হলো তার। জাহানারার কথার তাৎপর্য বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো আদিবের।সে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো, গভীর শ্বাস।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে টেনে নেওয়া শ্বাস টা নাসারন্ধ্র দিয়ে শব্দ করে বের করে জাহানারর দিকে তাকালো। জাহানারার মুখে দৃষ্টি রেখেই নিজের স্থির কদম বাড়িয়ে দিল তার দিকে।ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
জাহানারার পাশে বেড ঘেঁষে দাঁড়ালো ।জাহানারার নরম হাতটা নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে একটু ঝুঁকে নিজের গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

-কি হয়েছে?

-কোথায় ছিলে তুমি?আমার কেমন কেমন জানি হচ্ছিল।খুব কষ্ট হচ্ছিল।এখনো হচ্ছে।আমি কিছু মনে করতে পারছি না ।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।বুকের মধ্যে কেমন হচ্ছে।আমি মনে হয় মরে যাবো।এরা কিসব বলছে,কাকে দেখাচ্ছে আমি কাউকে চিন্তে পারছি না কিচ্ছু বুঝতে পাচ্ছি না……

কান্না ভেজা স্বরে অভিযোগের সুরে একের পর এক বলে গেল জাহানারা।আদিব টুল টেনে বসলো তার পাশে। জাহানারা বলা প্রতিটি শব্দ ,বাক্য, অক্ষর শুনলো মনোযোগ দিয়ে। জাহানারা এক সময় থামলো।চোখের পানিতে ভেজা পত্রপল্লব ঝাপটিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,

-আমি বাঁচবো না মনে হয়!

আদিবের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো সাথে সাথে। সেদিন রাতের সেই বীভৎস স্মৃতি টুকু ভেসে উঠলো চোখে।সে নিজের বা হাতটা আলতো করে জাহানারার ব্যান্ডেজ আবৃত কপালে রেখে নরম সুরে বলল,

-তোমার কিচ্ছু হবে না,আমরা তোমার কিচ্ছু হতে দেবো না।তুমি শান্ত হ‌ও।

-আমার কাউকে লাগবে না ,তুমি হলেই হবে।তুমি হলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো।তুমি কোথাও যেও না প্লিজ।

-ঠিক আছে।আমি কোথাও যাবোনা।

আশ্বস্ত সুরে বলল আদিব। জাহানারা তার কথায় আশ্বস্ত হলো। বাধ্য মেয়ের মত শান্ত হলো। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হলো তার। জাহানারা থির হতেই ঘাঢ় ফিরিয়ে রাকিবের দিকে একবার তাকালো আদিব।চোখের ইশারায় বোঝালো আমি সামলে নেব।রাকিব আদিবের চোখের ভাষা বুঝে নিল ।বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে।

-আমার পেটের ভেতর জ্বলছে, খুব।খিধে লেগেছে।আমাকে কিছু খেতে দিবা?

আদিব রাকিবের প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন জাহানারার কথাটা কানে গেল তার।সে জাহানারা দিকে তাকালো। মেয়েটার কথা শুনে তার অভুক্ত নিস্তেজ মুখটা দেখে মায়া হলো আদিবের।সে সাথে সাথে পাশে দাঁড়ানো নার্স কে বলল কিছু খাবার এনে দিতে।পরিপূর্ণ ভাবে জ্ঞান ফেরার পর থেকে একটা দানা পানি মুখে নেয় নি জাহানারা। দুই দিন ধরে স্যালাইনের উপরেই আছে সে ।আজ নিজে থেকে খাওয়ার আর্জি করায় তার দায়িত্বরত নার্স আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না।ছুটলো খাবার আনতে।তবে খাবার নিয়ে আসার পরে বাঁধলো বিপত্তি। জাহানারা নার্সের হাতে খাবে না,সে আদিবের হাতে খাবে। ডাক্তারি পেশা মানুষের সেবা করার জন্য বেছে নিলেও মানুষকে আজ পর্যন্ত এভাবে সেবা করা হয়নি আদিবের। জাহানারা কে খাওয়াতে গিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগতে হলো তাকে। জাহানারা খাওয়ার ফাঁকে নিজের কথা,নিজের পরিবারের কথা,সে এখানে কি করে এলো,এসব নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো।আদিব সময় নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে ধৈর্যের সাথে জাহানারার সব প্রশ্নের উত্তর দিলো।

জাহানারা কে খাবার খাওয়ানোর পর ঔষধ দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কেবিন থেকে বের হতে অনেকটা সময় লাগলো আদিবের।বাইরে বের হতে‌ই রাকিবের সাথে দেখা হলো তার।রাকিব তার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিল।আদিব কে দেখতেই সে আদিব কে আর শাহেদ কে নিজের কেবিনে আসতে বলল। আকিব হাসপাতালে উপস্থিত নেই আর জায়েদ মেয়ের অবস্থা দেখে বিধ্বস্ত প্রায় এই মুহূর্তে জাহানারার অভিভাবক হিসাবে শাহেদ‌কেই একমাত্র উপযুক্ত মানুষ মনে হলো রাকিবের কাছে ।সেই জন্য জায়েদ কে উপেক্ষা করে তাকে ডাকলো রাকিব।রাকিবের কেবিনে পৌঁছাতেই রাকিব আদিব আর শাহেদ কে বসতে বলল চেয়ারে।তারপর টেবিলের অপর পাশে গিয়ে নিজের বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসলো রাকিব।রাকিব চেয়ারে বসতেই শাহেদ তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো জাহানারা কেন আদিব কে নিজের স্বামী মনে করছে।উত্তরে রাকিব একটা হতাশ শ্বাস ফেলে বলল সেদিন জ্ঞান ফেরার পর নার্স নাহিদার বলা কথাটা জাহানারার মস্তিষ্কে বিরাট ছাপ ফেলেছে যার দরুন এই অবস্থা।

-কিন্তু তুমি তো বলেছিলে জাহান সব কিছু ভুলে গেছে, এমন কি নিজেকেও, তাহলে?

আবার প্রশ্ন করলো শাহেদ।আদিব দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিক তাকিয়ে এক নজরে সময় টা দেখে নিলো।মা-কে বলে আসা সময় ইতিমধ্যে পার হয়েছে।ফোন বের করে মায়ের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটা বার্তা পাঠিয়ে তাকালো রাকিবের দিকে।মন দিল তার কথায়।চাচার করা প্রশ্নটা তার মাথাতেও ঘুরছে। শাহেদের করা প্রশ্নের উত্তরে রাকিব বলল,

-চাচু , মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে জাহানারার স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়েছে এটা স্পষ্ট ।এখন আদিব কে তার কীভাবে মনে আছে সেটা আমি সঠিকভাবে বলতে পারছি না তবে ধারণা করছি জাহানারা আহত হ‌ওয়ার পর আদিব কে চোখের সামনে পা‌ওয়ায় তার মুখটা হয়ত ভুলতে পারেনি। তারপর আবার সেদিন নার্সের বলা ভুল স্টেটমেন্টেটা জাহানারার মস্তিষ্কে এমন একটা বিভ্রান্তির তৈরি করেছে যে, সেদিন নার্সের বলা কথাটা সত্যি মেনে নিয়েছে জাহানারা।এখন যেহেতু সে কাউকে চিন্তে পারছে না তাই নার্সের বলা কথাটাই তার কাছে সত্যি মনে হচ্ছে।তবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত না।এটা শুধু মাত্র আমার ধারণা।আমি কিছু টেস্ট করে আমার স্যারের সাথে কথা বলে তবেই নিশ্চিত ভাবে আপনাদের কিছু জানাতে পারবো।

-এখন আমাদের করণীয় কি ?

গম্ভীর কণ্ঠে আদিবের সোজা প্রশ্ন। রাকিব শাহেদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আদিবের উপর ফেলল।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের আকর্ষণীয় চেহারার মুখটা হঠাৎ কেমন যেন জ্বালা ধরলো তার বুকে।এমন একটা মুহূর্তে হঠাৎ এমন অনুভূতির কোন কারণ খুঁজে পেল না রাকিব।তবে আদিবের মুখটা তার দেখতে ইচ্ছা করলো না।মনে হলো আজ এই ছেলেটা এখানে না আসলে ভালো হতো।খুব ভালো হতো।মনের নেতিবাচক ভাবটা খুব সাবধানে গোপন করলো রাকিব তারপর বলল,

-আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার স্যারের সাথে কথা বলে জাহানারাকে ইউএসএ নিয়ে যা‌ওয়ার ব্যবস্থা করছি তুমি ততদিন একটু ওকে সামলে নাও।ও তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।তুমি এখন যা বলবে ওর কাছে সেটাই সত্যি। সেটাই ব্যাস্তব।

শেষ কথাটুকু সময় নিয়ে বলল রাকিব।আদিব তার চোখে চোখ রাখলো।রাকিব সাথে সাথে দৃষ্টি পরিবর্তন করলো। মেডিকেল ফাইলের কাগজ গুলো অকারণে এদিক সেদিক উল্টে বলল,

-আদিব এই মুহূর্তে আমাদের তোমার হেল্পর প্রয়োজন।আশা করি তুমি আমাদের এই সাহায্য টুকু করবে।তুমি যদি

– চব্বিশ তারিখ আমার ফ্লাইট।

রাকিবের কথা শেষ না হতেই বলল আদিব।আদিবের কথা শুনে থামলো রাকিব। চব্বিশ তারিখ মানে হাতে আছে আর মাত্র পনেরো দিন। এরমধ্যে সব বন্দোবস্ত করতে হবে তাকে।সে বলল,

-দ্যাট’স এনাফ।

জাহানারা শারীরিক অবস্থা নিয়ে আরো কিছু টুকিটাকি সতর্কতা দিয়ে নিজের কথা শেষ করলো রাকিব।রাকিবের সাথে কথা শেষ হতেই তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো আদিব আর শাহেদ।রাকিবের কেবিন থেকে বের হতেই শাহেদ আদিবের দিকে লক্ষ্য করতেই তার চিন্তিত মুখটা চোখে পড়লো।শাহেদ আদিবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,

-কি হলো?কি ভাবছিস?

আদিব তানিয়ার কথা ভাবছিল।তার মা যদি জানতে পারে আদিব পনেরো টা দিন জাহানারার আশেপাশে ঘুরবে তাহলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে।আদিব চাইছে না ফিরে যাওয়ার আগে কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের তিক্ত স্মৃতি নিয়ে যেতে।সে মায়ের কাছ থেকে কীভাবে বিষয়টা লুকাবে সেটাই ভাবছিল। শাহেদের কথায় তার ভাবনায় ছেদ পড়ল।জোরপূর্বক হেঁসে মনের ভাবনা লুকিয়ে বলল,

-কিছু না।

শাহেদের মনে হলো আদিব তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে কিন্তু সে এ বিষয়ে আদিবের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। প্রসঙ্গ বদলালো।

এরপরের সময়টা ভীষণ অস্বস্তিকর ছিল আদিবের জন্য। জাহানারার স্বামী হিসাবে দিনের পর দিন অভিনয় করা বেশ কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠেছিল তার জন্য।তবুও সেজ চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে, মানবিকতার খাতিরে নিজের চেষ্টায় ত্রুটি রাখছিল না সে। কিন্তু এভাবে দেখতে দেখতে যখন তেরো দিন অতিবাহিত হলো তখন বাঁধলো বিপত্তি।এমন অবস্থা হলো আদিবের যে পরশু তার ফ্লাইট কিন্তু সে যাবে কি না ?সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগলো।বিগত দিনগুলো দিপ্তীর বাসায় আছে এ কথা বলে মা-কে বোঝালেও লন্ডন যা‌ওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতেই তানিয়ার ছটফটানি বাড়লো।আদিব কে বলল খুলনায় ফিরতে।ফেরার আগে অন্তত একদিন তার কাছে কাটিয়ে যেতে।আদিব মায়ের আবদার রাখতে জাহানারাকে তার জরুরি কাজের বাহানা দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে র‌ওনা দিল খুলনা। জাহানারা ততদিনে নিজের আশেপাশের মানুষের সাথে সহজ হয়েছে।আদিব তার জরুরি কাজের কথা বলতেই জাহানারা আপত্তি করলো না যেতে দিল তাকে। তাছাড়া আদিবের জন্য ভীষণ মায়া তার।তার জন্য লোকটা নিজের কাজ কাম ফেলে রাত জেগে হাসপাতালে পড়ে থাকে এটা দেখে কষ্ট হয় তার। খারাপ লাগে লোকটার জন্য।সেই জন্য তো আদিবের কথা বোঝার চেষ্টা করে।তার কথা শোনে।

রাকিব বলেছিল পনেরো দিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলবে কিন্তু কিছু কারণে সময় আরো বাড়লো।সে আদিব কে অনুরোধ করলো তাকে আরো পনেরো দিন সময় দেওয়ার জন্য।রাকিবের কথায় এবার দোটানায় পড়লো আদিব।তার ছুটির মেয়াদ শেষ।ফিরতে হবে তাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ছুটি বাড়ানোতে রুষ্ট হবে।চাকরি হয় তো যাবেনা প্রফেসর “স্টিফিনের” জন্য। কিন্তু দাগহীন ক্যারিয়ারে দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার দাগ পড়বে। কিন্তু এদিকে জাহানারার অবস্থা‌ও ভালো না।মেয়েটা সবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।এই মুহূর্তে তাকে ফেলে যা‌ওয়া মানে মাঝ দরিয়ায় ধাক্কা মা’রা।কি করবে, কি করবে ভেবে আশরাফের শরণাপন্ন হলো আদিব। আশরাফ ছেলেকে অল্প শব্দে বলল,

-নিজের চকচকে ভবিষ্যতের পিছনে, একটা মানুষের সুস্থতা ফেলা যাওয়া কতটা উচিত সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা!তুমি বুদ্ধিমান ছেলে আশা করি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে।

বাবার কথায় টনক নড়লো আদিবের।নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যাকুল না হয়ে সে জাহানারার সুস্থতা কে প্রাধান্য দিল। সিদ্ধান্ত নিল আরো কিছু দিন দেশে থাকার।বেছে নিল জাহানারার সুস্থতা।
নিজের ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করে ডাক্তার “স্টিফিনের” সুপারিশে আরো তিন মাস ছুটি বাড়ালো।থেকে গেল দেশে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১২

-আমাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছিল আদিব?

জাহানারার প্রশ্নে সুপের চামচটা বাটিতে রেখে তার দিকে তাকালো আদিব। জাহানারার প্রশ্নের জবাবে কি বলবে ভেবে পেল না। যেখানে বিয়েই হয় নি সেখানে বিয়ে কীভাবে হয়েছিল সেটা কি করে বলবে সে।আদিব কে চিন্তিত দেখালো।আদিব কে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে নেহা এগিয়ে এলো।,বলল,

-আপনাদের ল্যাভ ম্যারেজ হয়েছিল ম্যাডাম। একেবারে গোপনে।

জাহানারা নেহার দিকে তাকালো।নেহার মুখে চ‌ওড়া হাঁসি।মেয়েটা জাহানারার ব্যক্তিগত সহকারী। জাহানারা অভিনয় জগতে প্রবেশ করার সময় থেকে তার সাথে আছে। জাহানারার সুখ দুঃখ সহ অনেক গোপন অভিসারের খবর জানে সে।

-আমি কি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি?তুমি এত পটপট করো কেন,একটু চুপ করে থাকতে পারো না।শোন, যদি চুপ করে থাকতে না পারো তাহলে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে কিন্তু আমাদের স্বামী স্ত্রীর কথার মধ্যে কথা বলতে যাবে না।

জাহানারার রুক্ষ কণ্ঠ।নেহার মুখের হাসিটা দপ করে নিভে গেল।তবে জাহানারা সেটা গুরুত্ব দিল না। সে আদিবের উদ্দেশ্যে ফের প্রশ্ন ছুড়লো,

-আমাকে ডিসচার্জ দেওয়ার পর কি তুমি আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?

-না!

তড়িৎ বলে উঠলো আদিব।এটা তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিল। জাহানারা কে ব‌উ হিসাবে নিজের বাড়ি নিয়ে যা‌ওয়ার কথা শুনতেই মায়ের অ’গ্নিমূর্তি ভেসে উঠলো চোখের সামনে মুখ দিয়ে আপনা আপনি “না” শব্দটা ছিটকে এলো।

-কেন?

জাহানারার বিষণ্ন কণ্ঠ।আদিব তাকে নিজের সাথে তার বাড়ি নিয়ে যাবে না এটা ভেবে মন খারাপ হলো।আদিব জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,একটু সময় নিয়ে বলল,

-আমাদের বিয়ের বিষয়ে তোমার পরিবার জানলেও আমার পরিবার এখনো কিছু জানে না জাহানারা।

-কেন জানে না?

আবার প্রশ্ন!আদিবের বিরক্ত লাগলো এবার।সে কোন মতে বলল,

-আমার কিছু সমস্যা আছে ,সেটা মিটমাট হলেই বাড়ি জানাবো ভেবেছিলাম এরমধ্যে তোমার অ্যাকসিডেন্টটা হলো, তাই আর জানানো হয় নি।

-কী সমস্যা?

-আছে একটা সমস্যা।তুমি খাবারটা শেষ করতো।আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।কাজ আছে আমার কিছু।

জাহানারার মুখের সামনে সুপের চামচ ধরে বলল আদিব। জাহানারা সুপ ভর্তি চামচটা মুখে নিয়ে সেটা গলদ্ধ করণ করে ফের বলল,

-কি কাজ?

এবার ধৈর্য চ্যুত হলো আদিব।সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

-এত প্রশ্ন করো কেন জাহানারা।

-তুমি নিজে থেকে কিছু বলো না তো,সেই জন্য তো প্রশ্ন করতে হয়।

একটু থামলো জাহানারা তারপর অভিযোগের সুরে বলল,

-তুমি আমার হ্যাজবেন্ড, কিন্তু আমি তোমার নাম ছাড়া তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না।আমার বুঝি জানতে ইচ্ছা করে না?

-তুমি তো নিজের সম্পর্কেও কিছু জানো না ,নিজের সম্পর্কে তোমার কিছু জানতে ইচ্ছা করে না?

-না, জ্ঞান ফেরার পর থেকে নিজের বিষয়ে শুনেই যাচ্ছি।এখন আর শুনতে ইচ্ছা করছে না।আমি তোমার ব্যাপারে জানতে চাই।

আদিব জাহানারার মুখের দিকে তাকালো। অসুস্থ নির্জীব মুখটায় কিছুটা প্রাণের ছোঁয়া এসেছে তার। ব্যান্ডেজ বিহীন চুল ছাড়া মাথাটা মেয়েটার সৌন্দর্যে যথেষ্ট ঘাটতি তৈরি করতে চাইলেও সেভাবে সফল হয় নি।চুল ছাড়া একটু অদ্ভুত দেখাচ্ছে জাহানারা কে, তবে একেবারে অসুন্দর না। জাহানারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আদিবে ছোট বেলার একটা কথা মনে পড়লো। জাহানারা তখন নতুন নতুন স্কুলে যা‌ওয়া শুরু করেছে।স্কুলে থেকে মাথায় উকুন বাধিয়েছে। সারাদিন মাথা চুলকে বেড়ায়।সালেহা মেয়ের নাজেহাল অবস্থা দেখে জোর করে চুল কেটে ন্যাড়া করে দিল তাকে।চুলের শোকে জাহানারা সে কি কান্না। কান্নার চোটে বাড়ির উঠানে গড়াগড়ি দিতে লাগলো সে।দাদি গিয়ে কোনোরকমে সামলালো তাকে।দুই দিন চুলের শোকে বাড়ি থেকে বের হলো না জাহানারা। তারপর যেদিন বাইরে এলো সেদিন তাদের মহল্লার মামুন নামের এক ছেলে তাকে দেখে,
“টাক টাক চার‌আনা,
চাবি দিলে ঘোরেনা।
টাকের কি অবস্থা,
বেগুন কি সস্তা।”
এই ছড়া কাটতে লাগলো। জাহানারা তাকে নিষেধ করলেও সে শুনলো না।রাগ হলো জাহানারার। রাস্তা থেকে ইট কুড়িয়ে চেলে মারলো মামুনের দিকে।ভারি ইটের টুকরো গিয়ে লাগলো মামুনের কপালে, সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বের হলো মামুনের কপালের ক্ষ’ত থেকে। জাহানারা রাগে ইট চেলে মারলেও ভাবেনি এমন কিছু হবে। রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেল সে।দৌড়ে ঢুকলো আদিবদের বাড়ি।দাদির কাছে আশ্রয় নিতে। কিন্তু দাদি বাড়ি নেই ,বাঁচাবে কে তাকে!তানিয়া জাহানারা কে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসতে দেখে এগিয়ে গেল। ছোট্ট শরীরটা আগলে নিল যত্নে। জাহানারা বড় চাচির আহ্লাদ পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তানিয়া কি হয়েছে জানতে চাইলে গড়গড় করে সব বলে দিল।আদিব তখন ডাইনিং টেবিলে বসা। স্কুল থেকে ফিরে নাস্তা করছে। জাহানারার মুখে টাক টাক চার‌আনা ছড়া শুনে সে নিজেকে সামলাতে পারলো না, খিকখিক করে হেঁসে উঠলো।আদিবের হাঁসি দেখে জাহানারা কান্না আরো বাড়লো।তানিয়া আদিবকে কপট ধমক দিয়ে তার হাঁসি থামলেও জাহানারার কান্না থামাতে পারলো না।সে নিজের মতো কেঁদে গেল।তানিয়াকে বেশ বেগ পোহাতে হল তার কান্না থামাতে।সে দিনের সে কথা মনে পড়তেই আপনি আপনি আদিবের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল। জাহানারা যেটা লক্ষ্য করলো।আদিবকে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে সাথে সাথে মাথায় হাত উঠলো তার। চুলহীন মাথায় হাত পড়তেই ঠোঁট উল্টোলো সে।বলল,

-তুমি আমাকে দেখে হাসছো?

যদিও আদিব জাহানারা কে দেখে হাসছিল না তবুও এই মুহূর্তে এসে জাহানারার অমন মুখো ভঙ্গি দেখে কেন জানি নিজেকে আটকাতে পারলো না আদিব।স্থান কাল ভুলে শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠলো। জাহানারা অবাক হলো। ড্যাবড্যাবে চোখে দেখতে লাগলো আদিবের হাঁসি। জাহানারা হঠাৎ আবিষ্কার করলো ছেলেটার হাঁসি মারাত্মক সুন্দর। জাহানারা কে নিজের দেখে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকাতে দেখে কোনোরকমে নিজের হাঁসি থামালো আদিব। ঠোঁটের মাঝে হাসির ছাপ রেখেই বলল,

-আই এম স্যরি ,কিন্তু তোমাকে দেখে হাঁসি নি।আসলে একটা পুরোনো কথা মনে পড়েছিল তাই…!

– সমস্যা নেই, তুমি হাসো।তোমাকে হাসলে সুন্দর দেখায়।

আবিষ্ট চিত্তে বলল জাহানারা।আদিবের হাসি দেখে তার হাসির কারণেই ভুলে বসেছে সে। জাহানারার কথায় নেহার সামনে একটু অপ্রস্তুত হলো আদিব।অযথা গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,

-আচ্ছা এবার খেয়ে না‌ও, ঔষধ খেতে হবে।দেরি হচ্ছে।

-খাচ্ছি কিন্তু তুমি তো কিছু বললে না।

বাচ্চাদের মতো কথা জাহানারার।রাকিব বলেছিল অসুস্থতার দরুন জাহানারার মধ্যে বেশ কিছু মানসিক পরিবর্তন দেখা দিবে।যেমন,রাগ,জেদ,বাচ্চামো,অভিমান ইত্যাদি। প্রথম প্রথম জাহানারার এমন ব্যবহারে সবাই চিন্তিত হলেও এখন সয়ে গেছে।

-বললাম তো তোমাকে দেখে হাঁসি নি

-হাসার কথা বলছি না তো।তোমার ব্যাপারে বলবে না।

আদিবের কথা কেটে বলল জাহানারা।আদিব একটা শ্বাস ফেলল,

-বলো কি শুনতে চাও।

-সব শুনতে চাই।

-ওকে।আমার নাম খন্দকার আদিব আহসান।বাবার নাম খন্দকার আশরাফ আহাসান,মায়ের নাম তানিয়া।আমার বাড়ি খুলনার **** শহরে।আমার দুইটা বোন আছে।বড় বোনের নাম দীপ্তি, ছোট বোনের নাম তৃপ্তি।দুই জনের বিয়ে হয়ে গেছে দুইজনেই স্বামীর বাড়ি সুখে শান্তিতে সংসার করছে।

-এগুলো তো আমি জানি!তোমার সম্পর্কে বলো।

-এগুলোও তো আমার সম্পর্কে!আমার পরিবার কে নিও তো আমি।

-হ্যাঁ তোমার পরিবারকে নিও তুমি কিন্তু তুমি আমার কথা বুঝছো না! আমি তোমার বিষয়ে শুনতে চাইছি। শুধু তোমার বিষয়ে।

শেষক্ত কথাটা গাঢ় স্বরে বলল জাহানারা।আদিব হাতের খালি প্লেট টা নেহার দিকে এগিয়ে দিল। মৃদু হেঁসে বলল,

-আমার বিষয়ে শুনতে গেলে বোর হবে।আমার জীবন অতোটা হ্যাপেনিং না।

-তবুও শুনবো।

-ফাইন,আমি আদিব। লন্ডন *****হসপিটালে জুনিয়র কার্ডিওলজিস্ট হিসাবে কর্মরত আছি। লন্ডনের *****শহরে থাকি।দুই রুমের নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট আছে সেখানে।একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি আছে।যেটাতে করে রোজ হসপিটালে যা‌ওয়া আসা করি।ব্যাস।

-ব্যাস!আর কিছু নেই! বন্ধু বান্ধব,ঘোরা ফেরা,শখ আহ্লাদ? কিচ্ছু না?

-নো।

-এতো পানি পান্তা! তোমার প্রেমে পড়লাম কি করে আমি?

অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল জাহানারা।আদিব প্রশশ্ত হাসলো। জাহানারার নিজেকে করা প্রশ্নটা নিজ মনে সেও একবার আওড়ালো।”তোমার প্রেমে পড়ালাম কি করে ?”এই প্রশ্নটা তো এতগুলো বছরে সেও একাধিক বার করেছে নিজেকে যে, জাহানারা ম্যাডাম তার প্রেমে পড়লো কি করে । তবে আজ জাহানারা কথা শুনে মনে হচ্ছে জাহানারার তার প্রতি যে অনুভূতি ছিল সেটা কিশোরী বয়সের আবেগ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

-কি জানি কীভাবে পড়েছিলে!

-আচ্ছা আমি তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম, না তুমি?

ভাবুক কণ্ঠ জাহানারা।আদিবের হাঁসি পেল আবার।সেদিন বিকেলে জাহানারা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলা কথাগুলো আবার মনে পড়লো।সে বলল,

-তুমিই করেছিলে।

-হুম সেটাই স্বাভাবিক।তুমি যে বোরিং, তুমি তো আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না। আচ্ছা আমি তোমার সাথে লন্ডনে থাকতাম ,না ঢাকায় ,না কি খুলনায়?

-এবার থামো। একদিনে সব জানবে না কি?

-হ্যাঁ।আজকেই জানবো, তোমাকে তো পা‌ওয়া যায় না।আর এরা যা বলে আমার বিশ্বাস হয় না।তুমি বলো প্লিজ।

জাহানারা নাছোড়বান্দা।আদিব হতাশ চোখে তার দিকে তাকালো।আবার মিথ্যা বলতে হবে তাকে। কিন্তু কি বলবে সেটাই তো মাথায় আসছে না তার।আদিব অনেক ভেবেও বুঝে পেল না কি বলবে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। সাহায্যের জন্য তাকালো নেহার দিকে।নেহা জাহানারার বেডের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। জাহানারার ক্যাটকেটে কথা শোনার পর আর একটাও টু শব্দ করেনি।তবে এই মুহূর্তে আদিব কে অসহায় অবস্থায় দেখে মায়া হলো তার।আদিবের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো সে।আদিবের হয়ে সে বলল,

-আপু আপনাদের তো লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ ছিল।ছোট বেলার প্রেম ,তারপর ভাইয়া পড়াশোনার জন্য বিদেশ গেল এরপর ফোনে ফোনে আলাপ সালাপ।

-তাহলে আমাদের বিয়ে হলো কবে?

আবার প্রশ্ন করলো জাহানারা।নেহা তড়িঘড়ি বলল,

-এই তো মাস তিনেক আগে। আপনার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল সেই জন্য তো ভাইয়া ছুটে এলো লন্ডন থেকে।তারপর এসেই সোজা কাজী অফিস।

একদমে কথাগুলো বলে থামলো নেহা।আদিব অবাক চোখে তাকালো।মেয়েটার বানিয়ে মিথ্যা বলার কৌশল দেখে মনে মনে খুশি হলো।তবে জাহানারা খুশি হতে পারলো না তার মনে আরো প্রশ্নের উদয় হলো সে বলল,

-আমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল কেন?আমার বাবা কে দেখে তো মনে হলো সে আদিব কে বেশ পছন্দ করে !তাহলে?

-আর একটাও কথা না জাহানারা।কত প্রশ্ন করো তুমি!নেহা দেখি ঔষধের বাক্স টা দাও তো।

জাহানারা কথা শেষ না হতেই বলে উঠলো আদিব‌। একপ্রকার ঔষধ খাওয়ানোর অযুহাতে জাহানারার কৌতূহল দমালো।তবে জাহানারা কৌতূহল দমলো কি না বোঝা গেল না।সে বাধ্য মেয়ের মতো ঔষধ খেলেও তাকে বেশ ভাবুক দেখালো।আদিব বুঝলো ঔষধ খাওয়ানো হলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে হবে না হলে এই মেয়ে আবার প্রশ্নের সয়লাব আনবে।এই মুহূর্তে এসে নাহিদা নামক সেই ভদ্রমহিলার উপর ভীষণ রাগ হলো আদিবের।কেন যে ভদ্রমহিলা পণ্ডিতি করে তাকে এই মেয়ের স্বামী বলতে গিয়েছিল……!না হলে আজ এত ঝামেলা পোহাতে হত তাকে!রাগে দুঃখে তপ্ত শ্বাস ফেলল আদিব। ঔষধ খাওয়ানো শেষে জাহানারা কে কোন কথার সুযোগ না দিয়ে বলল,

-জাহানারা আমার একটা কাজ আছে, আমি দুই দিন হসপিটালে আসতে পারবো না হয়ত।

-আবার কাজ ?এই তো দুই সপ্তাহ কাজের দোহাই দিয়ে এলে না,আজ এসে আবার বলছো কাজ আছে!তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না, না?

অভিযোগের সুরে বলল জাহানারা।আদিবের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠলো। সেদিন রাতে জাহানারার বলা কথাটা আবার কানে বাজলো।সে অযথা গলার শ্লেষ পরিষ্কার করে বলল,

-জরুরি কাজ।একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।

-পরশু আমাকে ডিসচার্জ দেবে হাসপাতাল থেকে।তুমি থাকবে না?

উদাস কণ্ঠে বলল জাহানারা।আদিব ঔষুধের বাক্স টা নেহার হাতে দিয়ে ছোট করে বলল,

-দেখি।

-থাক, তোমার আর দেখা লাগবে‌ না।বুঝেছি, থাকতে পারবে না।

গাল ফুলিয়ে বলল জাহানারা।আদিব মুচকি হাসলো।বলল,

-আমি চেষ্টা করবো তোমার ডিসচার্জ এর আগে ফেরার, তবে যদি না ফিরতে পারি, তাহলে আশা করবো আমার বউ বুঝবে আমার দিকটা।

কথাটা বলে থমাকালো আদিব।নিজের কথাটা নিজের কানেই কেমন যেন লাগলো।”আমার বউ”এই শব্দদ্বয় কানে ঝংকার তুলল তার। অপ্রস্তুত হলো কিঞ্চিৎ। কিন্তু জাহানারার মুখে দেখা গেল এক গাল হাসি।সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

-ঠিক আছে, তোমার ব‌উ বুঝবে।

-ওকে,তাহলে থাকো তুমি, আমি আসছি।

ব্যস্ততা দেখিয়ে অনেকটা পালিয়ে এলো আদিব।সেটা জাহানারার থেকে না নিজের মনের অবচেতন অনুভূতি থেকে সেটা বোঝা গেল না। কেবিন থেকে আসার আগে নেহা কে জাহানারা খেয়াল রাখার কথা একবার মনে করিয়ে দিল।

বাইরে বের হতেই জায়েদের সাথে দেখা হলো আদিবের।জায়েদের থেকে জানতে পারলো। জাহানারা কে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দেওয়ার পর খুলনা নিয়ে যাবে।রাকিবের প্রফেসর ডাক্তার মার্লিন না কি বলেছে এই মুহূর্তে জাহানারার পরিচিত পরিবেশ আর আপনজনদের কাছে থাকা উচিত।তাহলে না কি সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।এ কথাটা শুনে আদিবের চাচার কাছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো, রাকিব যে জাহানারা কে চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় নিয়ে যা‌ওয়ার কথা বলেছিল তার কি হলো?আদিবের মনের কথা হয়ত পড়ে নিল জায়েদ ,তাই তো নিজে থেকেই বলল জাহানারার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে এখনো তিন চার সপ্তাহ লাগবে সেখানে যেতে।তবে ডাক্তার মার্লিনের ভাষ্যমতে জাহানারার এখন উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামের থেকে বন্ধু-বান্ধব ও আপনজনদের হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার আর সহযোগিতার বেশি প্রয়োজন। তাছাড়া সামনের মাসে তিনি এক মেডিকেল কনফারেন্সে আসছে বাংলাদেশে।সেই সুযোগে তিনি এসে জাহানারা কে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবে জানাবে তাকে আদৌ আমেরিকা নিয়ে যা‌ওয়ার প্রয়োজন আছে কি না। ডাক্তার মার্লিনের সামনের মাসে আসার কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল আদিব।তার জন্য জাহানারার সাথে স্বামীর অভিনয় করা কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠছে দিনকে দিন।এখন ডাক্তার মার্লিন আসার পর যদি কিছু উপায় বের হয় তাহলে সে বেশ উপকৃত হবে। তাছাড়া তাকে ফিরতে হবে!ছুটি শেষ হচ্ছে।

জায়েদের সাথে কথা শেষ করে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলো আদিব। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিল সে তখন পকেটে থাকা ফোনটা তার স্বরে চেচিয়ে উঠলো।আদিব ফোন বের করে দেখলো তার মা ফোন করছে।ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই অপর পাশ থেকে তানিয়ার থমথমে গলা কানে ঠেকলো তার ,

-আদিব তুমি কোথায়?

মায়ের মুখি তুমি সম্বোধন শুনে ভ্রূতে ভাজ পড়লো আদিবের।মা সাধারণত রেগে থাকলে তুমি সম্বোধন করে থাকে।আদিব বোঝার চেষ্টা করলো মা তার‌উপরে রেগে আছে কি না। কিন্তু আপত দৃষ্টিতে তার উপরে তার মায়ের রাগের কোনো কারণ মনে পড়লো না।সে একটু সময় নিয়ে ইতস্তত করে বলল,

-কি হয়েছে মা?

-তুমি কোথায় আদিব।

-আমি বড় আপার বাড়ি।

-তাহলে *******হাসপাতালের সামনে কে?

মায়ের কথায় চমকালো আদিব। তড়িৎ নজর ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো।খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না আদিবের। বা পাশে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো গাড়ির কাছে দেখা মিলল তার।আদিব সাথে সাথে চোখ বন্ধ করল নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,”সিট”।মনে পড়লো বাবার বলা অনেক পুরোনো এক প্রবাদ,”চোরের দশ দিন,গৃহস্থের একদিন।”

-আমি অপেক্ষা করছি।গাড়িতে এসে বসো।

ফোন কাটলো তানিয়া।আদিব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।আদিব গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি চালু করলো গাড়ি চালক।তানিয়া গাড়ি চালককে আদেশ করলো গাড়ি খুলনার দিকে নিতে।তার কথায় গাড়ি চালককে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো। কিন্তু তানিয়ার অস্বাভাবিক নিরাবতার সামনে কিছু বলতে সাহস পেল না।গাড়ি ঘোরালো সে।ঢাকা থেকে খুলনা সড়কের দূরত্ব প্রায় ৩৩৩ কিলোমিটার, পাঁচ ছয় ঘণ্টার রাস্তা।তানিয়ার মাজার হাড়ের সমস্যা আছে ।সে বেশি সময় একাধারে বসে থাকতে পারে না।কষ্ট হয়।আদিব মায়ের কথা ভেবে মায়ের দিকে একবার তাকালো।তানিয়ার থমথমে মুখটায় চোখ রেখে সাহস করে কিছু বলতে উদ্যত হতেই তাকে থামিয়ে দিল তানিয়া,বলল,

-আদিব একটা কথাও বলবে না।বাড়ি ফিরে কথা হবে।

মায়ের এ কথার পর আর কোনো কথা বলতে পারলো না আদিব।শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল সে। দৃষ্টি রাখলো বাইরে। দেখতে লাগলো, কীভাবে গাড়িটা ঢাকা শহরের ইমারত গুলো একে একে পিছনে ফেলে নিজ গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে