#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৫
আদিবের বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক বেশি সময় নিল না এটা বুঝতে যে তার বাবা কোন এক কালে জাহানারার সাথে তার বিয়ে দিবে বলে সেজ চাচাকে কথা দিয়েছিল।মা এখন যেটা মানতে চাইছে না।দাদি এবং মায়ের বলা কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে ভেতরটা বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল আদিবের।গলা দিয়ে আর খাবার নামলো না তার।খাওয়ার মাঝপথে খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।জাহানারা বেগম তাকে এভাবে উঠতে দেখে জানতে চাইলেন কি হয়েছে?আদিব কোন মতে পেট ভরে গেছে বলে স্থান ত্যাগ করলো।
জাহানারার সাথে নিজেকে ভেবে সে রাতে ভালো ভাবে ঘুম হলো না আদিবের।পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বাবার সামনে উপস্থিত হলো।কোনো ভণিতা ছাড়া বাবাকে বলল,
-“বাবা আমি জাহানারা কে বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না।”
আশরাফ খবরের কাগজ পড়ছিল, ছেলের কথা শুনে সেটা ভাজ করতে করতে বলল,
-কেন?
-আমার তাকে ভালো লাগে না।চাচাতো বোন হিসাবে সে ঠিক আছে, কিন্তু জীবন সঙ্গী হিসেবে আমি তাকে ভাবতে চাই না।
-ঠিক আছে।
আশরাফের গলার স্বর একদম স্বাভাবিক।আদিব বাবার মুখ পানে অবাক চোখে চাইলো।বাবা যে তার কথা এত সহজে মেনে নেবে সেটা সে ভাবতে পারেনি।আদিব কে নিজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আশরাফ আদিবকে জিজ্ঞেস করল,
-আর কিছু বলবে?
আদিব দুই দিকে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে কিছু বলবে না। আশরাফ খবরের কাগজের ভাজ খুলে আবার সামনে ধরলো।আদিব চলেই আসছিল কিন্তু কি মনে করে দাঁড়ালো।বলল,
-বাবা তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?
-বলো।
খবরের কাগজে চোখ রেখেই বলল আশরাফ।আদিব একটু সময় নিল।নিজ মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল একবার। তারপর বলল,
-বাবা তুমি জ্ঞানী মানুষ।আমার থেকে বেশি জানো তুমি।আমার কথায় কিছু মনে করো না তবে আমার মনে হচ্ছে সেজ চাচাকে আমার আর জাহানারার বিয়ের বিষয়ে কথা দেওয়া উচিত হয় নি তোমার।
ছেলের কথায় ঘাড় উঁচু করে তার দিকে তাকালো আশরাফ। বাবার চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামালো আদিব। আশরাফ কিছুক্ষণ ছেলের দিকে সেভাবেই তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ছোট করে বলল,
-হুম।
নিজের কথা শেষ করে আশরাফের সামনে থেকে সরে এলো আদিব। এরপর থেকে অকারণেই জাহানারার প্রতি একটা বিরক্তি কাজ করতে লাগলো আদিবের মনে।সে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে লাগলো জাহানারা কে।এভাবে সময় অতিবাহিত হলো।
নিজের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হলো আদিব। জাহানারা নামক মেয়েটা মোটা মোটা অ্যাডমিশন বইয়ের আড়ালে ঝাপসা হলো। এরপর একদিন বিকেলের কথা অনেকদিন পর ছাদে গিয়েছিল আদিব। ছাদ থেকে সেজ চাচাদের বাড়ির উঠানে চোখ যেতেই দেখলো সেজ চাচি চুলায় রান্না করা খড়ি কাঠ নিয়ে জাহানারা কে শাসাচ্ছে।আর জাহানারা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।দূর থেকে চাচির কথা তো কিছু বোঝা গেল না তবে মেয়েটা যে আবার কোনো অকাজ করছে সেটা বেশ বুঝলো আদিব।মন আরো একবার বলে উঠলো, “আদিব অ্যান্ড জাহানারা!” নো চান্স।এর ঠিক বেশ কিছু দিন পর এক শেষ বিকেলের সময়, আদিব কোন এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিল তখন রাস্তা আগলে দাঁড়ালো জাহানারা। জাহানারার হঠাৎ আগমনে ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো আদিবের।সে জাহানারার মুখের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো মেয়েটাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। চারদিকে ফাগুনের দমকা বাতাস থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা দরদর করে ঘামছে ,হাতটাও কেমন যেন একটু কাঁপছে তার। জাহানারাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করার পর আদিবের মনে হলো মেয়েটা হয়ত অসুস্থ।সে নরম গলায় বলল,
-জাহানারা তুমি ঠিক আছো?
আদিবের ভারি গলায় একটু কেঁপে উঠলো জাহানারা।শরীরের কম্পন দৃশ্যমান হলো।আদিবের চোখের দিকে ভীতু চোখে চেয়ে চোখে নামিয়ে নিল সে।চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো ভেতরে।বাধো বাধো গলায় বলল,
-আমি আপনাকে ভালোবাসি আদিব ভাই।
জাহানারার কম্পিত কণ্ঠ।আদিব বাকরুদ্ধ জাহানারার সাহস দেখে।সে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জাহানারা দিকে।তার মন চাইলো এমন নির্লজ্জতার জন্য মেয়েটার ফরসা গালে চটাস করে একটা চড় বসাতে। কিন্তু সম্পর্কের দূরত্ব অনুভব করে মনের চাওয়া মনেই দাবিয়ে দিল। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।ফোঁস করে একটা উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-বাড়ি যাও জাহানারা।
কথাটা বলেই নিজের পথের হাঁটা ধরলো আদিব। জাহানারা তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ যেটা আদিব বুঝতে পারলেও পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।
বাড়ি ফিরে সোজা দাদির ঘরে ঢুকলো আদিব।দাদিকে জানাল তাকে বলা জাহানারার কথাটা।আদিবের কথা শুনে জাহানারা বেগমের মুখে অন্ধকার নামলো।সে আদিব কে কোনোরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলল জাহানারার বলা কথাটা আদিব যেন আর কাউকে না বলে।এ কথা জানাজানি হলে জাহানারার বদনামি হবে , পরিবারের মধ্যে অশান্তি হবে।সে সময় করে সালেহাকে জানাবে।দাদির কথা শুনে আদিবরও তেমনটাই মনে হলো।সে বাধ্য ছেলের মত দাদির কথা মেনে নিল।চেপে গেল জাহানারার সরল স্বীকারোক্তি।সেই বিকেলের এক খণ্ড স্মৃতি মুছে দিল নিজের মন থেকে।
এরপর থেকে জাহানারা কে আগের থেকে আরো বেশি এড়িয়ে চলতে লাগলো আদিব।তবে সমস্যা হলো আদিব যত বেশি জাহানারা কে এড়িয়ে চলতে চাইলো জাহানারা যেন তোতবেশি তার সামনে ঘোরাফেরা করতে লাগলো।সেদিনের পরে আদিবকে জাহানারা কিছু না বললেও নিজের চাতক পাখির নেয় অধীর দৃষ্টি দিয়ে অপ্রস্তুত করতে লাগলো যেখানে সেখানে।জাহানারার সেই অধীর দৃষ্টি গায়ে বাঁধতো আদিবের, বিরক্ত লাগতো তার।একটা মেয়ে কীভাবে এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে সেটা ভেবে ভেবে রাগ হত জাহানারার উপর।তবে কোন এক অজ্ঞাত কারণে জাহানারা কে কিছু বলতে পারতো না সে। মাঝে মাঝে জাহানারা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কারণে অগ্নি চোখের দৃষ্টি ফেলতো জাহানারা উপর।ব্যাস এতটুকুই। এর বেশি সে জাহানারা সাথে কঠোর হতে পারতো না। জাহানারার জন্য সেজ চাচার বাড়ির রাস্তা ভুলতে হলো আদিবকে।সজীবের সাথে দেখা সাক্ষাৎ রাস্তা ঘাটেই সারতে হলো। আদিব নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল জাহানারা থেকে দূরে থাকার। কিন্তু আদিবের উপস্থিত কিংবা অনউপস্থিতি কোনোটাই তেমন প্রভাব ফেলল না জাহানারার অনুভবে। সে নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে ভালোবাসতে লাগলো আদিব কে। সময় গড়ালো।বছর পেরুলো।আদিবের প্রতি জাহানারার ভালোবাসার তীব্রতা বৃদ্ধি পেল।মরিয়া হয়ে উঠলো সে আদিব কে বোঝাতে, যে সে আদিবকে কতটা ভালোবাসে। আদিব সবটা দেখেও না দেখার ভ্যান করে গেল।আদিবের এই নির্লিপ্ততা জাহানারা কে যেন আরো উতলা করে তুলল।সে কোন কিছু না ভেবেই একদিন আবার আদিবের সামনে দাঁড়ালো।চোখ না তুলেই কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-আদিব ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি আপনি…
-আদিব ,জাহান !
মেজ চাচির হঠাৎ আগমনে থামতে হলো জাহানারা কে। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো সে। তড়িঘড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ডালিয়া এগিয়ে আসতেই আদিব তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো।আদিবের সাথে কথা শেষ করে জাহানারার ঘাবড়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালো ডালিয়া। জিজ্ঞেস করল,
-এই জাহান এভাবে ঘামছিস কেন ?কি হয়েছে?
জাহানারা চাচির কথায় আমতা আমতা করে বলল,
-নিতুর সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম তো তাই ঘামছি। আচ্ছা চাচি থাকেন আমি আসছি।
কথাটা বলেই দৌড়ালো জাহানারা। জাহানারার গমনরত পথের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ডালিয়া।তার চোখে মুখে সন্দেহীন ভাব।আদিবের চোখে এড়ালো না যেটা।তার মনে হলো এবার আর চুপ থাকলে চলবে না।সেজ চাচিকে ব্যাপারটা জানাতে হবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ পা বাড়ালো সে সেজ চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে ছোট খালাকে নামতে দেখে পথ বদলাতে হলো।ছোট খালাদের আগমনে জাহানারার কথা সরে গেল আদিবের মাথা থেকে। ব্যস্ত হলো সে তাদের নিয়ে।
দুই দিন পরে আবার জাহানারার সাথে দেখা হল আদিবের। আদিব তার খালাতো বোন সিনথিয়া কে নিয়ে তাদের বাড়ির পাশে দিঘির পাড়ে গিয়েছিল। সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে জাহানারা আর নিতুকে দেখতে পেল।আদিব সিনথিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের। সিনথিয়ার সাথে জাহানারার পরিচয় করবার সময় জাহানারার মুখটা থমথমে দেখালো।আদিবের কেমন যেন লাগলো বিষয়টা। কিন্তু সেভাবে পাত্তা দিল না সে।সিনথিয়াকে নিয়ে দিঘির পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটি করে রওনা দিল বাড়ির পথে। যাওয়ার আগে নিতুকে বলল সে আর জাহানারা যেন তাদের সাথে আসে।কথাটা আদিব নিতুকে বললেও তার হয়ে জাহানারা উত্তর দিল। বলল তারা আরো কিছুক্ষণ থাকবে সেখানে।জাহানারার কটকটে গলাটা কেমন যেন শোনাল আদিবের কাছে। আপনা আপনি ভ্রূতে ভাজ পড়লো তার। জাহানারা কে উপেক্ষা করে সে নিতুর উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলল তারা যেন বেশি দেরি না করে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে যায়।নিতু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেও জাহানারা চোখ মুখ কাঠ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিবের দিকে।আদিব সেটা দেখেও না দেখার ভান করে সিনথিয়া কে নিয়ে চলে আসলো সেখান থেকে।
কিছুদূর আসার পর আদিবের মনে হলো তাদের পিছু নিয়েছে কেউ।সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।দেখলো নিতু আর জাহানারা আসছে।নিতু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাটলেও জাহানারার হাঁটার ধরন ভিন্ন। অস্বাভাবিক।আদিব লক্ষ্য করে দেখলো শুধু হাঁটার ধরন না জাহানারাকেও অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।টকটকে লাল চোখ,গনগনে দৃষ্টি,ফোলানো নাকের পাটা,আর ফ্যাকাশে মুখ। আদিব ভ্রূ কুঁচকালো।তবে থামলো না।ঘাড় ফিরিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে সিনথিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেত লাগলো।
মা আর ছোট খালার জোরাজুরিতে আদিব লন্ডনের ******মেডিকেলে ভর্তির জন্য *****টেস্ট দিয়েছিল যার প্রথম ধাপে সে উত্তীর্ণ হয়েছে এখন দ্বিতীয় ধাপ পার করতে পারলে অ্যাডমিশন কনফার্ম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লন্ডনে পড়াশোনার যে খরচ সেটা হয়ত আশরাফ টানতে পারবে না।আদিবের এ কথা শুনে সিনথিয়া জানালো তার বড় খালা মানে তানিয়া না কি বলেছে আদিবের নানার কাছ থেকে হেল্প নিবে। সিনথিয়ার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য থমকালো আদিব।তার মা বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল একে অপরকে, যার কারণে নানা তাদের বিয়ে মেনে নেয় নি।আদিবের জন্মের পর নানার রাগ কমলেও বাবাকে এখনো তারা বক্র চোখেই দেখে।আদিব কিংবা তার বোনেরাও তেমন যায় না নানা বাসায়।এ অবস্থায় ছেলের পড়াশোনার জন্য নানার কাছ থেকে সাহায্য কিছুতেই নেবে না তার বাবা। সিনথিয়ার মুখে মায়ের পরিকল্পনা শুনে বেশ চিন্তিত হলো আদিব।তার কেন যেন মনে হলো সামনে বেশ বড় সড় একটা ঝামেলা হতে চলেছে।আদিবকে অন্যমনস্ক দেখে তার বাহুতে হাত রাখলো সিনথিয়া।আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। সিনথিয়া জানতে চাইলো আদিব কি ভাবছে।আদিব নিজের মনের ভাব লুকিয়ে অন্যকথা তুলল। সিনথিয়ার সাথে কথার মাঝে আদিব লক্ষ্য করলো নিতু আর জাহানারা তাদের পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে।ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে সিনথিয়ার কথায় মনোযোগ দিল আদিব। সিনথিয়া তার স্কুলের কথা বলছে।তাদের পরীক্ষা ব্যবস্থার কথা বলছে।আদিব মন দিয়ে সেসব শুনছে আর অলস পায়ে হাঁটছে।তার অন্য কোনোদিকে খেয়াল নেই।সে লক্ষ্যই করলো না জাহানারা কে তার দিকে আসতে।যখন লক্ষ্য করলো তখন জাহানারা আর তার মধ্যে এক হাতের দূরত্ব।ডুবন্ত সূর্যের আলসে রোদে জাহানারা ছায়া সিনথিয়ার উপর পড়তেই আদিব তাকালো সামনে। জাহানারার অশ্রু শিক্ত জ্বলজ্বলে চোখ দুটো দেখতেই অকারণে ধক করে উঠলো ভেতরটা। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হলো আদিব।পুরু ঠোঁট নেড়ে জানতে চাইলো,
-কি হয়েছে জাহানারা?
আদিবের চিন্তিত কণ্ঠ স্বর। জাহানারা পলক ঝাপটালো সাথে সাথে ভাসা ভাসা চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।আদিব কে বাকরুদ্ধ করে হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরলো জাহানারা।জাহানারার আকস্মিক কাণ্ডে চমকে উঠলো নিতু।ভড়কে গেল আদিব। সিনথিয়া একটু অবাক হলো। উপস্থিত তিন জনের মুখে খেলে গেল তিনরকম অভিব্যক্তি।জাহানারা আদিব কে জড়িয়ে ধরে কান্নারত কণ্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-আদিব ভাই,আপনি আমার। শুধু আমার…
নিজের কথায় দাড়ি টানতে পারলো না জাহানারা।তার আগে আদিব নিজের থেকে জাহানারা কে ছাড়িয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল তার গালে।আদিবের কঠোর হাতের থাবায় ছিটকে পড়লো জাহানারা।নিতু তড়িঘড়ি ধরলো তাকে।আদিব আহত সিংহের নেয় ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।পায়ের কাছে পড়ে থাকা ইটের আদলায় সজোরে একটা লাথি মেরে গর্জে উঠে বলল,
-আর একটা ফালতু কথা বললে আমি তোমার জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো বেয়াদব!খুব বাড় বেড়েছো না তুমি!
আদিবের রাগান্বিত কণ্ঠ। জাহানারা কেঁপে উঠলো।তার সাথে নিতুও যেন একটু চমকালো।আদিবের এমন রাগ দেখে সিনথিয়াও যেন একটু ভয় পেল।আদিবের সেই বিধ্বংসী রাগ দেখে নিতু কিংবা সিনথিয়ার সাহস হলো না একটাও শব্দ করতে।নিতু ভয়ে জাহানারার বাহু ধরে তাকে ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো।তবে জাহানারা উঠলো না।সে বিবস হয়ে জেদ করে বসে রইলো ধুলোর মাঝে।যেটা দেখে আদিবের আরো রাগ হলো।সে ধমকে উঠলো,
-এই মেয়ে ওঠো!ওঠো বলছি।
আদিবের ধমকে কাজ হলো, উঠে দাঁড়ালো জাহানারা।আদিবের উত্তপ্ত শ্বাসে ভারি হলো পরিবেশ।সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো আদিব। নিতুর উদ্দেশ্যে গমগমে গলায় বলে উঠলো,
-নিতু তুমি ওকে নিয়ে সোজা সেজ চাচার বাড়ি যাবে ।আমি আসছি।
নিতু তড়িঘড়ি ঘাড় নাড়ালো। সম্মতি জানালো। জাহানারা কে অনেকটা টানতে টানতে নিয়ে গেল সে।আদিব পিছু গেল তাদের। সিনথিয়া কে বাড়ির গেটে রেখে পা বাড়ালো সেজ চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সেজ চাচার বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই জাহানারা কান্নার আওয়াজ আর সালেহার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর পায়ের গতি ধীর করলো আদিবের।বুঝতে পারলো তার বলতে আসা কথা চাচি ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছে।আদিব আর ভেতরে ঢুকলো না ফিরে আসলো।বাড়ি ঢুকতেই বসার ঘরে তানিয়া ধরলো তাকে কড়া গলায় জানতে চাইলো,
-তোমার আর জাহানারার মধ্যে কি চলছে?
মায়ের কথায় আকাশ থেকে পড়লো আদিব। সিনথিয়ার দিকে তাকালো একবার। সিনথিয়া দুইদিকে মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে কিছু বলেনি।আদিব চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
-কিছু চলছে না।
-কিছু যখন চলছে না তাহলে লিচু বাগানের রাস্তায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?
-আপা!
তানিয়ার লাগামহীন ভাষা।সোনিয়া বাধ সাধলো।আদিবের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইলো।চোখ তুলে তাকাতে পারলো না সে মায়ের দিকে। জাহানারা উপর তৈরি হওয়া কিছুক্ষণ পূর্বের রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো আবার।মন হলো মেয়েটাকে আরো দুটো চড় লাগাতে পারলে শান্তি হত।
-আদিব, দীপ্তি যেটা করছে সেটা আমি এখনো মানতে পারেনি।এখন তুমি যদি আবার একই কাজ করবে বলে ভেবে থাকো ,তাহলে আগে থাকতে বলে দাও আমাকে। মানুষের কাছে লজ্জিত অপমানিত হওয়ার চেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ি।
আদিব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মায়ের দিকে।সোনিয়া বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
-আপা কি বলছিস?মাথা ঠিক আছে তোর।
-না, মাথা ঠিক নেই আমার।ও জানে না ;ওর বড় বোনের কীর্তির জন্য আমাদের কতটা অপমানিত হতে হয়েছে! তারপর আবার কোন সাহসে ঐ মেয়ের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রং তামাশা করে! লজ্জা করে না ওর!
চোখে পানি, কণ্ঠে তেজ তানিয়ার।ঠিক সেই সময় বাড়িতে ঢুকলো আশরাফ। তানিয়ার চোখ মুখের দশা দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো কি হয়েছে। আশরাফের কথা যেন তানিয়ার রাগের আগুনে ঘৃতাহুতি দিল।সে চেতে উঠে বলল,
-তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তোমার ছেলে তোমার আশা পূরণ করার জন্য একধাপ এগিয়ে গেছে। এবার শান্তি হবে তোমার।যাও ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করো। তোমার সেজ ভাইকে খবর দাও দুই ভাই মিলে আনন্দ করো। উল্লাস করো।
আশরাফ তাজ্জব বনে গেল তানিয়ার কথায়। তানিয়ার কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।সে তানিয়ার কথা উপেক্ষা করে আদিব কে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।মায়ের কথা শুনে আদিব স্থবিরের নেয় দাঁড়িয়ে ছিল।সে চেয়েও বাবার কথার উত্তর দিত পারলো না।আদিবের মৌনতা দেখে সোনিয়া এগিয়ে এলো, জানাল কিছুক্ষণ আগের কথা।পাশের বাড়ির আতিয়ার সাহেবের স্ত্রী আদিব আর জাহানারা কে লিচু তলার রাস্তায় একে অপরের সাথে অপ্রস্তুত ভাবে দেখেছ।যেটা তিনি বাড়ি বয়ে এসে জানিয়ে গেছেন।তাই নিয়ে তানিয়া চাটছে। সোনিয়ার কথা শেষ হতেই আশরাফ তাকালো আদিবের দিকে জানতে চাইলো তার উপর কৃত আরোপের সত্যতা।আদিব লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল।বাবা কে জাহানারা করা কাজটা বলতে তার জিভ সংকোচ বোধ করলো।আদিব কে এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে সিনথিয়া মুখ খুললো। সবিস্তারে সবটা বলল সবাইকে। সিনথিয়ার কথা শুনে তানিয়া ক্ষান্ত হলো। আশরাফ জাহানারার পক্ষ নিয়ে বলে উঠলো,
-জাহান ছোট মানুষ, আবেগের বসে ভুল করে ফেলেছে।দেখি আমি ওর সাথে কথা বলবো।
-তোমার ঐ ছোট মানুষ ভাতিজির আজ বিয়ে দিলে কাল বাচ্চা কাচ্চা হয়ে যাবে।খবরদার ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে আসবে না। তোমার ভাইকে বল মেয়েকে সামলাতে, না হলে আমি বলতে গেলে ব্যাপারটা ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!
কথা শেষ করে পায়ে গটগট শব্দ তুলে নিজের ঘরে ঢুকলো তানিয়া।আদিবও ধীর পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।সেদিনের পরে তানিয়া জেদ ধরলো ছেলেকে সোনিয়ার সাথে বিদেশ পাঠানোর।সে আর এসব ছোট লোকদের মধ্যে রাখবে না তার ছেলেকে।যত টাকা লাগে লাগুক দরকার হলে সে নিজের বাপের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি করে দেবে ,তবুও ছেলেকে লন্ডন পাঠাবে।তানিয়া বাবার সাথে দেখা করলো এই নিয়ে আলোচনা করতে। তোফায়েল সাহেব মেয়ের কথা শুনে বললেন তানিয়াকে কিছু করতে হবে না। সেই আদিবের লন্ডনে যাওয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহন করবে। তানিয়ার বাবা তোফায়েল সাহেব বিরাট শিল্পপতি তার কাছে লন্ডনে আদিবের পড়াশোনার খরচ বহন করা তেমন কোনো ব্যাপার না কিন্তু সমস্যা হলো তার বয়স বেড়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য ছেলেদের হাতে চলে গেছে।তার এই সিদ্ধান্ত শুনে ছেলের খুব একটা খুশি হলো না।আদিবের মামারা আশরাফ কে খুব একটা পছন্দ করে না।তানিয়ার ছেলের জন্য এই সাহায্যের আবদারে তাদের এতো দিনকার আক্রোশটা যেন আর চাপা থাকলো না। আশরাফের আর্থিক অবস্থা নিয়ে তাদের পরিবার নিয়ে অনেক তীক্ষ্ণ কথা বললেন তারা।আদিব মায়ের সাথে উপস্থিত ছিল সেখানে। বাবার সম্পর্কে শ্রুতি কটু বাক্য শুনে চোয়াল শক্ত হলো তার।মামাদের মুখের উপর বলে দিল তাদের কোন সাহায্য তার লাগবে না। কিন্তু তোফায়েল একমাত্র নাতির কথায় আপত্তি জানালো।আদিব কে তিনি ভীষণ ভালোবাসে, তার জন্য নিজের সবটাও দিয়ে দিতে পারে। সেখানে এ কটা টাকা তার কাছে কিচ্ছু না।সে ছেলেদের কঠিন গলায় বলল নিজেদের ভাষা নিয়ন্ত্রণে আনতে। তানিয়াও ছেলেকে কোনোমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করলো।মা আর নানার কথায় দমলো আদিব।
মায়ের অশ্রু শিক্ত আকুতিতে বাবার অপমান গলদ্ধ করলো। চুপচাপ লন্ডন ******মেডিকেলের *****টেস্টের প্রস্তুতি নিতে লাগলো। IELTS এর রেজাল্টও হাতে আসলো তার মধ্যে।এখন শুধু লন্ডন *****মেডিকেলের অ্যাডমিশন টেস্টের ধাপ গুলো ক্লিয়ার করার অপেক্ষা। রাতদিন এক করে পড়ার টেবিলে পড়ে রইলো সে।আদিবের সেই কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা সফল হলো। লন্ডন****মেডিকেলের অ্যাডমিশন টেস্টের ধাপ গুলো একে একে পিছনে ঠেলে উপরে উঠলো আদিব। কনফার্ম হলো তার অ্যাডমিশন।ছোট খালারা ততদিনে লন্ডন ফিরে গেছে।তানিয়া ছেলেকে সোনিয়ার সাথে পাঠাতে চাইলেও ভিসা টিসার নানান ঝামেলায় সেটা হয়নি।নিজের ক্যারিয়ার গোছানোর তোড়জোড়ে জাহানারাকে ভুলে বসেছিল আদিব তাছাড়া তানিয়া নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে জাহানারা কেন;তার বিষয়ে কোন খবরাখবর খবরও ছেলের কাছে না আসে। কিন্তু তবুও আদিবের কানে এলো খবরটা। জাহানারা কে দেখতে আসছে আগামী কাল। জায়েদের এক কলিগের ছেলে ।এখন আংটি পরিয়ে রাখবে। জাহানারার আঠারো হলেই বিয়ে। খাওয়ার টেবিলে দাদি বলল কথাটা।কথাটা শুনে আশরাফের মুখটা কেমন যেন মলিন হলো।আদিবের খারাপ লাগলো বাবার মলিন মুখটা দেখে।তবে বাবার জন্য খারাপ লাগলেও তার কিছু করার ছিল না, জাহানারা চাচাতো বোন হিসাবে সমাদরের হলেও , জীবনসঙ্গী হিসেবে মোটেও নয়। তাছাড়া যেখানে তার মা এই সম্পর্কে ঘোর বিরোধী সেখানে সে আগাবে কি করে।আদিব একবারের জন্য নিজের অনুভূতি পাশে রেখে বাবার কথা মানলেও মা কে অখুশি করে কীভাবে আগাতো!নিজের মনে কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদিব।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবে মাত্র ডাইনিং পৌঁছেছিল আদিব ঠিক তখন উদ্ভ্রান্তের নেয় ছুটতে ছুটতে নিতু এলো তাদের বাড়ি। আশরাফ তখন ডাইনিং টেবিলে বসা। সকালের নাস্তা করছে।নিতু হাঁফাতে হাঁফাতে এসে আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,
-বড় চাচা! জান হাতের শি’রা কে’টেছে, আপনি একটু চলুন তাড়াতাড়ি।
নিতুর গলা কম্পমান। আশরাফ তার কথার অর্থ বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো।হাতে পানি ঢেলে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত পিষে বলল,
-এবার খুশি তো!
নিজের চিকিৎসার ব্যাগ টা হাতে নিয়ে সে ছুটলো নিতুর পিছনে। আদিব হতবাক হলো।বাবার প্রস্থানরত পথের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।