সৌরকলঙ্ক পর্ব-১+২

0
3

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১

-আদিব বাড়ি ফিরছিস তুই?

-হুম।

-হঠাৎ বাড়ি আসতে চাইছিস?কিছু হয়েছে? বাবা কিছু বলেছে?

ফোনের অপর পাশে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর তানিয়ার।তার কেন জানি মনে হচ্ছে, তার ছেলের হঠাৎ দেশে আসতে চাওয়ার পিছনে তার স্বামী আশরাফের বিশেষ কোন ভূমিকা আছে।না হলে যে ছেলেকে বিগত এগারো বছরে হাতে পায়ে ধরেও, কেও এ মুখো করতে পারে নি, সে কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিল।তানিয়া ছেলের এই সিদ্ধান্ত জানার পর থেকে বেশ চিন্তিত। চিন্তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে,ছেলেটা সবে লন্ডনের মাটিতে পা শক্ত করেছে।এখনো কত কিছু বাকি।আর এখুনি যদি সে বাবার কথায় খ্যামখেয়ালিপানা করে! একেবারের জন্য দেশে চলে আসে,তাহলে চিন্তা হবে না!সে তো জানে কত কষ্ট করে ছেলে তার আজকের অবস্থান তৈরি করেছে।সেই অবস্থান বাপের কথায় আবেগি হয়ে ছেড়ে আসলে ছেলের কত বড় ক্ষতি হবে ,সেটা ছেলে না বুঝলেও তানিয়া ঠিক বুঝেছে।তাই তো ছোট মেয়ের কাছ থেকে ছেলে দেশে ফেরার খবর শুনে তড়িঘড়ি ছেলেকে ফোন করেছে। উদ্দেশ্য সে যে খবর শুনেছে তার সত্যতা যাচাই করা।

আশরাফ বরাবরই ছেলের প্রবাসে থাকা নিয়ে অসন্তুষ্ট।সে সবসময় ইনিয়ে বিনিয়ে চেষ্টা করেছে ছেলেকে দেশে ফেরাতে। কিন্তু ছেলের পোক্ত মনোভাবের কাছে তার কথাগুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।তবে তানিয়ার মনে হচ্ছে এবার তার স্বামীর আবেগি কথায় ফেসেছে ছেলে।তাই তো বাড়ি আসতে চাইছে। এবং সেই কথাটা তার থেকে গোপন‌ও করেছে! বাপের কথা শুনে ছেলে কোন বোকামো না করে বসে, এটা ভেবেই মন উদ্বিগ্ন হচ্ছে তানিয়ার।
এতগুলো বছরে ছেলেটা লন্ডনের মতো বিলাসবহুল শহরে কত কষ্টে নিজের অবস্থান তৈরি করছে সেটা তার অজানা নয়।কত কঠোর পরিশ্রম আর ত্যাগতিতিক্ষার ফল আদিবের এই বর্তমান অবস্থান।সেই অবস্থান বাবার কথায় এত সহজে ছেড়ে দিবে ছেলে!সেটা তানিয়া হতে দিতে পারে না। কিছুতেই না।
এগারো বছর!প্রায় এগারোটা বছর সে তার বুকে পাথর বেঁধে ছেলেকে এতদূর এমনি এমনি তো রাখেনি।এখন যখন ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,নিজের সুউচ্চ অবস্থান তৈরি করছে, তখন সেসব ছেড়ে বাড়ি আসার প্রশ্নই ওঠে না।তার স্বামীর বোকামির জন্য সে ছেলের এতো বড় সর্বনাশ হতে দিতে পারে না!
মায়ের উদ্বেগ বুঝলো আদিব ।সে একটা শ্বাস গোপন করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

-বাবা কিছু বলে নি মা।একটা লম্বা ছুটি পেয়েছি, তাই মনে হলো একটু ঘুরে আসি বাড়ি থেকে। তাছাড়া তোমাদের দেখতে ইচ্ছা করছিল।তাই…

-আমরা আসছি তো বাবু তোর কাছে।আর কটা দিন একটু সবুর কর।এতোটাকা খরচ করে তুই আসবি, আবার ফিরবি!বাবু ফ্লাটের ইএমআই তো এখনো বাকি।এখন এতো খরচা খরচ করলে চলবে!

আদিবের কথা শেষ না হতেই বলল তানিয়া। মুখস্থ কথা ,যেন প্রস্তুত ছিল সে আদিবের কথার প্রেক্ষিতে কথাটা বলতে।মায়ের কথা শুনে মনে মনে হাসলো আদিব।খরচা খরচের ভয় দেখিয়ে মা যে তাকে পরোক্ষভাবে দেশে ফিরতে বারণ করছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।তবে সেটা মা কে বুঝতে না দিয়ে মায়ের কথার প্রতি উত্তরে বলল,

-তোমাদের কাগজপত্র ঠিক করে এখানে আসতে এখনো অনেক দেরি মা।আর র‌ইলো ফ্লাটের ইএম‌আই,ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ।সেটা গতমাসে ক্লিয়ার হয়েছে।

আদিবের ভণিতাহীন জবাব।ছেলের কথায় কিঞ্চিৎ নিরাশ হলো তানিয়া।সে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

-ও। আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আই।ঘুর যা।

একটু থামলো তানিয়া তারপর কি যেন মনে পড়েছে এমন ভাব করে আবার বলল,

– আদিব,, তুই একবারে চলে আসছিস না তো বাবা?

-মা বললাম তো ছুটিতে আসছি।আমার কথা কি ঠিক করে শোনোনি? ওকে ফাইন, তোমার আপত্তি থাকলে আমি আসছি না!

-আহা; আমি কখন বললাম আমার আপত্তি আছে।আমি ভাবছিলাম তুই আবার তোর বাপের কথা শুনে সব ফেলে চলে আসছিস কি না; তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।রাগ করছিস কেন! আচ্ছা শোন ওসব বাদ দে।সকালে নাস্তা করেছিস?আজ কি খেলি?

প্রসঙ্গ বদলাতে কথা ঘোরালো তানিয়া।ছেলের অল্পতে রেগে যাওয়া স্বভাব সম্পর্কে ভলিভাতি অবগত সে।এক কথা একবারের বেশি শুনতে পছন্দ করে না আদিব।রেগে যায়। বিরক্ত হয়।এখন ছেলের কাজের সময়। তানিয়া চায় না এখন ছেলেকে রাগাতে সুতরাং কথা ঘোরানোই ভালো।

আজ ঘুম থেকে উঠতে দরী হয়েছে আদিবের যার কারণে সকালের খাবার টা এখনো পেটে পড়েনি।তবে সে কথা মা কে বললে সে অন্য কথা টেনে আনবে। যেটা আদিব এই মুহূর্তে চাইছে না।সে কোনোরকমে বলল,

-ব্রেড-জ্যাম,কফি।

তারপর একটু থেমে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

-মা রাউন্ডে যেতে হবে, ফোন রাখছি।রাতে ফোন দিবো।

– দাড়া,কল কাটিস না।বলছি তুই কবে আসছিস?এই সপ্তাহে?

-হুম।সামনের সোমবার।

-এই সোমবার!আজ তো শনিবার।তাহলে পরশু?

-পরশু রাতে এখান থেকে ফ্লাইটে উঠবো। বাংলাদেশে পৌঁছতে মঙ্গলবার দুপুর দুটো তিনটা বাজবে হয়ত।

-মঙ্গলবার! আচ্ছা ,আমি তোর মামাকে বলবো তোকে এয়ার পোর্টে নিতে যেতে।সেদিন ওদের ওখানে থেকে পরেরদিন খুলনা আসিস।অবশ্য তোর মামাকে বললে সে গাড়ি করে তোকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে যাবে।

অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল তানিয়া।নিজের সহজ সরল সাজেশন শোনাল ছেলেকে।তবে আদিবের মায়ের সাজেশন টা পছন্দ হলো না।সে আপত্তি জানিয়ে বলল,

-মামাদের এখন কিছু জানাতে হবে না।আমি ঢাকা টু যশোর ফ্লাইট নিবো। যশোর থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেব।

-সে কি এত পথ পাড়ি দিয়ে, আবার জার্নি করবি! তার থেকে ওদের ওখানে একদিন থাক। রেস্ট নে। তারপর বাড়ি আই।

-মা কেন শুধু শুধু মানুষকে বিরক্ত করা!আর তাছাড়া তুমি তো জানো আমার ওখানে যেতে ভালো লাগে না।তাহলে কেন বলছো।আমি সোজা বাড়ি যাবো। আচ্ছা এখন রাখছি।পরে কথা বলবো।

নিজের মতো কথা বলে কল কেটে দিল আদিব।তানিয়া ছেলের কণ্ঠের রুক্ষতা স্পষ্ট বুঝতে পারলো। মনে মনে ছেলের ব্যবহারে রুষ্ট হলো সে। শব্দ করে স্মার্ট ফোন টা সামনের টি টেবিলের উপর রেখে নিজের সূক্ষ্ম রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।এরপর কিছু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে আশরাফের দিকে চোখা চোখে চেয়ে বলল

-সত্যি করে বলো তো তুমি কি বলছো আদিব কে?

আশরাফ সকালের বাসি খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল। তানিয়ার কথা শুনে খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই কাটকাট গলায় বলল,

-তোমার ছত্রছায়ায় আবদ্ধ ছেলের… বাপের প্রতি অতটান নেই, যে সে বাপের কথায় সুদূর লন্ডন থেকে দৌড়ে আসবে!

আশরাফের কটাক্ষ পূর্ণ কথা। তানিয়া তেতে উঠে বলল,

-একটা সামান্য কথা জিজ্ঞেস করেছি আমি, এতে এমন টিটকারি করার কি আছে!

-সামান্য কথাটা আমার কাছে বৃহত্তর মনে হলো তাই টিটকারি করলাম।

আশরাফের কথায় তানিয়ার রাগ আরো চরমে উঠলো।একে তো ছেলে তাকে কিছু জানায়নি ,তার‌উপর তার কথা অসম্পূর্ণ রেখে কল কে’টে’ছে , এখন আবার এই লোক তাকে ঠেস দিয়ে কথা বলছে!একদিনে এতো কিছু সহ্য করা যায়! রাগে দুঃখে তার চোখ মুখ থমথমে হলো।সে আশরাফের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো। আশরাফ খবরের কাগজে চোখ নিবদ্ধ রেখেও বুঝতে পারলো তানিয়া তাকে নিজের অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে ভস্মীভূত করারা তীব্র প্রয়াসে আছে।বুঝলো প্রতিবারের মতো এবারও তাকেই হার মানতে হবে। না হলে এই অগ্নি চক্ষু যেকোনো মুহুর্তে বর্ষার পানিতে ডোবা খালে পরিণত হবে।সে খবরের কাগজ একপাশে রেখে বলল,

-আদিবের সাথে এরমধ্যে আমার কোন কথা হয় নি।এক সপ্তাহ আগে ও নিজে ফোন দিয়েছিল আমাকে।ফোন দিয়ে বলল ভিডিও কলে আসতে।আমাকে দেখবে। এরপর মনে হয় হাতে গুনে দুই মিনিট কথা হয়েছিল।ওটুকু সময়ে না আমি তাকে বাড়ি আসার কথা বলেছি ,আর না সে আমাকে তার দেশে আসার বিষয়ে কিছু জানিয়েছে। গতকাল তৃপ্তি আমাকে জানাল আদিবের দেশে ফেরার কথা। ব্যাস।পেয়েছ উত্তর?খুশি?

স্বামীর কথা শুনে তানিয়া যেন একটু স্বস্তি পেল।মনের ভেতর তৈরি হ‌ওয়া খুঁতখুঁতুনি টা কিছুটা শান্ত হলো। তানিয়ার মুখের পরিবর্তিত অভিব্যক্তি দেখে আশরাফ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।বসে থাকার ফলে কুঁচকে যাওয়া ফতুয়ার নিচের অংশ হাত দিয়ে টেনে সোজা করতে করতে বলল,

-ছেলে দেশে ফিরছে এ নিয়ে এত চিন্তা করছো কেন তানিয়া?তোমার তো খুশি হ‌ওয়া উচিত,এতদিন পরে ছেলে বাড়ি ফিরছে।আর কেউ না জানুক আমি তো জানি, প্রতি রাতে ছেলের জন্য কীভাবে চোখের পানি ফেল তুমি।ছেলেকে একপলক দেখার জন্য কতটা অধীর আগ্রহে সময় পার করো।তাহলে!ছেলে ফেরার কথা শুনে এত ছটফট করছো কেন?

আশরাফের সন্দেহীন কণ্ঠ।ভড়কালো তানিয়া।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো হয়ত আশরাফ কোন জাদু বলে তার মন পড়ে নিয়েছে।সে স্থির চোখে তাকালো আশরাফের দিকে।
দুই মেয়ের পরে জন্মেছিল আদিব।শুরু থেকে একটা ছেলের ইচ্ছা ছিল তানিয়ার কিন্তু পর পর দুই মেয়ে হ‌ওয়ায় সেই ইচ্ছা ত্যাগ করেছিল । কিন্তু সৃষ্টি কর্তার মনে হয়ত অন্য কিছুই ছিল। তাই তো ছোট মেয়ে তৃপ্তির জন্মের প্রায় এগারো বছর পর অপ্রত্যাশিত ভাবে আবার কনসিভ করলো তানিয়া।কনসিভ করার পর মনে থাকা ইচ্ছা টা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার।খুশিতে আত্মহারা হলো মনে মনে। কিন্তু খুশিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণে।প্রথমতো বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, তার‌উপরে থাইরয়েডের সমস্যা তুঙ্গে।ডাক্তার বলল এই বয়সে এতো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।ডাক্তারের কথায় আশরাফ‌ও সম্মতি জানালো।কিন্তু আশরাফের মা জাহানারা বেগম বেঁকে বসলেন।তানিয়াও শ্বাশুড়ির কথায় সাঁই দিল। আল্লাহ ভরসা, যা হবে দেখা যাবে।এই কথায় আমল করে অপেক্ষা করতে লাগল অনাগত সন্তানের।এরপর যেদিন আদিব ভুমিষ্ঠ হলো সেদিন তানিয়ার জান নিয়ে টানাটানি অবস্থা। নরমাল ডেলিভারি কিন্তু র’ক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। রক্ত শূন্য হয়ে একটু একটু করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে সে।চোখের সামনে নামছে অন্ধকার। ডাক্তার তার অবস্থা দেখে হিস্টেরেকটমি করতে বাধ্য হলো।বাদ পড়লো তার নারী শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।আজো চোখের সামনে সেই দিনটা ভাসে।
এতো এতো কষ্টের পরে পাওয়া ছেলে তার। সেই ছেলেকে এতোগুলো বছর নিজের থেকে দূরে রাখা তানিয়ার জন্য মোটেও সহজসাধ্য ছিল না।তবুও সে সেটা করেছে।ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মাতৃ স্নেহ কে দূরে ঠেলেছে।

-এতো কীসের ভয় তানিয়া!যে ভয়ে ছেলেকে দেশ ছাড়া করেছিলে সেসব তো কবেই চুকে গেছে। আমার মা‌ও তো বেঁচে নেই……!তুমি যার ভয় পাচ্ছো…… স্যরি যে কারণে ভয় পাচ্ছো তা তো আর সম্ভব না।

আশরাফের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো তানিয়ার।নিজের ভাবনা একপাশে রেখে সংযত কণ্ঠে সে বলল,

-আমি কোন ভয় পাচ্ছি না।আমরা যাচ্ছিলাম‌ই ওখানে।সেই জন্য চাইছিলাম আদিব যেন আবার অতগুলো টাকা খরচ করে এখানে না আসে।

যথেষ্ট শান্ত কণ্ঠ তানিয়ার।নিজের মনের ভাব লুকানোর ত্রুটিহীন চেষ্টা। তবুও যেন আশরাফ তার মনের ভাব বুঝে নিল। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাঁসি।

-ভয় না পেলেই ভালো।তবে যদি তোমার মনে উলটো পালটা কিছু উদয় হয়, আর সেটা ভেবে ছেলেকে দেশে ফেরা থেকে আটকাতে চাও, তাহলে তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দিচ্ছি যে তুমি যার থেকে তোমার ছেলেকে আড়ালে রাখতে এতো কসরত করছো। সে এখন তোমার ছেলের দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। সুতরাং তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।

নিজের কথা শেষ করে তানিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল আশরাফ।তানিয়া আশরাফের গমনরত পথের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল।আশরাফের বলা কথাগুলোর তাৎপর্য মনে করতেই চোখ বন্ধ করে একটা গভীর শ্বাস টানলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো সময় নিয়ে।
আশরাফের বলা কথা,নিজের অহেতুক ভাবনা সব একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো।ছেলে বাড়ি ফিরছে তার। এখন বসে থাকলে হবে না।ছেলের থাকা খাওয়ার যেন কোন‌ অযত্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।বাড়ি কাজের লোক আছে তবে তাদের ভরসায় ছেলের কাজ ফেলা রাখা যাবে না। তাছাড়া আদিব খুঁতখুঁতে স্বভাবের, কোন কিছু এদিক ওদিক হলেই চটে যায়। সুতরাং তানিয়া কোন ঝুঁকি নিতে চায় না।

দুই তলার দক্ষিণের ঘরের সামনে এসে থামলো তানিয়া।এই ঘরটা আদিবের।দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে।আদিব না থাকলেও রোজ নিয়ম করে ঘরটা পরিষ্কার করায় তানিয়া। তবুও আজ যেন মনে হলো ঘরের আনাচে কানাচে বেশ ধুলো জমেছে।সেই সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ‌ নাকে আসছে।ঘরের জানালা গুলো খুলে দিল তানিয়া। দক্ষিণের জানালা টা খুলতেই চোখ পড়লো সামনের আলিশান দোতলা বাড়িটা। সাথে সাথে মুখে জুড়ে অন্ধকার নামলো তার।জানালার আধ খোলা পাটটা শব্দ করে আবার বন্ধ করলো সে।অনেকদিন পর ফের রাগ হলো শ্বাশুড়ির উপর।
_______________
-কি খবর জায়েদ?শরীর গতি ভালো?

-জ্বি,মিয়া ভাই।

-শরীর ভালো; তাহলে চোখ মুখ অমন দেখাচ্ছে কেন রাতে ঘুম হয় নি?

-সালেহার শরীর ভালো না।কাল রাতেও গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে , সারারাত ঘুমায় নি।আবোল তাবোল বকেছে।

-সে কি কথা!এত খারাপ অবস্থা,আমাকে ডাকিসনি কেন?

-অত রাতে আর তোমাকে বিরক্ত করতে চাই নি।তাই আর কি…!

-রাবিস।তোমাকে কে বলল আমি বিরক্ত হবো।নিজের মনে যাতা ভাববেনা।চলো দেখি ,ভেতরে চলো, দেখি কি অবস্থা।

কথাটা বলতে বলতে নীল রঙের গেটটা ঠেলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আশরাফ।এই বাড়িটা তার সেজ ভাই জায়েদের। আশরাফের বাবা আহাসান‌উল্লার সহায় সম্পত্তি বলতে খুলনা শহরে পাঁচ বিঘা জমি ছিল।যা মৃত্যুর আগে তাদের চার ভাই,বোন আর তাদের মা জাহানারার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি।আহাসান‌উল্লার অবশ্য ইচ্ছা ছিল ছেলেরা একসাথে থাকবে এক ছাদের তলে কিন্তু পুত্র বধূদের আচার আচরণ দেখে সে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয় তাকে ।পরবর্তীতে যার যার অংশ তাকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রাচীর টানেন জমিতে।ছেলেরা দূরে থাকুক তবুও একে অপরের মনে থাকুক এমন ভাবনা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেন।
বাবার রেখে যা‌ওয়া সেই জমিতে পরে তারা তিন ভাই পাশাপাশি বাড়ি তৈরি করে।পরপর তিনটে বাড়ি, দূর থেকে দেখলে মনে হয় গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায় তাদের মধ্যকার দূরত্ব।ঠিক যেমন এ বাড়ির মানুষগুলোর সাথে একে অপরের দূরত্ব।
তিক্ত হলেও কথাটা সত্যি ,বাড়িগুলো একে অপরের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাড়ির লোকেরা কালে ভাদ্রেও একে অপরের সামনাসামনি হয় না। জাহানারার মৃত্যুর আগে যদিও কিছু আন্তরিকতা অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু জাহানারার মৃত্যুর পর সেটাও প্রায় নিঃশেষ হয়েছে।ভাই ভাইয়ে এখনো হয়ত কিছুটা সম্পর্ক আছে যার দরুন একে অন্যের বিপদে তারা এগিয়ে যায়,ভালো মন্দে পাশে থাকে হোক সেটা শুধু চৌকাঠ পর্যন্ত তবুও কিছু আছে। কিন্তু বাড়ির ব‌উ ছেলে-মেয়েরা ভুলেও একে অপরের ছায়া মাড়ায় না।কি জানি কোন অদেখা প্রতিযোগিতায় একে অপরের থেকে এগিয়ে থাকতে চায় তারা! যার জন্য নিজেদের মাঝে এই দূরত্ব টেনেছে!

আজ অনেক দিন পর জায়েদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো আশরাফ।বছর পাঁচেক আগে জায়েদের একতলা টিনের ঘর ভেঙ্গে তিন তলা বিশিষ্ট বিরাট বিল্ডিং তুলেছে আকিব।আকিবের তৈরি কৃত এই বিল্ডিংয়ে আজ প্রথম ঢুকছে আশরাফ।অবশ্য বাড়ি তৈরি করার সময় একবার দেখে গিয়েছিল কিন্তু তারপর আর আসা হয়নি। বাড়িতে ওঠার সময় আকিব চাচাদের দাওয়াত করেছিল তবে আশরাফ আসতে পারেনি। তৃপ্তির শ্বশুর মারা গিয়েছিল। আশরাফ কে সেদিন সেখানে যেতে হয়েছিল।আজ ভেতরে ঢুকে চকচকে ঝকঝকে বাড়িটা দেখে মুখের কোণে এক চিলতে হাঁসি খেলে গেল আশরাফের।যাকে বলে প্রশান্তির হাঁসি।

এক দুর্ঘটনায় জায়েদ যখন পায়ে আঘাত পেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলো তখন সব কিছু থমকে গিয়েছিল তাদের পরিবারের জন্য।তার বাবার মতো শক্ত মানুষ‌ও ভেঙ্গে পড়েছিলেন!অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক।হাতে ছেলের পুলিশ সুপার হিসাবে জয়েন্ট করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আর ছেলের পায়ের শিরা থেঁতলে যা‌ওয়ার জন্য অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন চলছে ।এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ ভেঙ্গে পড়বে।তবে মা শক্ত হাতে সব সামলেছিল। জায়েদ কে নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যুগিয়েছিলেন।ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য যা যা করণীয় তাই তাই করেছিল।জায়েদ‌ও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সামান্য প্রাইমারি স্কুলের চাকরি করে তাদের দুই ভাইয়ের মতো সমাজে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।পারেনি সংসারে অভাব অনটন ঠেলে সচ্ছল জীবন কাটাতে। জায়েদের সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন দেখে তার মা প্রায়স চিন্তা করতো।আফসোস করে বলতো,” আমার সবচেয়ে যোগ্য ছেলেটা ভাগ্যের ফেরে আজ সবার থেকে পিছিয়ে গেল!” মায়ের কত চিন্তায়ই না ছিল জায়েদ কে নিয়ে। জায়েদের অসচ্ছল অবস্থা নিয়ে।
অথচ আজ, আজ জায়েদ তাদের চার ভাইবোনের মধ্যে সবার থেকে এগিয়ে। সবার চেয়ে উপরে।তার আর্থিক সচ্ছলতা আর সামাজিক মর্যাদার সামনে এখন তারা চার ভাই বোন কিছুই না।মা আজ বেঁচে থাকলে আকিবের এই উন্নতি, জায়েদের এই সুখ দেখে কত খুশিই না হত!
কথা গুলো নিজ মনে ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে গেল আশরাফ।মায়ের অন‌উপস্থিতি শরণ করে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলতে ভুলল না।জায়েদ তার পাশেই ছিল।ভাইয়ের দ্বীর্ঘশ্বসের শব্দ তার কানে ঠিক পৌঁছাল।

-কি হলো? হঠাৎ দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললে যে?

-মা’র কথা মনে পড়লো হঠাৎ। আজকাল মা’র কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়।মনে হয় বাবা যতটুকু সুখ স্বস্তি দিয়ে গিয়েছিল, আমরা তার সিকি কণাও দিতে পারিনি তাকে।সেই জন্য হয়ত এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে।না হলে হয়ত আরো কটা দিন বাঁচতো।

-ও কথা বলতে নেই।হায়াত ম‌ওত আল্লাহর হাতে। আল্লাহ যা ভালো মনে করেছে করেছেন।

জায়েদের পাথর কঠিন কণ্ঠ।হয়ত কণ্ঠের কঠোরতার আড়ালে মনের দুর্বলতা লুকাতে চাইছে। ব্যাপার টা আন্দাজ করলো আশরাফ তবে কিছু বলল না।

-ব‌উমা বাড়ি নেই?

তিন তলার বিরাট ফ্ল্যাটটার ভেতরে প্রবেশ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে জানতে চাইলো আশরাফ।জায়েদ সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

-না।বাবার বাড়ি গেছে।আজ চলে আসবে।আকিব আনতে গেছে।

-এইবার বুঝেছি!ব‌উ বাড়ি নেই সালেহা নিশ্চয়ই পানি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে।সেই জন্য এই অবস্থা!

-সে কথা বলতে।উনি তো সুযোগ পেলেই ঐ করে।বাড়ি যে এতোগুলো কাজের লোক আছে তাদের কাজ ওনার পছন্দ হয় না।তারিন থাকলে যাও একটু বকে ধমকে রাখে কিন্তু সে নেই এই সুযোগে যা মনে চায় তাই করে।

সালেহার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল জায়েদ।সালেহা জেগেই ছিল বড় ভাসুরের গলার স্বর শুনে দুর্বল শরীরে উঠে বসলো।মাথায় কাপড় টেনে সালাম দিল আশরাফ কে।জায়েদ একটা চেয়ার টেনে বিছানার সামনে রাখলো।আশরাফ সালেহাকে সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,

-চেহারা ছবি যা বানিয়েছ তোমাকে দেখে তো ভয় করছে আমার।একি অবস্থা করেছ! হ্যাঁ! ঔষধ পানি ঠিকঠাক খাও তো না কি?

-খাই তো ভাই।তাও এরকম হলে কি করবো বলুন!

অসুখে পেঁচিয়ে ধরা ভাঙ্গা গলায় ম্লান হেঁসে বলল সালেহা। আশরাফ তার কথা শুনে বলল,

-শুধু ঔষধ খেলে তো হবে না।নিয়ম মাফিক চলতেও হবে।যে রাজ রোগ নিয়ে বেড়াচ্ছ;তাতে একটু এদিক ওদিক হলেই ভোগান্তির শেষ নেই।দেখি হাত দাও পেশার টা দেখি কি অবস্থা।

জায়েদ স্ফিগমোম্যানোমিটার এগিয়ে দিল আশরাফের দিকে।মায়ের অসুস্থতার জন্য এটা অনেকদিন হলো কিনেছে আকিব। আশরাফ পেশার মেপে যন্ত্র টা একপাশে রাখতে রাখতে বলল,

-পেশার লো।ভালো করে খাওয়া দাওয়া করো সালেহা।জায়েদ খেয়াল রাখ ওর দিকে।

এরপর প্রেসক্রিপশনে দুটো নতুন ঔষধ লিখে দিয়ে আবার বলল,

-ঔষধ দুটো খেয়ে উন্নতি হয় কি না সেটা জানাবে।আমি আবার কাল আসবো।আর ভুলেও পানির কাজ করতে যাবে না। শ্বাস কষ্টের রোগী তুমি, ওসব করতে গেলে হয়। তাছাড়া বাড়িতে কাজের মানুষ থাকতে তুমি ওসব করতে যাও কেন।ছেলে তোমার আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করছে,সেটা একটু ভোগ করো।কেন শুধু শুধু খাটা খাটনি করে শরীরের উপর জুলুম করছো!

কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালো আশরাফ।সালেহা তড়িঘড়ি দুর্বল কণ্ঠে জায়েদের উদ্দেশ্যে বলল,

-আকলিমাকে বলো ভাই কে চা নাস্তা দিতে।

-না, আজ আর কিছু খাবো না। তুমি সুস্থ হ‌ও, একবারে তোমার হাতে এলাচি দিয়ে দুধ চা খাবো।

-সে না হয় খাবেন।তবে আজ একটু কিছু মুখে দিন, অন্তত এক কাপ চা। কতদিন পরে আসলেন। হ্যাগো !দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও আকলিমাকে বলো।

সালেহা তাড়া দিল জায়েদ কে ।জায়েদ ব্যস্ত পায়ে সামনে আগাচ্ছিল তার আগে তাকে থামিয়ে দিল আশরাফ।বলল,

-আজ সময় নেই সালেহা ।এক জায়গায় যেতে হবে। আবার আসবো তো, সেদিন চা নাস্তা খাওয়া যাবে।আজ আসি।তুমি নিজের খেয়াল রেখ ।আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানিয়ো।

আশরাফের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো সালেহা। আশরাফ জায়েদের সাথে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।দুই ভাই কথা বলতে বলতে নিচে নেমে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই চোখ গেল রাস্তার অপর পাশে।নাজিফা নামছে রিকশা থেকে। সালেহার অসুস্থতার কথা শুনে তাকে দেখতে এসেছে সে। আশরাফ কে দেখেই এক প্রকার দৌড়ে এলো সে। আশরাফ কে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো। কুশলাদি বিনিময় শেষে আশরাফ অভিযোগের সূরে বলল,

-জায়েদের এখানে আসতে পারো তুমি আর দুই পা বাড়িয়ে আমার বাড়ি যেত পারো না!না কি মিয়া ভাইকে ভুলে গেছ তোমরা?সেদিন দেখলাম শাহেদ খুলনা এলো, সাজ্জাদের বাড়ি গেল, জায়েদের এখানে দুই রাত কাটালো আমার বাড়ি গেল না। আবার তুমিও আমার বাড়ি মুখো হ‌ও না। ঘটনা কি বলো তো !সবাই মিলে আমাকে এক ঘরে করার পরিকল্পনা করছো না কি?

-না না,মিয়া ভাই তেমন কিছু না।আসলে বাড়ি থেকে বের হওয়া হয় না,আজ‌ও আসা হতো না। মেয়ের কোচিংয়ে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে তাই ভাবলাম সেজো ভাবি অসুস্থ তাকে দেখে যাই।তোমার ওখানে সময় করে যাবো একদিন।

আশরাফের কথার জবাবে তড়িঘড়ি নিজের স্বপক্ষে বলল নাফিজা। আশরাফ বোনের কথা শুনে ম্লান হাসলো।সে জানে তার বোনের তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য ঐ একদিন হয়ত কখনোই আসবে না।মায়ের মৃত্যুর পর মাকে বহন করা খাটিয়ার পিছু পিছু আশরাফের বাড়ির উঠান থেকে তার বোন-ভাইয়েরা সেই যে বের হয়েছে আর তার চৌকাঠ মাড়াই নি।এতে অবশ্য সে তাদের দোষ দিতে পারে না।সে অধিকার তার নেই।দোষ যেখানে নিজের সেখানে অন্যকে দোষ দেওয়া চলে না।কথাগুলো নিজ মনে ভেবে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আশরাফ।বোনকে নিজের বাড়ি যা‌ওয়ার কথা আরো একবার মনে করিয়ে দিয়ে অনেকটা ব্যাস্ততার সাথে স্থান ত্যাগ করলো।মা মা’রা যাওয়ার পর থেকে কেন জানি ভাই বোনেদের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না সে।নিজেকে বড্ডো ছোট্ট ছোট্ট লাগে।অপরাধী মনে হয়।মনে পড়ে সেই বিভৎস রাতটা টা।বাবা মারা যা‌ওয়ার পরে মায়ের চোখে দেখা সেই প্রথম অশ্রু,সেই অসহায় মুখ ।সবটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।মাঝে মাঝে তার মনে হয় মা হয়ত তার উপর অভিমান করেই তাদের ছেঁড়ে চলে গেছেন। কষ্ট হয় কথাটা মনে হলেই।বুক ভারী হয়ে আসে। পুরুষ মানুষকে কাঁদতে নেই ,এই অঘোষিত নিয়ম ভেঙ্গে চোখের কোণ ভিজে যায়।
আশরাফের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় পিছনে ফিরে গিয়ে সবকিছু ঠিক করতে।এই যে সম্পর্কের দূরত্ব গুলো, এই দূরত্বের শুরুটা রুখে দিতে।পুরোনো সময়টা ফিরে পেতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।
চলে যাওয়া সময় কি আর ফিরে পা‌ওয়া যায়!যায় না…!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২

আদিবের যশোর এয়ার পোর্ট থেকে বের হয়ে গাড়ি ঠিক করতে করতে মাগরিবের আজান পড়লো।সে গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো গাড়িচালক।গাড়ির ছিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলো আদিব।শরীর ক্লান্ত ছিল তাই তো একটু আরামে চোখ বুজে এলো তার। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সেটা নিজেও টের পেল না।তার ঘুম ভাঙল পরিচিত কণ্ঠস্বরে।চোখ পিটপিট করে পাশ ফিরে জানালার বাইরে তাকাতেই লম্বাটে ভারি মুখটা দেখে ঘুম ছুটে গেল তার।মুখে ফুটে উঠল চ‌ওড়া হাঁসি।অপরপাশের ব্যক্তিটির‌ও চোখ পড়লো আদিবের সেই হাঁসি।সেও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভ্রূ নাচিয়ে বলল,

-ঘুম ভেঙ্গেছে ডিজনি প্রিন্স!না কি প্রিন্সেস লাগবে?

সেই পুরোনো ভঙ্গিতে নতুন রসিকতা। আদিব ডান ভ্রুতে তর্জনী বুলিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে হাসলো। হাঁসির সময় তার ত্যাড়া বাঁকা গজ দন্তটা উঁকি দিল ঠোঁটের ফাঁকে। দারুণ দেখালো ছেলেটাকে।আদিবের সেই দারুণ ভঙ্গির হাসি দেখে সজীব নিজের বুকের পাশে হাত রেখে নাটকীয় ভাবে বলল,

-ইশশশশ…খন্দকার সাহেব, জান নিবেন না কি!এত সুন্দর করে কেউ হাসে বুঝি!

সজীবের কথা শেষ না হতেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো আদিব।গাড়ি থেকে বের হয়ে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো পুরোনো বন্ধু কে। সজীব‌ও দৃঢ় আলিঙ্গনে আগলে নিল তাকে।একে অপরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই আদিব বলল,

-গুড টু সি ইউ ম্যান।আমি কল্পনাও করতে পারিনি দেশে ফিরেই তোর সাথে দেখা হবে।আমি খুব খুশি হয়েছি তোকে দেখে। খুব খুশি।কিন্তু তুই এখানে! মানে কীভাবে…?

সজীবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদিব। তার দেশে ফেরার কথা তার পরিবার ছাড়া কারো জানার কথা না।আর সজীবের তো প্রশ্নই ওঠে না!

-খূলনার দিকে যাচ্ছিলাম,মাঝপথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল।এই ভর সন্ধ্যা বেলায় হাইওয়েতে গাড়ি ঘোড়া কিছু পাচ্ছিলাম না বাধ্য হয়ে তোর এই গাড়ির সামনে জীবন বাজি রেখে দাঁড়াতে হলো।তোর ড্রাইভার সঠিক সময়ে ব্রেক না মারলে আজ আমার ভবলীলা সাঙ্গ হতো। ধন্যবাদ মামা সঠিক সময়ে ব্রেক কষার জন্য।
একদমে কথা বলে থামলো সজীব।শেষের কথাটা ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল। ড্রাইভার তার কথা শুনে মুখ কুঁচকালো।নিজের আঞ্চলিক ভাষায় থড়বড়িয়ে বলল,

-ওরকম পাগলামো করে কেউ! যদি আমি ঠিক সময় গাড়ি না থামাতাম, তাহলে কি হতো! গাড়ির চাকা আপনার উপরে উঠে যেত, আমাকে জেল খাটতে হত!

-আরে মামা এতো নাক মুখ শিটকাচ্ছেন কেন, ওঠেনি তো গাড়ির চাকা আমার উপর।সামলে নিছেন তো আপনি। সো জাস্ট চিল।

সজীবের কথা শুনে বিরক্তিতে ঠোঁট বেকালো গাড়ি চালক ।তারপর গাড়ি থেকে নেমে বিড়বিড় করতে করতে রাস্তার পাশে ঝোপের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। সজীব তা দেখে ঠোঁট চেপে হেঁসে বলল,

-বুঝেছিস ,গাড়ির ব্রেক কষতে গিয়ে, মামার ব্রেক ঢিলা হয়ে গেছে।

সজীবের কথা শুনে দাঁত বের করে শব্দহীন হাঁসি হাসলো আদিব।হাসতে হাসতেই বলল,

-আমি ভেবেছিলাম এত বছরে হয়ত সজীব ওয়াহিদ বদলে গেছে ।বাট স্যরি আই ওয়াজড রং।সে একটুও বদলায়নি।

স্বগোতক্তি করলো আদিব। সজীব আদিবের কথা শুনে নিজেকে ভালোভাবে পরখ করে বলল,
-কৈ! বদলেছি তো!ভালো করে দেখ। স্বাস্থ্য শরীর আগের থেকে উন্নত লাগছে না?

-আমি বাইরের পরিবর্তনের কথা বলছি না। বলছি ভেতরের পরিবর্তনের কথা।থাক তুই বুঝবি না।তুই তোর ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে আই র‌ওনা দিই।বাকি কথা যেতে যেতে হবে।

-ব্যাগ ব্যাগেজ!ওরে আল্লাহ! দাঁড়া আসছি।

আদিবের কথা শুনে হঠাৎ সজীবের কি যেন মনে পড়ছে এমন ভাবে ছুটলো গাড়ির দিকে।গাড়ির দরজা খুলতেই ব্যাকসিটে ছোট্ট তুলিকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। ঝুঁকে আলতো হাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে ড্রাইভারকে বলল তার লাগেজ আদিবের গাড়িতে উঠিয়ে দিতে।তারপর মেয়েকে আদিবের সামনে নিয়ে গিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে বলল,

-আমার মেয়ে,তুলি।

-তুই বিয়ে করলি ক

-আস্তে !আস্তে কথা বল।উঠে পড়বে তো।উঠলেই মায়ের জন্য প্যানপ্যান করবে।

আদিবের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল সজীব।কথাটা বলতে যেয়ে চোখ মুখে খেলে গেল তার অসহায়ত্ব।আদিব সেটা দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো।সজীব তা দেখে চোখ সরু করলো।মানে হাসছিস কেন?আদিব সাথে সাথে নিজেকে সংযত করলো।
তুলির ঘুম ভীষণ পাতলা একটু শব্দ কানে গেলেই ঘুম ছুটে যায় তার।এখন যদি এই মাঝ রাস্তায় মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলে ব্যাপারটা সজীবের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না।তাই এতো সাবধানতা।এতে এত হাসির কি আছে!

-বিয়ে করেছিস কবে?

সজীবের মতো ফিসফিসিয়ে বলল আদিব। সজীব গাড়ির দিকে আগাতে আগাতে বলল,

-ভেতরে চল বলছি।

গাড়িতে উঠে বসলো তারা। সজীব মেয়েকে একটা পাতলা চাদর দিয়ে মুড়ে নিজের সাথে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বসলো।সজীবের গাড়ি লক করে তার ড্রাইভার কেও সাথে নিলো।সামনে ********বড় বাজার পড়বে সেখান থেকে মেকানিক নিয়ে এসে গাড়ি ঠিক করে বাড়ি নিয়ে যাবে সে।গাড়ি চলমান হতেই আদিব তার করা প্রশ্নটা পুনরাবৃত্তি করলো।সজীব মেয়েকে নিজের সাথে আর একটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-সামনের ডিসেম্বরে বিয়ের বয়স পাঁচ বছর পড়বে।

-ভালো, তা ব‌উর নাম কি?

-শিপ্রা।

-কি! শিপ্রা!আমাদের শিপ্রা?
বিস্মিত কণ্ঠে আদিবের প্রশ্ন। উত্তরে সজীব মাথা ঝাঁকালো।সজীবের উত্তরে অবাকতা ছেয়ে গেল আদিবের চোখে মুখে।আদিব যতদূর জানতো শিপ্রা আর সজীব একে অপর কে দুই চোখে সহ্য করতে পারতো না।এমন কোন দিন যেত না, যেদিন দুজনের মধ্যে চুল ছেড়াছিড়ি ঝগড়া হতনা!তারা দুজন নাকি পাঁচ বছর ধরে একসাথে আছে।আবার একটা কন্যা সন্তানের মা-বাপ‌ও হয়েছে!এমন কথা শুনে অবাক হ‌ওয়াই তো স্বাভাবিক।আদিবের রিয়াকশন এমন হবে সেটা জানা ছিল সজীবের। সে আদিবের অবকতা নজর আন্দাজ করে বলল,

-অত অবাক হয়েও না মামা।তুমি তো আমাকে একা ফেলে লন্ডন উড়াল দিলে।আমি কলেজে এতিমের মতো ঘুরতে লাগলাম। শিপ্রা চুন্নির আমাকে দেখে মায়া হলো।চোখ মুখ কুঁচকে আমার পাশে এসে বসলো,ফেরার পথে পায়ে পা মিলালো।ব্যাস শুরু হলো একসাথে ওঠা-বসা, হাঁটা -চলা,পড়া-শোনা। দিন অতিবাহিত হলো।আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম মেয়েটা অতোটাও খারাপ না।বছর গড়াতেই দুইজনের বন্ধুত্ব গভীর হলো।সেই বন্ধুত্ব কখন কখন ভালোবাসার রূপ নিলো জানা নেই আমার।যাই হোক ভালো তো বাসলাম, কিন্তু বলার সাহস হলো না।যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া শয়তান ছেমড়ি তখনো আমাকে দেখে নাক কুচকাতো সুতরাং যেচে পড়ে অপমানিত হ‌ওয়ার ঝুঁকি নিলাম না।এভাবে সময় গড়ালো।দেখতে দেখতে এমবিবিএস শেষ হলো দুইজনের। বিসিএস দিলাম। কপাল ভালো ছিল আমার, তাই প্রথমবারেই টপকে গেলাম বিসিএসের গণ্ডি।এরপর এ ট্রেনিং, ও ট্রেনিং শেষ করে ঝিনাইদহের এক ভুঁড়ো গ্রামে সরকারি হাসপাতালে ডিউটি শুরু হলো আমার। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি করে বাড়ি ফিরলেই ঘুমে চোখ বুজে আসতো।এই নতুন ব্যস্ততায় শিপ্রার কথা মনে থাকলেও যোগাযোগ করা হয়ে উঠতো না।এমন করে মাস ছয়েক অতিক্রম হ‌ওয়ার পর হঠাৎ একদিন ম্যাডাম আমার হাসপাতালে হাজির।আমাকে দেখেই ভালো-মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করেই কালিবাজির মতো পটপট করে ফুটতে লাগলো।জানিস তো রেগে গেলে কেমন মুখ দিয়ে খ‌ই ফুটায়!নিজের সব রাগ অভিমান শেষ হ‌ওয়ার পর ফ্যা-ফ্যা করে কাঁদতে লাগলো।কেন কাঁদছে আমি জানি না সান্ত্বনা দেব কি বলে,ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার ভাবনার মধ্যে আর তার কান্নার মধ্যেই বিশ্রী শব্দ করে নাক টেনে বলল,”মা বিয়ে ঠিক করেছে,আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।”
বিশ্বাস কর এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবো কিচ্ছু বুঝে পেলাম না। সৌজন্য রক্ষার্থে বললাম,”ও”।এই “ও” বলায় আমার কাল হলো।কালনাগিনীর মতো ফুঁসে উঠে ছোবল মারতে উদ্যত হলো।আমি তো ভয়ে একদম চুপসে গেলাম।বুঝতে পারলাম আমার “ও” বলতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি।নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথে মুখে কুলুপ আঁটলাম।এরপর কতসময় নিয়ে তিনি ফোঁস ফোঁস করলো আমার জানা নেই।শান্ত হ‌ওয়ার পর বলল,”কাজী অফিসে চল তোকে বিয়ে করবো।” কথাটা শুনে মন জুড়িয়ে গেলরে।এরপর একটা শব্দও ব্যয় না করে সোজা কাজী অফিসে হাজির হলাম।বিয়ে সম্পন্ন হতেই শিপ্রা ওর বাপকে ফোন লাগালো।ওর বাপ ফোন ধরে বলল,”বিয়ে করেছিস ভালো কথা, এবার মন দিয়ে সংসার কর।খবরদার ভুলেও বরের সাথে মারামারি করে এ বাড়ি আসিস না ।তাহলে কিন্তু প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যাবে।তোর মাকে তো চিনিস!”বাপের কথা শুনে উনি ফোন রাখলেন।আমরা গিয়ে উঠলাম আমার ছোট্ট ভাড়া বাসায়।এরপর আর কি সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলাম।একবছর পরে এই ছানাটা হলো।এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তবে শাশুড়ি এখনো কেমন আড় চোখে তাকায়। আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের এই একটা সমস্যা।

-শাশুড়িকে দামি দামি মিষ্টি খাওয়ান, দেখবেন শাশুড়ি আর আড় চোখে তাকাবে না।

সজীবের কথা শেষ হতেই গাড়ি চালক তাদের কথার মাঝে ফোড়ন কাটল। সজীব তার উত্তরে বলল,

-আরে মামা সে কথা বলতে,গত পাঁচ বছরে ঢাকা শহরের সব নামিদামি দোকানের মিষ্টি তার পেটে ফেলেছি কিন্তু তার সেই আড় চোখ সোজা হয়নি।

-কি বলেন মামা!তাই নাকি?তাহলে তো আপনার শাশুড়ি খুব কঠিন মনের!

-কঠিন মানে, সেই কঠিন! একদম ইস্পাতের মতো!

কথাটা বলে হাসলো সজীব।তার হাঁসিতে উপস্থিত সবার ঠোঁটের কোণেও দেখা দিল মৃদু হাঁসির রেখা।সজীব হাসতে হাসতে গাড়ি চালকের উদ্দেশ্যে ফের বলল,

-মামা কি নোয়াখালীর না কি?

-জ্বি মামা।

-আমি কথা শুনেই বুঝছি…।মামার রাগ কমেছে?

-রাগ কমেছে তবে আপনি তখন কাজটা একদম ঠিক করেননি।উপর নিচে কিছু যদি একটা হয়ে যেত!

-স্যরি মামা।আসলে ভর সন্ধ্যা বেলা এমন জায়গায় গাড়িটা খারাপ হলো!মেয়ে রয়েছে সাথে এদিকে আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই তারপর লিফট চাইলে কোন গাড়িও দাঁড়াচ্ছে না। বাধ্য হয়ে একটু ডেয়ারিং দেখাতে হলো।

-বুঝেছি।তবে এমন আর করবেন না।আর কেউ আমার মতো ব্রেক না‌ও কষতে পারে।

-জ্বি মামা মনে রাখবো।

কথাটা বলে প্রশস্ত হাসলো সজীব।সে আসলে নিরুপায় হয়ে তখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল।গাড়ি নষ্ট হ‌ওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা দেড়িয়ে ছিল তারা সেখানে। ড্রাইভার তার সাধ্য মতো চেষ্টা করছে গাড়ি ঠিক করতে কিন্তু পারেনি।এদিকে সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসছে।আসে পাশে কোন বাড়ি ঘর‌ও নেই যে সাহায্য নেবে। মেয়েটা এদিকে কাঁদছে। অক্টোবর মাস চলছে। শীত না পড়লেও বাইরে ভালোই ঠান্ডা। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে মেয়েটার শরীর খারাপ করবে।এমনিতে মেয়েটার অল্পতে শরীর খারাপ হ‌ওয়ার ধ্যাত।এই হাইওয়েতে লিফটের উদ্দেশ্যে হাত দেখালেও কোনো গাড়ি থামছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে সামনে ধেয়ে আসা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে।কপাল ভালো ছিল গাড়ির ড্রাইভার তার থেকে কিছুদূরে গাড়ির ব্রেক করলো। হ্যাঁ দুই চারটে আঞ্চলিক ভাষায় গালিগালাজ করলো তাকে কিন্তু সেসব শোনার সময় কোথায়! সে ছুটলো সাহায্যের জন্য।গাড়ির কাছে গিয়ে ড্রাইভার কে কিছু বলতেই যাবে তখন চোখ গেল পিছনের ছিটে।খুব পরিচিত একটা মুখের পরিবর্তিত রূপ চোখে পড়লো তার। তৎক্ষণাৎ নিজের চোখকে বিশ্বাস না করতে পারলেও পরে বুঝলো সে ঠিক দেখছে।এটা তার পুরোনো বন্ধু আদিব।সাথে সাথে ডাক লাগালো আদিব কে।গাড়ি চালক এই সময়টুকুতে কত কথা যে বলল তাকে কিন্তু সেসব কানে তুলল না সজীব।

-আমার তখনকার কথা গুলো মনে নিয়েন না ভাই আসলে রাগের মাথায় তখন কি না কি বলেছি।

অনেকটা ইতস্তত করে বলল গাড়ি চালক।নিজের রাগের মাথায় করা ব্যবহারের জন্য লজ্জিত সে।সজীব বুঝলো তার মনোভাব।সে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।বলল,

-আপনি তো তাও গালির উপর দিয়ে গেছেন। আপনার জায়গায় আমি হলে মাইর লাগাতাম।আমি বুঝেছি আপনার সিচুয়েশন,কিছু মনে করিনি।

গাড়ি চালক ইনার রিয়ার ভিউ মিরারে সজীবের হাস্যোজ্জ্বল মুখটার দিকে অবাক চোখে তাকালো।সজীবের বেশ-ভূষা, কথা-বার্তায় স্পষ্ট সে একবারে সাধারণ কেউ নয়।বেশ বড়সড় মাপের কেউ। সাধারণত এমন ধরনের মানুষকে একটু কড়া গলায় সর বললেও তারা তেড়ে মারতে আসে।অথচ এই লোক তার সাথে আন্তরিক গলায় কথা বলছে, আবার নিজের দোষ‌ও মানছে!গাড়ি চালক নিশ্চিত এই লোকের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে নিজের দোষ মানা তো দূরের কথা, উলটো তার তখনকার ব্যবহারের জন্য তাকে দুই চার ঘা লাগিয়ে দিত। কিন্তু এই মানুষ টা তার দিক বোঝার দাবি করছে।নিজের ভুল গুনছে!

আদিব আর সজীব কথা বলছিল তার মাঝেই সজীবের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।সে ফোন হাতে নিয়ে তার ড্রাইভার মতিন কে দেখিয়ে বলল,

-দেখো মতিন এখন দরকার নেই অথচ নেটওয়ার্ক এখন টঙে।চারকাঠি একদম জ্বলজ্বল করছে।আবার সিম কোম্পানির ফোন‌ও আসছে। কিন্তু যখন দরকার ছিল তখন পাওয়া যাচ্ছিল না।এদের সিম ফেলে দেব আমি। মতিন তুমিও ফেলে দেবে।বিপদে পড়লে যাদের নেটওয়ার্ক আগে পালায়, তাদের সিম রাখবো না।

-জ্বি স্যার।

সজীবের কথায় সম্মতি জানালো মতিন। সজীবের সাথে তাল মিলিয়ে সিম অপরেটারদের উদ্দেশ্যে সেও কিছু কটু বাক্য ব্যবহার করলো।মতিন আর সজীব মন মতো সিম অপরেটারদের কথা শুনিয়ে খ্যান্ত হলে আদিব বলল,

-ভালোই হয়েছে তখন কোন সাহায্য পাস নি। না হলে আমার সাথে কি তোর দেখা হত!আমার দাদি প্রায় একটা কথা বলতো ,”আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন!”

আদিবের সাথে সাথে সমস্বরে কথাটা বলে উঠলো সজীব।আদিব চকিত কণ্ঠে বলল,

-মনে আছে তোর?

-হ্যাঁ ,আছে।

ম্লান হাসলো সজীব।জাহানারা বেগম কে অনেক কাছ থেকে দেখার, জানার সৌভাগ্য হয়েছিল সজীবের।সেই সুবাদে অনেক সময় কাটিয়েছে সে তার সাথে।আজ হঠাৎ আদিবের মুখ থেকে মানুষ টার বলা কথা শুনে অনেকগুলো পুরোনো স্মৃতি হুড়মুড় করে মানসপটে ভেসে উঠলো।সাথে সাথে মনটা কেমন মিইয়ে গেল।তবে সেটা আদিবকে বুঝতে না দিয়ে প্রসঙ্গ বদলালো সে।বলল,

-তুই হঠাৎ দেশে ফিরলি যে! লন্ডন থেকে লাথি মেরে বের করে দিয়েছে না কি?

-অনেকদিন পর লম্বা একটা ছুটি পেলাম, তাই ভাবলাম তুই বেঁচে আছিস কি না দেখে আসি।

-হা…!ওসব বয়ান বাদ দাও চাদু!আমি মরে গেলেও যে তুমি আসতে না, সে আমার ভালো করে জানা আছে। লন্ডন যা‌ওয়ার আগে আমাকে বলে পর্যন্ত যাওনি।কি মনে করেছ সব ভুলে গেছি!না। কিচ্ছু ভুলিনি। নেহাত গাড়িটা নষ্ট হলো তাই দায় ঠেকে পিরিত দেখালাম ,না হলে কথা‌ও বলতাম না তোমার সাথে! হুঁ!

-ওরে শালা ! তোর মনে মনে তাহলে এই ছিল!আর আমি ভাবলাম তুই পুরোনো কথা ভুলে গেছিস!

– শালা না, সম্পর্কে মামা হ‌ই।তোর কপাল ভালো থাকলে মামা শ্বশুর হতা

নিজের কথা শেষ না করেই থেমে গেল সজীব।আদিবের মুখের পাল্টে যাওয়া রং দেখে বুঝতে পারলো মুখ ফসকে যে কথাটা বলতে যাচ্ছিল সেটা বলা উচিত হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে অযথা গলা ঝাড়া দিল।কথা ঘুরিয়ে বলল,

-কত দিনের জন্য এসেছিস দেশে?

-তিন মাস।

-তারপর আবার ফেরত যাবি?

-হুম।

-এবার কী মিয়া ভাই আর ভাবিকে নিয়ে যাবি সাথে?

-আমি থাকতে থাকতে যদি তাদের ভিসার কাজটা হয়ে যায় তাহলে নিয়ে যাবো। আমার কথা বাদ দে তোদের খবর বল।তোর বাড়ির সবাই কেমন আছে?
একটু থামলো আদিব তারপর একটু ইতস্তত করে বলল,
-সেজো চাচারা কেমন আছে?
এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আদিবের কেমন জানি লজ্জা করছিল।নিজের আপন চাচার খবর তাকে অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে ব্যাপারটা একটু লজ্জা জনক।তবে লজ্জার হলেও কথাটা সত্যি যে সে নিজের ফুপু চাচাদের কোন খবর জানে না।বিগত এগারো বছরে তাদের সাথে তার সেভাবে যোগাযোগ হয় না।
বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম প্রথম ছোট্ট চাচু আর ফুপুর সাথে যোগাযোগ রেখেছিল আদিব কিন্তু তানিয়া জানার পর অশান্তি শুরু করলো। বিভিন্ন কথা বার্তা বলতে লাগলো। যার জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হলো আদিবের। এরপর নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে এতোটাই ব্যস্ত হলো যে সম্পর্ক গুলো সব পিছনে ছুটে গেল।একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদিব।

-বড় বু’র শরীর ভালো না। তাছাড়া সবাই ভালোই আছে।

-কি হয়েছে সেজ চাচির?
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো আদিব। সজীব একটা দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ফেলে বলল,

-বছর সাতেক হলো শ্বাস কষ্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছুদিন হলো সেটা বেড়েছে।

সজীবের কথার মাঝেই গাড়িতে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। স্থানীয় বড় বাজারে থামিয়েছে সে গাড়ি। মতিন গাড়ি থেকে নেমে গেল।সজীব তাকে কিছু টাকা দিয়ে কি কি করতে হবে সেই দিকনির্দেশনা দিয়ে গাড়ি ছাড়তে বলল।গাড়ি আবার চলমান হলো।বাকি পথটুকু আর তেমন কোথা জমলো না দুইজনের।তুলির ঘুম ভাঙল। সজীব তাকে নিয়ে ব্যস্ত হলো আদিব‌ও নিজের ফোনে মনোযোগ দিল।
গাড়ি যখন আদিবের বাড়ির সামনে এসে থামলো রাত তখন প্রায় নয়টা।আদিব আর সজীব গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলো তাদের বাড়ির সামনে থেকে শুরু করে তার মেজ চাচা সাজ্জাদের বাড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষের ছড়াছড়ি।যার মধ্যে কেউ পরিচিত তো কেউ অপরিচিত।বাড়ির সামনে এমন অবস্থা দেখে আদিবের কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়লেও সজীবের ভেতরটা কেমন যেন কু ডেকে উঠলো। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল সামনে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে