মায়ের কথা পর্ব-০৩

0
5

#মায়ের_কথা
পর্বঃ৩
#সাবাব_খান

আমি গোপন প্ল্যান করলাম। আমার আত্মীয়-স্বজনদের সমানে থাকতে হলে জীবনে বড় কিছু করতে হবে। নয়তো সারাজীবন ওদের হাতে শো’ষিত হতে হবে। বড় মাপের সরকারি চাকরি করলে ওদের সমানে থাকতে পারবো। কিন্তু সরকারি চাকরি পাওয়া এত সোজা নয়। দীর্ঘমেয়াদি পড়ালেখা করা লাগে। এই ধরুন বিসিএস পরীক্ষা দিতে গেলে প্রিলি,রিটেন,ভাইবা সব মিলিয়ে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এত বছর সময় তো আর আমার নেই। এত ধৈর্যও নেই। মনটাও স্থির নয়। ছোটবেলা থেকেই সংসারের চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলে তখন আর দীর্ঘমেয়াদি পড়ালেখা হয় না। আম্মার স্বপ্ন ছিল আমি বিসিএস অফিসার হই। কিন্তু মাকে বোঝালাম অতোটা সময় আমি পাবো না। তাছাড়া বোন দুটোও বড় হচ্ছে। সারা অনার্সে,স্নিগ্ধা ইন্টারমিডিয়েটেড পড়ে। ওদেরও তো ভবিষ্যৎ আছে। আমি ভালো কিছু না করলে ওদেরকেও যোগ্য করে তুলতে পারবো না।

আম্মাকে আমার গোপন প্ল্যানের কথা বললাম। আমাদের ভা’গের পুকুরটাকে বিক্রি করে দিতে চাই। কারণ এই পুকুরে ব্যবসা করা হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। যখনই মাছ চাষ করতে যাবো তখনই হয় বি’ষ মিশিয়ে দেবে। না হয় মাছ চু’রি করবে। অথবা অন্য কোনো ঝামেলাও করতে পারে। তাই মা’কে বললাম মা পুকুরটা বিক্রি করে দিয়ে আমি ভবিষ্যত দাঁড় করাতে চাই। আম্মা বলল, ‘ তোর চাচারা শুনলে কখনোই বিক্রি করতে দেবে না।’

আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘পুকুরটা তো আমাদের। চাচারা বিক্রি করতে দেবে না কেন?’

আম্মা বলল, ‘তারপর ওরা বাধা দেবে!’

আমি চিন্তা করলাম চাচাদেরকে না জানিয়েই পুকুরটাকে বিক্রি করব। যদি চাচারা কিছু টের পেয়ে যায় সেক্ষেত্রে বলবো পুকুরটা লিজ দিচ্ছি। মিথ্যেই বলব।

এদিকে আমি পড়াশোনা শুরু করলাম। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পড়াশোনা। আইএলটস্ কোচিং অনলাইনে। পুকুর ক্রয়ের কাস্টমারও খুঁজছিলাম। আইএলটস কেন বেছে নিয়েছি জানেন? সময় কম লাগে পাশ করতে। স্বল্পমেয়াদি প্রসেস। সরকারি চাকরি পাওয়া তো দীর্ঘমেয়াদি প্রসেস। আবার সরকারি চাকরিতে ইদানিং ঘু’ষেরও প্রয়োজন হয়। ঘু’ষ দিয়ে চাকরি নিয়ে সেই টাকা উঠানোর জন্য চাকরিতে ঢুকে ঘু’ষও খেতে হয়। পুরো জীবনটাই বরবাদ। মেধায় কয়জনের চাকরি হয় বলুন! বছরের পর বছর পড়াশোনা করে যদি চাকরি না পাই সেই চিন্তাও মাথায় ছিল। তাই আইএলটস পড়া শুরু করেছি। বন্ধুরা বলেছিল তুই ইংরেজিতে অনার্স করেছিস। তোর বিদেশ যেতে আইএলটস লাগবে না। আমি চিন্তা করলাম আইএলটস করেই বিদেশ যাবো। তাহলে বিদেশ গিয়ে আমি মাস্টার্স করবো। বিদেশ মাস্টার্সের সাটিফিকেট থাকলে পরবর্তীতে ভালো একটা চাকরি পাবো। আইএলটস না করে গেলে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে না। এসব চিন্তা করেই সব শুরু করলাম।

কয়েক মাসের মধ্যে পুকুরে ক্রয় করার লোকও পেয়ে যাই। এদিকে আমার আইএলটস পরীক্ষার রেজাল্ট হয়। মেধা তো আর খা’রাপ না। ভালো পয়েন্ট পেয়েছি। বিশাল পুকুর আমাদের। মোটা অংকে পুকুরটাকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এরমধ্যে চাচারা কিভাবে যেন কিছুটা টের পেয়ে যায়। আমিও জানিয়ে দেই পুকুরটাকে লিজ দিচ্ছি। চাচারা লিজের কথা শুনেও বিরোধিতা করে, ‘ আমাদের বাপ,দাদার জমির মধ্যে পুকুরটাকে লিজ দিবি কেন? জমির মধ্যে অন্য মানুষ আসা যাওয়া করবে! বাড়ির মধ্যে অন্য মানুষ আসা ভালো না!’

আমি জানিয়ে দিলাম এছাড়া উপায় নেই। চাচারাও আগের মতোই বিরোধিতা করে। উনাদেরকে না জানিয়েই পুকুরটাকে বিক্রি করে ফেলি। এরপরে শুরু হয় বিদেশ যাওয়ার প্রসেস। বেশিদিন লাগেনি। অন্যের টাকারও প্রয়োজন হয়নি। পুকুর বিক্রির টাকাতেই হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজন কারো কাছেই বলিনি আমি এমেরিকায় আসবো। ভিসা হয়েছে, প্লেনের টিকেট হয়েছে। তখনও বলি নি। কারণ যেকোনো ক্ষতি করতে পারতো আত্মীয়-স্বজন। ওদেরকে এখন আর বিশ্বাস করি না। দুর্বলকে সবাই আরো চেপে চেপে মারতে চায়। ফ্লাইটে ওঠার আগের দিন ঢাকায় বসে সবাইকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলাম।

যথাসময়ে আমি চলে আসি এমেরিকায়।
দুই সপ্তাহ হলো এসেছি। নিউইয়র্কে আছি। এখনো ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়নি। আমার এক বন্ধুর বড় ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি কয়েকদিনের জন্য। দেশ থেকেই বন্ধুর সাথে কথা বলে সব ঠিক করে এসেছিলাম। ওদের সাথে আমার আরেকটা সম্পর্কও আছে। বন্ধু কিন্তু ছেলে নয়, মেয়ে বন্ধু। ওর নাম রিম্পা। রিম্পাই ওর ভাইকে বুঝিয়েছে আমাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য। এখানে প্রবাসী জীবনটা খুব সহজ নয়। সেটেলড হতে হলে প্রথমে খুব কষ্ট করতে হয়। এখনো চাকরি খুঁজতে হচ্ছে আমায়। চাকরি না পেলে কি করব, না করব! রিম্পার বড় ভাইও কাজ খুঁজছেন আমার জন্য।

আজ হঠাৎ করে ফেসবুকে টেক্সট আসে, রাফার টেক্সট। জানেন তো, রাফা আমার বড় মামার মেয়ে। আমায় টেক্সট পাঠিয়েছে, ‘কেমন আছো সাবাব ভাইয়া?

আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘ভালো! তুই কেমন আছোস?’

‘মনটা ভালো না সাবাব ভাইয়া?’

‘কি হইছে তোর মনের?’

‘আমার কথা বাদ দাও। তুমি এত তাড়াতাড়ি এমেরিকা গেলা কেমনে?’

‘আইএলটস করে এসেছি।’

‘আমারও না এমেরিকা যাবার খুব স্বপ্ন!’

‘তাহলে তুইও আইএলটস করে চলে আয়!’

‘পড়ালেখা আমার মাথায় ঢুকে না!’

‘তাহলে অনার্স করছিস কিভাবে?’
‘এইতো কোন ভাবে পাশ করছি। ভালো কোনো রেজাল্ট তো আর করছি না। আচ্ছা সাবাব ভাইয়া, অন্য কোন উপায়ে এমেরিকা যেতে পারবো না?’

‘পারবি! এমেরিকা প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করে চলে আসবি!’
‘এমন ছেলে কই পাবো!’

‘খোঁজ, খুঁজলে পেয়ে যাবি! আশেপাশে কতো এমেরিকা প্রবাসী ছেলে আছে!’

‘সত্যি কইতাছো তো?’

‘হুম!’

‘পরে কিন্তু অস্বীকার করতে পারবা না।’

‘এইখানে অস্বীকার করার কি আছে? আচ্ছা, তোর সাথে পরে একদিন চ্যাটিং করব। আমার একটু বের হতে হবে। সময়-অসময়ে নক দিস না তো। অনেক ব্যস্ত আমি!’

এরপরে আর কথা হয়নি রাফার সাথে। ইদানিং নাকি মামা-চাচা সবাই আম্মার খুব যত্ন করে। আসলে কি জানেন? তাদের ছেলেমেয়েকে যদি এমেরিকায় পাঠাতে পারে! আমি নিজেই তো আসলাম মাত্র কিছুদিন। নিজের সেট হতে হয়তো কয়েক বছর লাগবে। রিম্পার বড় ভাই আমাকে একটা কাজ খুঁজে দিয়েছে। আসলে বলা হয়নি আপনাদেরকে। রিম্পার সাথে আমার ভাব ছয় মাস ধরে। আমি কথা দিয়েছি ওকে বিয়ে করবো। এজন্যই ওর ভাইও আমাকে হেল্প করেছে। বিনা প্রয়োজনে কেউ কাউকে সাহায্য করে না।

রিম্পার সাথে প্রতিদিনই কথা হয়, ভার্সিটি আর কাজের ফাঁকে। আমি এখন অন্য জায়গায় শিফট হয়েছি। রিম্পার ভাইয়ের বাসায় আর থাকি না। ওনার নাম রিমন। সেই রিমন ভাইয়াই আমাকে অন্য জায়গায় উঠিয়ে দিয়েছে। আজ সকালে আম্মা ফোন করলেন। আমি রিসিভ করতেই আম্মা বললেন, ‘তোর সাথে দরকারি কথা আছে সাবাব!’
‘কি কথা আম্মা?’
‘তুই নাকি রাফারে পছন্দ করোস?’
‘এসব তুমি কি কইতাছো আম্মা?’

‘রাফা কইলো অরে ইনডাইরেক্টলি বিয়ার প্রস্তাব দিছোস!’

‘তুমি পা’গল হয়া গেলা আম্মা?’

‘শোন, চালাকি করিস না। তোর বড় মামা আজকে আসছে বিয়ার প্রস্তাব নিয়া! রাফায় আমারে মেসেজ দেখাইছে। তুই কইছোস আশেপাশে অনেক এমেরিকা প্রবাসী ছেলে আছে। খুঁজলেই নাকি পাওয়া যাইবো! এই কথার অর্থ কি?’

‘আর একটা কথাও বলবা না মা তুমি! আমি কি আমার কথা বলছি নাকি?’

‘দেখ, তুই বা’টপারি করলে আমার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক থাকবো না!’

‘তুমি কোনোদিন ঠিক হইবা না মা। বাপের বাড়ির মানুষের পেছনেই দৌড়াইবা।’

‘আর একটা কথাও কবি না সাবাব। তোর কথায় রাফা অর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ দিছে।’
‘ইয়ার্কি শুরু করছে অরা? ঐ বা’টপারের গুষ্ঠি তোমারে মিত্যা কইছে সব!’

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে