তুমি_আমার_মা
ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট
আমি কিছু বলার আগে মা আমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। আমি মা’কে উদ্দেশ্য করে বললাম, ” আচ্ছা মা তোমার নামে যে এসব বলছে একটা কথারও কি প্রতিবাদ করতে পারো না তুমি? চুপ করে থেকে এসব সত্যি কেন প্রমাণ করছো? ”
দাদি হুংকার দিয়ে বললেন, ” সত্যি সত্যি বলছে তাই চুপ করে আছে। যদি সত্যিই এসব না বলবে তাহলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে কেন? ”
আব্বু দাদিকে বললো, ” আচ্ছা মা, তুমি একটু চুপ করো। কি হয়েছে আমি দেখছি। ”
হঠাৎ করে রহিমা কাকি বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে লাগলেন। অন্যের ঘরে আগুন লাগতে গিয়ে নিজে এমন ফেঁসে যাবে বুঝতে পারেনি হয়তো। আমি উনাকে ডাকতে গেলে আব্বু ইশারায় ডাকতে নিষেধ করলেন। আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে চলে গেলাম। আমি রহিমা কাকিকে কোনো প্রকার গালাগালি করিনি। একটা বাজে কথাও বলিনি। শুধু বলেছিলাম যে, ” মায়ের ব্যাপারে দাদিকে কি বলেছেন?’ এই সামান্য একটা কথা নিয়ে কতকিছু করলেন উনি। আব্বু আমাকে মারেনি এইটা আমার কপাল ভালো। সেদিন রাতে বাড়ির পরিবেশ একদম শান্ত। মনে হচ্ছে ভুতের বাড়ি এটা। একটা পিন পড়লেও হয়তো বোমা পড়ার মতো আওয়াজ হবে! অথবা বাতাস হলেই নিরবতার চাদর ছিঁড়ে যাবে৷ এসব শুধুই আমার কল্পনা। নির্ঘুম চোখে সারা রাত শুয়ে রইলাম। বাড়ির দক্ষিণ কোণের মসজিদ থেকে ফজরের আজানের শব্দে মনে হলো সকাল হয়ে গিয়েছে। রাতের সকল অন্ধকার কেটে গিয়ে আশার আলো ফুটে উঠেছে সারা পৃথিবীতে। বিছানা থেকে উঠে নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর রাস্তায় হাঁটতে বের হলাম। সকালে আবহাওয়া বড্ড মধুর লাগে আমার কাছে।
সকালবেলা থেকে বাড়ির পরিবেশ একদম স্বাভাবিক। মা চুলার পাশে বসে বসে সবজি কাটছে আর ফুফু মায়ের কাজে সাহায্য করছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কাল রাতে এতো কান্ড ঘটছে এখন কেউ বুঝতেই পারবে না।
বাড়ির শান্ত পরিবেশটা হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠলো রহিমা কাকি বাড়িতে আসার কারণে। তিনি সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় চিৎকার করে বলতে লাগলো ” ভাইজান দেখেন, ফাতেমা আপাকে নিয়ে এসেছি। উনার কাছ থেকেই শোনেন কি হয়েছে!”
কাকির চিৎকার শুনে আব্বু ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। সাথে আমরা সকলেও গেলাম। আব্বু অন্যদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ” কি হয়েছে? আপনি কি বলবেন?”
রহিমা কাকি ফাতেমা কাকিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” এ বল কাল ফয়সালের মা কি বলেছিল!”
ফাতেমা কাকি একবার সকলের দিকে তাকালেন। তারপর সকলকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ” কাল ফয়সালের মা শাড়ির কথা কিছুই বলেনি। রহিমা আপাই শুরু করেছিলো যে তোমার ননদকে দেখলাম নতুন শাড়ি পরা। তা তোমার শাড়ি কোথায়? নাকি তোমাকে শাড়ি কিনে দেয়নি? তখন ফয়সালের মা বলেছিলো যে, ভাই বোনকে কি কিনে দিলো না দিলো তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমার কি কোনো লাভ আছে! আমাকে সুখে রাখে এটাই অনেক। ”
রহিমা কাকি ফাতেমা কাকিকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। হয়তো ভাবতেও পারেনি কাকি তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। রহিমা কাকি কর্কশ গলায় বললো, ” কি রে ভাবি আমি আপনাকে নিয়ে এলাম সব খুলে বলতে আর আপনি আমার বিপক্ষে কথা বলছেন?”
ফাতেমা কাকি মুচকি হেসে বললেন, ” তোমার মন রাখতে গিয়ে আজ মিথ্যা বললে কাল কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবো? আমি যা শুনেছি তাই বলেছি। আজ কারো মন রাখতে গিয়ে মিথ্যা বলে নিজেকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চাই না আমি।
ফাতেমা কাকির কথা শুনে দাদির মুখটা শুকিয়ে গেছে। রহিমা কাকি রীতিমতো ঘামছে। এলাকার সকলেই আব্বুকে রাগী বলে জানে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আব্বু রহিমা কাকিকে বললেন, ” আপনি যা করেছেন ভালোই করেছেন। আর প্রয়োজন নেই। আপনি এখন আসতে পারেন।
আব্বুর মুখে এমন কথা শুনে রহিমা কাকি তড়িঘড়ি করে আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। উনি চলে গেলে আব্বু মা’কে বললো, ” এতোটা সহজসরল হওয়াটাও ভালো না। ”
মা কিছু না বলে নিজের কাজ করতে গেলেন। সকলে চলে যাওয়ার পর আব্বু দাদির কাছে গিয়ে বসলেন। তারপর দাদির কি অবস্থা সব জানতে চাইলেন। মা ছেলে খুব ভালো ভাবে কথা বলছে। আমিও সেখান থেকে চলে গেলাম। আর ভাবতে লাগলাম আমি আমার মা’কে ঠিক শাড়ি কিনে দিবো। কিন্তু এখন যদি টিউশন পড়াতে যাই তাহলে টাকা পেতে মাস পেরিয়ে যাবে। অল্প কয়েকদিনের ভিতর টাকা রোজকার হবে এমন কোনো কাজ করতে হবে। কলেজে গিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। আল্লাহকে বারবার বলতে লাগলাম যেন একটা রাস্তা বের করে দেয়। কিন্তু কি করবো কিছুতেই মাথায় আসছে না। কলেজে গিয়ে আমার কয়েকটা বন্ধুকে বললাম যে, ” দোস্ত শোন। আমার অনেক ইচ্ছে করছে মা’কে একটা শাড়ি কিনে দিবো নিজের টাকায় কিন্তু কি করে দিবো বল তো। হাতে কোনো টাকাই নেই।
আমার কথা শোনার পর আমার একটা বন্ধু বললো, দোস্ত আমরা সবাই মিলে যদি কোনো কাজ করি তাহলে কেমন হয়? কাজের পরে সকলে টাকা ভাগ করে নিলাম। এ ছাড়া কোনো কাজই ছোট নয়। মজার ছলেই না হয় কোনো কাজ করলাম।
ও-র কথা শুনে অন্য বন্ধু বলে উঠলো, ” হ্যা চল আমরা সবাই মিলে কোনো কাজ করবো তারপর সকলে মায়ের জন্য উপহার কিনে নিয়ে যাবো। জানিস তো গতমাসে মা’কে একটা চকলেট কিনে দিয়েছিলাম। গতকাল মায়ের ডাইরির ভিতরে সেই খোসাটা পেয়েছি। আসলে সন্তানরা মা’কে কোনো উপহার দিলে মায়েদের কাছে তা হিরার থেকে বেশি মূল্যবান হয়।
বাকিরাও ওদের কথায় সম্মতি দিলো। আমরা একসাথে ছয়জন বন্ধু থাকি। একটা গ্রুপের মতো আর কি! কেউ কাউকে ছাড়া কোনো কাজের সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। সকলে রাজি হলেও কি কাজ করবো তা ঠিক করতে পারলাম না। আসলে আমরা কোনো কাজ করতে অভ্যস্ত নই। সকলেই বাবা মা’র আদরের সন্তান। সকলেই যখন চিন্তার সাগরে ডুবে আছি। তখন আশার আলো খুঁজে পেলাম আামদের এক স্যারের কথায়! স্যার ক্লাসের পরে আমাদের ডেকে নিয়ে বললেন, ” বাবারা তোরা ক্লাসের ভিতর খুব ভালো ছেলে। তোদের একটা কাজের দায়িত্ব দিতে চাই। কলেজের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় একটু ফুল বাগানের মতো করতে চাইছিলাম। তোমরা যদি দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করে দিতে তাহলে খুব ভালো হতো। ”
স্যারের কথা শুনে আমার এক বন্ধু বললো, ” স্যার আমরাই বাগান করে দিবো আপনার শুধু আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেই হবে। ”
স্যার মুচকি হেসে বললো, ” তাহলে তো খুব ভালো হয়। তোমরাই কাজটা করো। ”
স্যারের সাথে কথা বলার পর কুরআন শরীফের একটা একটা আয়াত মনে চলে আসলো। আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেছেন, –” বলো, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা ৩৯ জুমার, আয়াত: ৫৩)।
এবং আরো বলেন, আল্লাহর সাহায্যে অতিনিকটে।
নিমেষেই মনটা খুশিতে ভরে গেলো। চারপাঁচ দিনের মধ্যে কলেজের সামনের ফাঁকা জমিটা পরিষ্কার করে তাতে গাছ লাগিয়ে দিলাম। ফাঁকা হলেও জমিতে প্রচুর আগাছা ছিলো। কাজ শেষ হওয়ার পর স্যার আামদের পাঁচ হাজার টাকা দিলেন। আমরা স্যারকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ” স্যার এতো টাকা কেন দিলেন?”
স্যার মুচকি হেসে বললো, ” তোমরা ছোট বলে তোমাদের ঠকাবো কেন? জায়গাটা তো আমি দেখেছি, ওখানে বাগান করতে তোমাদের বেশ খাটতে হয়েছে। জানো তো বাবারা জেনে বুঝে কাউকে ঠকানো উচিত নয়। আজ তুমি একজন ঠকিয়ে যদি মনে করো তুমি জিতে গেছো তাহলে ভুল ভাবছো। কারো হক নষ্ট করা কোনো মানুষের কাজ নয়। ”
আমরা সকলেই স্যারের কাজে বেশ অবাক হলাম। এখনো পৃথিবীতে ভালো মানুষ আছে তা এসব লোকদের দেখলে বোঝা যায়। টাকগুলো নিয়ে সকলে মার্কেটে চলে গেলাম। ছয় মিলে অনেক দামাদামি করে পাঁচ হাজার টাকায় ছয়টা শাড়ি কিনলাম। তারপর ছয়জনে ভাগ করে নিলাম। এখন আমার হাতে খুব সুন্দর একটা শাড়ি। শাড়িটা নিয়ে মা’কে দিতে পারলে মা অনেক খুশি হবে। মায়ের হাসি মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। রাস্তায় কোথাও সময় নষ্ট না করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আজ কেন জানি রাস্তাটা শেষ হচ্ছে না। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি আর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে বাড়ি পৌঁছাতে, সীমাহীন উত্তেজনা কাজ করছে আমার মধ্যে। হঠাৎ করে প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠলাম। এতো সময় দুইহাতে শক্ত করে ধরে রাখা শাড়িটা আমার থেকে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লো। একটা বড় ট্রাকের চাকাগুলো আমার শরীরের উপর দিয়ে চলে গেলো। মনে হলো আমার সব হাড় গু’ড়ো হয়ে গেছে। অনুভব করলাম মৃ’ত্যু য’ন্ত্র’ণা! র’ক্তা’ক্ত শরীর থেকে আ’ত্মা এই বুঝি চলে যায়। শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখলাম মায়ের জন্য শখ করে কেনা শাড়িটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করলো শাড়িটা তুলে ধূলোগুলো ঝেড়ে ফেলতে কিন্তু তার আগেই আঁখিদ্বয় চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। কখনো কখনো সামান্য দূরত্ব হয়ে উঠে সীমাহীন। যা পার করার সাধ্য আমাদের কারো হয়ে ওঠে না। জানি না মায়ের জন্য কেনা সবুজ শাড়িটা মা পেয়েছিলো কিনা! শাড়িটা বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডেকেছিলো কিনা। যেখানে আমি মা’কে সবুজ শাড়িটা উপহার দিতে চাইলাম সেখানে অন্য লোকেরা আমার রক্তাক্ত ক্ষ’ত’বি’ক্ষ’ত শরীরটা মা’কে উপহার দিলো। জানি না মা কেঁদে ছিলো নাকি স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো। শুধু জানি তুমি আমার মা! আমাকে হারানোর কষ্ট সবাই ভুলে গেলেও তুমি কখনো ভুলতে পারবে না। তুমি যে মা। মা তোমার সন্তান তোমার কোল খালি করে চলে যাচ্ছে, তুমি দোয়া করো আল্লাহ যেন জান্নাতে আমাদের দেখা করিয়ে দেয়। তখন তোমার হাতে একটা সবুজ রঙের শাড়ি তুলে দিয়ে বলতে পারি, তুমি আমার মা। আমি থাকতে তোমার কোনো ইচ্ছে কি অপূর্ণ থাকতে পারে নাকি! আব্বু তোমাকে শাড়ি দেয়নি তো কি হয়েছে, তোমারও তো সন্তান আছে। সে তোমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করবে।
সমাপ্ত