তুমি আমার মা পর্ব-০১

0
2

সূচনা পর্ব
তুমি_আমার_মা
ফারহানা_কবীর_মানাল

গতমাসে আব্বু যখন মা’কে বাদ দিয়ে শুধু দাদি আর ফুফুকে শাড়ি কিনে দিয়েছিলো মা তখন শাড়ি দুইটার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। মায়েরও শাড়ি নিতে ইচ্ছে করেছিল কিনা ঠিক বলতে পারবো না। তবে শাড়ির রঙটা মায়ের মনকে বারবার আকর্ষণ করছিলো এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত । মা বরাবর অন্যদের থেকে আলাদা জিনিস পছন্দ করে। সে সুবাদে মায়ের সবুজ রং বড্ড পছন্দের। আর আব্বু দাদি আর ফুফুকে যে শাড়ি দুইটা কিনে দিয়েছিলো তার দুইটাই সবুজ রঙের। একটা নীড় পাড়ে সবুজ শাড়ি অন্যটা মাঝে হলুদ ছোপ ছোপ রং লাগানো। খুব দামী না হলেও শাড়ি দুইটা দেখতে বড্ড নজরকাড়া। দাদি আর ফুফু শাড়ি পেয়ে বা নিজের বোন আর মা’কে শাড়ি দিতে পেরে বাবা, দাদি আর ফুফুর হাসি মুখের মাঝে মা’য়ের মুখটা কেন যেন আমার মনে বড্ড বিঁধে গেলো। আব্বু চাইলেই মা’কেও শাড়ি কিনে দিতে পারতো কিন্তু তা না করে নিজের মা বোনকে কিনে দিয়েছে। মা অবশ্য এই ব্যাপারটা নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বা মায়ের মুখটাও বিন্দু মাত্র মলিন হলো না। তবে আমার চোখের সামনে মায়ের শাড়ির দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা বারবার ভেসে উঠছিলো। নিজের টাকায় মা’কে শাড়ি কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার এখনও হয়নি। সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিবো। বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়ার টাকাটাও প্রতিদিন মা বাবর কাছ থেকে হাত পেতে নিতে হয়। কখনো কখনো কিছু টাকা জমালেও এখন আমার হাত একদম ফাঁকা।

এমন সাতপাঁচ চিন্তার মাঝে মায়ের গলা শুনতে পেলাম। মা আমাকেই ডাকছে। আমার নাম ধরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ” কি রে কত রাত হয়ে গেলো খেয়াল আছে তোর। ফয়সাল খেতে আয় তাড়াতাড়ি। ”

আমাদের বাড়িতে সকলেই একসাথে বসে খাবার খায়। বিশেষ করে রাতের বেলা। কারণ এইসময়ে আব্বু বাড়িতে থাকে। খুব উচ্চবিত্ত পরিবার না হলেও আমাদের অভাব বলতে তেমন কিছু নেই। আর অভাব থাকলেও হয়তো সকলের চাহিদা সীমিত বলে অভাবটা তেমন চোখে পড়ে না। আমরা দুইভাই বোন। বোনটা বড়, তাই ও-কে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করেছি অনেক আগে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ভালো ভালো খাবারে নিজের ভাগটা ছাড়েনি। ভালোকিছু রান্না হলেই মা টিফিনবাক্স ভরে মেয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে কলেজের ফাঁকে আমিও ও-কে চানাচুর মুড়ি মাখা, বাদাম এসব কিনে দিয়ে আসি। আপুও আমার পছন্দের খাবার রান্না করলে আমার জন্য পাঠিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে হাতের ভিতর দশ পাঁচ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলে কলেজে যাওয়ার সময় কিছু কিনে খাস। আপুর বিয়ে হওয়ার পর থেকে বাড়িতে আমরা চারজন সদস্য। আমি আব্বু, মা, দাদি আর ফুফু। ফুফুর স্বামী মারা গেছে পাঁচ বছর হলো। ছেলেমেয়ে কেউ না থাকায় আমাদের বাড়িতেই থাকে। মা বাবা কখনো ফুফুর থাকা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। সংসারে ইনকাম করার লোক বলতে শুধু আব্বু। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। মাস গেলে পঁচিশ হাজার টাকা বেতন পায়। আজকালকার বাজারে এই টাকা দিয়েও আমাদের দিব্যি ভালোভাবে মাস পার হয়ে যায়।

রাতের খাওয়া শেষ করে সকলে ঘুমাতে যাবো। এমন সময় দেখলাম টেবিলের উপর আব্বুর মোবাইলটা পড়ে আছে। রাতে কারো প্রয়োজনীয় কল আসতে পারে ভেবে ফোনটা নিয়ে আব্বুর ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। আব্বু আম্মুর রুমটা বারান্দার পাশে একদম। রুমের সামনে যেতেই আব্বু গলা কাবে আসলো। হয়তো মা’কে কিছু বলছে। ঘরের দরজার সাথে আমার দূরত্ব কমতেই আবৃবু কথা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আব্বুকে মা’কে বলছে যে, ” তাহেরা তুমি তো জানো জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে বাড়ছে তাতে মাস শেষ সংসারে টানাটানি পড়ে যায়। তোমাকে শাড়ি কিনে দিতে পারিনি বলে তুমি মন খারাপ করো না। সামনের মাসে বেতন পেলে আমি তোমাকে শাড়ি কিনে দিবো। ”

মা’য়ের উত্তরটা শোনার জন্য আর দরজার কড়া নাড়লাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যদিও কারো কথা লুকিয়ে শোনা উচিত নয়৷ তবুও ওদের কথার মাঝে বাঁধা হতে ইচ্ছে করলো না।

ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম মা শান্ত গলায় বলছে, ” আমার অনেক শাড়ি আছে। তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। অনেক শাড়িই তো কিনে দেও তুমি আমাকে। মা’য়ের বয়স হয়েছে এখন একটু সাজগোছ করলে মন ভালো থাকবে। আর আপার তো সবসময়ই মন খারাপ থাকে। এতো অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে গেছে। এসব পেলে যদি মনটা একটু ভালো হয়। অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে আবার কাজে দৌড়াতে হবে। ”

একজন প্রকৃত জীবনসঙ্গী হতে গেলে কতটা আত্মত্যাগ করতে হয় তা আজ মায়ের কথায় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে আব্বুকে ডাক দিলাম। যদিও দরজা খোলা। আমি চাইলেই ভিতরে গিয়ে ফোনটা দিয়ে আসতে পারি কিন্তু রুমের ভিতরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা উচিত নয়।
আব্বু আমার ডাকে সাড়া দিয়ে বাইরে আসলো। আমি আব্বুর হাতে ফোনটা দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। আব্বু নয় আমিই এবার মা’কে শাড়ি কিনে দিবো। কিন্তু কি করে! কাছে তো কোনো টাকা নেই। কলেজের নাম করে টাকা চাইলে হয়তো ওরা টাকা দিয়ে দিবে কিন্তু চুরি করে যেমন দান করা উচিত নয় তেমনি মিথ্যা বলে টাকা নিয়ে উপহার কিনে দেওয়াটাও বাঞ্ছনীয় নয়।

সারারাত চিন্তা করেও কোনো উপায় বের করতে পারলাম না। কোথা থেকে টাকার জোগাড় করবো। খুব দামী শাড়ি না হলেও সাত আটশো টাকার নিচে কোনো ভালো শাড়ি পাওয়া যাবে না।
সকালে খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম মা বারবার ফুফুর শাড়ির দিকে দেখছে। হয়তো অনেক পছন্দ হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষদের জীবনের ইচ্ছেগুলো একটা কথাই আটকে যায় তা হলো থাক লাগবে না। মায়ের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই। সকালের খাওয়া শেষ করে নিজের কাজে চলে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না। কি করে টাকা জোগাড় করবো! আব্বু কি মাসে পঁচিশ হাজার টাকা বেতন পেয়ে তিনটা শাড়ি কিনতে পারতো না? মা’কে বলদ পেয়ে হয়তো যা খুশি বুঝিয়ে দিয়েছে হয়তো। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে দেখলাম মা মন খারাপ করে বসে আছে। আমি কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ” মা কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ করে বসে আছো কেন? ”

মা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে দাদি ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। দাদির মুখটাও ভার ভার৷ আমি শান্ত গলায় দাদিকে প্রশ্ন করলাম, ” কিছু হয়েছে নাকি? ”

দাদি বিলাপ করে বলে উঠলো, ” আমার সবহারা মেয়েটাকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে ছেলেটা, তাই তোর মার চোখে সহ্য হয়নি। ওই বাড়ির রহিমাকে বলেছে, তার স্বামী নাকি সব মা বোনকে দিয়ে দেয়। তোর মা’কে নাকি কিছুই পায় না। ”

আমি দাদির কথা শুনে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা চুপ করে বসে আছে। একদম স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন। আমি শান্ত গলায় দাদিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ” তুমি কি নিজপর কানে মা’কে এই কথা বলতে শুনেছো?”

দাদি মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলো। তারপর বলে উঠলো, ” রহিমা মেয়েটা বড্ড ভালো। মাঝে মাঝে আমার খোঁজ নিতে আসে। ও কি আমাকে মিথ্যা বলবে নাকি?”

ঘরের লোকের থেকে বাইরের লোককে বেশি ভরসা করাটা আমার কোনো কালেই পছন্দ না৷ দাদির এমন কথা আমার মেজাজটাকে বিগড়ে দিতে যথেষ্ট হলো। আমি কর্কশ গলায় বললাম, ” তোমার রহিমা যদি সত্যি তোমার ভালো চাইতো তাহলে তোমার সংসারে কুট কাঁচালি লাগাতো না। রহিমা খোঁজ নেয় বলে মেয়েটা অনেক ভালো, তিনবেলা যে আমার মায়ের রান্না গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছো তাতে কিছু না? মা তো তোমাদের কখনোই কিছু বলে না। তোমার রহিমা তো শশুর শাশুড়ির সাথে দুইমাসও থাকতে পারেনি। ”

মা এতো সময় চুপ করে থাকলেও এবার আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর কড়া গলায় বললো, ” আমি কি তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি যে বড়দের মুখে মুখে তর্ক করো?”

আমি মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ” তোমার এই ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে সকলে তোমাকে নানান কথা শোনায়। তুমি এতোটা ভালো না হলেও পারো মা। ”

মা আর কিছু বললো না। রাতের বেলা আব্বু বাড়িতে আসলে রহিমা কাকি দৌড়ে আব্বুর কাছে আসলেন। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,” ভাইজান আপনার পোলাডা আমাকে কিসব বিশ্রী ভাষায় গালাগাল দিয়েছে। ফাতেমা আপাও তখন সেখানে ছিলো। ”

সারাদিন কাজের পরে আব্বুর মেজাজ বরাবর চড়া থাকে। রহিমা কাকির কথায় আব্বু যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে রাগী গলায় বললেন, ” এইসব কি বলছে উনি,?”

আমি শান্ত গলায় বললাম, ” আমি উনাকে কথা শুনিয়েছি কারণ উনি দাদিকে মায়ের নামে মিথ্যা বলেছে। আর তাই নিয়ে দাদি মা’কে অনেক কথা শুনিয়েছেন। ”

আব্বু অগ্নি দৃষ্টিতে মা’য়ের দিকে তাকালেন। তারপর শান্ত গলায় রহিমা কাকিকে বললেন, ” আমার ছেলের হয়ে আমি আপনার কাছে মাফ চাচ্ছি। ”

দাদি আফসোস করে বলে উঠলো, ” ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলাম না। আজ আমাদের এইদিন দেখতে হচ্ছে! ”

আমি কিছু বলার আগে মা আমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে