সবিতা
পর্ব : ১১
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ
সবিতার জীবনে এখন শান্ত একটা রুটিন।
স্কুল, শিক্ষার্থীদের গল্প, আয়শার ঘুরে দাঁড়ানো… সব মিলিয়ে সে এখন একজন সত্যিকারের পথপ্রদর্শক।
কিন্তু জীবনের বাঁকে বাঁকে যে টানাপোড়েন জমে থাকে, একদিন সেই পুরনো মুখ ঠিকই ফিরে আসে।
একদিন হঠাৎ…
স্কুল ছুটির পর গেটের সামনে একটা সাদা গাড়ি।
সবিতা প্রথমে পাত্তা দেয় না।
কিন্তু ভেতর থেকে যখন লোকটা নামে, তার চোখ আটকে যায়— সাইফ।
হাঁটুর ওপর একটা দামী পাঞ্জাবি, চোখে ক্লান্তি, আর মুখে একটা অনুশোচনাময় ভঙ্গি।
— সবিতা, তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
সবিতার কণ্ঠ ঠান্ডা, কিন্তু দৃঢ়।
— “তুমি তো ভেবেছিলে আমাকে ঠকিয়ে তুমি ভালো থাকবে, ভালো আছো কি?
সাইফ চুপ। তারপর কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলে,
— “ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল। তুমি থাকতে বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি আমি কী হারিয়েছি।”
সবিতা তাকিয়ে থাকে সাইফের চোখে।
এই মানুষটা একসময় তার সব ছিল।
আজ শুধু একটা পরিচিত ছায়া।
— “তুমি যেটা হারিয়েছ, সেটা আমি একটুও হারাইনি, সাইফ। বরং আমি নিজেরে খুঁজে পেয়েছি। নিজের একটা আলোকপথ বানিয়ে নিয়েছি।”
সাইফ কণ্ঠ নরম করে নির্লজ্জের মতো আজও বলে,
— “তুমি চাইলে… আবার শুরু করতে পারি?”
সবিতার উত্তর আসে ধীরে, কিন্তু অমোঘভাবে—
— “আমি শুরু করেছি, সাইফ। তবে সেটা তোমার সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে। আর সেই শুরুতে তোমার কোনো জায়গা নেই।”
সাইফ আজ ও শূন্য হাতেই ফিরে যায়।
তবে রাতের ডায়েরিতে সবিতা লেখে
> “আজ আমি তাকে ক্ষমা করেছি।
কিন্তু ফিরে যাওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য নয়।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই তো আমি সেই রাতে বেরিয়ে এসেছিলাম… অন্ধকার পেরিয়ে আলোর খোঁজে।”সেই আলো আমি খুঁজে পেয়েছি,তাহলে কেনো আবার অন্ধকারে যাবো?
—
সবিতার জীবনটা যেন সত্যিই একটা বইয়ের মতো—
প্রতিটি অধ্যায়ে নতুন কিছু, নতুন যুদ্ধ, আর নতুন আলো।
সাইফের ফিরে আসা তাকে কাঁপিয়ে দেয়নি, বরং নিজের অবস্থানটা আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে।
এখন সে জানে—নিজের পথেই সে আলোর খোঁজ পেয়েছে।
—
আয়শা এখন শুধু আঁকেনা, কথা বলতেও শিখে গেছে।
সে অন্য মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের গল্প শোনে, সাহস দেয়।
একদিন সবিতাকে বলল,
— “আপু, আমি যদি নিজের একটা গ্রুপ বানাই?
যারা নিজেদের গল্প বলবে, আর একে অপরের পাশে দাঁড়াবে?”
সবিতার মুখে প্রশংসার হাসি।
— “এই পথটাই তো তোদের জন্য খুলে দিতে চেয়েছিলাম।
তুই নিজেই নিজের ‘আয়শা’ হয়ে উঠেছিস।”
আয়শা মাথা নেড়ে বলে,
— “আপু, আমি একদিন আপনার মতোই হবো।
মানুষকে বোঝাবো—আগুন দিয়ে নয়, আলো দিয়ে বাঁচতে হয়।”
—
এদিকে তাওহীদ নিজের উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত।
সবিতার স্কুলকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
একদিন দুজনে ছাদে বসে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলে—
তাওহীদ বলল,
— “স্কুলটাকে আরও বড় করতে চাই।
নিজের একটা জায়গা, যেখানে তুমি ইচ্ছামতো স্বপ্ন বুনবে।
আমিও পাশে থাকব—সহযোদ্ধা হয়ে।”
সবিতা তাকিয়ে থাকে তাওহীদের দিকে।
এই মানুষটা কখনোই তাকে দাবী করেনি, কিন্তু প্রতিটি স্বপ্ন পূরণের পথে এক শক্ত ভরসার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাওহীদ অনেক সাহস নিয়েই বলে,
— “একদিন একটা বাড়ি হবে আমাদের,
যেখানে থাকবে শুধু সম্মান, ভালোবাসা আর স্বপ্ন,”
সবিতা মুচকি হাসে।
—
এতো কিছুর মধ্যেও সমাজ থেমে থাকে না।
মেয়ে হয়ে এতদূর আসার পরও সবিতাকে কটাক্ষ করা হয়—
“নিজের সংসার না গড়েই নাকি এত নারী ক্ষমতায়নের কথা!”
“ভাঙা সংসার নিয়ে এসব নাটক!”
কিন্তু সবিতা জানে, এদের জবাব কথায় নয়—কাজে দিতে হয়।
প্রতিদিন আরও একজন মেয়ের জীবন বদলানোই তার সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ এখন।
—
একদিন তাওহীদ সবিতাকে নিয়ে যায় একটা জমির সামনে—
খালি জায়গা, পাশে গাছপালা, আর দূরে ছোট্ট একটা নদী।
— “এখানেই হবে তোমার নতুন স্কুল—‘নবআলো’।”
— “নতুন ঠিকানা, নতুন শুরু।
তুমি মেয়েদের শেখাবে নিজের মতো করে বাঁচতে, আর আমি তোমার ছায়া হয়ে থাকব।”
সবিতার চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।
নিজের স্বপ্নগুলোকে এতদিন কাগজে আঁকতো, আজ সে স্বপ্নগুলো মাটিতে গেঁথে যাবে।
সে মনে মনে বলে—
“আমি ফিরে যাচ্ছি না। আমি এগিয়ে যাচ্ছি—নিজের গল্প, নিজের মানুষ, আর নিজের আলো নিয়ে।”
—
দুই মাস পেরিয়ে গেছে। খালি জমিটা এখন আর খালি নেই। বাঁশের চটা ঘর, টিনের ছাউনি আর দেয়ালে রঙিন আঁকা—
লেখা আছে বড় করে:
“নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র”
এই ছোট্ট স্কুলঘর এখন যেন একটা বিপ্লবের কেন্দ্র।
প্রতিদিন সকাল হতেই আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা ভিড় জমায়।
কারও চোখে ভয়, কারও মুখে কৌতূহল, আর কারও মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা আশা।
সবিতা দাঁড়িয়ে থাকে গেটের পাশে,
যেন এই আলো তার নয়, বরং তাদের জন্য—যারা পথ হারিয়ে খুঁজে ফিরছে নিজের নাম, নিজের সম্মান, নিজের স্বপ্ন।
—
একটা মেয়ে প্রথমদিন এসেই কোণায় বসে পড়ে। কারও সঙ্গে কথা বলে না।
নাম?
রুমাইসা।
বয়স ১৫। বাবা নেই, সৎমায়ের হাতে নির্যাতন। পড়াশোনা বলতে খুব সামান্য। মুখে একটা দগদগে দাগ।
সবিতা তার পাশে বসে।
— “আয়নার দিকে তাকাতে ভয় পাও?”
রুমাইসা চোখ ঘোরায়, কিছু বলে না।
সবিতা ধীরে বলে—
— “এই দাগটা তোমার না, সমাজের। তুমি ওটা নিয়েই সুন্দর। আমরা সবাই কিছু না কিছু নিয়ে এসেছি এখানে। নবআলোতে তুমি আর ‘অসুন্দর’ নও, তুমি শক্তি।”
রুমাইসা চোখ মুছে তাকায়।
একটা ভেতরের তোলপাড় যেন তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
সেদিন থেকে সে প্রতিদিন নিয়ম করে আসে।
—
স্কুলের প্রথম মাস শেষ হলে, তাওহীদ এক সন্ধ্যায় এসে সবিতাকে একটি ছোট বাক্স দেয়।
— “খুলে দেখো।”
সবিতা খুলে দেখে ভেতরে ছোট ছোট কার্ড।
প্রতিটি মেয়ের হাতে লেখা চিঠি।
“আপু, আপনি না থাকলে আমি এখনো রান্নাঘরের কাজ করতাম।”
“আপু, আপনি আমাকে নাম দিয়েছেন। ‘বেকার’ থেকে ‘শিক্ষার্থী’ বানিয়েছেন।”
“আপু, আপনি আমার মা, আপু, আলোর মানুষ।”
সবিতা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
তাওহীদ হেসে বলে—
— “শুধু শিক্ষা নয়, তুমি ভালোবাসাও শিখিয়েছো ওদের।”
—
এক সন্ধ্যায়
সবিতা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে আকাশ লালচে।
হাতের চায়ের কাপটা ধরে ফিসফিস করে বলে—
“আমি হারাইনি, বরং পেয়েছি।
নিজেকে, আমার মানুষগুলোকে, আর এই আলোর পথটাকে।”
তাওহীদ এসে পাশে দাঁড়ায়।
— “তুমি একা নও সবিতা। তোমাকে দেখে আমরাও পথ খুঁজে পাই।”
সবিতা হেসে বলে—
— “আমার নাম হলো সবিতা, মানে সূর্য।
এজন্য আমি যত দিন বেঁচে থাকবো গরীব,অসহায় আর নির্যাতিত মেয়েদের আলো দিয়ে যাবো।
আজ আমি কেবল আলোর মাঝেই বাস করছি, আর চাই যেন এই আলো কারও চোখে আর নিভে না যায়।”
চলবে_____