সবিতা পর্ব-১০

0
7

সবিতা
পর্ব : ১০
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

নতুন পথের শুরুতে সবসময়ই কিছু প্রশ্ন থাকে।
তাওহীদের বিয়ের প্রস্তাবের পর সবিতা এখন রাতজাগে। একা একা পুরনো দিনের ডায়েরি পড়ে—সাইফের নির্লিপ্ততা, শ্বশুরবাড়ির চুপচাপ সহ্য করা অত্যাচার , নিজের কান্নাভেজা রাতগুলো।
সবকিছু মিলিয়ে সে একটাই সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর কারো সংসারে নয়, নিজের পরিচয়ের ভেতরেই বাঁচতে চায়।

সবিতা এখন জানে, জীবন কখনো সোজা হয় না।
তবু তার গল্প থেমে নেই। সে লিখছে একেকটা মেয়ের মুক্তির গল্প।
আর তার পাশে একজন মানুষ—তাওহীদ—যে ভালোবাসা দাবি করতে চায় না, শুধু থাকতে চায় তার ছায়া হয়ে।আর সবিতাও তাকে বন্ধু হিসেবেই রেখে দিয়েছে।

বিকেলের আলো গা ছুঁয়ে যায়।
সবিতার স্কুলে আজ বিশেষ আয়োজন—নারী উদ্যোক্তা উৎসব।
সবিতার হাতে গড়া ছাত্রীরা আজ নিজেদের বানানো হ্যান্ডিক্রাফট, জামা-কাপড়, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে।
লোকজন মুগ্ধ। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না—এই মেয়েগুলো একসময় নির্যাতিত, পরিত্যক্ত ছিল।

এই উৎসবের মাঝেই তাওহীদ পাশে এসে দাঁড়ায়।

– “তোমার মেয়েগুলো তোমার মতোই জেদি, জানো?”
সবিতা মুচকি হেসে বলে,
– “তাদের জেদটুকু দিয়েই ওরা বাঁচবে।”

সবকিছুর মাঝে একদিন অপ্রত্যাশিত একজন অতিথি আসে—সাইফের মা।

হঠাৎ তাকে দেখে সবিতা থমকে যায়।

– “তোমার সঙ্গে কথা আছে মা রে,” কাঁপা গলায় বলে।
সবার চোখের আড়ালে তারা একটু দূরে গিয়ে বসে।

– “আমি জানি, তোকে কোনোদিন আমরা তোর প্রাপ্য সম্মান টুকু দিতে পারিনি।অনেক অত্যাচার করেছি তোর সাথে,তুই মুখ বুঝে সব শুধু সহ্য করে গেছিস।এখন আমরা সবাই আমাদের ভুল বুঝতে পারি, ভুলটা আমাদের ই ছিল,তুই নিষ্পাপ, ফুলের মতো পবিত্র ছিলি।

সবিতা চুপচাপ, তার কোনো উত্তর নেই,আর কি উত্তর দেবে সে?
সাইফের মা এবার বললো,
তুই নিজের মতো করে উঠেছিস—আমি সবাই গর্বিত।”এটা ধরে রাখ।

এবার সবিতার চোখে জল আসে। সে কিছু বলে না। কিন্তু এই অনুতপ্ত স্বীকারোক্তি তার দীর্ঘ ক্লান্ত পথের প্রতি একধরনের স্বীকৃতি।

সবিতা মনে মনে বলে, সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি,কারণ তোমরা সেদিন আমার উপর এই নির্যাতন না করলে আজ আমি সবিতা হতে পারতাম না।

দেখতে দেখতে আরও এক বছর কেটে যায়।

সবিতার স্কুল এখন রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত।
পাঁচজন ছাত্রী আজ চাকরি পেয়েছে এনজিওতে।
তিনজন নিজের দোকান খুলেছে।

সবিতা নিজেও একটা প্রজেক্ট হেড পদে যোগ দেয়—নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে বড় এক প্রোগ্রামে।

এক সন্ধ্যায় ছাদে বসে চা খাওয়ার সময়, তাওহীদ খুব সহজ করে বলে—

– “সবিতা, এবার যদি তুমি রাজি থাকো, তবে চল একটা ছোট্ট বাসা নিই।
তুমি স্কুল চালাবে, আমি অফিস করব, আর সন্ধ্যায় একসঙ্গে চা খাব।
ভালোবাসার চেয়ে সম্মানের জায়গাটা আগে থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”

সবিতা শুধু হাসে,কিন্তু কিছু বলে না।

হেমন্তের হাওয়া বইছে।
নতুন একটা ভোর এসেছে—শান্ত, ধূসর, অথচ আশায় ভরা।
সবিতা আজ প্রথমবার নিজের নামে একটা চেক হাতে পেয়েছে।
নিজের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে, নিজের স্বাক্ষরসহ।
চোখে জল চলে আসে—এ যেন কাগজের মধ্যে জীবনের ছাপ।

তাওহীদ এসে বলে,
— “আজ তোমাকে গাড়ি করে স্কুলে নিয়ে যাবো। সময় হয়ে গেছে ‘সাইকেলচালিত স্বপ্ন’ ছাড়ার।”

সবিতা হেসে ওঠে।
সেই হাসির ভিতর ছিল নতুন জীবনের দৃঢ়তা।

একদিন হঠাৎ কাকুলির ফোন আসে।
— “তুই এত দূর চলে গেছিস, আন্নি। আমি গর্বিত, জানিস?”

সবিতা তা শুনে বলে একদিন দেখতে আসিস আমাকে,আমাকে কি দেখতে ইচ্ছে করে না?

কাকুলি হেসে উত্তর দেয়,যাবো,যাবো।তুই রেডি থাকিস।

জানিস,কাকুলি মা-ও ফোন দেয় মাঝে মাঝে।
বলে,
— “তোর বাচ্চাগুলোকে একদিন আমাদের বাড়িতে আনিস।”
সেই কণ্ঠে অনুশোচনা নেই, আছে একধরনের শান্ত সমর্পণ।

আমার যে কত খুশি লাগে এখন।

কাকুলি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে তুই সার্থক হয়েছিস আন্নি।তুই আমাদের সবার গর্ব।

__________

সবিতা বার বার সাইফ কে ফিরিয়ে দেওয়ায় আর যোগাযোগ করেনি সাইফ।
তবে শোনা যায়, অহনার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই,সবিতা সাইফ কে ছেড়ে চলে আসার পর পরই সে অহনার থেকেও দূরে সরে যায়।সাইফ তার ভুল বুঝতে পারে,সে সবিতাকে ছাড়া ভালো নেই।

একসময় মানুষ যে ফাঁকা জায়গায় ভালোবাসা খোঁজে, সেখানে শুধু আজ ক্ষমা জেগে থাকে।

সবিতার স্কুলে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে।

একটা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে আসে স্থানীয় ওসি সাহেব।
মেয়েটা নাকি আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।

নাম—আয়শা।
চোখে ভয়ার্ত অন্ধকার।
মুখে একটাও শব্দ নেই।
কিন্তু সবিতা জানে, এই মেয়েটাই আগামী দিনের আগুন হবে—জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নয়, আলো ছড়িয়ে।

সবিতা তার পাশে বসে বলে,

— “তোকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি তোর মতই একদিন গুমরে কেঁদেছিলাম।”

আয়শা চুপ করে থাকে। কিন্তু তার ঠোঁটে একটুখানি কম্পন—
কোনো এক ভরসার ইশারা যেন।

সবিতা আর তাওহীদ একসাথে ছাদে দাঁড়িয়ে।
নিচে শহরের আলো, মাথার ওপর তারা।
তাওহীদ বলে,

— “তোমার প্রতিটি যুদ্ধের পাশে থাকার শপথ আজ আবার করছি।”

সবিতা তখন হঠাৎ কোনো কিছু না ভেবে বলে,

— “আমি আর কোনোদিন পালাতে চাই না। এবার আমি থাকবো—নিজের গল্পের কেন্দ্রে, নিজের মতো করে।”

তাওহীদ হেসে ওঠে শুধু,কিন্তু কিছু বলে না।সবিতা যে তাকে অগাধ বিশ্বাস করে তা তাওহীদ ভালো করেই জানে।হয় তো একটু আধটু পছন্দও করে।কিন্তু বলার সাহস পায় না।সবিতা সংসার জীবন টাকে আজকাল অনেক বেশি ভয় পায়।

সবিতা আর তাওহীদ একসাথে আকাশের দিকে তাকায়।
তারা আজ অনেক দূরে।ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সকালবেলা।
স্কুলের বারান্দায় সূর্যের আলো এসে পড়ে।
আয়শা এখনো চুপচাপ। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না।
সবিতা জানে—প্রথমে কথা নয়, দরকার ভরসা।

তাই প্রতিদিন সবিতা নিজের হাতে তাকে নাস্তা দেয়, পাশে বসে গল্প করে।
একদিন হঠাৎ আয়শা বলে ওঠে,

– “আপু, আমি আসলে মরতে চাইনি। শুধু সবাইকে একটু বোঝাতে চেয়েছিলাম, আমি কতটা কষ্টে আছি।”

সবিতা থেমে থাকে। তারপর মাথায় হাত রেখে বলে,
– “তুই বেঁচে আছিস, সেটাই এখন আমাদের শক্তি।”

দুপুরের রোদ্দুরে আয়শা একদিন নিজের গল্প খুলে বলে—
তার চাচাতো ভাইয়ের হাতে নিপীড়িত হওয়া,
মা-বাবার চুপচাপ মুখ,
আর একদিন তার মায়ের বলা কথা—
“তোর মুখ বন্ধ রাখ, নয়তো তোর জন্যই আমাদের মান-ইজ্জত যাবে।”

সেই দিন থেকেই আয়শার ভিতরে আগুন জমে।
একদিন আগুন দিয়েই নিজের শরীর পোড়াতে চেয়েছিল।
কিন্তু ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছে।

সবিতার চোখে জল আসে, তবু গলা শক্ত করে বলে,
– “তুই একটা যুদ্ধিনী, আয়শা। যুদ্ধ না করলে তো অন্যায়েরাই জয়ী হয়।”

পরবর্তী কিছুদিনে আয়শা আবার আঁকতে শুরু করে।
তার ছবিতে এক মেয়ের মুখে থাকে আগুন, চোখে অশ্রু আর পেছনে বিশাল এক ডানা।

স্কুলে আয়োজিত “আলোকিত বাঁচা” প্রতিযোগিতায় সে এই আঁকা জমা দেয়।
প্রথম পুরস্কার তার হয়ে যায়।
লোকজন ভীষণ মুগ্ধ হয়। সংবাদপত্রেও আসে এই খবর—
“আগুন থেকে আলোর পথে: আয়শার গল্প”

শেষে এক চিঠি

এক সন্ধ্যায় আয়শা সবিতাকে একটা চিঠি দেয়—

> “আপু, আপনি না থাকলে আমি সত্যিই থাকতাম না।
আমি এখন জানি, আমি কারও বোঝা না।
আমি নিজেই একটা স্বপ্ন।
আপনার কাছ থেকে আমি শুধু ভরসা না, একটা নতুন জীবন পেয়েছি।
আমি বড় হয়ে ঠিক আপনার মতো একটা স্কুল খুলব।
যেখানে আরেকটা আয়শা আসলে, তাকে কেউ মরতে না বলে—বাঁচতে বলবে।”

সবিতার চোখে জল আসে।
সে জানে, এই গল্পের শুরুটা কষ্টের হলেও শেষটা আলোর, সাহসের আর শক্তির।

চলবে______

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে