সবিতা পর্ব-০৬

0
5

সবিতা
পর্ব : ০৬
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
মোহাইমিনের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে তার আর কোনো ইচ্ছা নেই।
তার মধ্যে এক নতুন শক্তি তৈরি হচ্ছে, এবং তার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—

“আমি নিজের পথেই চলব।”

মোহাইমিন জানেন, তার যাত্রার শেষ কোথায়—
অন্য কেউ এটা জানে না।
কিন্তু, সবিতা জানে, তার কাজের উদ্দেশ্য একটাই—

“নারীর স্বাধীনতা, সম্মান, আর অধিকার।”

তবে সেই যাত্রায় এক নতুন বিপদ তৈরি হয়।
কিছু অন্ধকারমনা মানুষ সবিতার কাজকে একেবারে বিপজ্জনক মনে করতে শুরু করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবিতার বিরুদ্ধে ঘৃণিত পোস্ট আসতে থাকে,

তার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ তোলে—
“এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর, এর ফলে পরিবার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।”

কিন্তু সবিতা জানে, যে কাজ সে করছে, তা সত্যি ও প্রয়োজনীয়—
এটা চলতেই থাকবে।

একদিন সবিতা অফিসে ছিল।
তখন তার ফোনে একটি কল আসে—
এটা সাইফের ফোন।

সবিতা ফোন ধরে নীরবে শুনতে থাকে—

সাইফ বলে—
– “আমি জানি, আমি অনেক কিছুই ভুল করেছি। আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি শুধু চাই, তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও, যেন আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি।”

সবিতা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সে জানে, সাইফ তার জীবনে অনেক কিছুই ভুল করেছে।সে সবিতার বিশ্বাস কে একদম চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে,যা আর পূর্বের অবস্থায় ফিরবে না কখনো।

তবে একটা জায়গায় সাইফ একেবারে সঠিক—

সাইফ সবিতার জীবনে আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

সাইফের আকুতি মিনতি আজ আর কোনো কাজে আসবে না সবিতার জীবনে।এজন্য সবিতা চুপ করে থাকে,
কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেয়।

রাইয়া ও সবিতার সম্পর্ক এখন নতুন একটা স্তরে পৌঁছেছে।
রাইয়া শুধু তার সহকর্মী নয়, বরং তার আত্মবিশ্বাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একদিন রাইয়া সবিতার কাছে এসে বলে—

– “আপা, আপনি জানেন, আপনি ছাড়া আমি কখনো এগোতে পারতাম না। আপনিই তো আমাকে সেই সাহস দিয়েছিলেন।”

সবিতা রাইয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চুপ হয়ে যায়।
তার চোখে এক অনিচ্ছাকৃত অনুভূতি চলে আসে—

“আমিও তো নিজের জন্য কিছু করতে পারিনি। কিন্তু আমরা একে অপরকে শক্তি দিচ্ছি।”

রাইয়া তখন বলেন—
– “আপনি একা নন, আপা। আমরা একসাথে আছি। আপনার সকল স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে।

এদিকে মোহাইমিন আবার সবিতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে।

সে জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে তার ধারণা ছিল, সবিতা হয়তো কিছুটা সময় নেবে, পরে সে তার প্রস্তাবে সম্মত হবে।

কিন্তু সবিতা জানে—
এবার তার পথ আলাদা।

একদিন মোহাইমিন অফিসে এসে বলেন—

– “আপনি জানেন, আমি চাই আপনার কাজ আরেকটি স্তরে উঠুক। আপনার আন্দোলন সমাজের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়। আমি আবারও বলছি,

আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে চাই।”

সবিতা তখন গভীরভাবে মোহাইমিনের দিকে তাকায়।
তার মনে এক ধরনের সন্দেহ চলে আসে।
“এটা কি শুধুই সহযোগিতা, না কি তার ভেতরে অন্য কিছু?”

তবে সে আর কিছু বলে না, শুধু বলে—

– “আমার কাজের সাথে আপনি আর যুক্ত হবেন না।”

মোহাইমিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, মুখে একটা সঙ্কুচিত হাসি দেয় এবং চলে যায়।

..………….

দিন কয়েক পরে সবিতার কাছে এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ আসে।
একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের কাজে সবিতাকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেয়—
তারা জানায়, তারা চায় সবিতা তাদের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করুক, যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে নারীদের অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দেবেন, সেমিনার পরিচালনা করবেন, এবং কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

সবিতার মনে এক নতুন আশা জাগে।
এটা তার কাজকে আরও বিস্তৃত করতে পারবে, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।
তবে একে অপরের সাথে ঘনীভূত সম্পর্কের ফলে, সবিতা কি এটি গ্রহণ করবে?

সবিতা এখনও সেই আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তাবটি চিন্তা করছে। তার সামনে নতুন সুযোগ, নতুন যাত্রা, কিন্তু সে জানে—এটি সহজ হবে না। সে অনেক কিছু হারিয়েছে, অনেক কিছু শিখেছে, কিন্তু এখন তার সামনে এক নতুন যুদ্ধ আসছে। এই যুদ্ধ শুধু নিজের জন্য নয়, বরং দেশের নারীদের জন্যও।

……….

একদিন সাইফ একাধিক বার ফোন করে সবিতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। সবিতা জানে, সাইফ বুঝতে পারছে না, তার সাথে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সাইফের পরিবর্তন আসেনি, সে আবারও সবিতার কাছে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু সে জানে, সবিতা আর কখনো তার কাছে ফিরে যাবে না।

এদিকে সবিতা যখন এই ভেবে নিশ্চিন্ত যে, সে সাইফের থেকে মুক্তি পেয়েছে, সাইফ আবার তার জীবনে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

একদিন সবিতা অফিসে বসে ছিল, সাইফ তার সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

– “আমি জানি, আমি তোমার অনেক কিছু ভেঙে ফেলেছি, কিন্তু আমি শুধু চাচ্ছি তোমার পাশে থাকতে। প্লিজ সবিতা, একবার আমাকে সুযোগ দাও।”

সবিতা এক মুহূর্ত চুপ থাকে। তার চোখে ঝিলমিল করা অশ্রু।

তবে সে জানে—এটা আর হবে না। সে জানে, তার পথের সঙ্গে সাইফের পথ আর কখনো মেলানো যাবে না।

“এবার তুমি আমাকে প্লিজ একে অপরের থেকে দূরে থাকার সুযোগ দাও।”সবিতা শান্তভাবে বলে।

সাইফ একেবারে চুপ থাকে, কিছু বলার সাহস পায় না। সে আজও আবার ধীরে ধীরে চলে যায়।

এতদিন যে তীব্র অসন্তোষ ছিল, যে অস্থিরতা সবিতার মধ্যে ছড়িয়ে ছিল, সেটি কিছুটা হলেও শান্ত হয়। সবিতা সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর অপেক্ষা করবে না। এই সুযোগ তার জন্য তৈরি হয়েছে, এবং সে এটি গ্রহণ করবে। তার জীবনের স্বপ্ন, তার লক্ষ্য, তার কামনা—সবই তার হাতের নাগালে।

রাইয়া তাকে সমর্থন জানায়। রাইয়া জানে,সবিতা যখন কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাকে কেউ থামাতে পারবে না।

– “তুমি সেই সাহসী মেয়ে, যে সবার আগে দাঁড়িয়ে আছে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য। তুমি জানো, আমাদের সকলের পক্ষে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই পথে চলতে চলতে তুমি এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।”

সবিতা তার দিকে তাকায় এবং তার চোখে এক নতুন আশার ঝিলিক দেখা দেয়।

কিন্তু নতুন পথ সহজ হতে যাচ্ছে না।
সবিতার নতুন যাত্রায় তাকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। একদিকে সাইফের পরিবার আবারও তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তুলতে শুরু করে—তারা সবিতার সম্পর্কে নিন্দা করতে থাকে, তার সামাজিক সম্মানহানি করতে চায়।

এদিকে, যখন সবিতা আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মসূচিতে অংশ নেয়, তখন তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হয়—কেউ কেউ তাকে ‘ঘরবাড়ি ভাঙানোর অপরাধী’ বলেও অভিহিত করে।

কিন্তু সবিতা এসবকে কিছু মনে না করে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সে জানে, এই পথ সত্যি হলেও কঠিন, তবে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তার কাছে একমাত্র লক্ষ্য হলো—নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাদের জন্য একটি সমতাভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করা।

মোহাইমিনও জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু সে সবিতাকে আরেকটি সুযোগ দিতে চায়। মোহাইমিন সবিতার সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করে, এইবার সে সবিতার পক্ষে কিছু কাজ করতে চায়।

– “তুমি যে কাজ শুরু করেছ, সেটি আমি বিশ্বাস করি। আমি চাই, তুমি আমার মধ্যে কাজ করতে থাকো, এবং আমাদের যৌথ উদ্যোগ দেশের উন্নতি করবে।”

সবিতা মোহাইমিনের দিকে তাকিয়ে, এক মুহূর্ত ভাবনায় ডুবে যায়। সে জানে, এই প্রস্তাব তার জন্য কোনো ভালোর দিকে নিয়ে যাবে না। তবে সে আর কিছু বললে না, শুধু ঘাড় নেড়ে তার সিদ্ধান্ত জানায়—

“ধন্যবাদ, কিন্তু আমি নিজের পথে চলব।”

মোহাইমিন হতাশ হয়ে ফিরে যায়, তবে তার চোখে এক অদ্ভুত লুক থাকে, যেন সে কিছু পরিকল্পনা করছে যা সবিতার ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হতে পারে।

সবিতা আজকে একটা নতুন পৃষ্ঠা লিখছে। তার সামনে পৃথিবী এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। এই নতুন প্রস্তাব, নতুন পথ—তার মধ্যে এক নতুন শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। একদিন, সে জানবে যে, তার এই যুদ্ধ শুধুমাত্র তার নিজস্ব নয়, পুরো সমাজের জন্য। তার গল্প, তার সংগ্রাম, তার জয়—সেটি অন্যদের জন্যও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

সে বুঝতে পারে, জীবনে যতই অন্ধকার আসুক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু আলোকিত হয়ে ওঠে।

[চলবে…]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে