সবিতা পর্ব-০৫

0
6

সবিতা
পর্ব: ০৫
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

রাইয়া কাঁপা গলায় নিজের গল্প বলা শুরু করে—
সে কিশোরী বয়সেই এক আত্মীয়ের লালসার শিকার হয়।
কেউ বিশ্বাস করেনি তাকে।
মা বলেছে, “মেয়ে হয়ে এত কথা বলে না।”
বাবা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

একদিন রাইয়া রাগ করে শুধু একটা ব্যাগ আর কিছু বই নিয়ে পালিয়ে আসে ঢাকায়।

শেল্টার হোমে এসে সে দেখে, এখানে ওরকম আরও অনেকে আছে।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়—যখন সে দেখে সবিতার মতো মেয়েও তার ভালোবাসার মানুষের কাছে দিনের পর দিন নির্যাতিত আর অবহেলিত।কিন্তু বর্তমানে তার আত্নবিশ্বাস প্রখর,চোখে কোনো ভয় নেই,মনের ভিতর এক আকাশ পরিমাণ বড় হওয়ার বাসনা,যাতে অন্যের মুখাপেক্ষী না হতে হয় তাকে।

সবিতা বলে—
– “তুই একা না, বুঝলি?”
রাইয়া জিজ্ঞেস করে—
– “আপনি কীভাবে এত শক্ত হন?”
সবিতা বলে—
– “যেদিন থেকে আমি অন্যের জন্য নিজেকে শক্ত করলাম, সেদিন থেকে।”


সবিতা এখন শুধু ব্লগার না।
সে চায় একটা ‘আশ্রয় ও পুনর্গঠন কেন্দ্র’ গড়তে—যেখানে নির্যাতিত নারীরা শুধু আশ্রয় নয়, পাবে শিক্ষা, কাজ শেখা, আইনি সহায়তা, এবং সম্মান।

প্রজেক্টের নাম দেয়—
“আলোকধারা”

নওরীন আপু ও একাধিক এনজিও পাশে দাঁড়ায়।

মিডিয়াতে আবার সবিতার নাম উঠে আসে—
“সাবেক গৃহবধূ থেকে নারী অধিকারকর্মী:সবিতার পথচলা।”

একদিন সন্ধ্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
নামেন একজন ব্যক্তি—পরিচিত মুখ, কিন্তু চোখে একেবারে অচেনা ভাষা।

মোহাইমিন চৌধুরী।
নতুন এক এনজিওর পরিচালক, দেশের বাইরে থেকেও কাজ করেন।
সে আগেই সবিতার কাজের কথা শুনে এসেছে।
আজ সরাসরি দেখা করতে।

– “আপনার সাহস আর স্পষ্টতা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে,”—সে বলে।

সবিতা চমকে ওঠে না।
কারণ এখন এসব প্রশংসায় সে মাথা ঘোরায় না।
তবু তার চোখে প্রশ্ন—
“আপনি কেন এখানে?”

মোহাইমিন হেসে বলে—
– “কারণ আমি চাই, আপনি দেশজুড়ে ‘আলোকধারা’র শাখা খুলুন। আমরা সহায়তা দেব। আপনি নেতৃত্ব দিন।”

সবিতার মুখে এক অদ্ভুত নির্ভরতা।
তবু ভিতরে ভিতরে একটা দ্বিধা খেলে যায়।

রাইয়া এখন শুধু নিরাপদ নয়—সে শিখছে ডিজাইন, কথা বলা, নেতৃত্ব।
একদিন সে বলে—
– “আপা, আপনি যদি না থাকতেন, আমি হয়তো বেঁচেই থাকতাম না।”

সবিতা চেয়ে থাকে—
আসলে সে তো নিজেকেও বাঁচাতে চেয়েছিল।
এখন বাঁচাচ্ছে আরো অনেককে।

…..……

সবিতা যখন ‘আলোকধারা’ শুরু করে, তখন এর সাফল্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এটা একদিকে মানুষের জন্য আশ্রয়, অন্যদিকে সবিতার জন্য নতুন এক পরিচিতি তৈরি করে।
কিন্তু সাফল্যের সাথে আসতে থাকে নতুন চ্যালেঞ্জ।
এখন সবিতা শুধু নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে না—সে হয়ে উঠছে সমাজের চোখে এক প্রতীকি লড়াকু।

এদিকে, মোহাইমিনের পাশে দাঁড়ানোর পর সবিতার মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা চলে আসে।
সে জানে না, মোহাইমিন কেবল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, নাকি তার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
তার মানসিক দ্বন্দ্ব ঘিরে ধরে।
সে কখনো মোহাইমিনের সাহায্যকে মেনে নেয়, কখনো আবার তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে।

আজ সবিতা তার বাড়িতেই আছে।হঠাৎ সাইফ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার চোখে অনুরোধ।
সে বলে—
– “আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি, কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়াতে চাই।”প্লিজ আন্নি সুযোগ দাও একটা।প্লিজ।

সবিতা নির্বিকারভাবে সাইফের দিকে তাকায়।

সে ভালো করেই জানে, সাইফ এখনও তার পুরনো গন্ডির মধ্যে আটকে আছে।সাইফ বিন্দুমাত্র নিজেকে চেঞ্জ করে নি।
তার জীবনে আসলে সবিতা ছিল একটা অস্থায়ী পরিসর।
সে নিজেকে এতটাই গুটিয়ে ফেলেছে যে,সবিতার এমন পরিণতি, যা তার কারণেই হয়েছে,সেটা স্বীকার করতে এখনো সক্ষম হয়নি সাইফ।

তবে সবিতা জানে, এই সময়ে সাইফের তার সামনে এসে দাঁড়ানোর পেছনে এক বড় কারণ আছে—

সে কি শুধুই অপরাধবোধের কারণে ফিরে এসেছে?

না কি তার জীবনের প্রতি পূর্ণ ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করছে?

সবিতা এদের কোনোটাই বিশ্বাস করতে পারে না।
সে বলে—
– “তুমি কি কখনো আমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলে? আমি চলে যাওয়ার পর তুমি কি এক মুহূর্তও আমাকে খুঁজেছিলে? না, সাইফ, তুমি তা করো নি,আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দাও,আর তুমি শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচো।”প্লিজ আমার সামনে আর এসো না।আমি তোমাকে ছাড়া বেশ ভালো আছি।আমাকে ভালো থাকতে দাও দয়া করে।

সাইফ আজও সেখান থেকে চলে যায়, নিঃশব্দে।

সে এতো বড় অপরাধ করেছে যে যার কোনো দিন কোনো ক্ষমা নেই সবিতার কাছে।

সবিতা বর্তমানে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে,তার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, এজন্য তার কিছু শত্রুরাও হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

একদিকে কিছু পুরনো পরিচিত মুখ তাকে অপমান করতে চায়, তো অন্যদিকে তার কাজের প্রতি বিরোধিতা জানায়।

কিছু মানুষ মনে করে যে, সবিতার কাজ নারীদের জন্য আসলেই উপকারী, কিন্তু তারা যে সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে এর বিরোধিতা করে, তা নিয়ে সবিতার সন্দেহ বাড়ে।

কিছু লোক সবিতার প্রতিষ্ঠানে তার কাজকে অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক বলে মনে করে।
তারা মনে করে—

“সবিতা যদি নারীদের অধিকার নিয়ে এত কথা বলে, তাহলে তার শিখানো মূলনীতি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করবে।”

একদিন, সবিতা যখন নিজেই খুঁজতে থাকে কাদের বিরোধিতা তাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দেয়, তখন সে বুঝতে পারে—

এর মধ্যে এক ধরনের বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কাজ করছে।
একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শিক লড়াইয়ে সবিতা পড়ে গেছে।
অথবা, কেউ সবিতার অর্জনগুলিকে হুমকি মনে করছে।
সবিতার চারপাশে এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়।

রাইয়া একদিন সবিতাকে বলে—

– “আপা, আপনি ভাবছেন, সমাজ ও পরিবার আমাদের বিরোধিতা করছে, কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি যে কাজ শুরু করেছেন, তা চিরকাল আপনাদের বিশ্বাস ও উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

রাইয়ার কথায় সবিতার মনে এক নতুন শক্তি খেলে যায়।
সে বুঝতে পারে, সমাজের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সে একা নয়।
এখন তার পাশে অনেক সঙ্গী, যারা একে অপরকে শক্তি দেয়।
এই অনুভূতি সবিতাকে দৃঢ় করে তোলে।

মোহাইমিন আবার সবিতার কাছে আসে—

– “আপনি জানেন, আপনাকে আমি শুধু সহায়তা দিতে চাই না, বরং আপনার কাজে যোগ দিতে চাই। আমি চাই, আপনার প্রজেক্টকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে।”

সবিতা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
তার সামনে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—
কীভাবে সে এই মানুষটির প্রস্তাব মেনে নেবে?

সবিতা মোহাইমিনের মনোভাব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
তবে সে জানে, তার কাজের জন্য সহযোগিতা দরকার।
এটা কি তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে?

[চলবে…]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে