#সবিতা
সূচনা পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ
ভোরের আলো এখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। জানালার ফাঁক গলে এক ফালি সূর্য রশ্মি আন্নির মুখে এসে পড়তেই সে চোখ খুলে ফেলে। পাশ ফিরে তাকায়—সাইফ ঘুমোচ্ছে না, বরং ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার ভান করে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। দু’জনের মাঝখানে শীতল নিঃশ্বাসের দেয়াল, যা স্পর্শ করা যায় না, শুধু টের পাওয়া যায়।
আন্নি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে পড়ে এক বছর আগের সেই বিকেলটা, যখন সে হাত ধরেছিল সাইফের, ভালোবাসার দায়ে সমস্ত কিছু ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলো। কত স্বপ্ন ছিল তাদের—একটা ছোট বাসা, দুটো টিকটিকি ঝগড়া করবে দেয়ালে, ছাদের কোণায় গুচ্ছ গুচ্ছ রোদ জমে থাকবে, আর সন্ধ্যায় ওরা মিলে একসাথে চা খাবে।
সেইদিন আন্নির বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা চিরে বেরিয়ে গিয়েছিলো—ভালোবাসা নয়, বিশ্বাস ছিল সেটা।
আন্নি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সাইফকে।
পরিবারের কেউ রাজি ছিল না। অনেক অনুরোধ, অনেক বোঝানো—সব ব্যর্থ। শেষমেশ ভালোবাসার টানেই এক ঝড়বিক্ষুব্ধ বিকেলে আন্নি পালিয়ে যায় সাইফের সঙ্গে।
সেই রাতে আকাশ ঝরেছিল, ঠিক যেমন তার বুকের ভেতর কান্না আর আনন্দ একসাথে ঝড় তুলেছিল।
সাইফ হাত ধরে বলেছিল,
— “এখন থেকে আমি শুধু তোমার। কোনো কষ্ট পেতে দেব না তোমায়।”
আন্নির মনে হয়েছিল,
“এটাই তো আমার স্বর্গ, আমার বাড়ি, আমার পৃথিবী।”
কিন্তু সে স্বর্গ ছিল খুব অস্থায়ী।
শুধু এক বছর।
এক বছর পর আন্নি টের পায়—সাইফ বদলে যাচ্ছে। তার চোখে অহনার প্রতিচ্ছবি।
অহনা, সাইফের ক্লাসমেট। স্মার্ট, চটপটে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
প্রথমে সন্দেহ, পরে নিশ্চিত বিশ্বাস।
সাইফ অহনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
প্রথমে সামান্য পরিবর্তন এসেছিলো সাইফের আচরণে। ফোনে কথা বলার সময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত, রাত করে বাসায় ফিরত। আন্নি যখন জানতে চাইত, সে বিরক্ত হতো, রাগ করত। তারপর একদিন আন্নির সামনে দাঁড়িয়ে সাইফ চিৎকার করে বলে উঠেছিলো,
— “তুমি একটা প্যারানিয়া,এত সন্দেহ তোমার?
ও আমার ক্লাসমেট।
এসব মানসিক রোগীর মতো আচরণ বাদ দাও!
আন্নি প্রতিবাদ করলে সাইফ এভাবে তেড়ে আসে—
সাইফ যখন অহনার মেসেঞ্জারে সিঙ্গেল হার্ট ইমোজি দেয়, আন্নি তখন আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখে—একটা মেয়ের ইতিহাস পড়ে যায় সেখানে। যে একদিন ভালোবেসেছিল, আবার একদিন নিজেকেই ভালোবাসতে শিখবে।
সাইফ একদিন চড় মারতে হাত তোলে।
যদিও সেই হাত থেমে যায়, কিন্তু আন্নির আত্মসম্মান থামে না।
শুরু হয় অশান্তি।
ভালোবাসার ঘর, এখন শুধুই অভিযোগের দেওয়াল।
শশুর-শাশুড়ির কাছ থেকেও কোনো সান্ত্বনা মেলেনি। বরং শাশুড়ি বলেছিলেন,
— “ছেলে মানুষ, একটু এদিক-ওদিক করতেই পারে।
সারাদিন কি বউয়ের আঁচলে বাঁধা থাকবে নাকি?”
শশুর আবার গলা গলিয়ে যোগ করেন,
— “ছোট মানুষকে বিয়ে করেছো, এখনও তো কলেজে পড়ে! সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে না?”
আন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো তাঁদের দিকে। যাদের কাছে সে একটু আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছিলো, তারা তাকে আরও ভেঙে দিলো।
আন্নি সবার কথা চুপ করে শোনে শুধু।
তার চোখে এখন আর জল নেই, শুধু একরাশ বিস্ময় আর আত্মসম্মানের স্পষ্ট ছায়া।
রাতের পর রাত ঘুম হয় না আন্নির। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাগুলো শুধু বালিশ ভিজিয়ে যায়। কখনো মনে হয়, ফিরে যাই মায়ের কাছে, আবার মনে পড়ে—মা-ও তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেই পালিয়ে যাওয়ার রাতে।
বলেছিলেন,
“ভালোবাসা দিয়ে সংসার চলে না”—মায়ের বলা কথাগুলো কানের ভেতর এখনো গুনগুন করে।
কিন্তু আন্নি এখনো ভেঙে পড়ে না। কারণ সে জানে, তার ভিতরে এখনো অনেক গল্প বাকি। সে হয়তো একা, হয়তো হারিয়েছে বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রিয় মুখ, কিন্তু তার আত্মসম্মান এখনো জাগ্রত।
……….
রাত গভীর।
জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে, ছায়া ফেলেছে দেওয়ালে।
দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির টিকটিক শব্দটা যেন খুব স্পষ্ট হয়ে বাজে আন্নির কানে।
যেন সময়টাও আন্নির নিঃসঙ্গতা গুনে চলেছে।
সাইফ ফেরেনি এখনও।
আন্নি বসে আছে জানালার ধারে একলা।
রাতটা অদ্ভুতভাবে নিরব।
হাতের ডায়েরির ভাঁজে লুকানো চিঠিটা আজ ও পুড়ছে,
তবে আন্নির চোখে যে জলের ফোঁটা, তা এখন সাইফের প্রতি নয়—
তা নিজের জীবনের প্রতি ক্ষোভ,
নিজের ভুলগুলোকে না বলতে পারার তীব্র আক্ষেপ।
সেদিনের কথা মনে পড়ে—এইচএসসি পরীক্ষার শেষ দিন।
প্রথমবার হাতে হাত ধরে,
সাইফ বলেছিল,
“চলো, সবকিছুকে পেছনে ফেলে আমাদের একটা গল্প লিখি।”
আন্নি বিশ্বাস করেছিল।
ভেবেছিল, ভালোবাসা মানেই মুক্তি।
ভেবেছিল, যেখানেই থাকুক—ভালোবাসার সংসারেই আশ্রয় থাকবে।
কিন্তু কে জানত, সেই গল্পের কালি এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে?
সেই ভুলটা…
এইচ,এস,সি এক্সাম শেষ করেই সাইফের হাত ধরে সব ফেলে চলে যাওয়া।
মা-বাবার চোখের জল, বড় বোন আমেনার রাগ, ছোট ভাইয়ের ভেঙে পড়া মুখ—সব এখন আন্নির বুকের ভেতর ছাইয়ের মতো জমে আছে।
এক বছরের সংসারে, সাইফ একবারও বলেনি—“তুমি আবার পড়ো”।
আন্নির সব স্বপ্ন ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে রান্নাঘরের ধোঁয়া, শাশুড়ির চাহনি, সাইফের চুপ থাকা।
আজ হঠাৎ করে মনে হলো—এই সংসারটা সে নিজেই তো বেছে নিয়েছিল।
তবে কেন এখানে এতটা একা?
কেন তার দু:খটাও এখন শেয়ার করার মতো কেউ নেই?
আজ হঠাৎ বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ঝড় উঠে আছে।
মাথা কাঁপছে, কিন্তু হাত চলে যায় ফোনের দিকে।
হাত কাঁপতে কাঁপতে মোবাইলটা নিয়ে বড় বোন
আমেনার নাম্বারে কল দিল।
কল ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর গলা,
— “হ্যাঁ? কী হয়েছে?”
দূর থেকে বোনের গলা শুনেই কান্না আটকে রাখতে পারল না আন্নি।
কথা না বলে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।
আন্নি এক ফোঁটা স্বরে বলে,
— “আপু… আমি আর পারছি না।”
কিন্তু উল্টো সান্ত্বনা নয়,
বোনের কণ্ঠে উঠে আসে উপেক্ষা আর বিদ্রুপ।
ওপাশ থেকে তীব্র রাগে উত্তর এলো,
— “তখন তো কারো কথা শুনোনি। প্রেমে অন্ধ হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে। এখন কাঁদছো?
মা-বাবাকে ফেলে পালিয়ে গিয়ে এখন চোখে পানি এসেছে?”
মা-বাবা মরলেও খোঁজ নিতে আসবে না তুমি, বুঝে নিও।”
আন্নি নিশ্চুপ হয়ে গেল।
আমেনার কথাগুলো বুকের ভেতর গর্ত করে দেয়।
কোনো উত্তর দেয় নি আন্নি।
চোখের জল মোছে নি, কথা বলে নি, তার সামনে মাথা নোয়ায় নি,
শুধু ফোনটা নিঃশব্দে কেটে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
বুকের ভেতর জমে থাকা জলের সাগর, আজ বালিশ ভিজিয়ে দেয়।
বার বার শুধু বোনের বলা কথাগুলো মাথায় বাজতে থাকল—
“তুমি তো নিজের ইচ্ছেতে নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছিলে।”
সেই রাতে, আন্নি আর কাউকে কিছু বলেনি।
না সাইফকে, না শাশুড়িকে।
নিজের বুকের ভিতরই আগুনটাকে চেপে রাখল।
তবে সেই আগুনের মাঝে একটা স্বপ্ন আবার মাথা তুলল—
ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়া।
পরদিন সকালে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা বানাতে বানাতে ভাবছিল—এই কি তার জীবন?
চা, ডিমভাজি, সাইফের পোশাক ইস্ত্রি করা, শাশুড়ির ওষুধ, বাজারের লিস্ট,
আর… নিজের পছন্দ-অপছন্দ-স্বপ্ন গিলে ফেলা একটা মেয়ের গল্প?
হঠাৎ বুকের গভীর থেকে একটা ইচ্ছা মাথা তোলে।
ডিগ্রিতে ভর্তি হবো। যেভাবেই হোক।
শাশুড়ি ডাইনিং টেবিলে বসতেই আন্নি সাহস করে বলে উঠল,
— “মা, আমি যদি আবার পড়াশোনা শুরু করি? কলেজে ভর্তি হতে চাই ডিগ্রিতে।”
শাশুড়ি থমকে তাকালেন,
তার চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
শাশুড়ির মুখখানা রঙ পাল্টাল এক নিমিষে।
চোখে উঠল অবিশ্বাস, কণ্ঠে ঝলকে উঠল কষ্ট ও শাসন।
— “এই বয়সে আবার কী পড়া? ঘরের কাজ ছেড়ে?
ঘরের কাজ সামলাও, এই তো অনেক হয়েছে!”
তারপর গলা নীচু করলেন,
— “সাইফ জানলে তো একদম মেনে নেবে না। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার?”
সে শুনলে রাগে পুড়ে যাবে!
আন্নির বুকের ভিতর যেন কিছু একটা টুপ করে ভেঙে গেল।সে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
কিছু বলল না।
তার চোখে তখন ঠিকরে পড়ছিল একরাশ প্রতিজ্ঞা।
সেই রাতে আন্নি শুয়ে শুয়ে ভাবছিল—এই ঘরটা কি তার?
নাকি শুধু এক বাঁচিয়ে রাখা শ্বাসের নাম?
তার যদি কোনো জিনিস একান্ত নিজের হয়ে থাকে,
তা শুধু একটা—
তার স্বপ্ন।
পৃথিবীর সবাই ছেড়ে দিলেও,
স্বপ্ন একবার ধরা দিলে,
সে আর হাত ছাড়ে না।
এই স্বপ্নই তার একমাত্র নিজের জিনিস।
কারণ সবাই চলে গেলেও, স্বপ্ন তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
চলবে……….