আলতো বাঁধন পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
16

#আলতো_বাঁধন(ছোটগল্প)
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ২(অন্তিম)

ছাদ থেকে নিচে নেমে অনুভব এক কোণার সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। ঘরে উচ্ছ্বসিত কোলাহল,একরকম উৎসবমুখর পরিবেশ। মনে হচ্ছিল, সব কিছু বুঝি চূড়ান্ত।
কোনো কথা না বলে মোবাইলটা বের করে স্ক্রলিং শুরু করল অনুভব। চোখ হয়তো স্ক্রিনে, কিন্তু মন আর কান কথোপকথনের দিকে।
কিছু সময়ের ভেতরই পুরো পরিবেশটা উপলব্ধি করতে পারল সে।
পাশে এসে বসল ছোটবোন নিহি। চাপা হাসি ঠোঁটের কোণে।
অনুভব নিচু গলায় বলল,
“এখনো এদের প্যাচাল শেষ হলো না? বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়নি?”

নিহি ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে বলল,
“উফ ভাইয়া, তুই তো এখনো একেবারে রসকসহীন রয়ে গেলি! এখানে কাহিনী উল্টে গেছে রে!”

ভ্রু কুঁচকে অনুভব তাকাল,
“মানে?”

রিহি তখন ফিসফিস করে পুরো কাহিনী খুলে বলল। কানে কথাগুলো পৌঁছাতেই, অনুভব চোখ তুলে তাকাল ঘরের দিকটায়। বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। তার মানে, ছাদে পিছনের সাইট দেখা সেই মেয়েটাই প্রথমে পাত্রী ছিল!
হঠাৎ করেই তার বুকের ভেতর কিছু একটা খচখচ করে উঠল। নিজের উপর বিরক্তি ভর করল। কেন সে চলে এলো? কেন ছাদের সেই মুহূর্তে কিছু বলল না, কিছু করল না?

ঘরভর্তি মানুষের হাসি তার কানে কাঁটার মতো বাজলো। কী অবলীলায় সবাই বদল মেনে নিল!
আর সেই মেয়েটার পরিবারও? তাদের পরিবারেরই একজনের চোখের জল কি এদের কারও চোখে পড়ে না?
সবার দিকে তাকিয়ে, অনুভব প্রথমবারের মতো গভীর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার মনে হলো, কেউ একজন নীরবে কান্না করছে,আর পুরো পৃথিবী উদাসীন হয়ে হাসছে। এমনকি তার কাছের মানুষগুলোও!

“কিরে, এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেন, অনুভব ভাই?”
নরম কণ্ঠে পেছন থেকে বলল আরিশ।

অনুভব ধীর চোখে তার দিকে তাকাল। গলায় কোনো উত্তাপ না রেখেই বলল,
“তুই এটা ঠিক করিস নি।”

আরিশ থমকালো।
“মানে?”

অনুভব এবার সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে বলল,
— “তা তুই ভালোই বুঝতে পারছিস।”

আরিশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “অনুভব ভাই, তুমি অন্তত এই কথাটা আর বলো না। জানি তুমি আমাদের সবার চেয়ে আলাদা। কিন্তু এভাবে মুখের ওপর এমন কথা বলে মন খারাপ করে দিও না।”

— “যেটা সত্যি, সেটাই তো বলছি।”

— “ওই মেয়েটার সাথে আমার কিছুতেই মানাবে? তুমি সত্যি করে বলো তো।”

অনুভব এবার কণ্ঠে একটু শীতল রাগ ঢেলে বলল,
— “রঙই কি সব সৌন্দর্য?”

— “হ্যাঁ, অবশ্যই। এখন আবার তুমি উল্টো ব্যাখ্যা কোরো না প্লিজ।”

— “মনের সৌন্দর্য তোরা কবে দেখবি রে, আরিশ?কবে আরেকজনের মনের কষ্টটা বুঝবি তোরা?”

অনুভব উঠে দাঁড়াতেই সবার দৃষ্টি তার দিকে পড়লো।
সে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আরিশের গলা শোনা গেল,
— “কই যাচ্ছ তুমি?”

— “আমি আর এখানে থাকতে পারছি না, আরিশ। বাড়ি ফিরবো।”

আরিশ উঠে এলো, গলায় একরাশ অনুরোধ নিয়ে বলল,
— “না, আমরা ভাবছি আজই সব পাকাপাকি করে ফেলবো। তুমি না থাকলে—আমার এই বিশেষ দিনে, তা কি হয়?”

অনুভব এক ঝটকায় ঘুরে তাকালো। কণ্ঠে ব্যঙ্গ মিশিয়ে শুধালো,
— “এই বাণীগুলো না বললেই ভালো হতো। পাত্রী দেখতে এসে শালিকা যার পছন্দ হয়ে যায়, তার মুখে এমন ‘সত্যি কথা’ শুনে হজমের ওষুধ ঠিক হজম হচ্ছে না।”

— “অনুভব ভাই…”

— “তোর এই তথাকথিত শুভদিনে, আমার উপস্থিতি মুখ দুটোই অশুভ হয়ে উঠুক—এটা আমি চাই না। তোরই খারাপ লাগবে পরে, বুঝে নিস।”

আরিশ থমকে দাঁড়ায়। একটু থেমে কাঁপা গলায় বলল,
— “তুমি এমন বলতে পারলে! তাহলে তুমি আমাকে কোনোদিন ভাই ভাবোনি। শুধু একটা চাচাতো সম্পর্কই মেনে দায়িত্ব পালনে এসেছো তাহলে, তার বাইরে আর কিছু না?”

অনুভব এবার একটু নরম হলো, কিন্তু কণ্ঠে ক্লান্তি ও রাগের দাগ স্পষ্ট,
— “ভেবেছি বলেই তো উঠে যাচ্ছি। কেউ না থাকলে এখনই তোকে দুটো থাপ্পড় দিতাম, জানিস। যাই।”

এই বলে সে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

উঠানে এসে পৌঁছতেই তার চোখ টানল ছাদের কোণায়।
সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে, একা। চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় ওড়ে, মুখ অস্পষ্ট হলেও অনুভবের চোখে স্পষ্ট একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে- একটা মেয়ে, যার চোখে ছিল অসম্মান, যার পাশে ছিল না কেউ, আর যার কান্না ছিল শুধুই নিজের জন্য।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে মনে মনে বলল,
“আমার পরিবারের জন্য… তোমাকে হেনস্থার মুখে পড়তে হলো। ক্ষমা করে দিও।”

কিন্তু অনুভব বেশিদূর এগোতে পারলো না। দরজার কাছে পৌঁছাতেই আরিশ এসে পথ আটকে দাঁড়াল। চোখেমুখে কোনো অভিমান,অদৃশ্য অনুরোধ। অনুভব থেমে দাঁড়ালো—কোলেপিঠে করে মানুষ করা সেই ছোটভাইয়ের এমন শুভদিনে এভাবে চুপচাপ চলে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? সে বুঝে গেল, ইচ্ছে না থাকলেও, আজকের এই ঘটনায় সে নিজেও একটুকরো অন্যায়ের অংশ হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে আন্টির ডাকে যখন রিমি নিচে নামলো, তখন তার চোখে এখনও কান্নার দাগ। তবুও সে মুখে একরাশ হাসি এনে নিচে নামলো।
ভেবেছিল, আজ সে ছাদেই থাকবে, নিজেকে আড়ালে রাখবে।
কিন্তু এক সময় মনে হলো, এই আনন্দের দিনে বোনের পাশে না থেকে সে কি করে পারবে?এই সম্পর্কটা শুধুই এক বিয়ের নয়,এটা ভালোবাসার, যত্নের, বন্ধনের।
রিমি নিজেকে বোঝালো-দুঃখ এখন দূরে রাখতে হবে।
আজ যদি ছোটবোনের জায়গায় সে থাকতো, তবে রিমি-ই কি আগলে রাখতো না সবকিছু?
নিজের মনেই সে উত্তর পেল—
হ্যাঁ, অবশ্যই রাখতো। একজন অভিভাবকের মতো, বুক চিতিয়ে পাশে দাঁড়াতো। তাহলে আজ কেন সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে?

এই ভাঙা হৃদয়ের ভেতরের সঙ্গে এক খণ্ড দায়িত্ববোধ মিশে রিমিকে আবারো টেনে আনলো, সবার মাঝে। কারণ কিছু সম্পর্ক কাঁটার মতো নয়, যারা কাঁটা ছুঁয়ে বুঝিয়ে দেয়-ভালোবাসা শুধু নিজের জন্য নয়, কিছু কিছু আপনজনের জন্যও!
অনুভব মাকে নিয়ে একটু আড়ালে সরে এল। ভিড়ভাট্টা, লোকজনের হাসি-ঠাট্টা থেকে দূরে—শুধু মা আর ছেলে।

সে ধীর গলায় বলল,
“মা, এগুলো ঠিক হচ্ছে না।”

আমেনা বেগম একবারে ছেলের চোখের দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি কী করবো বল? ওদের বাবা-মা যদি এমন সিদ্ধান্তে সায় দেয়, আমি কি গিয়ে কিছু বলতে পারি? তাছাড়া আরিশ তো আমার কাছেও নিজের ছেলের মতোই। তোদের মধ্যে কখনো পার্থক্য করিনি। কিন্তু এখন আমি কিছু বললে সেটা উল্টোভাবে নেবে।”

অনুভব নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। মায়ের বলা কথাগুলো এতটা নির্মমভাবে সত্য।

“কিন্তু জানিস” আমেনা বেগম একটু থেমে যোগ করল,
“ওই বড়ো মেয়েটা না, ভীষণ শান্ত। একটুও উচ্চবাচ্য না করে মেনে নিল সব। তার চেহারাটা… কেমন এক ধরনের মায়া মাখানো! অথচ আমাদেরই লোকজন শুধু রঙ দেখে রায় দিচ্ছে।”

অনুভব হঠাৎ হেসে ফেলল, মায়ের দিকে তাকিয়ে একমুঠো স্নেহ ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার পছন্দ হয়েছে?”

আমেনা বেগম একটু হেসে বলছিলেন, “হ্যাঁ, ভীষণ।”
কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন, চোখে প্রশ্ন ভেসে উঠলো।
“তুই এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

অনুভব গভীরভাবে মায়ের চোখে চোখ রাখল।
তারপর একটিমাত্র বাক্যে উত্তর দিল—
“আমি বিয়ে করবো।”

আমেনা বেগমের মুখে বিস্ময়ের পর খুশির ঝলক দেখা গেল। অবশেষে, তার ছেলে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ের কথা বলছে! কিন্তু পরমুহূর্তেই চোখে ভাঁজ পড়ল চিন্তার, একটু গম্ভীর গলায় বললেন,
“এই কথার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির কী সম্পর্ক? আমি তো কিছুই বুঝলাম না।”

অনুভব মুচকি হেসে মাকে ঠাট্টার সুরে বলল,
“তোমার সাদামাটা মাথায় যেটা আসছে, সেটাই ধরো মা।”

মায়ের চোখে বিস্ময় আরও গাঢ় হয়।
“মানে? মানে… তুই ওই মেয়েটাকে করবি? কিন্তু… এটা তো দেখতে ভালো লাগবে না। ভাইয়ের জন্য যাকে দেখে এলি, পরে তাকেই করবি?”

মায়ের কণ্ঠে স্বাভাবিক দ্বিধা। খুশির মাঝে এক টুকরো সমাজের ভয়।
অনুভব এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
“ওরা যেটা করেছে, সেটার চেয়ে আমি অনেক ভালো কিছুই করছি মা। অন্তত কাউকে হেয় করছি না, কেউ অপমানিত বোধ করবেও না। তোমার বরং আমার উপর গর্ব করা উচিত।”

আমেনা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
“তোকে নিয়ে আমি সবসময়ই গর্ব করি। কিন্তু একটা কথা বল, তুই কি শুধুই মায়া থেকে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস?”

অনুভব একটু থেমে, স্থির গলায় বলল,
“ভালোবাসার প্রথম ধাপটাই তো মায়া, মা। আমি সেই মায়া থেকেই সংসার শুরু করতে চাই। ধাপে ধাপে ভালোবাসাটাও তৈরি হয়ে যাবে।”

মা ছেলের মুখে এক অপূর্ব স্থিরতা দেখলেন। চোখে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের দীপ্তি নিয়ে বললেন,
“আমি রাজি।”

অনুভব মুচকি হেসে মাথা ঝুঁকাল। তারপর চুপিচুপি তাকাল ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে—রিমির দিকে।
তার এলোমেলো চুলে সন্ধ্যার বাতাস খেলা করছে।
সে নিজের মনে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আই প্রমিস, তুমি অনেক ভালো থাকবে। রত্নের কদর সবাই জানে না, কিন্তু আমি জানি—তোমার বোন যদি হয় সোনা, তবে তুমি তার চেয়ে ১০গুণ এগিয়ে একটা রত্ন। করুণার মাঝেই হোক আমাদের ভালোবাসার সূচনা।”

ভিড়ের মাঝেও সেই মুহূর্তটা নিঃশব্দ, অথচ সবচেয়ে গভীর ছিল,যেখানে সম্মান আর অনুভব মিশে এক আশ্চর্য সাহসে রূপ নিল ভালোবাসা। আর একটা সুন্দর সম্পর্কের সূচনা।

#সমাপ্ত
(এটা এটুকুই থাক। থিমটা দিয়ে কয়েকদিন সময় নিয়ে আবারও আসবে গল্প। এরপর থেকে শুরু হবে পরবর্তী পর্ব, সম্পূর্ণ নতুনরূপে, এটা জাস্ট এমনিতে আগের অংশটুকুই । এটা ছোটগল্প হিসেবে ভেবে নিতে পারেন। আবার পরের গল্পের শুরুর দিকও ভাবতে পারেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে