মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৮+১৯

0
11

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৮.
মৃন্ময়ীর বিয়ে। আয়োজন ছোট্ট। কিন্তু আনন্দ উপচে পড়া। মৃত্তিকা-মৃদুলা এত খুশি! তাদের এত বেশি খুশি শেষ কবে দেখেছিল মনে নেই মৃন্ময়ীর। সাজেদা বেগম আজ পুরোদস্তুর ব্যস্ত। মৃন্ময়ীর কাছে আসার সময় পাচ্ছেন না। পূর্বের কথামতো মৃত্তিকা-ই মৃন্ময়ীকে বউ সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। মৃদুলা-ও মায়ের সাথে কাজে ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে সে এসে মৃন্ময়ীর সাজগোজ দেখে যাচ্ছে। মৃত্তিকাকে সাহায্য করছে মৃন্ময়ীর দুই বান্ধবী। মৃন্ময়ী বারবার করে বলছে,
“বেশি সাজাবি না, আমাকে ভূতের মতো লাগবে।”
অনামিকা বলল,
“আরে লাগবে না। আমার বিয়েতে আমি সাজিনি? আমাকে কি ভূতের মতো লেগেছিল?”
“তোর অভ্যাস আছে, আমার তো নেই।”
“চিন্তা করিস না। আমার মতো তোকে ভারি সাজ দিচ্ছে না। তোর হবু বর এসে হতে আমাকে ম্যাসেজে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে আমার মতো যেন তোকে না সাজাই।”
মৃন্ময়ীর আরেক বান্ধবী প্রিয়া দুষ্টুমি করে বলল,
“তার তো তর সইছে না বউকে দেখার জন্য, তাই অল্পতে সাজ শেষ করতে বলছে।”

বান্ধবীর মুখে এ কথা শুনে মৃন্ময়ীর লজ্জা লাগল। প্রিয়া তাকে আরও লজ্জায় ফেলে দেওয়ার পাঁয়তারা করে বলল,
“প্রভাতের নতুন বউ দেখছি লজ্জা পাচ্ছে। বেচারাকে এত ঘুরিয়ে লাভ কী হলো বল তো? সেই তো এখন তার জন্যই বউ সাজছিস।”
অনামিকা বলল,
“ঘুরিয়েছে বলেই তো বুঝতে পেরেছে আমাদের প্রভাত খাঁটি প্রেমিক। সঙ্গে-সঙ্গে পাত্তা দিয়ে দিলে তো বুঝতে পারত না তার মনে কী আছে।”
মৃত্তিকা হেসে বলল,
“একদম ঠিক বলেছ আপু। রাজি হতে এতটা সময় নিয়েছে বলেই আপু প্রভাত ভাইয়ার খাঁটি প্রেম বুঝতে পেরেছে। আমরাও এখন তাকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারছি।”
অনামিকা হাসিমুখে বলল,
“চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রভাতকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো। আমরা জানি ও কেমন ছেলে। মৃন্ময়ী-ই একমাত্র মেয়ে, যার প্রতি ও শুরু থেকে এত লয়াল। মৃন্ময়ীকে যে ও আজীবনে-ও কষ্ট দিবে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকো।”
প্রিয়া বলল,
“এক কথায় বলা যায় আমাদের মৃন্ময়ী ভাগ্যবতী।”
মৃত্তিকা বলল,
“তা-ই যেন হয় আপু। আমার আপার ভাগ্যের পরিবর্তন দেখার বড়ো সাধ আমার মায়ের। আমার আপা যেন বাকি জীবন একটা সুখী সংসার পায়।”

মৃদুলা সেখানে উপস্থিত হয়ে বাকি কথা না শুনলেও, মৃত্তিকার শেষ কথাটা শুনতে পেল। সঙ্গে-সঙ্গে সে বলে উঠল,
“আমার আপাকে যেচে বিয়ে করতে এসেছে মানে তাকে সুখী রাখতেই হবে। নচেৎ আমি নিজ দায়িত্বে দুলাভাইয়ের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাব। আমি আমার আপার মতো অত ভদ্র মানুষ নই।”
মৃত্তিকা তাকে চোখের ইশারায় একটু ধমকে দিলো। অনামিকা শব্দ তুলে হেসে বলল,
“বেচারা প্রভাত যদি জানত বিয়ের আগেই ওর শ্যালিকা ওকে হুমকি দিচ্ছে।”
প্রিয়া বলল,
“ওর জন্য এমন শ্যালিকা-ই ঠিক আছে।”

মৃন্ময়ীকে সাজানো শেষ করে মৃত্তিকা বলল,
“দেখো তো সবাই সাজ ঠিকঠাক আছে কি না?”
মৃত্তিকা বলল,
“ঠিক আছে। এর বেশি সাজানোর দরকার নেই। এতেই আপাকে সুন্দর লাগছে।”
প্রিয়া দুষ্টুমি করে বলল,
“আরে সবাই দেখে কী করবে? একজন দেখলেই হবে। আজ মৃন্ময়ীকে যা মারাত্মক লাগছে, ওই একজন দেখে জ্ঞান না হারালেই হয়।”
মৃন্ময়ী তাকে খোঁচা মেরে মিনমিনে গলায় বলল,
“আর বাজে বকিস না তো।”
প্রিয়া বলল,
“এখন আমার কথা বাজে বকবক-ই মনে হবে। তোমার জামাই যখন হা করে তাকিয়ে থাকবে, তখন বুঝবে আমার কথায় কোনো ভেজাল নেই। এখন প্রভাতের নাম শুনেই লজ্জা লাগছে তো? দুদিন পর দেখব এই লজ্জা কোথায় থাকে।”

প্রভাত-মৃন্ময়ীর বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর যখন তাদের পাশাপাশি বসানো হলো, মৃন্ময়ী তখন লাজুক বধূ হয়ে ঘোমটা টেনে বসে রইল। তা-ও প্রভাত সুযোগ বুঝে ফিসফিসিয়ে বলে বসল,
“আজ তোমায় মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে বউ।”

বউ! ডাকটা শুনেই যেন মৃন্ময়ীর হৃদস্পন্দন এক মুহুর্তের জন্য দ্বিগুণ বেড়ে গেল। লজ্জায় সে মুখ তুলে তাকাল না। যে মুখে সে এই অবধি ‘ম্যাডাম’ ডাক শুনেই অভ্যস্ত, আজ সে মুখ তাকে ‘বউ’ ডাকছে। ভাবা যায়! আজ প্রথমবারের মতো সে কীভাবে প্রভাতের মুখোমুখি হবে, তা নিয়ে সে এখনই চিন্তায় পড়ে গেছে। শুরুটা তার জন্য নিশ্চয়ই সহজ হবে না।

মৃদুলা বারবার বলে রেখেছিল মৃন্ময়ীর বিদায়ে সে একদম কাঁদবে না। কাঁদবে কেন? আজীবনের জন্য তো সে বোনকে বিদায় জানাচ্ছে না। বোনের জীবনের এই সুদিনটি দেখার জন্য সে কত অপেক্ষা করে ছিল। অপেক্ষায় ছিল একজন সুপাত্র এসে কবে তার আপার জীবনটা রাঙিয়ে তুলবে। তার সকল অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। আজ সে হাসিমুখে বোনকে বিদায় জানাবে, সাময়িক বিদায়। সে যতবারই এ কথা বলেছিল, মৃত্তিকা খুব হেসে বলেছিল, ‘সময় আসুক, দেখব কত হাসতে পারিস।’ শেষমেশ গিয়ে মৃত্তিকার কথাই সত্যি হলো। মৃন্ময়ীর বিদায় মুহূর্তে মা যখন তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, নিমেষেই মৃদুলার সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। কাঁদবে না বলে সে নিজেই সবার চেয়ে বেশি কাঁদল। মৃন্ময়ীকে নিয়ে পাত্রপক্ষ বিদায় নেওয়ার পরও তার কান্না থামল না। তখন মৃত্তিকা-ই তাকে শান্ত করতে এগিয়ে এল।


প্রভাতের বাড়িতে প্রথমদিনেই মৃন্ময়ী অবাক হয়ে প্রভাতের সৎ মায়ের কাণ্ড দেখছে। রাহেলা বেগম নিজের কাজের ফাঁকে বারবার এসে তার খোঁজ নিচ্ছে, তার কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছে। বিয়ের চাপে ঠিকঠাক খেতে পেরেছে কি না ভেবে নিজ হাতে মৃন্ময়ীর জন্য খাবার-ও বয়ে এনেছে। মৃন্ময়ী খেতে চায়নি বলে সে নিজেই জোর করে কিছু খাবার খাইয়ে দিয়েছে। খাবার খাইয়ে চলে যাওয়ার আগে সে বারবার করে মৃন্ময়ীকে বলে গিয়েছে যেকোনো প্রয়োজন যেন তাকে বলে। মৃন্ময়ী কেবল মনের ভেতর বিস্ময় চেপে রাখল। বাড়ি এসে হতে মৃন্ময়ীর চারপাশে মহিলাদের আনাগোনা প্রভাতকে বিরক্ত করে তুলেছে। অবশেষে রাতে যখন তার সুযোগ মিলল, ঘরে ঢুকে মৃন্ময়ীর পাশে বসেই সে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“উফ্! অবশেষে মুক্তি মিলল। বিয়ে করলাম আমি, অথচ মানুষজনের জন্য আমি নিজেই আমার বউয়ের কাছে আসার সুযোগ পাচ্ছি না। এ কেমন অবিচার!”
পরক্ষণেই মৃন্ময়ীর নতমুখের দিকে উঁকি মে’রে তাকিয়ে বলল,
“ম্যাডাম দেখি এখনও লাজুক বধূ হয়ে আছেন। কী ব্যাপার? বর পছন্দ হয়নি?”
মৃন্ময়ী তখন লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। মুখ তুলে তাকানোর অবস্থায়-ও নেই সে। এতদিন যাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, আজ তার চোখে চোখ রাখবে কী করে? প্রভাত হেসে বলল,
“এত লজ্জা পেতে হবে না। আমরা তো আর অপরিচিত কেউ নই। আমি তোমার বন্ধু ছিলাম না? কত কথা বলেছো তুমি আমার সাথে। সেভাবে একটু কথা বলো তো। অপরিচিতদের মতো মুখ নুইয়ে রেখো না। দেখি, তাকাও। তোমার বর এদিকে বসে।”

তা-ও মৃন্ময়ী মুখ তুলে তাকাল না। চুপচাপ বসে নখ খুঁটছে সে। প্রভাত আরও একটু এগিয়ে তার গা ঘেঁষে বসল। মৃন্ময়ীর সামনে নিজের দুহাত পেতে ধরে বলল,
“তোমার হাতটা দিবে ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিতে পারল না। প্রভাতের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে হাত চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল সে। প্রভাত তাকে তাড়া দিলো না, অপেক্ষা করল। সময় নিয়ে মৃন্ময়ী নিজের ডান হাতটা তুলে দিলো প্রভাতের হাতে। প্রভাত সে হাতটা অতি যত্নে মুঠোবন্দী করে নিল। বলল,
“এই হাতটা ধরার জন্য আমি অনেক অপেক্ষায় ছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল একদিন আমার জীবনে এই দিনটি আসবে। ফাইনালি আমার অপেক্ষা শেষ হলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর আমি এই হাত ছাড়ছি না ম্যাডাম।”

প্রভাত অনেক কথাই বলল। মৃন্ময়ী কেবল চুপ করে শুনে গেল। প্রভাত আজ একটুও মজা করছে না। তবে মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে প্রভাত নানান কথায় তার মনোভাব সহজ করতে চাইছে। তার লজ্জা ভাঙানোর চেষ্টা করছে। প্রভাত মৃন্ময়ীকে একটা উপহার দিলো। সেই উপহার পেয়ে মৃন্ময়ী যারপরনাই অবাক হলো। কয়েক মাস আগে প্রভাতের তাকে যে গহনা সেট উপহার দিয়েছিল, সে ফিরিয়ে দেওয়াতে যার স্থান হয়েছিল রাস্তার ধারের দিঘির জলে, সেই গহনাগুলোই আজ প্রভাত তাকে উপহার দিয়েছে। মৃন্ময়ী হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। নাহ্, চিনতে তার একদম ভুল হয়নি। এগুলো সেই গহনাগুলোই। মৃন্ময়ী দুচোখে বিস্ময় নিয়ে প্রভাতের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। প্রভাত মুচকি হাসছে। সে বুঝতে পেরেছে মৃন্ময়ীর মনে কী প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। মৃন্ময়ী প্রশ্ন করার আগেই সে প্রশ্ন করল,
“কী ম্যাডাম? চেনা-চেনা লাগছে?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“হুঁ, এগুলো ওই গহনাগুলোই না? কিন্তু তুমি তো ওগুলো পানিতে ফেলে দিয়েছিলে।”
“তোমার স্বামী তোমার জন্য ডুবুরি দিয়ে এই অতি মূল্যবান গহনা উদ্ধার করে এনেছে।”

মৃন্ময়ীর কপালে ভাঁজ পড়ল। প্রভাতের ফাজলামি তার বিশ্বাস হয়নি। প্রভাত হেসে বলল,
“আবার কিনেছিলাম।”
“আবার কেন কিনেছিলে?”
“আগেরগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে দুদিন পর মনে হয়েছিল কাজটা একদম ঠিক হয়নি। রেখে দিলে পরে তোমাকেই দিতে পারতাম। তাই আবার কিনে রেখেছিলাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আবার কেনার দরকার ছিল না।”
“তোমার দরকার না থাকলেও, আমার বউয়ের জন্য আমার দরকার ছিল।”

মৃন্ময়ী মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করল,
“আমার প্রতি তোমার হাসি আসছে না প্রভাত?”
প্রভাত পালটা প্রশ্ন করল,
“হাসি? কেন?”
“বিয়ে করব না বলেও সেই তোমাকেই বিয়ে করলাম যে।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“ওহ্! এই কারণে? নাহ্, আমার হাসি আসছে না। তবে আনন্দ আসছে।”
“হাসি আসছে না?”
“উঁহু। কারণ আমি জানি আগের ওসব কথা তোমার মুখের ছিল। মনে তো আমার জন্য ঠিকই অনুভূতি ছিল, কিন্তু বুঝতে দাওনি। আজো কি মনের কথা লুকিয়ে রাখতে চাও? না কি শোনার সৌভাগ্য হবে আমার?”
মৃন্ময়ী লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রভাত হেসে বলল,
“থাক, লজ্জা পেতে হবে না। একটু সহজ হলে তুমি নিজেই সব বলে দিবে। অবশ্য তুমি না বললেও বুঝে নেওয়ার দৈব শক্তি আছে আমার।”
তারপর প্রভাত মৃন্ময়ীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমার আজ সত্যিই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে মৃন্ময়ী। আজ আমার শুধুই আনন্দের দিন। আমি তোমাকে পেয়েছি। এরচেয়ে বড়ো পাওয়া আর আমার জীবনে দ্বিতীয়টি নেই। শোনো, আজ থেকে আমি তোমার পরিবার, তোমার নিজের মানুষ। তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তোমার যেকোনো সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, সবকিছু আমার সাথে শেয়ার করবে। সবকিছু মনে চেপে রেখে নিজের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না। আমি এটা একদম বরদাস্ত করব না। আজ থেকে তোমার সমস্ত সমস্যা আমার‌। আজ এই মুহূর্ত থেকে সবসময় আমি তোমার মুখে হাসি দেখতে চাই। বাকি জীবন আমি সুখী মৃন্ময়ীর সাথে কা’টাতে চাই। শুনতে পেয়েছ আমার কথা? আজীবন তোমাকে সুখে রাখার জন্য যা করতে হয় আমি করব। কোনো পরিস্থিতিতে আমি তোমায় একা ছাড়ব না। এখন থেকে তুমি একজন নও, দুজন। তুমি আমি, আমি তুমি। মনে থাকবে?”

মৃন্ময়ী মুখে উত্তর না দিয়ে মাথাটা মৃদু দোলাল। প্রভাত ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখল মৃন্ময়ীর চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াতেই সে চট করে মুছে নিচ্ছে। প্রভাত তার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল,
“কাঁদছো কেন? আমি কি তোমাকে বকেছি, না কড়া কথা শুনিয়েছি? দেখি, কান্না বন্ধ করো। বিদায়ের সময় যথেষ্ট কেঁদেছ। মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে জোর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসছি। নতুন বউটাকে আর কাঁদতে দেখতে চাই না।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর চোখের পানি মুছে দিলো। আহ্লাদ পেয়ে মৃন্ময়ীর কান্না থামার বদলে বেড়ে গেল। প্রভাত ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল,
“কী হলো? আরে! কান্নাকাটির কী হলো আবার?”
মৃন্ময়ী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। প্রভাতের এক হাত চেপে ধরে সে ভেজা গলায় বলল,
“সরি প্রভাত। আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি।”
“তোমাকে কে বলেছে আমি কষ্ট পেয়েছি? আমি তো কেবল অপেক্ষা করেছি। তোমায় নিয়ে একসঙ্গে হাসার জন্য অপেক্ষা করেছি। হাসো তো একটু বউ। হাসো, হাসো। কতদিন তোমার হাসি দেখি না!”
মৃন্ময়ী হাসল না। ব্যথিত গলায় বলল,
“আমি ক্লান্ত প্রভাত।”
এতটুকু একটা কথায় যেন আকাশ সমান ব্যথা লুকিয়ে ছিল। সে ব্যথা গিয়ে লাগল প্রভাতের বুকের ভেতরটায়। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে অতি আদরে মৃন্ময়ীর কপালে চুমু খেল। তারপর তাকে যত্ন সহকারে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি জানি এতটা বছর তোমার ওপর দিয়ে কেমন চাপ গিয়েছে। প্রতিটা দিন তুমি কীভাবে বেঁচে ছিলে, আমি সব জানি। আর নয় ম্যাডাম। আজ এখানেই তোমার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-ক্লান্তি বিসর্জন দাও। আমি আর তোমায় পুরোনো জীবনে ফিরতে দিবো না। আজ থেকে আমি তোমায় নিয়ে নতুন জীবনে যাত্রা শুরু করলাম। জীবনের সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা আমি তোমায় উপহার দিবো। আমার হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসা জমা আছে, সবটাই তোমার, কখনও এক চুলও ছাড় দিয়ো না।”


মৃন্ময়ীর বিয়েতে জাহিদ আসেনি। অথচ তার দাওয়াত ছিল দুই পক্ষ থেকেই। দুদিন আগেও সে মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কোন পক্ষে থাকা উচিত। মৃদুলা বলেছিল তার যেদিকে ইচ্ছা থাকতে পারে। যে পক্ষেই থাকুক, অনুষ্ঠান তো একই বাড়িতেই হবে। প্রভাতের কথামতো বরযাত্রী এসেছিল গোটা কয়েক মানুষ। তারমধ্যে জাহিদকে দেখতে না পেয়ে মৃদুলা ভেবেছিল জাহিদ হয়তো তার অতিথি হয়েই আসবে। কিন্তু জাহিদ আসেনি। নিজের ব্যস্ততার মাঝেও মৃদুলা তাকে কয়েকবার কল করেছিল। কলটা-ও রিসিভ করেনি। মৃদুলা আশা করেছিল রাতে আবার কল করে জাহিদের না আসার কারণ জেনে নিবে। কিন্তু জাহিদ রাতে-ও কল রিসিভ করল না। মৃদুলা এখন পড়ে গেছে চিন্তায়। জাহিদ কখনও এমন করে না। মৃদুলা কল দিয়েছে, আর সে ইচ্ছাকৃত কল এড়িয়ে গেছে, এমন আজ পর্যন্ত হয়নি। উলটা কল ঘুরাতে দেরি হলে সে দুঃখ প্রকাশ করে। তবে আজ তার কী হলো? কোনো সমস্যায় পড়েনি তো? না কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? চিন্তায় মৃদুলার দুচোখের ঘুম উড়ে গেছে। অথচ তার সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা এখন একটু বিশ্রাম চাইছে। জাহিদের খোঁজ নেওয়ার কোনো উপায় সে খুঁজে পাচ্ছে না। একমাত্র উপায় ছিল প্রভাত। কিন্তু এত রাতে সে প্রভাতকে-ও বিরক্ত করতে পারবে না। মৃত্তিকা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তারা আজ আপার ঘরে ঘুমাতে এসেছে। মৃদুলা চুপচাপ বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বসার ঘরে আলো জ্বলছে। মৃদুলা নিজেই ওই ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গিয়েছিল। মৃদুলা এগিয়ে গিয়ে দেখল তার মা এই ঘরে আছে। চুপচাপ বসে আছে। মৃদুলা মাকে ডেকে বলল,
“এখানে কী করছো মা? ঘুমাওনি কেন?”
সাজেদা বেগম তাকে দেখে বললেন,
“ঘুম আসছিল না, তাই বসে আছি। তুই ঘুমাসনি কেন?”
“আমারও ঘুম আসছে না।”
মৃদুলা মায়ের পাশে বসল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মুখটা কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে। মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপার জন্য চিন্তা করছো মা?”
সাজেদা বেগম চিন্তিত মুখে বললেন,
“আমার মেয়েটা কি সত্যিই সুখ পাবে রে মৃদুলা?”
মৃদুলা বলল,
“পাবে মা, পাবে। এখনও তুমি ভরসা পাচ্ছ না?”
“ভরসা তো করতে চাইছি, ছেলেটা তো ভরসা করার মতোই মনে হয়। তবু মন থেকে খটকা দূর হচ্ছে না।”
“কটা দিন যাক, নিজের চোখে আপার সুখ দেখলে তোমার মনের খটকা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। এত চিন্তা কোরো না। আপা ভালোই থাকবে। ঘুমাতে যাও, সারাদিন অনেক খাটাখাটুনি করেছ।”
সাজেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ভালো লাগছে না। মেয়েটাকে আর ঘরে হাঁটাচলা করতে দেখব না, ভাবলেই ঘরটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে।”
মৃদুলার মনের কথাই যেন মা বলে দিলো। এখন থেকে আপাকে আর রোজ চোখের সামনে দেখবে না, ছুঁতে পারবে না ভাবলে তারও কষ্ট লাগছে। সাজেদা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“যাই, শুই গিয়ে। তুই ঘুমাবি না?”
“যাচ্ছি।”
‘যাচ্ছি’ বলেও মৃদুলা উঠল না। মা চলে যাওয়ার পরও সে এক জায়গাতেই ঠাঁয় বসে রইল। জাহিদের নাম্বারে আবারও দুবার কল দিলো। এবারে কল-ই ঢুকল না। নাম্বার বন্ধ বলছে। মৃদুলার হঠাৎ চোখ দুটো জ্বলে উঠল। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। আপার অজুহাতে কিছুটা সময় সে কেঁদেও নিল। কেউ দেখল না তার কান্না।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৯.
বিয়ের পর থেকে মৃন্ময়ী রোজ প্রভাতের সঙ্গে তার মায়ের ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করেছে। অথচ প্রভাত তার সঙ্গে কথা-ই বাড়াতে চায় না। প্রসঙ্গ তুললেই এড়িয়ে যায়। মৃন্ময়ীকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে ওই মহিলাকে নিয়ে কথা না বলার জন্য। মৃন্ময়ী হাল ছাড়ে না। এ কদিনে সে স্পষ্ট বুঝে গেছে তাদের মা-ছেলের মধ্যকার সমস্যা গভীর। এটা মোটেও সৎ-মায়ের হিংসাত্মক ঘটনা নয়। কারণ রাহেলা বেগমকে সে যতটুকু দেখেছে, চিনেছে, তাতে তার মনে হয়েছে এই মহিলা একদমই হিংসুটে বা খারাপ মনের মানুষ না। প্রভাতের জন্য তিনি যথেষ্ট মায়া করেন। মৃন্ময়ীর সঙ্গে তার আচার-ব্যবহার এমন যে, মৃন্ময়ীর কখনও মনেই হয়নি এই মহিলা তার সৎ শাশুড়ি। মৃন্ময়ী খুব চেষ্টা করছে এই ভালো মানুষটির সাথে প্রভাতে সম্পর্কের জটিলতার আসল কারণ জানার। এতদিনে সে যতটুকু লক্ষ্য করেছে, তাতে তার মনে হয়েছে সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি প্রভাতের মাঝেই। সে তার মায়ের ধারেকাছেও ঘেঁষে না, যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে। অন্যদিকে রহিমা বেগম বেছে-বেছে প্রভাতের পছন্দের খাবারটা রান্না করার চেষ্টা করেন। প্রভাত ঠিকঠাক খাচ্ছে কি না, তা নিয়েও তার ভাবনার শেষ নেই। খাবার নিয়ে মৃন্ময়ীর সঙ্গেও মহিলা এখন খুব তোড়জোড় করেন। মৃন্ময়ী কোনো খাবার খাবে না বললেও তাকে শোনানো যায় না। তার একটাই কথা, মৃন্ময়ী বয়সের তুলনায় খাবার কম খায়। তার স্বাস্থ্যের জন্য এতটুকু খাবার যথেষ্ট নয়। খাবার নিয়ে মৃন্ময়ীর সাথে এত জোরাজুরি তার মা-ও কখনও করতে পারেনি। কারণ তার ব্যস্ত জীবনে আরামসে বসে খাবার খাওয়া খুব কমই হয়েছে। ফলস্বরূপ তাড়াহুড়ায় দিন-দিন তার খাবারের পরিমাণ-ও কমে গিয়েছে। মৃন্ময়ী মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে যে করে হোক প্রভাতকে চেপে ধরে তার পেট থেকে সত্য কথা বের করবে, আর নয়তো রাহেলা বেগমকেই জিজ্ঞেস করবে। ভেবেচিন্তে আগে সে রাহেলা বেগমের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল। তাই ছুটির দিনে যখন প্রভাত বাড়ির বাইরে গেল, সেই সুযোগ সে কাজে লাগাল। রান্নাঘরে রাহেলা বেগমের সাথে হাতে-হাতে কাজ করতে-করতে কথা গুছিয়ে নিল। তারপর এ-কথা, ও-কথার মাঝে প্রভাতের প্রসঙ্গ টেনে বলল,
“আম্মা, কিছু মনে না করলে প্রভাতের ব্যাপারে দুটো কথা জিজ্ঞেস করব?”
রাহেলা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
“কিছু মনে করব কেন? প্রভাতকে নিয়ে তুমি প্রশ্ন করতেই পারো।”
“প্রশ্নটা আসলে আপনার সাথে প্রভাতের সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে। তাই ভাবছি আপনি আবার কিছু মনে করেন কি না।”
“কী জানতে চাও, বলো।”
রাহেলা বেগমের মাঝে কোনো জড়তা নেই দেখে মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“প্রভাত কেন আপনার কাছ থেকে দূরে সরে থাকে? আমি যতটুকু দেখেছি, আপনি ওকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। তবু এই দূরত্ব কেন? সমস্যাটা আসলে কী বা কার? আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমাকে একটু সত্যিটা বুঝিয়ে বলবেন?”
রাহেলা বেগম বললেন,
“একসঙ্গে থেকে এসব দেখতে তোমার ভালো লাগছে না নিশ্চয়ই?”
মৃন্ময়ী ওপর-নিচে মাথা দোলাল। রাহেলা বেগম বললেন,
“বুঝেছি। এসব আমাদের এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। তুমি পরিবারে নতুন বলে তোমার চোখে লেগেছে। আমাদের সম্পর্ক সবসময়ই এমন।”
“কেন?”
“জানতে যখন চেয়েছ, তোমাকে প্রথম থেকেই খুলে বলি, শোনো।”

মৃন্ময়ী কৌতুহল নিয়ে রাহেলা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাহেলা বেগমের মুখটা হঠাৎ কেমন রং বদলে নিয়েছে। হয়তো দুঃখবোধ থেকে। তিনি বলতে শুরু করলেন,
“আমার প্রথম বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। তখন ঠিকমতো সংসারের কাজ-ও জানতাম না। তবু পরিবারে ভাই-বোন বেশি ছিল, আর বাপের রোজগার কম ছিল বলে বাবা-মা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, সে ছিল আমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী। তারা তিন ভাই ছিল। তিন ভাইয়ের পরিবার একসঙ্গেই থাকত। যৌথ পরিবার ছিল। খুব বড়ো পরিবার। একে তো ঠিকঠাক কাজ জানতাম না, তার ওপর এতগুলো মানুষের রান্নাবান্নার সব কাজ আমাকে দিয়ে করানো হত। তারপর কাপড় ধোয়া, ঘরদোর পরিষ্কার করা। কোনো কারণে কাজ করতে না চাইলে আমার শাশুড়ি যা নয় তা বলে গালাগাল করত। আর তার ছেলে তো কোনোদিন আমার কথা শোনার-ও প্রয়োজন মনে করত না। মা-ভাবিদের মুখে নালিশ শোনামাত্রই গায়ে হাত তুলত। এজন্য শরীর খারাপ হলেও কাউকে বলতে পারতাম না। একা-একা কান্নাকাটি করে আবার কাজে লেগে পড়তাম। কাঁদতে দেখলেও বলত প্রতিবেশীদের কাছে তাদের বদনাম ছড়ানোর জন্য নাটক করি। মায়ের সঙ্গে অনেকবার কেঁদেছিলাম। মায়ের তো আর কিছু করার ছিল না। তার নিজের সংসার-ই চলত ঠেলাগাড়ির মতো। বাবা বলত বয়স কম বলে আমার সহ্যশক্তি কম। সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ আমি যে কী সহ্য করেছিলাম, তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে সব যন্ত্রণা সহ্য করে শ্বশুরবাড়িতেই পড়ে ছিলাম। কিন্তু একদিন চুরির অপবাদ দিয়ে তারা আমাকে এমনভাবে মারল-”
“কিসের চুরির?” কথার মাঝে বাঁধ সেধে প্রশ্ন করল মৃন্ময়ী।
“টাকা চুরির। আমার প্রাক্তন স্বামী টাকা রেখেছিল তার মায়ের কাছে। আমি জানতাম-ও না সেই টাকা উনি কোথায় রেখেছিলেন। দুদিন পরেই শুনি টাকা গায়েব। টাকা না কি রেখেছিলেন বিছানার নিচে। বিছানা গোছাতাম তো আমি, দোষ এসে পড়ল আমার ওপর। আমার কথা কেউই বিশ্বাস করেনি। স্বামী বিশ্বাস না করলে আর কাকেই বা বিশ্বাস করাতাম? সে তার মা-ভাবিদের কথা শুনেই আমাকে মারধর করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। শরীরে মারের দাগ নিয়ে প্রমাণসহ যখন বাবার ঘরে উঠেছিলাম, তখন আমার বাবা আমাকে বিশ্বাস করেছিল। তারপর একমাস কেটে গেলেও আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আমার কোনো খোঁজ নেয়নি, ফিরিয়ে নেওয়া তো দূর। আমারও আর ওই সংসারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। তারপর আমার বাবা লোকজন ধরে তালাকের ব্যবস্থা করে আমাকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তি কি আর এত সহজে মিলে? তখনই আমার শরীরে আরও একটা প্রাণের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর জানতে পেরেছিলাম আমার পেটে দুই মাসের বাচ্চা।”
কথাটা বলেই রাহেলা বেগম থেমে গেলেন। বোধহয় পুরোনো ব্যথাগুলো নতুন করে তিনি অনুভব করতে পারলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“বাচ্চার কথা জানার পর আমার মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। তাই তালাকের সিদ্ধান্ত থেকে পিছাতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সন্তানের জন্য হলেও সংসার নামক নরকে আবার ফিরে যাব। বাবার ঘরে আমি একা মানুষ-ই বাড়তি বোঝা ছিলাম। তার ওপর একটা বাচ্চার দায়িত্ব আমি কাকে দিতাম? আমার বাবা আমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। অথচ সে বাড়িতে যাওয়ার পর আমাদের ঘরের ভেতর পা-ও রাখতে দেয়নি আমার শাশুড়ি। আমার সঙ্গে আমার বাবাকে যা-তা বলে গালাগাল করেছিলেন। বাবা আমার পেটের সন্তানের কথা বলার পর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে। তখন তাদের ছেলে বাড়ি ছিল না। আমি বলেছিলাম তাদের ছেলেকে খবর দিতে। সন্তানের খবর জানার পর আমাকে রাখবে কি না, তা আমার সন্তানের বাবার কথার ওপর নির্ভর করে। তারা তাদের ছেলেকে খবর দিয়ে বাড়ি এনেছিলেন। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আর বাবা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমার শরীর খারাপ লাগছিল। তবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এই আশায় যে, সন্তানের খবর শোনার পর ওর বাবার মন যদি একটু গলে। অথচ আমার প্রাক্তন স্বামী বাড়ি ফিরে আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তার মা ব্যঙ্গ করে আমার সন্তানের কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে সে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেছিল। তার কথা শুনে আমার দুনিয়া নড়ে উঠেছিল। আমি শরীরের শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। তবু তার হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয় বিনয় করেছিলাম যেন আমার সন্তানকে সে ফিরিয়ে না দেয়। আমি নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায় মেনে নিলেও সন্তানের প্রতি এই অবিচার মানতে পারছিলাম না। সন্তানের জন্য আমি সেদিন আমার শাশুড়ির পা পর্যন্ত ধরেছিলাম। আমার বাবা বয়সে বড়ো হয়েও মেয়ে জামাইয়ের হাতে ধরে বহু অনুরোধ করেছিলেন। তবু তারা আমাকে রাখেনি। নিজেদের রক্তের সন্তানসহ তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। পিতৃপরিচয়হীন সন্তান নিয়ে আমার কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। এত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি বিছানা থেকেই উঠতে পারিনি।”

মৃন্ময়ী ব্যথিত দৃষ্টি মেলে রাহেলা বেগমের যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে চেয়ে আছে। মনে-মনে সে ওই জঘন্যতম মানুষগুলোর প্রতি ভীষণ ঘৃণা অনুভব করছে, যারা একটা বাচ্চার প্রতিও একফোঁটা মায়া দেখায়নি। যে লোকটা নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেছে, তাকে কাপুরুষ বলে গালাগাল দিতে ইচ্ছা করছে। মুখ ফুটে সে রাহেলা বেগমকে কিছু বলে সান্ত্বনা-ও দিতে পারছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে। অথচ রাহেলা বেগম কী নির্দ্বিধায় তাকে নিজের জীবনের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে শোনাচ্ছেন। যেন সে তার পুত্রবধূ না, সমবয়সী বান্ধবী। রাহেলা বেগম মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাচ্চাটার কী হলো, কোথায় আছে জানার কৌতুহল জেগেছে, না?”
মৃন্ময়ী ধীর গতিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। রাহেলা বেগমের ঠোঁটের কোণে এক ফালি তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে উঠেও মিলিয়ে গেল। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,
“অসুস্থ হয়ে আমি যখন বিছানায় পড়ে ছিলাম, তখনই আমার স্বামী আমাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার অবস্থা তখন আরও খারাপ হয়ে পড়েছিল। আমার মা আমাকে নাকে-কানে বুঝিয়ে বলেছিলেন বাচ্চাটা না রাখতে। বাচ্চা রাখলে আমার আর বাচ্চার, দুজনের ভবিষ্যত-ই নষ্ট হবে। এক বাচ্চা নিয়ে আমাকে আরেক ঘরে পাঠাতে কষ্ট হবে। আমি রাজি হইনি। যা-ই হোক, নিজের শরীরের অংশকে কে এভাবে মেরে ফেলতে চায়? বাবা শুনে বলেছিল বাচ্চাকে যদি আমি নিজের টাকায় চালাতে পারি, তবেই যেন রাখি। আমি কোথায় টাকা পাব? উপার্জন করার ক্ষমতা তো আমার ছিল না। জীবনে ঘরের বাইরের জগত দেখিনি। বাইরের মানুষের সাথে মিশিনি। একা আমি কীভাবে দুটো জীবন সামলাব? নদীর মাঝখানে পড়ার পরও ছোট্ট একটা প্রাণকে মারার সাহস আমার হচ্ছিল না। সন্তান নিয়ে কীভাবে জীবন-যাপন করব, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা না থাকলেও বাবা-মাকে আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম বাচ্চাটাকে রাখার জন্য। কিন্তু আমি কারোর মন গলাতে পারিনি। অসুস্থ অবস্থায় মা আমাকে ধরে-বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমি গলা ফাটিয়ে এত কেঁদেছিলাম, আমার আজন্ম মনে থাকবে। অমন কান্না হয়তো আমি পুরো জীবনেও কাঁদিনি। একইসঙ্গে সংসার হারিয়ে, বাচ্চা হারিয়ে আমি কেমন পাগল-পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক হতে আমার প্রায় দুই মাস লেগে গিয়েছিল।”

রাহেলা বেগম মোটেও কাঁদছেন না। এত পুরোনো ব্যথা তার বহু আগেই সয়ে গেছে। এখন আর কান্না আসে না। তবে বুকের ভেতরটা জমাট বেঁধে থাকে। জমাট বাঁধা কষ্টটুকু হালকা করতেই হয়তো তিনি আবারও কিছু সময় চুপ রইলেন। মৃন্ময়ী অনুভূতিশূন্য গলায় মৃদু স্বরে জানতে চাইল,
“তারপর কী হয়েছিল?”
রাহেলা বেগম বললেন,
“ছাড়াছাড়ির পর শুধু দশ মাস বাবার বাড়িতে ছিলাম। দশ মাসেই আমার বাবা-মায়ের কাছে আমি বোঝা হয়ে উঠেছিলাম। দশ মাসে আমার বাবা আমার জন্য বিশ বার ঘটক ধরেছিলেন। দশ মাস পর এক ঘটক প্রভাতের বাবার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে গিয়েছিল। ভালো পরিবার, পয়সা দেখে বাবা জেদ ধরে বসেছিলেন এখানেই আমার বিয়ে দিবেন। আমার ইচ্ছা বা মতামতের কোনো গুরুত্ব ছিল না। অভাবের সংসারে বাড়তি বোঝা হয়ে ছিলাম। বাবা-মা বোঝা হালকা করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বয়স কম ছিল, বুঝ-ও কম ছিল; তবু নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছিলাম। এছাড়া তো আর আমার কিছু করার ছিল না। পড়াশোনা যতটুকু জানি, তাতে নাম লেখার চেয়ে বেশি কিছু করা যেত না। যাইহোক, প্রভাতের বাবার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। ঘরোয়াভাবে বিয়ে করে আমাকে এনেছিলেন। বিয়ের আগে শুনেছিলাম তার একটা ছেলে আছে। কিন্তু জানতাম না ছেলে কতটুকু। এ বাড়িতে আসার পর প্রভাতকে দেখেছিলাম। ওর বয়স তখন পনেরো বছর। আমি নিজেই ছিলাম অল্পবয়সী, তার ওপর এক সন্তানহারা মা। আমার জন্য তখন পনেরো বছর বয়সী ছেলেকে সন্তানের স্নেহ দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই প্রভাত আমার কাছ থেকে দূরে থাকত। প্রথমদিকে আমার-ও ওকে ডাকতে অস্বস্তি হত। তাই নিজেও ওকে এড়িয়ে চলতাম। তখন আমার শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। একটা কথা না বললেই নয় মা, এক শাশুড়ি আমাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই, পরবর্তীতে যে আমি মায়ের মতো শাশুড়ি পাব, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রভাতের দাদি আমাকে খুব ভালো জানতেন। কোনোদিন আমার সঙ্গে একটু রেগেও কথা বলেননি। বরং খুব বুঝিয়ে কথা বলতেন। তিনিই আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন প্রভাতকে যেন আমি এড়িয়ে না চলি। নিজের মাকে হারানোর পর থেকে প্রভাত একটু চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমিও যদি ওকে দূরে ঠেলে রাখি, তাহলে ও পরিবারের সঙ্গে থেকেও একা হয়ে পড়বে। তার ওপর ওর বাবার সঙ্গে ওর খুব একটা ভাব ছিল না। ও না কি মায়ের পাগল ছিল। ওর বাবা-ও আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। আস্তে-আস্তে আমি বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলাম। প্রভাত সত্যিই পরিবারের সঙ্গে থেকেও নিজেকে আলাদা করে রাখত। অথচ ওর বয়সটা একা কাটানোর মতো ছিল না। ওকে দেখে আমার তখন খারাপ লাগত। কপালপোড়া আমি এই পরিবারে বউ হয়ে আসার পর আমার জীবনটাই বদলে গিয়েছিল। এই পরিবারে আমি যে সম্মান আর ভালোবাসা পেয়েছিলাম, তা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। অথচ প্রভাত এই পরিবারের ছেলে হয়েও কারোর ভালোবাসা ওর মন ছুঁতে পারত না। ব্যাপারটা খারাপ লাগার মতোই ছিল। তারপর থেকে আমি ওকে কাছে ডাকতাম, ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু ততদিনে প্রভাত যেন আমাকে নিজের শত্রু ভেবে নিয়েছিল। আমি ডাকলেও ও সাড়া দিত না। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথা বলত না। ওর দাদি এত করে বুঝিয়ে বলত আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে, ও তা মানতেই পারত না। বুঝাতে-বুঝাতে বিরক্ত হয়ে ওর বাবা কয়েকদিন ওকে মারতে-ও গিয়েছিলেন, তবু ওকে কোনোভাবেই মানানো যায়নি। উলটো ওর বাবাকে-ও ও পর ভাবতে শুরু করেছিল। এই যে দেখছো না ওর বাবার সঙ্গে ওর কেমন নীরব দূরত্ব, এসবের সূচনা তখন থেকেই। ওর একটাই কথা, ওর মা নেই। নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে ও মা বলে ডাকবে না। যদিও তখন আমার খুব একটা খারাপ লাগত না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম আমি আর কোনোদিন মা হতে পারব না, তারপর থেকেই খারাপ লাগাটা অনুভব করতে পেরেছিলাম। নিজের কোনো সন্তান ছিল না, যাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতে চাইতাম, সে আমাকে মায়ের জায়গা দিতেই নারাজ ছিল। কষ্টটা তখন থেকেই বুকের ভেতর জমাট বেঁধে ছিল। ভেবেছিলাম প্রভাত বড়ো হলে হয়তো বুঝতে পারবে আমি ওর শত্রু নই। তখন হয়তো আমাকে মা ডাকবে। কিন্তু আমার কপালে আর সেই সোনার দিন দেখা হয়ে ওঠেনি। আজ পর্যন্ত-ও প্রভাতের মুখে মা ডাক শোনার ভাগ্য আমার হয়নি। এক ছাদের নিচে থাকি ঠিকই, খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ও আমার সঙ্গে কথাও বলতে চায় না। ওকে টেবিলে খাবার দিয়ে আমার উঠে যেতে হয়। আমার সামনে বসে খেতেও ওর আপত্তি।”

ব্যাপারটা ধরতে পেরে মৃন্ময়ী শুধাল,
“এই কারণেই প্রভাতের খাওয়া শেষ হলে আপনি খেতে বসেন?”
রাহেলা বেগম মাথা ঝাঁকালেন, অর্থাৎ হ্যাঁ। মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তাই বলে প্রভাত এত বছরেও বুঝবে না? আমি ভাবতাম ও একটু পাগলাটে স্বভাবের হলেও চিন্তাধারার দিক থেকে অন্যরকম। এবার বুঝতে পারছি, কেন ও সবসময় আপনার প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলেই এড়িয়ে যায়।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“থাক মা, তুমি এসব নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে যেয়ো না। শুধু-শুধু রেগে যাবে। আমি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কখনও তো এসব কথা কারো সাথে বলি না। আজ তুমি জিজ্ঞেস করেছ বলে বললাম। নইলে আমার মনের কথা মনেই থাকত।”
“আমি তো আপনার ঘরের মানুষ আম্মা। এখন থেকে আপনি আমার সাথে সব কথা বলবেন। কোনো কথা মনে চেপে রাখবেন না।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“বলব মা, বলব। আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমার মতো একটা মেয়ে ঘরের বউ হয়ে আসুক। আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমার শ্বাশুড়ির কাছে আমি যেমন মেয়ের মতো ছিলাম, তুমিও আমার কাছে আমার মেয়ের মতোই থাকবে। আল্লাহর কাছে লাখ-লাখ শুকরিয়া, তিনি আমার ছেলের কপালে এত ভালো মেয়ে জুটিয়ে দিয়েছেন।”
মৃন্ময়ী হাসিমুখে বলল,
“দোয়া করবেন আম্মা, আমি যেন আজীবন আপনাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারি। আর আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি প্রভাতকে বুঝাব। ওকে বুঝতে হবে একজন মাকে ও দূরে সরিয়ে রাখছে। যেচে মায়ের স্নেহ, মমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখনও না বুঝলে আর কবে বুঝবে? ওকে বুঝতেই হবে।”
রাহেলা বেগম চিন্তিত মুখে বারণ করে বললেন,
“না-না মা, এসবের কোনো দরকার নেই। তুমি বলেছ, এটাই আমার কাছে অনেক। আমার কারণে পরে ও তোমার সাথে রাগ করবে।”
মৃন্ময়ী তাকে আস্বস্ত করে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমার সাথে ও রাগ করবে না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আপনার কাছে আপনার সন্তান ফিরিয়ে দিবো। আপনি শুধু আমাকে দোআ করবেন।”


কোচিং থেকে বেরিয়েই রোজকার মতো প্রভাতের হাসিমুখটা চোখে পড়ল মৃন্ময়ীর। তাকে দেখামাত্রই প্রভাত এগিয়ে এসে তার ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। প্রশ্ন করল,
“টায়ার্ড?”
দুদিকে মাথা নেড়ে মৃন্ময়ী বলল,
“টায়ার্ড তো তোমার হওয়ার কথা। এত করে বললাম তাড়াহুড়া করে অফিস থেকে এসে আমাকে নিয়ে যেতে হবে না। এটুকু রাস্তা আমি একাই যেতে পারব। তুমি শুনছোই না।”
“বিয়ের আগে যে বিকেলে একবার স্কুল গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতাম, রাতে আবার কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম?”
“তখন তো আর আমি তোমার বউ ছিলাম না। আর এখন যেখানেই থাকি, সেই তোমার ঘরেই ফিরে যেতে হবে। এরপরও তোমার কী দরকার এত দৌড়ঝাঁপ করার?”
“তোমার কথায় আমি বিকালে স্কুল গেইটে যাওয়া বাদ দিয়েছি। সারাদিন অফিস করে রাতে তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি, তা-ও বারণ করছো?”
“তোমার ভালোর জন্যই তো বলছি।”
“আমার ভালোর কথা ভাবলে তোমার উচিত আমাকে ডেকে তোমার কাছে আনা। তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা থেকে শুরু করে সকালে ঘুম থেকে ওঠা পর্যন্তই তো আমি তোমাকে কাছে পাই। কত অল্প সময়! তোমার উচিত চব্বিশ ঘন্টা আমার কাছে থাকা।”
“তাহলে বরং এক কাজ করি। আমার চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমার অফিসে গিয়ে বসে থাকি। তুমি আমার চেহারা দেখে-দেখে কাজ করো। কেমন হয়?”
প্রভাত চমৎকৃত হয়ে বলল,
“খুবই ভালো হয়। এরচেয়ে ভালো মাস্টার্সের সার্টিফিকেটটা তুলেই তুমি আমার অফিসে জয়েন হয়ে যেয়ো।”
“অ্যাহ্! আমার ইচ্ছা শিক্ষকতা করা, আমি গিয়ে বসে থাকব তোমার অফিসে? বললেই হলো?”
“তাহলে তো আর আমার দৌড়ঝাঁপ করতে হত না। একসঙ্গে কাজ করতে পারতাম। সারাদিন তোমাকে চোখের সামনে পেতাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“সারাদিন চোখের সামনে থাকি না বলেই তো মনের ছটফটানি টের পাও। দেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। এটাই ভালো।”
“কাজ শেষে একসঙ্গে বাড়িও ফিরতে পারতাম।”
“একসঙ্গে বাড়ি ফেরা কি খুব জরুরী?”
“অবশ্যই। অফিস থেকে বেরিয়ে আমি কতক্ষণে বউয়ের মুখ দেখব, সেই তাড়ায় থাকি। আগেভাগে বাড়ি গিয়ে বসে থাকার চেয়ে কোচিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢের ভালো। আর নিজের ভালোর জন্য রাত-বিরাতে তোমাকে একা বাড়ি ফিরতে দিবো, আমি কি এতটাই আহাম্মক?”
“আমার বাড়ি কোচিং থেকে দূরে বলে বিয়ের আগে তোমার চিন্তা ছিল। এখন তো তোমার বাড়ি কাছেই, এটুকু পথ যেতে আমার বিপদ হবে না।”
“আমি রিস্ক নেব কেন? আমার বউয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব অবশ্যই আমার। তুমি হাজারবার বারণ করলেও আমি আসব।”
মৃন্ময়ী হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা এসো। তোমাকে বারণ করাও ভুল।”
“বললাম চাইলে কোচিং ছেড়ে দিতে পারো, তা তো শুনছো না।”
“আগে একটা প্রোপার চাকরি পাই, তারপর ছেড়ে দিবো।”
প্রভাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“তোমার ইচ্ছা। মাকে কল করেছিলে?”
মৃন্ময়ী দাঁতে জিব কে’টে কপাল চাপড়ে বলল,
“ক্লাসের চাপে একদম ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরে কথা বলব নে।”
“আমি কল করার পর তো বলল তার মেয়ে না কি দিন-দিন তাকে ভুলেই যাচ্ছে।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“ওসব তো মায়ের অভিমানী কথা। তাছাড়া মায়ের এখন মেয়ের চেয়ে মেয়ের জামাইয়ের প্রতি দরদ বেশি।”
“হ্যাঁ, জামাই খোঁজ নেয় বলে তোমার নিতে হবে না।”
“হবে না কখন বললাম? নিই তো। মাঝে-মাঝে দেরী হয়ে যায়। মা কী বলল?”
“সে তো নিজের রোগ-শোক লুকিয়ে কথা বলে। মৃত্তিকা বলল মায়ের ডায়াবিটিস এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আছে। সুযোগ বুঝে গিয়ে দেখে এসো। দেখি, কাল-পরশু গিয়ে আমি ঔষধ কিনে দিয়ে আসব।”
“আমি যাওয়ার সময় ঔষধ কিনে নিয়ে যেতে পারব।”
“আমি নিয়ে গেলে তোমার কী সমস্যা?”
“সমস্যা নেই।”
“তাহলে?”
মৃন্ময়ী প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“কী কথা?”
“একটু দাঁড়াও। পরে বাড়ি ফিরি।”
মৃন্ময়ীর সঙ্গে প্রভাত-ও থামল। কৌতুহল নিয়ে সে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“এখানে দাঁড়িয়ে কী কথা বলতে হবে? বাড়ি ফিরে বলতে পারবে না?”
“না, এখনই বলতে চাই। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা।”
“বলো তাহলে।”
“তুমি কেন তোমার মাকে এখনও পর্যন্ত মা বলে ডাকো না?”
প্রশ্ন শুনেই প্রভাত পা চালিয়ে বলল,
“বাড়ি চলো। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
মৃন্ময়ী নড়ল না। এক জায়গাতেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত ফিরে তাকিয়ে বলল,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কথা না শোনা পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ব না।”
“কী মুশকিল! রাত বাড়ছে তো মৃন্ময়ী।”
“বাড়ুক। তুমি চলে যাও, তারপর আমাকে ভূতে ধরুক।”
প্রভাত দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এসব তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা?”
“হ্যাঁ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। কারণ তুমি ইচ্ছা করে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছ। আম্মা তোমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তা চোখে দেখেও দেখো না। কেন প্রভাত? তুমি জানো আম্মা মনে-মনে কত কষ্ট পান?”
প্রভাত সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি তোমাকে বারবার বলেছি এসব নিয়ে না ঘাঁটতে। তবু তুমি কেন সবসময় এই প্রসঙ্গ-ই টানো?”
মৃন্ময়ী বেজার মুখে বলল,
“তুমি আমার সাথে রাগ করছো?”
প্রভাত হোঁচট খেয়ে বলল,
“রাগ কখন করলাম?”
“এই তো মাত্রই করলে।”
“রাগ করিনি।”
“তাহলে বিরক্ত তো হয়েছ।”
“না।”
“বললেই হলো? তুমি তাহলে আজকাল আমার ওপর বিরক্ত হতে শুরু করেছ?”
প্রভাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“না রে বাবা, থুক্কু, বউ। তুমি হঠাৎ কেন বাচ্চামি করছো? অদ্ভুত!”
“তাহলে তুমি আমার কথা শুনছো না কেন?”
প্রভাত এগিয়ে এসে মৃন্ময়ীর হাত ধরে বলল,
“এমন অদ্ভুত আচরণ কোরো না ম্যাডাম। বাড়ি চলো প্লিজ।”
মৃন্ময়ী বলল,
“একটু বসে আমার দুটো কথা শোনার ধৈর্য তোমার নেই? আম্মার প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইছি বলে? তুমি কখনও তাকে বুঝতে চেয়েছ? জানো তার মনে কত দুঃখ? আজীবন সে কত কষ্ট ভোগ করে তোমাদের সংসারে এসেছিল? তোমাকে সে এত ভালোবাসে, তবু তুমি কোন কারণে এখনও তাকে এড়িয়ে চলো? তার সাথে আমার কথা হয়েছে। সে তার মনে চেপে রাখা সব কথা আমাকে বলেছে, যার এক অংশ-ও তুমি জানো না। তুমি শুধু নিজেকে মায়ের ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো না, একজন মাকে-ও সন্তানের ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো। কেন প্রভাত?”
“আমার মা বহু আগেই মরে গেছে। চলো।”
“তুমি কি চাও ভবিষ্যতে তোমার সন্তান নিজের বাবার আর দাদির সম্পর্কের জটিলতা দেখুক? তুমি এমন করলে তোমার সন্তান তোমার কাছ থেকে কি শিখবে, বলবে আমাকে?”
প্রভাত অনুরোধের সুরে বলল,
“এসব বাদ দাও না প্লিজ।”
“উঁহু, আজ তোমাকে এসব বিষয় ক্লিয়ার করতেই হবে। নইলে আমি এখান থেকে নড়ব না।”
“কেন এমন করছো?”
মৃন্ময়ী প্রভাতের হাত চেপে ধরে মুখ ফুলিয়ে ডাকল,
“প্রভাত-”

এরপর আর প্রভাত কথা বাড়াতে পারল না। মৃন্ময়ী গাল ফুলিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এ চাহনি এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। এমন সাধ্য সে কোনোদিন পেতে-ও চায় না। শেষমেশ প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বলো, শুনছি।”
মৃন্ময়ী খুশি হয়ে বলল,
“চলো বসি।”
“বসতে হবে?”
“হ্যাঁ। চা-ও খাব।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর হাতটা মুঠোয় নিয়েই হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“হঠাৎ এমন ত্যাড়ামি কোত্থেকে শিখলে?”
একগাল হেসে মৃন্ময়ী বলল,
“হঠাৎ কোথায়? এক ত্যাড়া মানুষ যতদিন ধরে আমার পিছু নিয়েছে, ততদিন ধরেই তো হাতে-কলমে ত্যাড়ামি শিখে আসছি।”
প্রভাত হেসে ফেলল। বলল,
“আচ্ছা, সুযোগ বুঝে খোঁচা মারা হচ্ছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“একদমই না। আমি তো কেবল সত্য কথা বললাম। একদম ভেজালহীন সত্য কথা।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে