মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৬+১৭

0
6

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
আহমদ তরফদার মৃন্ময়ীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। মৃন্ময়ীর মায়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। মৃন্ময়ীকে দেখতে যাওয়ার কথা বলেছেন। মৃন্ময়ীর মা এবারেও মৃন্ময়ীকে না জানিয়ে পাত্রপক্ষকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে দিয়েছেন। প্রভাত ভাবেনি বাবা এত সহজে রাজি হয়ে যাবে। সে ভেবেই নিয়েছিল ব্যাপারটা নিয়ে বাড়িতে আরও কদিন যুদ্ধবিগ্রহ চলবে। কিন্তু তার উলটোটা হওয়ায় সে একটু অবাকই হয়েছে। আহমদ তরফদার এত সোজা মানুষ না। কী ভেবে হঠাৎ নিজে থেকেই রাজি হয়ে গেলেন জানা নেই প্রভাতের। তবু ঝামেলা না বাড়ায় সে মনে-মনে খুশি হয়েছে। অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করছে পাত্র হয়ে মৃন্ময়ীকে দেখতে যাওয়ার। তার চেয়েও বড়ো অপেক্ষা বর সেজে যাওয়ার। যদিও তার জন্য তাকে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। প্রস্তাব পাঠানোর পর আবার মৃন্ময়ী তাকে কী কথাবার্তা বলে, তা-ও শুনতে হবে। এই মেয়েটার ত্যাড়ামিই এখন তার সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তার কারণ। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আর সাজেদা বেগম প্রভাতের পরিবারকে আসতে বলে দিয়েছেন, এই খবর মৃন্ময়ীকে প্রথমে দিলো মৃদুলা। খবর শুনে মৃন্ময়ী কিছু মুহূর্তের জন্য পুরোপুরি আহাম্মক বনে গেল। এবার আর সে মাকে জিজ্ঞেস করতে ছুটে গেল না। সবার আগে জিজ্ঞেস করল প্রভাতকে। আজ সে প্রভাতকে সরাসরি কল করে বসল। অন্য সময় হলে প্রভাত অবাক হত। আজ কাল পেয়ে অবাক হলো না। রিসিভ করে হাসিমুখে কথা বলল,
“ম্যাডাম আজকাল আমাকে এত বেশি মিস করছেন?”
মৃন্ময়ী সে কথার উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
“এটা কি করলে প্রভাত?”
“কী করলাম?” না বুঝার ভান করে শুধাল প্রভাত।
“তুমি জানো না তুমি কী করেছ?”
“ওহ্! বিয়ের কথা বলছো?”
“তুমি আমাকে জানিয়ে এটা কেন করলে?”
“না জানিয়ে কোথায়? তোমাকেই তো সবার আগে জানিয়েছিলাম। সেদিন যে বললাম, মনে নেই তোমার?”
“তাই বলে এতদূর? মায়ের সাথে কখন যোগাযোগ করলে, কখন বাড়ি আসার কথাবার্তা হলো, কোনোকিছু আমাকে জানিয়েছ তুমি?”
“জানালে কী হত?’
“কী হত মানে? এত বড়ো একটা ব্যাপার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?”
“জানালে বাঁধা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে?”
এবার আর মৃন্ময়ী উত্তর দিতে পারল না। সত্যিই তো। বাঁধা দেওয়া ছাড়া আর কীইবা বলত সে? প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“সত্য কথা শুনে চুপ হয়ে গেলে তো? এজন্যই তোমাকে জানাইনি। বাঁধা তো আমি তোমাকে দিতেই দিবো না।”
“এটা কেমন কাজ প্রভাত? তুমিও দেখি আমার মায়ের মতো আচরণ করছো।”
“শাশুড়ির আদরের হবু জামাই তো, তাই।”
“একটা সত্যি কথা বলো তো। মাকে তুমি কীভাবে পটালে?”
“আমার ভালোবাসার শক্তি দিয়ে।”
“ফাজলামি কোরো না, সিরিয়াসলি বলো।”
“একসঙ্গে এতকিছু জেনে কী করবে? একটু অপেক্ষা করো। বিয়ের পর তো সবসময় আমাকে কাছেই পাবে। তখন একান্তে বসে সব প্রশ্নের উত্তর জেনে নিয়ো।”
প্রভাত সবকিছুতে এত ত্যাড়া কথা বলে! অথচ মৃন্ময়ীর কাছে বর্তমান পরিস্থিতি খুবই সিরিয়াস। প্রভাত এমন ত্যাড়া কথা বললে কীভাবে হবে?


মায়ের সাথে মৃন্ময়ীর কথা হয়েছে। বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই মা যেভাবে তাকে কড়া গলায় কথা শুনালেন! সাথে এ-ও বললেন, এই প্রভাতকে পছন্দ করার কারণেই না কি এতদিন তার কোনো ছেলেকে পছন্দ হয়নি। মৃন্ময়ী অস্বীকার করলেও মা তার কথা মানতে নারাজ। ওদিকে প্রভাত-ও নাছোড়বান্দা। যতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, ততবারই সে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে পিছাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। মৃন্ময়ীর কোনো অজুহাত-ই সে কানে তুলছে না। তার এক কথা, ‘হয় এবার তোমাকে বিয়ে করব, নয় আজন্মের মতো বিয়ের‌ নাম ভুলব।’ মৃন্ময়ী না পারছে কাউকে কিছু বুঝাতে, না পারছে নিজেকে বুঝাতে। অথচ এসব ক্যাচাল চলতে-চলতেই প্রভাতের প্রতিক্ষার দিন ফুরিয়ে এল। আগামীকাল তারা মৃন্ময়ীকে দেখতে আসবে। ঘরে বসে মৃন্ময়ী এসব নিয়েই আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিল। তার চিন্তা-ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাল মৃত্তিকা আর মৃদুলা। তারা দুজন হঠাৎ রুমে এসে উপস্থিত হলো। মৃত্তিকা বিছানায় বসতে-বসতে জিজ্ঞেস করল,
“কী করছিস আপা?”
মৃন্ময়ী দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোরা না ঘুমিয়ে এখানে কী করছিস?”
মৃদুলা বলল,
“আমরা তোমার সাথে গল্প করতে আসতে পারি না?”
“তা পারবি না কেন? বোস।”
মৃদুলা বসল। মৃত্তিকা শুধাল,
“কালকের বিষয়ে কী ভাবলি আপা?”
মৃন্ময়ী বলল,
“এই তোদের গল্পের বিষয়?”
মৃদুলা তার একহাত ধরে বলল,
“আহা আপা! রাগ কোরো না। কালকের বিষয়টা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাথে একটু কথাবার্তা বলো না ওই বিষয়ে।”
“কী আর বলব বল? মা আমার কোনো কথা কানে তুলছে?”
“মায়ের কথা আপাতত বাদ দাও। সে তো আজীবনই এমন। তুমি আমাদের সাথে কথা বলো।”
মৃত্তিকা বলল,
“হ্যাঁ আপা, আমরা তোর সব কথা শুনতে চাই। তোর মনে যা চলছে বল আমাদের সাথে।”
মৃন্ময়ী মলিন মুখে বলল,
“আমার মনে যা চলছে সবটাই কনফিউশন রে।”
“কিসের কনফিউশন? তুই কি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিস?”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
মৃদুলা বলল,
“হয়তো স্বাভাবিক। তবু একটা মানুষ এত করে বুঝানোর পরও তোমার কনফিউশন কীভাবে থাকে আপা? এত কনফিউশন নিয়ে কি জীবন চলে?”
মৃন্ময়ী তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি রে মৃদুলা, একটা মেয়ে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে থাকলে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতেও সাহস পায় না, কনফিউশনে ভোগে। নইলে একটা সুখী জীবন কি আমার-ও প্রাপ্য ছিল না, বল?”
মৃত্তিকা বলল,
“প্রাপ্য বলেই তো আমরা তোর সাথে কথা বলতে চাইছি আপা। তোর মনে আমাদের নিয়ে কনফিউশন চলছে তো? প্লিজ তুই এই কনফিউশন থেকে বেরিয়ে আয়।”
“কীভাবে? কীভাবে বেরোতে বলছিস তোরা আমাকে? বিয়ে করে? বিয়ে করলেই আমার কনফিউশন কে’টে যাবে?”
“বিয়ে করলে তোর কনফিউশন কাটবে না। তোকে কনফিউশন কাটিয়ে বিয়ে করতে হবে। যতদিন তুই মনের ভেতর কনফিউশন রাখবি, ততদিন তুই বিয়ের কথাও ভাবতে পারবি না।”
“কার ভরসায় আমি কনফিউশন কাটাব রে? কে আছে আমাদের? বাবা তো নেই।”

কথাটা বলতে গিয়ে মৃন্ময়ীর গলা ধরে গেল, চোখ ভর্তি জল চলে এল। মৃত্তিকা তার হাত চেপে ধরে বলল,
“আপা, কার জীবনের দৈর্ঘ্য কতটুকু তা আমরা কেউ জানি না। আজ আমরা এই পরিস্থিতিতে আছি। আল্লাহ্ চাইলে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে। আমরা আজীবন এমন থাকব না। সবার জীবন পালটাবে। তোর জীবন-ও পালটাবে। জীবনের শেষ অবধি তুই একা কাটাতে পারবি না, এটা তোর নিজের প্রতি করা সবচেয়ে বড়ো অন্যায় হবে। অন্তত একজন মানুষকে আকড়ে ধরে বাকি জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একসঙ্গে জীবনযাপন করার জন্য হলেও তোকে বিয়ে করতে হবে। কারোর পছন্দে তোকে বিয়ে করতে হবে না। তোর যাকে নিজের জন্য সঠিক মনে হবে, যার সাথে তোর একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের সম্ভাবনা দেখবি, তাকেই বিয়ে করবি।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুইও তো নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলি মৃত্তিকা। শেষ পর্যন্ত শান্তি রয়েছে?”
“রয়নি, কারণ আমি ভুল মানুষকে পছন্দ করেছিলাম। আমি জানি তুই আমার মতো সেই ভুল করবি না। প্রভাত ভাই তোর জন্য কতটুকু সঠিক, তা তো আমাদের চেয়েও তোর মন ভালো জানে। তাই না, বল? তোর কি মনে হয়, প্রভাত ভাই আর শফিক এক পাল্লার মানুষ?”
মৃন্ময়ী ডানে-বায়ে মাথা দোলাল। মৃত্তিকা আবারও শুধাল,
“এতদিনে প্রভাত ভাইকে যতটুকু চিনেছিস তাতে কি ওনাকে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ মনে হয়?”
মৃন্ময়ী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মৃত্তিকা বলল,
“সত্যি করে বল।”
“মিথ্যা কোথায় বললাম? লোকের কাছে ও মানুষ যেমনই হোক, যারা ওকে কাছ থেকে চিনে তারাই শুধু জানে ওর মনটা আসলেই ভালো।”
“তারমানে তুই ওনাকে বিশ্বাস করিস?”
মৃন্ময়ী একটু ইতস্তত করে উত্তর দিলো,
“ওই… করি। অবিশ্বাস করার তো কারণ নেই।”
“তবু তো করছিস।”
“কোথায়?”
“এই যে নিজের জীবনের ক্ষেত্রে। ওনার প্রতি বিশ্বাস থাকলে তোর এত কনফিউশনে ভোগার প্রশ্নই আসত না।”
মৃন্ময়ী আবারও প্রত্যুত্তর হারাল। মৃদুলা বলল,
“আচ্ছা আপা, তোমার কি মনে হয় প্রভাত ভাই তোমাকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,
“হুম।”
“তুমি তাকে ভালোবাসো?”
“মৃদুলা, বেশি পেকে গেছিস। নিজের কাজে যা।”
মৃন্ময়ীর কপট রাগ দেখে মৃদুলা হেসে বলল,
“দেখেছ? তুমিও তবে প্রভাত ভাইকে ভালোবাসো। কিন্তু স্বীকার করতে চাও না।”
মৃত্তিকা বলল,
“সে তোকে ভালোবাসে, তুইও তাকে ভালোবাসিস। দুজনের ভালোবাসা-ই সত্যি। একজন আরেকজনকে বুঝতে পারিস। তোরা একে অপরের জন্য পারফেক্ট। এর বেশি আর কী চাই? ভরসা রাখ আপা, উনি তোকে হতাশ করবেন না।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি জানি রে। ওকে নিয়ে আমার তেমন ভয় নেই। আমি জানি ও আমাকে ভালো-ই রাখতে চায়। কথা দিয়ে তা ভাঙার মানুষ ও না। ও আমাকে এ-ও বলেছে যে, আমার পরিবারকে ও নিজের পরিবার ভাববে। আমার কোনো সিদ্ধান্তে, কোনো কাজে বাঁধা দিবে না। তবু বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবন তো এক হয় না।”
মৃদুলা বলল,
“প্রভাত ভাই যখন কথা দিয়েছে, তখন সব ঠিকঠাক থাকবে আপা। দেখো, আপুর ডেলিভারির পর তো আবার সে কাজে যাবে। দরকার হলে আমিও টিউশন বাড়িয়ে নেব। আমাদের জীবন চলে যাবে আপা।”

মৃত্তিকা-ও গলা মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আপা, তুই আর এসব নিয়ে ভাবিস না। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আমি মাকে আর মৃদুলাকে দেখে রাখব। প্রভাত ভাইকে যতটুকু চিনেছি, তাতে আমার-ও মনে হয় না সে তার কথা ভাঙবে। প্লিজ আপা, তুই এবার শুধু নিজেকে নিয়ে ভাব। আমরা স্বার্থপরের মতো আর তোকে ধরে রাখতে চাই না। মা তোকে নিয়ে দিন-রাত দুশ্চিন্তা করে। তার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে দেখ। সে শুধু তোর একটা সুন্দর, সুখী সংসার দেখতে চায়।”
মৃদুলা অনুরোধের সুরে বলল,
“প্লিজ আপা, এবার আর ‘না’ কোরো না। প্রভাত ভাইয়ের মতো মানুষ হারালে এমন মানুষ আবার তোমার জীবনে আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। মা এবার অনেক আশা নিয়ে আছে।”
মৃন্ময়ী কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করল না। তার মাথা কেমন ফাঁকা লাগছে। মনটা এত বেশি আবেগী হয়ে উঠেছে যে চোখ দুটো বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ কেমন কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ল সে?


প্রভাতসহ তার বাবা, মা আর চাচি এসেছে মৃন্ময়ীর বাড়িতে। মৃন্ময়ীর মা তাদের খুশিমনে আপ্যায়ন করছেন। মৃদুলা সব কাজে মাকে সাহায্য করছে। মৃত্তিকা চেপে ধরেছে মৃন্ময়ীকে। মৃন্ময়ী সাজগোজ করতে নারাজ ছিল। মৃত্তিকা তাকে শাড়ি পরিয়ে হালকা সাজিয়ে ছেড়েছে। তাকে ভীষণ আনন্দিত দেখাচ্ছে। মৃন্ময়ী খেয়াল করে বলল,
“তুই এত খুশি কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“খুশি হব না? আমার বড়ো আপার বিয়ে বলে কথা! কত্ত অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।”
“এখনও সামনেই গেলাম না, বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”
“সামনে গেলেই তো বিয়ে ফাইনাল।”
“তোকে বলেছে?”
মৃত্তিকা হাসিমুখে বলল,
“আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি।”
“কী বুঝেছিস?”
“এই যে তারা মূলত তোকে পুত্রবধূ করার পাকাপোক্ত পরিকল্পনা নিয়েই দেখতে এসেছে। শোন আপা, তোর বিয়ের দিন-ও কিন্তু আমি-ই তোকে সাজিয়ে দিবো। তোকে বউ সাজানোর খুব শখ আমার।”
“কেন?”
“জানি না। শুধু জানি আমার মন শান্তি পাবে।”
মৃন্ময়ী হাসল। সময় দেখতে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে থাকা প্রভাতের ম্যাসেজ চোখে পড়ল। আরও দশ মিনিট আগে সে লিখেছে,
“কত সাজছো ম্যাডাম? তোমাকে না বলেছিলাম সাজগোজের পেছনে বেশি সময় নষ্ট করবে না? তুমি আজ মুখে এক থাবা কালি মেখে এলেও আমি তোমাকে বউ বানিয়ে ছাড়ব। তাড়াতাড়ি এসো না। বসে থাকতে-থাকতে আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেল। হার্টটাকে-ও আর সামলানো যাচ্ছে না। দ্রুত দেখা দিয়ে আমাকে বাঁচাও প্লিজ।”

পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে মৃন্ময়ী লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারল না। পাত্রের জায়গায় প্রভাত বসে বলেই হয়তো তার লজ্জা এবার আকাশ ছুঁয়েছে। অন্যান্যবার পাত্রপক্ষের মহিলারা যেভাবে তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করেছিল, এবার মৃন্ময়ীর সাথে তেমনটা হলো না। হাতেগোনা কয়েকটা প্রশ্ন করল প্রভাতের মা-চাচি। মৃন্ময়ী বুঝতে পারল তারা আগে থেকে সবকিছু জেনেই এসেছেন, বিধায় অত প্রশ্নের ঝঞ্ঝাটে যাচ্ছেন না। একটা ব্যাপার না চাইতেও মৃন্ময়ীর নজরে পড়ল। তা হচ্ছে প্রভাতের মায়ের আচরণ। মহিলা হাসিমুখে খুব সুন্দরভাবে কথা বলছেন। মায়ের কাছে প্রভাতের-ও খুব প্রশংসা করছেন। কিন্তু প্রভাত যে বলেছিল তার মা তাকে ছেলে মনে করে না? মায়ের প্রতি তার যা অভিযোগ, তাতে মৃন্ময়ী ভেবেই নিয়েছিল মহিলা হয়তো ভীষণ খারাপ ধরনের। কথাবার্তা কটু, আচরণ অসহ্যকর। অথচ এখন মনে হচ্ছে তার কল্পনা পুরোটাই ভুল। মহিলা তো সম্পূর্ণ-ই তার বিপরীত ধরনের মানুষ। কিন্তু মহিলা কি সত্যিই এমন? না কি এটা কেবলই লোকদেখানো ভালোমানুষী? প্রভাত-ই বা তাকে মিথ্যা বলবে কেন? মৃন্ময়ী কেমন কনফিউশনে পড়ে গেল। বিয়ে-টিয়ের চিন্তা-ভাবনা রেখে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে বসে আছে মহিলার দিকে। কৌতুহলবশত লজ্জা ডিঙিয়ে সে একবার মাথা তুলে তাকাল কেবল মহিলার মুখটা দেখার জন্য। দেখতেও সে যথেষ্ট সুশ্রী। হাসি-হাসি মুখ। বয়সটা হয়তো মৃন্ময়ীর মায়ের চেয়েও কম। এই মহিলা প্রভাতের সৎ-মা, তা-ই আর মৃন্ময়ীর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল না। কী আশ্চর্য ব্যাপার!

মূর্তির মতো চুপটি করে বসে থাকতে মৃন্ময়ীর ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। ভাগ্যিস তাকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়নি। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরেই তাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সে ভেতরে চলে আসার পর মায়ের সাথে পাত্রপক্ষের আলোচনা বসল। মৃদুলা আর মৃত্তিকা আড়াল থেকে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে সেই আলোচনা শোনার জন্য। মৃন্ময়ী ধরেই নিয়েছিল এবারেও মা একই কাজ করবে। তাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করেই পাত্রপক্ষকে আশা দিয়ে বসবে। কিন্তু মৃত্তিকা আর মৃদুলা এসে খবর দিলো মা এবার তেমনটা করেইনি। বরং সে বলে দিয়েছে মেয়ের সাথে কথা বলে তাদের জানাবেন। প্রভাতের মা না কি এ-ও বলেছিলেন যে, তারা চাইলে আজ-ই নিজেদের মধ্যে স্বল্প আয়োজনে বিয়ের কাজ সেরে ফেলবেন। তাদের না আছে কোনোরকম দাবিদাওয়া, না চান বড়ো আয়োজন। তবু সাজেদা বেগম একটু সময় চেয়েছেন। তাড়াহুড়া করে তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান না। মৃন্ময়ী বেশ বুঝতে পারল মৃদুলা আগেভাগে মাকে সব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রভাতের বিষয়টা-ও যে মাকে এই মেয়ে-ই বুঝিয়েছে, এ-ও মৃন্ময়ী ঢের বুঝতে পেরেছে। এবার তিনজন জোট বেঁধে একসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমেছে তাকে বিদায় করার জন্য।


পরদিন স্কুল ছুটির পর মৃন্ময়ী রাস্তায় বেরোনোর সাহস পেল না। ভয়ে নয়, লজ্জায়। রাস্তায় বেরোলেই প্রভাতের মুখোমুখি হতে হবে যে! গতকালের ঘটনার পর মৃন্ময়ী প্রভাতের মুখোমুখি হতেই চাইছে না। ওই ছেলের মুখ যা লাগাম ছাড়া, দেখা হলেই কী না কী বলে দিবে! কিন্তু ছুটির পর মৃন্ময়ী কতক্ষণ-ই বা বসে থাকতে পারবে? ইতোমধ্যে ক্লাসরুমগুলোতে তালা পড়ে গেছে। টিচার্স রুমে-ও এক্ষুনি তালা পড়বে। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে মৃন্ময়ী স্কুল থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গে যম তার সামনে উপস্থিত হলো। অবশ্য যম মহাশয় আগে থেকেই অপেক্ষারত ছিল। মৃন্ময়ীকে দেখেই সে প্রশ্ন করল,
“এত দেরী করে বেরোলে যে?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
ছোটো করে উত্তর দিয়েই মৃন্ময়ী নিজের মনে হাঁটা দিলো। প্রভাত তার সাথে হাঁটতে-হাঁটতে তার মুখোভাব লক্ষ্য করল। তারপর প্রশ্ন করল,
“তুমি কি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছ? ম্যাডাম? কথা বলছো না যে?”
মৃন্ময়ী গম্ভীর মুখে বলল,
“কিছু বলার নেই।”
“বিয়ের ব্যাপারেও না?”
“আমার কথা শোনার প্রয়োজন আছে তোমাদের?”
“অবশ্যই আছে, যদি তোমার কথা শোনার মতো হয়।”
“আমার কথা তো শোনার মতোই না। তোমাদের সব কথা শোনার মতো।”
“উঁহু, এখনই এত ঝগড়া করলে হবে? বিয়ের পরের জন্য কিছু বাকি রাখো।”
“তোমাকে কে বিয়ে করবে?”
“অবশ্যই তুমি। বিয়ের জন্য সবাই প্রস্তুত হয়ে আছে, এখনও কনফিউজড থাকলে চলবে?”
“আমরা সময় চেয়েছি, এখনও মতামত জানাইনি।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আমি জানি তো তোমার মনের মতামত। মুখে যতই ‘বিয়ে করব না, করব না’ করো, মনে-মনে যে আমার বউ সাজার স্বপ্ন বুনছো, তা আর অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি সব জানি।”
“তুমি তো সবজান্তা শমসের।”
“শুধু তোমার জন্য।”

ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে বাড়িয়ে ধরল। প্রভাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বিয়ে ভাঙার জন্য হবু বরকে ঘুষ দিচ্ছ না কি? তাহলে পাঁচ কোটি টাকা দিলেও আমি রাজি নই, দুঃখিত। আমার ভালোবাসার মূল্য এত কম নয়।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“তোমাকে ঘুষ কে দিচ্ছে? এটা তোমার পাওনা টাকা।”
“পাওনা টাকা! কিন্তু তুমি আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছ বলে তো আমার মনে পড়ে না,” মনে করার চেষ্টা করে বলল প্রভাত।
“নাও, তারপর মনে করিয়ে দিচ্ছি।”
“উঁহু, আগে বলো কিসের টাকা।”
“নাও আগে।”
“না জেনে নিচ্ছি না।”
“অনামিকার বিয়েতে গিফট কেনার টাকা আমার থেকে কম নিয়েছিলে কেন?”
“কে বলল কম নিয়েছি?”
“কে বলেছে, সেটা বিষয় নয়। তুমি যে আমাকে মিথ্যা বলে টাকা কম নিয়েছিলে, এটা তো সত্যি।”
“না।”
“প্রভাত, আমি জানি তুমি এটা করেছ। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে এত কম টাকায় কী গিফট কিনেছ তোমরা। তখনই আমার ওদের কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। গতকাল রাসেলের সাথে কথায়-কথায় অনামিকার বিয়ের প্রসঙ্গ না উঠলে তো জানাই হত না।”
প্রভাত বলল,
“রাসেল বলেছে তাহলে? ওকে তো আমি-”
তার কথায় বাঁধা দিয়ে মৃন্ময়ী বলল,
“প্রভাত, আমি জানি তুমি আমার জন্য অনেক ভাবো। তাই বলে আমি সবসময় তোমার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চাই না। কষ্ট করে হলেও আমি নিজের প্রচেষ্টায় এই অবধি এসেছি।”
“আমি জানি তুমি কারোর থেকেই আর্থিক সহায়তা চাও না। আমি এ-ও জানি তখন তোমার টানাপোড়েন চলছিল, কারণ মাসের মাঝামাঝি সময়ে তোমার হাতে অত টাকা থাকার কথা নয়। তাই আমি তোমার ওপর চাপ ফেলতে চাইনি। দয়া করে বিষয়টা খারাপ চোখে দেখো না।”
“খারাপ চোখে দেখছি না। সাহায্য করেছ, সেজন্য ধন্যবাদ। এখন আমার হাতে টাকা আছে, তাই ফেরত দিচ্ছি।”
“আমি ফেরত নিতে চাই না।”
“কেন? নাও প্লিজ। আমি ঋণী থাকতে চাই না।”
“সব মানুষকে ঋণী করে রাখা যায় না। তুমিও আমার কাছে তেমন। যেদিন তুমি আজীবনের জন্য আমার হাত ধরবে, সেদিন থেকে বাকি জীবন আমি নিজেই তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব।”

প্রভাত নারাজ। মৃন্ময়ী কোনোভাবেই টাকাটা তাকে ফেরত দিতে পারল না। ঘুরেফিরে প্রভাত সেই বিয়ের প্রসঙ্গেই ফিরে গেল,
“শোনো, দ্রুত মতামত জানিয়ো। এতদিন আমি কীভাবে অপেক্ষা করেছি জানি না। গতকাল তোমার বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকে আমার আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তোমাকে না পেলে আমি এবার পাগল হয়ে যাব।”
মৃন্ময়ী‌ টিপ্পনী কে’টে বলল,
“তুমিই না কদিন আগে বলেছিলে আমার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে তোমার আপত্তি নেই? আমাকে না পেলেও তুমি আমাকে ছাড়বে না? তাহলে হঠাৎ করে টিনেজারদের মতো আবেগী হয়ে উঠলে কীভাবে?”
“জানি না। এখন আমি শুধু জানি তুমি আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসবে, নয়তো আমি সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে যাব।”
“ঠিক আছে। আমি তাহলে আজই পাগলা গারদে আলাপ করে রাখছি।”
প্রভাত গোমড়া মুখে বলল,
“তোমাকে ভালোবেসে আমি একটা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। আর তুমি আমাকে পাগলা গারদে পাঠাতে চাইছো?”
“আমি কোথায় চাইছি? চাইছ তো তুমি। আমি শুধু তোমার চাওয়াটা পূরণ করতে চাইছি।”
“এতদিন ধরে যা চাইছি, তা তো পূরণ করার নাম নিলে না। এখন হুট করে যখন পাগলা গারদের কথা বললাম, অমনি তোমার চাওয়া পূরণের ইচ্ছা জেগে উঠল?”
“ভুল কী বললাম? এখন তো তোমার ঘর আছে, পরিবার আছে। পাগল হওয়ার পর তো তুমি সব ভুলে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরবে। তাই আমি তোমার জন্য একটা নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে চাইছি।”
প্রভাত তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“ঘর? পরিবার? ওসব তো আমার থেকেও নেই ম্যাডাম। তোমার কাছে সবসময়ই তো আমার এটুকু চাওয়া-ই ছিল। ছোট্ট একটা ঘর, মিষ্টি একটা পরিবার, একটু যত্ন, ভালোবাসা আর ঘরভরা সুখ। এর বেশি কিছু আমার চাই না, বিশ্বাস করো। তুমি শুধু আমার এটুকু চাওয়া পূরণ করে দিয়ো, আমি এক জীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব।”

এসব কথার প্রেক্ষিতে মৃন্ময়ী আমতা-আমতা করে বলল,
“তোমাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল।”
“বলো।”
“আচ্ছা, তোমার মা কি সত্যিই এত খারাপ? গতকাল তাকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি মনে হয়েছে সে এতটাও খারাপ না। আবার তোমার কথার সাথেও কিছু মিল পাচ্ছি না। তাই গতকাল থেকে আমার মনে প্রশ্নটা উঁকি মারছে।”
প্রভাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“মুখে মিষ্টি ঝরলেই সবার মন মিষ্টি হয় না।”
মৃন্ময়ী আবারও কনফিউশনে পড়ল। সত্যিই কি এত মিষ্টি আচরণের মানুষটার মন বিষাক্ত? মৃন্ময়ীর মানতে ইচ্ছা করছে না। যদিও জগতের নিয়ম-ই এমন। মানুষের মুখ আর মনের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। ঠিক যেন বিষে ভরা সুদর্শন ফুল। দেখতে ভীষণই আকর্ষণীয়, ছুঁয়ে দিলেই আলগোছে বিষ ছড়িয়ে দেয়।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৭.
মৃন্ময়ীর মায়ের সাথে আহমদ তরফদারের কথা হয়েছে। আহমদ তরফদার নিজেই কল করেছিলেন তাদের মতামত জানার জন্য। মৃন্ময়ীর মা জানিয়েছেন তার মেয়ের আপত্তি নেই। এবার বিয়ের কথা এগোনো যায়। আহমদ তরফদার বেশি দেরী করতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন আগামী সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন। মৃন্ময়ীর মা তাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। একসঙ্গে বসেই বিয়ের পাকা কথা বলা দরকার। আহমদ তরফদার নিজেও এমনটাই চাইছিলেন। তবে তিনি সঙ্গে করে কাউকে নিবেন না। প্রভাত তাকে বলে দিয়েছে বিয়ের পাকা কথা বলতে বাবার সাথে শুধু সে নিজেই যাবে। অন্য কাউকে পাঠিয়ে সে মৃন্ময়ীর পরিবারের ওপর চাপ ফেলতে চায় না। তাছাড়া বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারেও খোলামেলা আলোচনা খুব জরুরী। তাকে ছাড়া সেটা ঠিকঠাক হবে না। আহমদ তরফদার আত্মীয়-স্বজন কাউকে সঙ্গে নিতে না পারায় মনে-মনে অসন্তুষ্ট-ই হয়েছেন। তবু তাকে ছেলের কথা মেনে নিয়ে একা যেতে হলো বিয়ের পাকা কথা বলতে। দুজন এলেও সাজেদা বেগম যথাযথভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন। সাজেদা বেগমের ভাই, ভাবি-ও উপস্থিত ছিলেন। তবু কথাবার্তা বলার সময়ে প্রভাত সাজেদা বেগমকে অনুরোধ করলেন মৃন্ময়ীকে ডাকার জন্য। সে চায় আলোচনায় মৃন্ময়ী নিজে উপস্থিত থাকুক। এই সংসারে বাবার অবর্তমানে যেহেতু হাল তার হাতেই, সেহেতু তার মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলের এমন কথা শুনে আহমদ তরফদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাজেদা বেগমের ভাই ইতস্তত করে বললেন,
“সমস্যা নেই বাবা। আমরা আছি তো অভিভাবক হিসেবে। আমাদের সাথেই সব কথা বলতে পারো। আমাদের মেয়ের তাতে আপত্তি নেই।”
প্রভাত বলল,
“আপত্তি যেন না থাকে সেজন্যই তার এখানে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত যদি তার মতের বিপরীতে চলে যায়, তাহলে সেটা ভালো হবে না। কারণ তার পরিবারের দিক থেকে যেকোনো সিদ্ধান্ত তার-ই নেওয়া উচিত। দয়া করে তাকে ডাকুন, তারপর আমরা কথাবার্তা শুরু করি। আপনারা দ্বিধাবোধ করবেন না। আমি নিজেই চাইছি আপনাদের মেয়ে সব কথা শুনুক আর নিজের মতামত-ও জানাক। তাহলে আমাদের দু’পক্ষের জন্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।”

প্রভাত বারবার এক কথা বলায় সাজেদা বেগম মৃন্ময়ীকে ডাকলেন। মৃন্ময়ী ভীষণ চিন্তিত ছিল কথাবার্তা বলে আবার কী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তার মা। বিশেষ করে বিয়ের আয়োজন নিয়েই তার যত দুশ্চিন্তা। বিয়েতে বেশি খরচ করার সাধ্য তাদের নেই। আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত করে খাওয়াতে এত টাকা কীভাবে ম্যাসেজ করবে, সেই চিন্তায়-ই তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। বিয়ের আলোচনায় বসেছেও সে দুরুদুরু বুকে। যদি দুই পক্ষের কথায় না মেলে? নিজস্ব মতামত জানানোর জন্য মৃন্ময়ীকে ডাকা হলেও, মৃন্ময়ীর তেমন কিছু বলার প্রয়োজন-ই পড়েনি। প্রভাত যেন তার মন পড়তে পারে, এমনভাবেই সমস্ত আলোচনায় তাকে কেবল বাঁচানোর চেষ্টা-ই করল। তাদের কোনো দাবিদাওয়া নেই, তা তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। বাকি ছিল অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাপারটা। প্রভাত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলো সে বড়ো আয়োজন চায় না। এমনকি তার পক্ষ থেকে গাড়ি ভর্তি মানুষ নিয়েও সে বিয়ে করতে আসতে নারাজ। হাতেগোনা কয়েকজন নিয়ে আসবে সে। আয়োজন হবে সাদামাটা। তার এসব কথা শুনে আহমদ তরফদারের মুখ কালো হয়ে যায়। বিষয়টি লক্ষ্য করে সাজেদা বেগম সৌজন্যতার খাতিরে বললেন,
“তা কী করে হয় বাবা? আত্মীয়-স্বজন রেখে বিয়ের মতো বড়ো ব্যাপার একা-একা সারা যায়?”
প্রভাত বলল,
“আত্মীয়-স্বজন রেখে করব না আন্টি। আমার আত্মীয়-স্বজনের জন্য যা আয়োজন দরকার, আমার বাড়িতেই করব। সবাইকে সাথে নিয়ে যে বিয়ে করতে আসতে হবে, এমন তো কোনো মাথার দিব্যি নেই। আর আপনাদের যদি মনে হয় আপনাদের আত্মীয়-স্বজন ডাকা দরকার, তাহলে অবশ্যই ডাকবেন। তাতে তো আর আমি বারণ করতে পারি না। তবে আমি চাই না আমাদের বিয়ের জন্য আপনাদের ওপর কোনোরকম চাপ পড়ুক। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ের সমস্ত খরচ আমি নিজেই বহন করব। আপনাদের কাউকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না।”
আহমদ তরফদার ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য জিজ্ঞেস করলেন,
“সমস্ত খরচ বলতে কোন খরচ?”
“বিয়ের আয়োজনের খরচ। মৃন্ময়ীর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি তার দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি যেহেতু বেঁচে নেই, আমি মনে করি বিয়ের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার-ও কেউ নেই। আর আমি অবশ্যই মৃন্ময়ীর ওপর চাপ ফেলতে চাই না। তাই বিয়ের আয়োজনের দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। আমি আশা করব আমার সিদ্ধান্তে কারোর আপত্তি না থাকুক।”
আহমদ তরফদার মৃন্ময়ীদের সামনে কিছু বলতে পারলেন না, তাই দাঁত চেপে বসে রইলেন। মৃন্ময়ী নিজেও কিছু বলতে পারছে না। তার কেমন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। প্রভাতের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ হচ্ছে। আবার ভেতর-ভেতর অস্বস্তি-ও হচ্ছে। পাছে প্রভাতের পরিবার না সিদ্ধান্তটা খারাপভাবে নেয়। তার বাবাকে-ও খুব একটা সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে না। নিরবতা-ই তার অসন্তুষ্টির লক্ষণ। মৃন্ময়ীর মামা কানের লতি চুলকে বললেন,
“না-না, আমাদের দিকের আয়োজন নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমরা ম্যানেজ করে নেব। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।”
প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“বিয়েটা তো আমিই করছি মামা। আপনারা আপনাদের মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন, এটা তো আয়োজনের চেয়েও অনেক বড়ো ব্যাপার। আপনাদের মাথার ওপর চাপ প্রয়োগ করে, মনে দুঃখ দিয়ে আমি আপনাদের মেয়েকে কেড়ে নিতে চাই না। এতে ও নিজে-ও মানসিক অশান্তিতে থাকবে। আমি চাই সবাই মন থেকে হাসিখুশি থাকুক। হাসিমুখে আমাদের বিয়েতে উপস্থিত থাকুক। দেখুন, আমার দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রস্তুতি নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দয়া করে আপনারা আপত্তি করবেন না।”

দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করেও কেউ প্রভাতকে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারল না। মুখ ফুটে বলেছে মানে বিয়ের খরচ সে-ই বহন করবে। আহমদ তরফদার চক্ষু লজ্জায় শেষে মিনমিনে গলায় সম্মতি জানালেন। এরপর আর সাজেদা বেগমের আপত্তি থাকার কারণ রইল না। সবার মতামত মিলে যাওয়ার পর তারা বিয়ের তারিখটা-ও ঠিক করে ফেললেন। আহমদ তরফদার নিজেই বললেন আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন নির্ধারণ করা হোক। কেউ তাতে আপত্তি জানায়নি।

মৃন্ময়ীর পরিবারের সামনে আহমদ তরফদার ছেলের সব সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নিলেও, তিনি মুখ খুললেন বাড়ি পৌঁছানোর পর। বাড়ি ফিরেই তিনি চেপে রাখা রাগটুকু ঝাড়তে শুরু করলেন। উঁচু গলায় প্রভাতকে শুনিয়ে-শুনিয়ে স্ত্রীর কাছে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরলেন। সঙ্গে প্রভাতের সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করতে-ও ছাড়লেন না। প্রভাত জানত বাড়ি ফিরলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবেই। বাবাকে থামানোর জন্য সে জামা-কাপড় ছেড়ে এসে সোজাসাপ্টা জানতে চাইল,
“আমার সিদ্ধান্তে আপনার সমস্যা কোথায়?”
আহমদ তরফদার তিক্ত স্বরে বললেন,
“সমস্যা কোথায়? তুই কোন পরিবারে বিয়ে করতে গেছিস যে বিয়ের খরচ-ও তোকেই দিতে হবে? মানুষজন শুনলে হাসবে।”
“মানুষজন হাসবে, না কাঁদবে, তা দিয়ে আমার তো কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষজনকে আপনি শুনাতে যাবেন কেন?”
“এসব কথা আবার চাপা থাকে? ভালো পরিবারের অভাব নেই, সব রেখে তার চোখ পড়েছে এমন পরিবারে, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কজন লোক খাওয়ানোর মুরোদ-ও যাদের নেই।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“ওই পরিবারের আসল দায়িত্ব নেওয়ার মানুষটাই নেই, তা কি আপনি দেখছেন না? মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য কি তারা এখন কিডনি বিক্রি করবে? আপনি তা-ই চাইছেন?”
আহমদ তরফদার চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“যোগ্যতা না থাকলে ভালো ফ্যামিলিতে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার এত শখ কেন? তোর মাথা-ও কি খেয়েছে তারা? বিয়ের কথাবার্তা বলতে একা আমাকে নিয়ে গেছিস। কী করতে নিয়েছিস? চেহারা দেখাতে? আমার কোনো মতামত জানার প্রয়োজন পড়েছে তোর? তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত তুই একাই নিয়ে নিয়েছিস। এখন আবার বিয়েতে-ও কাউকে নিবি না বলে এসেছিস। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে আমি একা-একা সেরে আসব? এই, আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারব রে? কী শুরু করেছিস তুই? ফাজলামি পেয়েছিস?”
প্রভাত নিজেও রাগত মুখে বলে উঠল,
“আমার যাকে পছন্দ, আমি তাকেই বিয়ে করব। ফ্যামিলির দিকে তাকিয়ে আমি কী করব? তাকে নিয়ে সংসার আমি করব, জীবন আমি কাটাব। আপনি ফাজলামির কী দেখলেন? আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে নিয়ে বিয়ে করতে যাব না বলে আপনার এত দুঃখ? আমার মা মরার পর কদিন আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী এসে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছে? কে আমাকে ডেকে একবেলা ভালো-মন্দ খাওয়াতে চেয়েছে? উলটা আমার বাড়ি এসে পেটভরে খেয়ে গেছে। খাওয়ালেই তাদের কাছে আপনি ভালো। আপনার এত ভালো সাজার শখ জাগলে আপনি নিজেই গোরু কেটে আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর খাওয়ান, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আপনার স্বার্থপর গোষ্ঠীকে পেটপূজা করাতে নিয়ে যাব না। আমার অত ভালো সাজার শখ নেই কারোর কাছে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা-ও আমার নেই।”
পরক্ষণেই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওনাকে ভালোমানুষী বন্ধ করতে বলুন। খাইয়ে-খাইয়ে মানুষের সামনে ভালো হতে যায়। তাকে কে খাওয়ায়? জীবনে তো আমাকে আপনারা ভালো থাকতে দিলেন না। এবার অন্তত আমাকে মুক্তি দিন। আমার ভালো থাকার পথ আমি বেছে নিয়েছি। এতেও যদি কেউ বাঁধা দেন, এই বাড়ি ছাড়তে আমি এক মুহুর্ত-ও ভাবব না। আমার মা-ও নেই, এ বাড়িতে আমার কোনো পিছুটান-ও নেই।”

আহমদ তরফদার আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন। প্রভাত আর তার কথা শোনার অপেক্ষা করল না। হনহনিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। রাহেলা বেগম বিরক্ত মুখে বললেন,
“আপনি থামুন তো। কী চেঁচামেচি শুরু করেছেন? আমার মাথা ধরে যাচ্ছে আপনার চেঁচামেচি শুনে।”
আহমদ তরফদার নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। একইভাবে বলে উঠলেন,
“আমি থামব কীভাবে? দেখছো না আমার জন্মের ছেলে আমার মুখে চুনকালি মাখতে চাইছে? ইচ্ছা করে সবার কাছে আমাকে ছোটো করতে চাইছে?”
“আপনি নিজেই নিজেকে ছোটো করছেন।”
“তুমিও ওর সুরে কথা বলছো?”
“তো কী করব? ছেলেটা নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সুখে থাকতে চাইছে, থাকুক না। আপনি কেন এত আপত্তি করছেন? মেয়েটা তো খারাপ না, যথেষ্ট ভালো। মেয়েটার পরিবার নিয়ে এত কথা বলেন কেন? বাবা ছাড়া মেয়েটা কত কষ্টে পরিবারকে টেনে চলেছে, ওদের যন্ত্রণা তো আমরা দূর থেকে বুঝতে পারি না। বাবা থাকলে তো আর ওদের অবস্থা এমন থাকত না।”
“তো কী দরকার ওই মেয়েকে বিয়ে করার? মেয়ের কী অভাব এদেশে?”
“দেশে মেয়ের অভাব না, দেশ ভর্তি মেয়ে আছে। কিন্তু সব মেয়েদের সাথে আপনার ছেলে ভালো থাকবে না। কারণ ওর ভালো থাকার মন্ত্র লুকিয়ে আছে শুধুমাত্র একজনের প্রতিই, সে মৃন্ময়ী, যাকে ও মন থেকে ভালোবেসেছে। আমরা বাঁচব আর কদিন? একটামাত্র সন্তান আমাদের, ওর একটা সুখী জীবন-ই তো আমাদের একমাত্র চাওয়া। যার সাথে ও ভালো থাকতে পারবে, আমাদের তো উচিত ওর জন্য তাকেই নিয়ে আসা। ওদের সুখী সংসার দেখে যেতে পারলে আমাদের জীবনে আর কোনো আফসোস থাকবে না। নিশ্চিন্তে বিদায় নিতে পারব।”
আহমদ তরফদারের রাগে একটুখানি ভাঙন ধরল। তবু তিনি রাগটা ধরে রাখার চেষ্টা করে বললেন,
“সবই তো মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই পণ্ডিত শেষমেশ কী বলে এল, শুনলে না? বরযাত্রী-ও সে ঠিকঠাক নিবে না। আত্মীয়-স্বজনের সামনে আমার মান-সম্মান মাটি করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“আচ্ছা, ও ভুল কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে? জানেন তো মেয়েটার পরিবারের কী অবস্থা। ওদের কথা ভেবেই প্রভাত বেশি লোকজন না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর আপনার আত্মীয়-স্বজন কি আপনি বৌ-ভাতে দাওয়াত করে খাওয়াতে পারবেন না? বরযাত্রী হিসেবেই নিতে হবে?”
“আমার বাড়ি আর ওই বাড়ি কি এক হলো?”
“না হয় নেই। সবকিছুতে যেচে অপমান বোধ করতে যাবেন না তো। প্রভাত যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। ও সবকিছু ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“জানতাম তুমি এবারেও ওই ফাজিরটার হয়ে কথা বলবে। তোমাকে কোনো কথা বলা-ই বেকার। সরো তো, আজাইরা সময় নষ্ট। আমার ঘরে আমি ছাড়া সব পণ্ডিতের বাস। কোনো কিছুতেই আমাকে দরকার হয় না।”
আহমদ তরফদার একা-একা বকবক করতে-করতে ঘরে চলে গেলেন। রাহেলা বেগম গলা তুলে বললেন,
“সবসময় আত্মীয়-স্বজন, আত্মীয়-স্বজন করে গলা শুকিয়ে ফেলবেন না তো। তাদের জন্য আপনার-ই মন কাঁদে। আল্লাহ্ না করুন, আপনার দুটো পয়সা কমে গেলে দেখবেন তারা আপনার মুখ-ও দেখতে চাইবে না। ছেলে উচিত কথা বলেছে বলে গায়ে লাগে? ওসব মানুষদের এভাবেই বলা উচিত। সব স্বার্থপরের দল।”


বাবার সাথে ঝামেলা হলেই প্রভাতের মনটা সহজে ভালো হয় না। সবকিছু বিরক্ত লাগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। মন ভালো করার জন্য সে বন্ধুদের ডেকে দীর্ঘ সময় আড্ডা দেয়, ঘুরাঘুরি করে। কিন্তু আজ তার সেই সময়টুকু-ও নেই। অফিসে কিছু কাজ বাকি পড়ে ছিল। সন্ধ্যাটা তার কাজ করেই কা’টাতে হলো। অফিস ছুটি হয় বিকালেই। প্রভাত এক অলস প্রাণী, যে কাজ জমিয়ে রেখে-রেখে মাঝেমধ্যে নাইট ডিউটি-ও করে। তাদের অফিসে নাইট ডিউটিতে খুব কম মানুষ-ই থাকে। প্রভাতের মন ভালো থাকলে সে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে পারে। নইলে সন্ধ্যাতেই বিদায় নেয়। আজ তার নাইট ডিউটিতে থাকার ইচ্ছা নেই। তাই বিকালেই বিদায় নিয়েছে। মৃন্ময়ীর স্কুলের বাইরে এসে কিছুক্ষণ হলো দাঁড়িয়েছে সে। আজ এটুকু সময়কেই খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। স্কুল ছুটি হতেই বাচ্চারা হুড়মুড়িয়ে গেট দিয়ে বেরোনো ধরল। প্রভাতের অপেক্ষমান চোখ জোড়া খুঁজে চলেছে মৃন্ময়ীর মুখ। মৃন্ময়ী বেরিয়ে এল দুজন শিক্ষকের সাথে কথা বলতে-বলতে। তার মুখে হাসি। হয়তো মন ভালো। প্রভাতকে দেখে মৃন্ময়ীর সাথের শিক্ষক দুজন চাপা স্বরে কী ঠাট্টা কর চলে গেল, প্রভাত শুনতে পেল না। মৃন্ময়ী এলোমেলো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এল। প্রভাত জানতে চাইল,
“ম্যাডামের মন ভালো?”
মৃন্ময়ী পথ চলতে-চলতে বলল,
“ভালো।”
“ফুয়াদ স্যারের সাথে যেভাবে মিষ্টি হেসে কথা বলছিলে, দেখেই বুঝেছি মন ভালো।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আরেকজন স্যার-ও তো ছিল, চোখে পড়ল শুধু ফুয়াদ স্যার?”
“সে তো বিবাহিত, আরেকজনের হবু বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার চান্স নেই।”
“ফুয়াদ স্যারের-ও গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“ওহ্! তাহলে ঠিক আছে।”

মৃন্ময়ী আরও একবার কপাল কুঁচকে তাকাল। বদলে প্রভাত তাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। সে হাসিতে মৃন্ময়ীর কী হলো কে জানে? হুট করেই তার বুকের ভেতর কম্পন ধরে গেল, মৃদুমন্দ বাতাসের মতো। শীতল বাতাস। ভেতরের শীতলতার ছোঁয়া যেন বাইরে এসে তার হাত-পা ঠাণ্ডা করে দিলো। লজ্জায় রাঙিয়ে দিলো সুন্দর মুখখানা। এ যেন এক নতুন অনুভূতি। মৃন্ময়ী সে অনুভূতি ধামাচাপা দিতেই প্রভাতের দিকে আর ফিরে না তাকানোর পরিকল্পনা করল। প্রভাত তাকে মৃদু স্বরে ডাকল,
“ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী চোখ না তুলেই সাড়া দিলো,
“হুঁ?”
“হাওয়াই মিঠাই খাবে?”
“উঁহু।”
“লজ্জা পেয়ো না, লজ্জা পেয়ো না। দুদিন বাদে তো এসবের জন্য সেই আমার কাছেই আবদার করবে।”
“আমি বাচ্চা না।”
“ভালোবাসার মানুষের কাছে থাকলে সবাই বাচ্চামি করে। যখন থেকে আমার কাছে থাকবে, তখন বুঝবে। একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।”
প্রভাত এক দৌড়ে গিয়ে চার প্যাকেট হাওয়াই মিঠাই কিনে আনল। এক প্যাকেটে ছোটো বল আকৃতির নয়টা হাওয়াই মিঠাই। মৃন্ময়ীর হাতে তিনটা প্যাকেট দিয়ে প্রভাত একটা প্যাকেট খুলল। মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এতগুলো কেন?”
“বাড়ি গিয়ে আমার শ্যালিকাদের নিয়ে খাবে।”
প্রভাত প্যাকেট খুলে সেটাও মৃন্ময়ীর আরেক হাতে ধরিয়ে দিলো। মৃন্ময়ী প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে নিজের দুহাতের দিকে তাকাল। দুই হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিলে সে খাবে কোন হাত দিয়ে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই প্রভাত খোলা প্যাকেট রেখে বাকি প্যাকেটগুলো নিজের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“খাও।”
মৃন্ময়ী একটা হাওয়াই মিঠাই বের করে প্রভাতের দিকে বাড়িয়ে ধরল। প্রভাত হাসিমুখে সেটা হাতে নিয়েই মুখে পুড়ে দিলো। মৃন্ময়ী তাকে আরও একটা সাধল, সে আর নিল না। খেতে-খেতে মৃন্ময়ী অনেকবার প্রভাতকে বিয়ের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে চাইল। কিন্তু লজ্জায় প্রসঙ্গ তুলতেই পারল না। প্রভাত তার মনের কথা বুঝতে পারল কি না কে জানে? সে নিজেই বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরল। মৃন্ময়ীকে প্রশ্ন করল,
“বিয়েতে তোমার আলাদা কোনো ইচ্ছা আছে ম্যাডাম?”
প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“কিসের ইচ্ছা?”
“থাকে না অনেক মেয়েদের নিজের বিয়েতে এটা-সেটা করার কত ইচ্ছা? তোমার তেমন কোনো ইচ্ছা থাকলে আমাকে জানাও প্লিজ।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“নেই।”
“সত্যি? লজ্জা পেয়ে আবার মিথ্যা বোলো না। আমি চাই না বিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে তোমার কোনো আফসোস থেকে যাক। তোমার যেকোনো ইচ্ছা আমি পূরণ করার চেষ্টা করব। বলো কী চাও।”
মৃন্ময়ী প্যাকেট থেকে আরেকটা হাওয়াই মিঠাই বের করতে-করতে বলল,
“একটা শান্তিপূর্ণ বিয়ে ছাড়া আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। বিয়ে নিয়ে সেভাবে কখনও ভাবিনি, তাই হয়তো আলাদা কোনো ইচ্ছা-ও জন্মায়নি।”
প্রভাত বলল,
“এখন থেকে ভাববে। বিয়ের আগে তোমার মনে যদি নতুন কোনো ইচ্ছা-ও জন্মায়, তুমি অবশ্যই আমাকে জানাবে। ঠিক আছে?”
মৃন্ময়ী কেবল মাথা দোলাল, সে জানাবে। যদিও তার মনে হয় না তার আলাদা কোনো ইচ্ছা জাগবে। আয়োজন করে যে তার বিয়ে হবে, এটাই তো অনেক। এর বেশি আর কী চাইবে সে? প্রভাত আবার প্রশ্ন করল,
“তুমি কি পার্লারে সাজতে চাও, না বাড়িতে?”
মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“বাড়িতে।”
“বাড়িতে কেউ সাজিয়ে দিবে, না পার্লারের লোক আনতে হবে?”
“মৃত্তিকা সাজাবে বলেছে।”
“তাহলে ঠিক আছে। পার্লারের মেয়েগুলো কী ভূত সাজিয়ে দেয়, ওসবের দরকার নেই। সাধারণ সাজেই তোমায় সুন্দর মানায়। মৃত্তিকাকে বলে দিয়ো বিয়ের দিন যদি আমার বউকে সুন্দর করে সাজাতে পারে, তাহলে তার জন্য বিশেষ পুরষ্কার আছে। যদিও আমার বউ এমনিতেই সুন্দর।”

কিছুক্ষণ কাচুমাচু করার পর মৃন্ময়ী মৃদু স্বরে বলল,
“আজ তুমি সবার সামনে যা সিদ্ধান্ত জানালে, তা কি তোমার একার সিদ্ধান্ত ছিল?”
প্রভাত হেসে বলল,
“বিয়ে করব আমি, সিদ্ধান্ত আর কার থাকবে?”
“তোমার বাবা-মায়ের সাথে আগে আলোচনা করনি?”
“উঁহু।”
“কেন?”
“তোমার কী মনে হয়? আগে থেকে জানালে এত সহজে আমার সঙ্গে গিয়ে বিয়ের পাকা কথা বলে আসত? হাজারটা আপত্তি জানিয়ে আমার মাথা খারাপ করে ছাড়ত।”
“তবু তারা তোমার অভিভাবক। বিয়ের মতো বড়ো ব্যাপারে অভিভাবকের সাথে আলোচনা সবার আগে জরুরী।”
“জরুরী, তা আমিও জানি। কিন্তু আমার অভিভাবকের সাথে বোঝাপড়া করা তোমার ভাবনার মতো এত সহজ নয়। আমি যা করেছি, ভেবেচিন্তেই করেছি। ওসব তুমি এখন বুঝবে না। যখন আমার সঙ্গে জীবনযাপন শুরু করবে, তখন বুঝতে পারবে।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এখন কি তারা তোমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়নি?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“তারা আজীবনই আমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট-ই হয়। ওসব আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। তারা সন্তুষ্ট হলেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না, অসন্তুষ্ট হলেও না। তাছাড়া আমি কারোর প্রতি নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিইনি। আমার নিজের যতটুকু সামর্থ আছে, তার জোরেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই কারোর আপত্তিতে আমার কিছু যায় আসে না।”
মৃন্ময়ী বলল,
“সবকিছুতেই বেপরোয়া তুমি।”
প্রভাত নিচু স্বরে বলল,
“বেপরোয়া ছেলেটাকেই শেষমেশ বিয়ে করতে চলেছেন ম্যাডাম?”
“তোমরা জোট বেঁধে আমাকে ফাঁসিয়েছ, নয়তো কে তোমায় বিয়ে করত?”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“এখনও গা বাঁচিয়ে কথা বলছেন ম্যাডাম? খুব বুদ্ধিমতী আপনি।”
মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাত পুনরায় বলল,
“ঠিক আছে, এখন মনের কথা লুকানোর চেষ্টা করছেন করুন। বিয়ের পর যখন আপনার মন সম্পূর্ণ দখলে নিয়ে নেব, তখন দেখব আর কত লুকিয়ে রাখতে পারেন।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে