মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৪+১৫

0
5

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
বাড়ি যাওয়ার পথে মৃন্ময়ীকে মিষ্টির দোকানের দিকে হাঁটতে দেখে প্রভাত জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“দোকানে।”
প্রভাত হেসে বলল,
“বিয়ে ভাঙার খুশিতে মিষ্টিমুখ করবে না কি?”
“জি না। আমার বাড়ির ছোটো সদস্য রাগ করেছে। মিষ্টি না খাওয়ালে তার রাগ ভাঙবে না।”
“মৃদুলার কথা বলছো? রাগ করেছে কার সাথে?”
“আমার আর মৃত্তিকার সাথে।”
“তোমরা বড়ো দুবোন মিলে আমার ছোটো শ্যালিকাকে এভাবে রাগাও তাহলে? কী ভদ্র আর মিষ্টি মেয়েটা!”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“একটা সত্যি কথা বলো তো। তোমার সাথে মৃদুলার এত ভালো সম্পর্ক হলো কবে থেকে?”
প্রভাত দাঁতে জিব কে’টে বলল,
“ছিঃ! কী যে বলো তুমি! তুমি ছাড়া আর কারো সাথে আমার সম্পর্ক থাকার কথাই না।”
“কথা ঘুরাবে না। আগেও অনেকবার মৃদুলার মুখে আমি তোমার কথা শুনেছি। ও তোমাকে ভালো চোখে দেখে। কিন্তু আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে সবসময় এড়িয়ে যায়। এখন আবার আমার বিয়ে আটকানোর জন্য ও নিজে থেকে তোমাকে সাহায্য করেছে। তুমিও ওকে এত ভালো মেয়ে ভাবো। এসব মোটেও একদিনের ব্যাপার নয়। মৃদুলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। হুট করে ও যার-তার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে না।”
প্রভাত বলল,
“তোমার কী ধারণা? মৃদুলাকে আমি মিষ্টি খাইয়ে পটিয়ে আমার দলে নিয়ে নিয়েছি?”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে বলল,
“মৃদুলা বাচ্চা মেয়ে না যে তুমি ওকে কিছু খাইয়ে পটাবে। আমি নিশ্চিত তুমি ওকে তোমার কথায় ভুলিয়েছ। ওকে এমনকিছু বুঝিয়েছ যা শুনে ও তোমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।”
“তোমার বোনটা তোমাকে খুবই ভালোবাসে।”
“হুম, ওর এই দুর্বলতাকেই তো তুমি কাজে লাগালে। এসব কবে থেকে চলছে বলো তো? এর আগে আর কী-কী খবর পাচার করেছে ও?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আনফরচুনেটলি তোমার লক্ষ্মী বোনটার সাথে আমার কখনও ভালোভাবে কথাই হয়ে ওঠেনি।”
মৃন্ময়ী বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি মিথ্যা বলা বন্ধ করবে? দেখছ আমি বুঝে গেছি তোমাদের কাহিনি, তবু মিথ্যা বলেই চলেছ।”
“মিথ্যা কেন বলব? সত্যি কথাই বললাম। মৃদুলার সাথে আমার পরিচয় আছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত ও আমার সাথে দাঁড়িয়ে দুমিনিট কথা বলেনি। সামনে পড়লে কেমন আছি জিজ্ঞেস করেই চলে যায়। কতবার কিছু খাওয়াতে চেয়েছি, তা-ও দাঁড়ায়নি।”
মৃন্ময়ীর কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। বলল,
“বিশ্বাসযোগ্য কথা বলো প্রভাত। কথাবার্তা ছাড়াই একজন তোমাকে সাহায্য করতে যাবে? তা-ও আবার সেই একজনটা মৃদুলা।”
“আমি কি একবারও বলেছি মৃদুলা আমাকে সাহায্য করেছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুমি এখনও অস্বীকার করছো?”
“আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস কোরো আমার সাথে ও কখনও ভালোভাবে কথা বলেছে কি না।”
“তুমি সত্যি কথা বলছো না, আমার বোন বলবে? ও তো কথা পেটে চেপে রাখার বেলায় তোমার চেয়েও একধাপ এগিয়ে।”
“তা-ও তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো আমার কথা মিলে কি না।”
“হয়েছে, তোমাদের কথা মিলিয়ে মাথা খারাপ করার শখ নেই আমার। যার যা ইচ্ছা করো, আমার কী?”
“তুমি নিজেই তো যেচে মাথা খারাপ করার পাঁয়তারা করছো। যাইহোক, বাদ দাও। অনামিকার বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছ?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম, গতরাতে ম্যাসেজ করেছিল।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? বিয়ের কথা বলল, দাওয়াত করল।”
“যাবে তো?”
“জানি না। সময় হবে না হয়তো।”
“সময় হবে না কেন? শুক্রবার বিয়ে। শুক্রবার তো আর তোমার ক্লাস করানোর প্যারা নেই।”
“ক্লাস করানো ছাড়া কি আমার আর কোনো কাজ থাকতে পারে না?”
“সে যে কাজই থাকুক। তুমি অজুহাত দেখিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে না। বিয়েতে অবশ্যই যাবে। গেলে অনেকের সাথে দেখা-ও হবে।”
“দেখি, গেলে তো দেখবেই।”
“দেখি না, অবশ্যই যাবে।”
“এমনভাবে জোর দিয়ে বলছো যেন তোমার বোনের বিয়ে।”
“নিজের বোন না হোক, প্রতিবেশী বোন তো। তার ওপর বান্ধবী। দেখো, তুমি তোমার বান্ধবীর বিয়েতে না গেলে কিন্তু ও-ও তোমার বিয়েতে আসবে না। আর তোমার বিয়েতে আসবে না মানে আমাদের বিয়েতে আসবে না। এটা আমি মোটেও হতে দিবো না। আমি চাই ভবিষ্যতে আমাদের বিয়েতে সবাই উপস্থিত থাকুক। সবাই দেখুক পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি আমার বউ হতে চলেছে।”
“বিয়ের জন্য দেখছি তোমার পেটের ভাত হজম হয় না। এক কাজ কোরো। অনামিকার বিয়ের আসরেই বিয়ে সেরে ফেলে পেটের ভাত হজম করে নিয়ো।”
প্রভাত হেসে বলল,
“অনামিকার সাথে তুমিও বউ সাজলে বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি রাজি থাকলে এক কাজিতেই দুটো বিয়ে হয়ে যেতে পারে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“বিয়ে বাড়ির আনাচে-কানাচে সুন্দরী মেয়েদের অভাব থাকে না।”
“ভুলভাল মানুষকে বিয়ে করে পরে পেটের ভাত হজম হওয়ার বদলে বদহজম হয়ে যাবে। যেচে বদহজম করার ইচ্ছা আমার নেই। আমার একজনকেই লাগবে, সে মৃন্ময়ী ম্যাডাম।”

অনামিকা মৃন্ময়ীর স্কুল জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এখনও তাদের মাঝে সম্পর্ক ভালো। প্রভাতের প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে অনামিকার সাথে তার-ও ভালো বন্ধুত্ব। অনামিকার বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপরই সে মৃন্ময়ীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল। বারবার করে বলে দিয়েছিল মৃন্ময়ী যেন কোনোভাবেই তার বিয়েতে অনুপস্থিত না থাকে। এদিকে মৃন্ময়ী পড়ে গেছে চিন্তায়। বিয়েতে গেলে বান্ধবী হিসেবে কিছু একটা উপহার তো দিতে হবে। মাসের মাঝামাঝি এসে সে কী করে অত টাকা খরচ করে ভালো উপহার কিনবে? টাকার চিন্তায় বিয়েতে যাওয়ার ইচ্ছা-ই মাটি হয়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ীর। না গেলেও অনামিকা রাগ করবে। এখন যাবে কি যাবে না, সিদ্ধান্ত নিতেই সে দ্বিধায় ভুগছে। অনামিকার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়া তার জন্য সম্ভব হয়নি। অনামিকা অনেকবার বলেছিল, কিন্তু কোচিংয়ের কারণে সে যেতে পারেনি। তাছাড়া বিয়ের আগেরদিন এসেও যাওয়া নিয়ে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। এখনও কোনো উপহার-ও কেনা হয়নি। মৃত্তিকা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল এক হাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার জন্য। সে-ও শেষমেশ মনে-মনে এটাই ঠিক করেছিল। যাওয়া হলে টাকা-ই দিয়ে দিবে। এই মুহূর্তে অনুষ্ঠানে গিয়ে এক হাজার টাকা খরচ করাই তার জন্য অনেককিছু। এর বেশি খরচ করে উপহার কেনা তো অসম্ভব ব্যাপার। এরমধ্যে প্রভাত আবারও তাকে প্রশ্ন করে বসল অনামিকার বিয়েতে যাবে কি না। বিয়ের কথা শুনে হতেই সে মৃন্ময়ীকে এ প্রশ্ন করেই চলেছে। এতদিন মৃন্ময়ী নিজে দ্বিধায় ছিল বলে ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেনি। আজ বলল,
“গেলে তো কাল দেখতে পাবেই।”
প্রভাত বলল,
“অনামিকা এত করে বলল, এখনও তুমি এ কথা বলছো?”
“তুমি কি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওনি?”
“ওখান থেকেই এলাম।”
“অনুষ্ঠান শেষ?”
“শুরু হলে তো শেষ হবে। মেয়েদের সাজতে এত সময় লাগে? বাপরে! রাত নয়টা বেজে গেছে, তা-ও শুনি সাজ আরেকটু বাকি আছে। সাজ শেষ হবে, তারপর ফটোশুট হবে, তারপর হবে গায়ে হলুদ। বসে-বসে অত কাহিনি দেখার ধৈর্য আমার নেই। তাই চলে এসেছি। এরচেয়ে ভালো তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যাব। গিয়ে এক প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাব।”
“অনুষ্ঠানে থাকার চেয়ে বিরিয়ানি খাওয়া তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
“খাওয়ার জন্যই তো দাওয়াত দিয়েছে। খাওয়া ছাড়া আমার আর কাজ কী? আমি তো আর বান্ধবী না যে বসে-বসে ওকে সাজিয়ে দিবো। ভালো কথা, শোনো, আমাদের বিয়ের সময় কিন্তু তুমি সাজগোজের পেছনে এত সময় লাগাবে না। হালকা সাজেই তোমাকে দারুণ লাগে। আমার বউ আমার কাছে ভালো লাগলেই হয়, আর কারোর ভালো লাগার দরকার নেই। মনে থাকবে? অনামিকার মতো এমন কাজ মোটেও করবে না। আমি এত অপেক্ষা করতে পারব না।”
মৃন্ময়ী এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে বলল,
“অযথা বকবক না করে চুপ থাকো।”
“এসব মোটেও অযথা বকবক না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। বিয়ে তো একদিন করব-ই। এসব কথা আগে থেকে বলে রাখাই ভালো। মনে রেখো কিন্তু। যাইহোক, এখন বলো কাল শিওর যাচ্ছ তো?”
“তুমি আমার যাওয়া নিয়ে উঠেপড়ে লাগলে কেন? বলছি তো গেলেই জানতে পারবে।”
“এটা বললে কীভাবে হবে? আমাদের গিফট কিনতে হবে না? তুমি কি গিফটের কথা কিছু ভেবেছ?”
“না।”
“তাহলে? কাল যাওয়ার আগে তো গিফট কিনতে হবে। আমরা ছয়জন আছি। পাঁচজনের টাকা অলরেডি তুলে ফেলেছি। বাকি আছো শুধু তুমি।”
মৃন্ময়ী আবারও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। ছয়জন মিলে উপহার কেনার জন্য কত টাকা করে তুলেছে কে জানে? যদি এক হাজার টাকার বেশি হয়, তাহলে সে কী বলবে? প্রভাত এভাবে বললে তার কাছে টাকা দিবে না বলবেই বা কীভাবে? তবু সে জানতে চাইল,
“কী উপহার কিনবে?”
“ওরা কী কিনবে বলল, মনে নেই আমার। তুমি কি আমাদের সাথে দিবে? তাহলে পাঁচশো টাকা দিয়ে দিতে পারো আমার কাছে।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“পাঁচশো টাকা! তোমরা পাঁচশো টাকা করে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“পাঁচশো টাকা করে তুলে কী কিনবে?”
“সে যা কিনে কিনুক ওরা। ছয়জন মিলে দিলে এর বেশি লাগবে না। তুমি কি এরচেয়ে বেশি দিতে চাও?”
“আমি বেশি দিতে যাব কেন?”
“তাহলে এত প্রশ্ন কোরো না। টাকা দিলে দিয়ে দাও। কাল সময়মতো চলে যাবে।”
এত অল্প টাকার কথা শুনে মৃন্ময়ী অবাক হলেও না করল না।‌ ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকা বের করে প্রভাতের হাতে দিয়ে দিলো। টাকা নিয়ে প্রভাত বলল,
“ওদের বিয়েতে আমরা দুজন একসঙ্গে উপহার দিচ্ছি ঠিকই, ওদের সবাইকে বলে দিবো আমাদের বিয়েতে আলাদা উপহার দেওয়া বাধ্যতামূলক। নয়তো কাউকে দাওয়াত দেওয়া হবে না। নইলে আবার সবকটা আমাদের দুজনকে একসঙ্গে উপহার দিয়ে পার পেয়ে যেতে চাইবে। তা চলবে না।”


আজও জাহিদ দেরী করেছে। নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট পর উপস্থিত হয়েছে সে। মৃদুলা-ও গুণে-গুণে দশ মিনিট গাল ফুলিয়ে থেকে তবেই তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। অবশ্য দেরী হতে পারে বুঝে আগেভাগেই জাহিদ আসার আগে ফুল কিনে নিয়েছিল। নয়তো আজ তাকে দশ মিনিটের বদলে বিশ মিনিট শাস্তি মাথা পেতে নিতে হত। আজ তাদের ছুটির দিন। দুজন মিলে রিকশায় চড়ে যেদিকে খুশি ছুটে চলার দিন। বাকি দিনগুলো ব্যস্ততার মাঝে তাদের ঘোরাঘুরি হয় না। দেখা হয়, একটু পথ একসঙ্গে হাঁটা হয়, একটু কথাবার্তা, খাওয়া-দাওয়া করেই বাসায় ছুটতে হয়। এ কারণে শুক্রবারটা তাদের জন্য বিশেষ। এদিন কারোর কোনো ব্যস্ততা থাকে না, বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না। সপ্তাহে শুক্রবার-ই মৃদুলা একটু সাজগোজ করে বেরোনোর চেষ্টা করে। সারা বিকাল তারা রিকশায় ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে-ঘুরতে নিজেদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে হাজারো গল্পের পসরা সাজায়। শান্তিতে খাওয়া-দাওয়া করে, ছবি তোলে। বাড়িতে জানে শুক্রবারে-ও মৃদুলার টিউশন থাকে। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, আবার পুরোপুরি মিথ্যা-ও নয়। শুক্রবার তার টিউশন থাকে, তবে শুধু সন্ধ্যার পর একটি টিউশন। বিকালে তার একদম অবসর। ওই সময়টা জাহিদকে দেওয়ার জন্যই সে বাড়িতে মিথ্যা বলেছে। জাহিদ-ও তাই প্রত্যেক শুক্রবারে খুব করে চেষ্টা করে মৃদুলাকে খুশি রাখতে। মৃদুলার মন খারাপ হবে বা সে রেগে যাবে, এমন কথা বা কাজ সে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আজ তাদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রভাত-মৃন্ময়ীর বিয়ে। কদিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে তাদের কথা হচ্ছিল। আজ তাদের আলোচনা খুবই সিরিয়াস। প্রভাত জাহিদকে বলেছে যেভাবেই হোক মৃদুলা যেন তার মাকে বুঝানোর দায়িত্বটা নেয়। এই দায়িত্বটা তাকেই নিতে হবে। প্রভাত বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর যদি মৃন্ময়ীর মা তাকে দেখে ‘না’ করে দেয়, তাহলে ঝামেলা বাড়বে। মৃন্ময়ীকে তো সে নিজেই সামলে নিবে। কিন্তু তার মাকে তো সামলাতে পারবে না। জাহিদ বারবার করে মৃদুলাকে এ কথা বলায় মৃদুলা বলল,
“আমি পারব বলেছি তো। মা একটু ত্যাড়া মানুষ, তবে অবুঝ নয়। আপার বিয়ে-ই এখন তার সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যথা। সে যখন বুঝতে পারবে প্রভাত ভাই আপাকে ভালো রাখার মতোই ছেলে, তখন আপার আগে সে-ই রাজি হয়ে যাবে।”
“তুমি আজ-ই বলে দেখো আন্টিকে।”
“বলব, বলব। আমি বলেছি যখন, তখন মাকে রাজি না করিয়ে আমি হাল ছাড়ছি না। আপনি আমাকে এত তাড়া দিয়েন না তো। বড়ো ভাইয়ের বিয়ের জন্য এত তাড়া দেখাচ্ছেন, নিজের বেলায় কতটুকু তাড়া থাকে দেখব।”
জাহিদ হেসে বলল,
“সময় আসুক, দেখবে। নিজের বেলায় আমি প্রভাত ভাইয়ের মতো এত অপেক্ষা করব না কি? গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেই একটা জব জয়েন করব। তারপর কোনোদিক না তাকিয়ে আগে তোমাকে বিয়ে করে নেব।”
“আচ্ছা, তারপর?”
“তারপর আবার কী? তারপর আমাদের সংসার হবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে।”
“গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার পরপরই আপনাকে বিয়ে করাতে চাইবে আপনার পরিবার?”
“চাইবে না মানে কী? বিয়ে আমার, বউ আমার, সংসার আমার, অন্য কেউ আপত্তি করবে কেন? আগে বিয়ে করব, তারপর যা হওয়ার হবে।”
“হুম, দেখব তখন এতো বড়ো-বড়ো কথা কতটুকু সত্যি হয়।”
“অবশ্যই দেখবে। দেখবে কী? সাক্ষী হবে। এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দাও।”
মৃদুলা মৃদু হেসে বলল,
“এখনই এত বেশি এক্সাইটেড হওয়ার দরকার নেই। সময়ের কথা কেউ বলতে পারে না। সময় কখন কোন পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়, তা হয়তো আমরা এখন কল্পনা-ও করতে পারছি না।”
জাহিদ অসন্তুষ্ট মুখে বলল,
“এভাবে বলছো কেন মৃদুলা? পরিস্থিতি যা-ই হোক, বিয়ে তো আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে করব না। তুমি কি এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি?”
“বিশ্বাস করব না কেন? আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। অবশ্যই আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু বাস্তবতা বলেও তো একটা কথা আছে। আপনি যতই বলুন আমি-ই আপনার বউ হব। সময় আপনাকে দেখাবে বাস্তবতা মুখের কথার মতো এত সহজ নয়। ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কে হাজারটা বাঁধা স্পষ্ট, তা আপনি চোখ খুললেই দেখতে পাবেন।”
“আমি জানি তুমি কী ভাবছো। ওসব নিয়ে ভেবো না মৃদুলা। আমার ওপর যখন বিশ্বাস আছে, তখন এটুকু বিষয়ে নিশ্চিত থাকো যে ভবিষ্যতে যে বাঁধা-ই আসুক, আমি তোমাকে ছাড়ব না। তোমার জন্য আমি পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে যেতে-ও প্রস্তুত।”
মৃদুলা একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে নিয়ে বলল,
“জীবনে অতটা খারাপ সময়-ও আমাদের না আসুক।”
জাহিদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“আসবে না। ভরসা রাখো।”

ওদিকে অনামিকার বিয়েতে গিয়ে প্রভাত মৃন্ময়ীর পিছু-ই ছাড়ছে না। মৃন্ময়ী এসে হতে সে তার পেছনেই পড়ে আছে। এই নিয়ে তার বন্ধুরা-ও খুব হাসাহাসি করেছে। তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। মৃন্ময়ী রাগ করেও তাকে দূরে সরাতে পারেনি। অনামিকাকে বউ সাজে দেখার পর বন্ধুদের সাথে মৃন্ময়ী খুব প্রশংসা করছিল যে তাকে বউয়ের সাজে খুব সুন্দর লাগছে। তখন সুযোগ বুঝে প্রভাত বুদ্ধি খাটিয়ে চাপা স্বরে তাকে বলল,
“লাল রংটা ছাড়া কি অন্য কোনো রংয়ের শাড়ি পেল না ওরা?”
এ কথা শুনে মৃন্ময়ী তাকে পালটা প্রশ্ন করল,
“কেন, লাল রংয়ে কী সমস্যা?”
“কেমন টকটকে রং, চোখে লাগে।”
“কে বলল? নতুন বউদের লাল রংয়েই সবচেয়ে বেশি মানায়। টুকটুকে লাল রংয়ের শাড়ি পরলেই মনে হয় রাঙা বউ। কেমন একটা বিয়ে-বিয়ে ভাব আসে।”
“এত সাজার-ই বা কী দরকার? বিরক্ত লাগে না?”
“মেয়েরা বিয়েতে তাদের মনমতো সাজতে চায়। বিয়ে তো একদিনই হয়। এই একদিন নিয়ে অনেকেরই অনেক রকম ইচ্ছা থাকে, স্বপ্ন থাকে। তাদের জীবনের বিশেষ দিনে নিজেদের মনমতো সাজতে দেওয়া উচিত। তুমি ওসব বুঝবে না।”
“এখন বুঝে নিয়েছি। তা ম্যাডামের-ও কি তবে নিজের বিয়ের জন্য লাল শাড়ি পছন্দ?”
মৃন্ময়ী ইতস্তত করে বলল,
“তা কখন বললাম?”
“আর বলতে হবে না, বুঝে নিয়েছি।”
“তোমার স্বভাব-ই সবসময় বেশি-বেশি বোঝা।”
“অনামিকাকে আসলে লাল শাড়িতে সুন্দর-ই লাগছে। আমি তো কথাটা বললাম তোমার মনের কথা জানার জন্য।”
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই প্রভাত প্রশস্ত হেসে বলল,
“তুমি তো মুখ ফুটে বলবে না। আমাকে তো জানতে হবে বিয়েতে তুমি কোন রংয়ের শাড়ি পরতে চাও, কীভাবে সাজতে চাও।”
মৃন্ময়ী চাপা স্বরে বলল,
“চুপ থাকো। সবসময় মুখে এক কথা।”
প্রভাত বলল,
“এখন আর চুপ থাকার সময় নেই। তোমার বউ সাজার সময় ঘনিয়ে এল বলে ম্যাডাম।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৫.
সাজেদা বেগম রান্নার জন্য তরকারি কাটছেন। এক বালতি কাপড় একসঙ্গে ধুতে গিয়ে তার রান্নায় অনেক দেরী হয়ে গেছে। রান্নায় বেশি দেরী হলে তাড়াহুড়া লেগে যায়। তাড়াহুড়া করে কাজ করলেই সাজেদা বেগমের মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। মৃদুলা কলেজ থেকে ফিরে বুঝে উঠতে পারেনি মায়ের মেজাজ বিগড়ে আছে।‌ সে রান্নাঘরে এসেই মাকে জিজ্ঞেস করল,
“মা, কী করো?”
সাজেদা বেগম চড়া গলায় উত্তর দিলেন,
“নাচি, তুই দেখছিস না?”
মায়ের ত্যাড়া উত্তরেই মৃদুলা বাসার পরিবেশের অবস্থা বুঝে ফেলল। ধীর পায়ে চুলার কাছে গিয়ে সে নরম গলায় বলল,
“রান্নায় দেরী হয়ে গেছে দেখছি। কিছু করা লাগবে? কী করব বলো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ডাল চুলায় বসিয়ে আর উঠে দেখতেও পারিনি, তরকারি কাটতে বসেছি। দেখ কী অবস্থা।”
সঙ্গে-সঙ্গে মৃদুলা ডাল রান্নার কাজে হাত লাগাল। ডাল নাড়তে-নাড়তে সে মায়ের মেজাজ হালকা করার চেষ্টা করল। ভাব জমানোর জন্য বলল,
“মা, আমি ডালে হলুদ দিলেই রং কেমন গাঢ় হয়ে যায়। তোমার মতো ঠিকঠাক হয়-ই না।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ডালকে তরকারি ভেবে চামচ ভর্তি হলুদ দিলে তো রং গাঢ় হবেই। তরকারির মতো ডালে অত বেশি হলুদ লাগে না। সামান্য পরিমাণে দিবি।”
“আচ্ছা।”
“টমেটো দে। ওই বাটির মধ্যে কেটে রেখেছি, দেখ।”
“আপু না তোমাকে বলেছিল ওর টমেটো টক খেতে ইচ্ছা করে?”
“খাওয়াব নে। কালোজিরা শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন আগে।”
“আচ্ছা, আমি এনে দিবো নে।”

টুকটাক কথাবার্তার পর একসময় সাজেদা বেগম নিজেই বলে উঠলেন,
“ওই ব্যাপারটার কোনো খবর নিয়েছিলি?”
“কোন ব্যাপার?”
“ওই যে মৃন্ময়ী কাউকে পছন্দ করে কি না।”
এতক্ষণ ধরে মৃদুলা এই প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা-ই করছিল। মা নিজেই সুযোগ করে দেওয়ায় তার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দ্রুত উত্তর দিলো,
“শুধু কি খবর নিয়েছি? ভূপৃষ্ঠ থেকে একদম তাজা খবর সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি। বলেছিলাম না এ ব্যাপারে আমাকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারো?”
সাজেদা বেগম হাতের কাজ বন্ধ করে উৎসুক হয়ে উঠলেন। জানতে চাইলেন,
“কী খবর পেলি?”
“খবর একদম একশোতে একশো সত্য। আমি তোমাকে বলব। কিন্তু শর্ত হচ্ছে তুমি রেগে যেতে পারবে না। ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনতে হবে।”
“আচ্ছা শুনছি। তুই তাড়াতাড়ি বল তো।”
মৃদুলা দু’পা এগিয়ে গলার স্বর একটু নিচু করে বলল,
“তোমার কি ওই ছেলেটার কথা মনে আছে, আপা যার কথা বলেছিল?”
“কোন ছেলে?”
“আপার পেছন-পেছন যে ঘুরঘুর করত।”
“ও, হ্যাঁ। মৃন্ময়ীকে সবসময় বিরক্ত করত, ওই ছেলেটা?”
“হ্যাঁ, ওই ছেলেটাই। কিন্তু তোমার কথায় একটু ভুল আছে মা। ওই ছেলেটা আপাকে বিরক্ত করত না। পছন্দ করত, তাই পেছনে ঘুরত।”
“ওই একই তো।”
“উঁহু, এক না। পছন্দ করা এক ব্যাপার, আর বিরক্ত করা আরেক ব্যাপার।”
“তুই পাকামি করতে এসেছিস? মৃন্ময়ী নিজেই তো বলেছিল ছেলেটা ওকে বিরক্ত করে।”
“বলেছিল, কারণ আপা তখন ছেলেটাকে দেখলেই বিরক্ত হত। এই ব্যাপারটা একটু বুঝতে হবে তোমাকে। ছেলেটা কিন্তু আপার ক্লাসমেট ছিল। তখন সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আপা যখনই জানতে পেরেছিল ছেলেটা তাকে পছন্দ করে, তখন থেকেই সে ছেলেটার প্রতি বিরক্ত ছিল। এমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ আপা চাইত-ই না কেউ তাকে পছন্দ করুক, তাকে বিয়ে করতে চাক। ওই ছেলেটা আপাকে বিয়ে করতে চাইত বলেই আপা তার ওপর এত বিরক্ত ছিল। সে তো বিয়ে না করার পণ করে বসে আছে। কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইলে তার ছায়া তো তার বিরক্ত লাগবেই। তুমি তো জানোই তোমার মেয়ে কেমন।”
সাজেদা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“হতে পারে। কিন্তু তুই এখনকার কথা রেখে আগের কথা ঘাঁটছিস কেন?”
“কারণ আছে বলেই ঘাঁটছি। বিরাট কারণ আছে।”
“তো বলছিস না কেন?”
“বলছি, বলছি। ধৈর্য ধরো। আমি যে কথাগুলো বলছি, তা কিন্তু অপ্রয়োজনীয় না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মন দিয়ে শোনো। তো আপা তখন যা-ই বলত, আমরা তার কথাই বিশ্বাস করে নিতাম। তাই না? কেন বিশ্বাস করতাম? কারণ আমরা তো ভেতরের খবর জানতাম না।”
“তাহলে তুই এখন জানলি কীভাবে?”
“তখন তো আপার মুখের কথা-ই সত্য ভেবে নিতাম। এখন খোঁজ নিয়েছি বলেই সত্যিটা জানতে পেরেছি। এখন আমার আফসোস হচ্ছে যে কেন তখন আমি খোঁজ নিলাম না, আর তোমাকে সত্যি কথা জানালাম না। তখন জানালে তুমি একজন বিশ্বাসযোগ্য মেয়ে জামাই পেতে পারতে।”
সাজেদা বেগমের কৌতুহল যেন বেড়েই চলেছে। তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন,
“ছেলেটা কি আবারও ওর পেছনে ঘুরছে?”
“আবারও কী বলছো? ছেলেটা তো আজ পর্যন্ত আপার পিছু-ই ছাড়েনি।”
একথা শুনে সাজেদা বেগমের চোখ দুটো গোলাকার হয়ে গেল। চরম বিস্ময় নিয়ে তিনি বললেন,
“ছেলেটা এখনও মৃন্ময়ীর পেছন-পেছন ঘোরে?”
“হ্যাঁ, সেই থেকে এখন পর্যন্ত ছেলেটা আপার পিছু ছাড়েনি, শুধুমাত্র আপাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য। কোনো ছেলে যে আপার মতো ত্যাড়া মেয়ের জন্য এত ধৈর্য ধরে রাখতে পারে, তা আমার কল্পনাতে-ও ছিল না।”
“বলিস কী! মৃন্ময়ী তা-ও রাজি হলো না?”
“তোমার ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে আজ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি করাতে পেরেছ? ওই ভাইয়াটা-ও পারেনি। তার জায়গায় আমি হলে কবে পিছু ছেড়ে দিতাম। সে এত ধৈর্য কোথায় পেয়েছে আল্লাহ্ জানে।”
সাজেদা বেগম জানতে চাইলেন,
“ছেলেটা কে রে? চিনিস তুই?”
“শুধু চিনি না, ছেলের সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েই এসেছি আমি। ছেলে খুবই ভালো।”
“কী কাজ করে?”
“কম্পিউটার অপারেটর। ইনকাম ভালো। পরিবার-ও ভালো। তোমার মেয়ে যদি একবার বিয়েতে রাজি হয়ে যেত, সুখ সুনিশ্চিত ছিল। আহারে! ভাইয়াটা আপাকে এত ভালোবাসে! অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই বিয়ে করে নিত। তোমার মেয়ে আসলেই একটা হৃদয়হীন।”
“এত ভালো ছেলে হলে এতদিন ধরে ওর পেছনে পড়ে আছে কেন? ভালো কোনো মেয়ে দেখে বিয়ে করতে পারল না?”
“ভালোবাসা মা, ভালোবাসা। ছেলেটা আপাকে সত্যি-সত্যি অনেক ভালোবাসে। নয়তো এ যুগে কে কার জন্য এত অপেক্ষা করে থাকে? এমন ছেলে সচরাচর তোমার চোখে পড়ে?”
সাজেদা বেগমকে খানিক চিন্তিত দেখাল। তিনি বললেন,
“মৃন্ময়ী তো সবসময় ছেলেটার বদনাম-ই করত। আমি তো জানতাম ছেলেটা খুব খারাপ। তো ও কি কিছু না জেনেই এত মিথ্যা কথা বলেছিল?”
“আহা মা! তোমার মেয়ে আবার কোন ছেলের প্রশংসা করে? বিয়ের ভয়ে তো বদনাম করবেই। তুমি তার কথা আর বিশ্বাস কোরো না তো। আর তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যা কথা বলছি? একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি খবর জোগাড় করে এনেছি। বিশ্বাস না হলে তুমি নিজেও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। আপার বন্ধু-বান্ধব সবাই এ বিষয়ে জানে। শুধু আমরা ঘরের মানুষ-ই জানতাম না।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ছেলেটার কোনো ছবি দেখাতে পারবি?”
“পারব। দাঁড়াও, আমি ফোন নিয়ে আসছি।”

মৃদুলা এক দৌড়ে গিয়ে ফোন নিয়ে এল। তারপর প্রভাতের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে তার ছবি বের করে মাকে দেখাল। সাজেদা বেগম ভালোভাবে ছবি দেখে বললেন,
“চেহারা তো ভালোই, খারাপ না।”
“হ্যাঁ, সবদিক থেকেই ভালো। সুপাত্র। আপার জন্য একজন পারফেক্ট। শুধু আপা-ই না বোঝার ভান ধরে থাকে। জানো? আপা কিন্তু এখন আর ছেলেটার ওপর বিরক্ত হয় না।”
“কীভাবে বুঝলি?”
“ছেলেটার সাথে আপার ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে। আপা আসলে বুঝতে পেরেছে ছেলেটা তাকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে। এ কারণেই তোমাকে বলেছিল ছেলেটা আর তাকে বিরক্ত করে না। অথচ বাইরে তারা ভালো বন্ধু।”
সাজেদা বেগম সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলেন,
“বন্ধু?”
মৃদুলা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“বন্ধু তো ওপরে-ওপরে। মনে-মনে এখন তোমার মেয়ে-ও ওই ছেলেকে পছন্দ করে। কিন্তু মুখ ফুটে স্বীকার করে না। স্বীকার করলে যদি বিয়ে করা লাগে, সেই ভয়ে।”
“স্বীকার না করলে তুই জানলি কীভাবে?”
“আমি বুঝে গেছি। হাবভাব দেখেই বুঝতে পেরেছি। তুমি এটা নিশ্চিত থাকো, আমার কোনো কথায় এতটুকুও ভেজাল নেই। আপা সত্যিই ওই ছেলেকে পছন্দ করে। ছেলেটাকে নিয়ে এখন তার কোনো সমস্যা নেই। তার আসল সমস্যাই হচ্ছি আমরা। আমাদের চিন্তা না থাকলে নিশ্চিতভাবে সে এতদিনে ওই ছেলেকে বিয়ে করে নিত।”
সাজেদা বেগমের চোখ-মুখে কৌতুহল সরে এখন চিন্তারা জায়গা করে নিয়েছে। তিনি বললেন,
“এতকিছু ঘটে গেছে তাহলে? এই মেয়ে দেখি নিজের সুস্থ চোখ-ও অন্ধ বানিয়ে বসে আছে। একে নিয়ে যে আমি কী করব!”
মৃদুলা বলল,
“করতে হবে মা, তোমাকেই সব করতে হবে। এখন তুমি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারবে না।”
“কী করব?”
“ওই ছেলের সাথেই আপার বিয়ে দিবে।”
সাজেদা বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“বিয়ে দিবো তোর ঘাড়ত্যাড়া আপাকে? এমনভাবে বলছিস যেন তোর আপা আমার কথায় ওঠে আর বসে। এতদিনে পেরেছি ওকে বিয়েতে রাজি করাতে?”
“আহা! তুমি বুঝতে পারছো না কেন? এতদিন না পারলেও এবার পারবে। কারণ এবারের পাত্র আপার পছন্দের মানুষ। একটু চাপ দিলেই রাজি করাতে পারবে। আমরা তো আছিই তোমার সাথে। তোমার চিন্তা কী?”
“আমার চিন্তা কী? চিন্তা তো ওর ত্যাড়ামি নিয়েই। নিজের ভালো পাগল-ও বোঝে, শুধু ও-ই বুঝল না।”
“বুঝবে মা, বুঝবে। এবার আমাদের আপাকে বুঝাতেই হবেই। আপাকে একটা সুখী জীবন দেওয়ার জন্য এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর আমরা পাব না। এবার আমাদের পারতেই হবে।”
সাজেদা বেগম সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“চেষ্টা-ই করতে পারব। শেষমেশ আবার হয়তো সেই একই ঘটনা ঘটবে। যাইহোক, ছেলেটার সাথে কি কোনোভাবে যোগাযোগ করা যায়? তুই খোঁজ-খবর নিয়েছিস কার থেকে?”
“আমার এক বন্ধুর থেকে। ওই ভাইয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে তার। ভাইয়া না কি বলেছে সে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চায়।”
সাজেদা বেগম বলে উঠলেন,
“সত্যি? কবে?”
“কবে পাঠাবে তা তো নিশ্চিত জানি না। তবে পাঠাবে যে, এটুকু নিশ্চিত থাকো।”
“ঠিক আছে, আমি আজই মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলব। মাথামোটা মেয়ে একটা!”
“আজই কিছু বলার দরকার নেই। তাহলে আবার আপা কী না কী ভাবে। একটু অপেক্ষা করো। আগে বিয়ের প্রস্তাব আসুক। তারপর না হয় যা বলার বলবে।”
“তুই নিশ্চিত, প্রস্তাব পাঠাবে তো?”
“একশো ভাগ নিশ্চিত।”


আমাদের দেখা হয়েছিল এক আয়োজিত সন্ধ্যায়,
কনকনে শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে
তুমি এসেছিলে খুব আয়োজন করে।
প্রথম দর্শনে আমি তোমার মুখ জুড়ে
দেখেছিলাম কেবলই স্নিগ্ধতা,
ঘাসের ওপর জমে থাকা
এক ফোঁটা শিশির বিন্দুর মতো স্নিগ্ধতার
প্রেমে পড়েছিলাম আমি।
আমি সেদিন পরিচিত হয়েছিলাম প্রথম প্রেমের সবচেয়ে সুন্দর, শীতলতম অনুভূতির সাথে।
অথচ আমার তোমাকে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি,
তোমার সাথে প্রেমালাপ হয়নি,
জানা হয়নি তোমার মন।
তবু, তবু আমি প্রেমে পড়েছিলাম!
লোকে জানলে হয়তো তামাশা করে বলত,
‘কয়েক মুহুর্তের সাক্ষাতে-ও বুঝি প্রেম হয়?
এ পাগলামি ছাড়া আর কী?’
পাগলামি বুঝি? হোক তবে!
তুমি বলতে আমার তো ওই পাগলামিটুকুই আছে।
হাত বাড়ালেই আমি তোমায় ছুঁতে পারি,
পা বাড়ালেই হাঁটতে পারি কদম মিলিয়ে।
অথচ, অথচ আমাদের দূরত্ব যেন দুই হাতের নয়,
দুই মাইলের নয়,
কয়েক যুগের, কয়েক শতাব্দীর।
সে দূরত্ব কবে যে কোকিলের কুহুতানের
আড়ালে মুখ লুকাল,
টেরই পেলাম না।
আমার হৃদয়ে বসন্তের সুর যে
এক মাঘের সাঁঝেই নাড়া দিয়েছিল,
কেবল তুমিই তা বুঝলে না, বুঝতে চাইলে না।
প্রিয় বাসন্তী,
তোমাকে দেখার পর আমার জীবনে আর
আলাদা করে বসন্ত আসেনি।
এখন ছয় ঋতু-ই আমার বসন্ত, তুমিময় বসন্ত।

প্রভাত স্বপ্ন দেখে তার মৃন্ময়ীময় বসন্ত কেবল পৃথিবীর বুক জুড়ে নয়, একদিন তার বুক জুড়ে-ও থাকবে। মৃন্ময়ীকে নিয়ে তার সংসার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন বোনা হয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছে সবচেয়ে বড়ো কাজটাই, যা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হবে না। এখন তার একমাত্র লক্ষ্য শুধু মৃন্ময়ীকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া। সে জানে এটা খুব সহজ হবে না। তবে এবার সে ভেবেচিন্তেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মৃন্ময়ীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হলে আগে বাড়িতে বলতে হবে। কিন্তু সে এখনও বাড়িতে কিছু বলেনি। মৃন্ময়ীর সম্পর্কে বাড়ির কেউ এখনও কিছু জানে না। জানানোর মতো সম্পর্ক তার কারোর সাথেই নেই। এই পর্যন্ত অনেকবার বাড়ি থেকে তাকে বিয়ের তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। সে তা কানে তোলেনি বলে কেউ জোর করে-ও এ বিষয়ে কিছু বলেনি। অথচ এবার তার নিজেরই বিয়ের কথা বলার দরকার পড়ছে। তবু সে নিজের মুখে কিছুই বলল না। অস্বস্তির কারণে বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠাল বাবার কাছে। তার বন্ধু গিয়ে যখন তার বাবাকে বলল প্রভাত তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, তখন তার বাবা নিজেই আবার তার কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। মেয়ের বিষয়ে জানতে চাইলেন। প্রভাত মৃন্ময়ীর ব্যাপারে সবটাই বলল। পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে তা-ও বলল। সব শুনে তার বাবার মুখে স্পষ্ট অসন্তোষ দেখা গেল। মুখেও বললেন পরিবার তার পছন্দ হয়নি। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে বিয়ের পরও মেয়ে বাপের বাড়ির দায়িত্ব কাঁধে বয়ে বেড়াবে কেন? প্রভাত বলল,
“ও পরিবারের বড়ো মেয়ে। সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই, তাই বাধ্য হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বিয়ে করলে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না কেন? সমস্যা কোথায়?”
“বিয়ের পর বাপের বাড়ি নিয়ে পড়ে থাকলে নিজের সংসারে মন বসবে না।”
“কে বলেছে আপনাকে? ওকে কি আমার চেয়ে আপনি বেশি চেনেন? পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে বলে কি ও সংসার করার অধিকার রাখে না?”
“এত ঝামেলার কী দরকার? তুই এখনই বিয়ে করতে চাইলে আমরা মেয়ে দেখছি, বিয়ে করিস। এই মেয়ে বিয়ে করার দরকার নেই।”
একথা শুনেই প্রভাত রেগে গেল। শক্ত গলায় বলে দিলো,
“আপনাকে এতকিছু ভাবতে হবে না। আমি ওকে পছন্দ করি, বিয়ে করলে ওকেই করব। সংসার আমি করব, আমার সংসারের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। দরকার পড়লে আমি ওকে আলাদা সংসার দিবো। তবু আপনার সংসারে রাখব না।”
এই নিয়ে বাবার সাথে তার বেশ কিছুক্ষণ তর্ক হলো। তার সৎ-মা রাহেলা বেগম অদূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। প্রভাত বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“এই লোককে বুঝান। নয়তো আপনারা চাইলেও আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করব, না চাইলেও করব।”

মৃন্ময়ী লক্ষ্য করল আজ প্রভাত কথাবার্তা একটু কম বলছে। মুখে সবসময়ের স্বচ্ছ হাসিটা নেই। সে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার কি আজ কোনো কারণে মন খারাপ?”
“নাহ্,” প্রভাত অস্বীকার করল।
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমার তো মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ।”
প্রভাত হেসে বলল,
“তুমি তাহলে আমার মন-ও বুঝতে শিখে গেছো? বাহ্! আমার চেষ্টা তবে সফল হচ্ছে।”
“ফাজলামি কোরো না তো। বলো, বাড়িতে কিছু হয়েছে?”
“উঁহু।”
মৃন্ময়ী বুঝল প্রভাত কিছু বলবে না। তবু তার মন খারাপ থাকলে প্রভাত যেভাবে তাকে জেরা করতে থাকে, তা সে করতে পারল না। মনে-মনে নিজেকে ভীষণ অকর্মণ্য মনে হলো। ভাবল কীভাবে প্রভাতের মন ভালো করা যায়। প্রভাত তার মন ভালো করার জন্য কত চেষ্টা করে। অথচ সে কিছু বলতে-ও পারছে না। প্রভাত হঠাৎ কেমন মলিন কন্ঠে বলে উঠল,
“চলো এবার বিয়েটা করে নিই ম্যাডাম। আর বাঁধা দিয়ো না।”
হঠাৎ প্রভাতকে এভাবে কথা বলতে শুনে মৃন্ময়ী চুপ হয়ে গেল। প্রভাত থামল না, বলতেই থাকল,
“একটা সংসার ছাড়া আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না। তোমার সাথে আমার জীবন জুড়ে যাওয়ার পরও আমি তোমার জীবনের কোনো সিদ্ধান্তে আপত্তি করব না। তোমাকে সমর্থন করার জন্য, তোমাকে খুশি রাখার জন্য যা করতে হয় আমি করব। এতদিনেও কি তুমি আমাকে বুঝতে পারছো না?”
মৃন্ময়ী এবারেও প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাত বলল,
“কিছু বলছো না যে?”
মৃন্ময়ী মাথা নিচু করে হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“কী বলব? তোমায় এক কথা বলতে-বলতে আমি ক্লান্ত।”
“এক কথা আমি আর শুনতে চাচ্ছি না। এবার ভিন্ন কিছু বলো। নিজের মনকে আর কত বেঁধে রাখবে? মনকে একটু ছাড় দাও ম্যাডাম, আমি তাকে খুব যত্নে রাখব। কোনোদিন-ও অযত্ন করব না। তোমার পরিবার নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এ কথা তো তোমাকে হাজারবার বলেছি। তা-ও কেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না?”
“পাগলামি কোরো না প্রভাত।”
“পাগলামি এতদিন করিনি মৃন্ময়ী, এখন করতে চাইছি। খুব শীঘ্রই আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।”
মৃন্ময়ী চমকে উঠে থমকে দাঁড়াল। চট করে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,
“মানে কী?”
প্রভাত শান্ত চোখে চেয়ে উত্তর দিলো,
“মানে খুব শীঘ্রই আমি তোমাকে আমার ঘরে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। হতেও পারে তা এ সপ্তাহের মধ্যেই।”
মৃন্ময়ী উত্তেজিত হয়ে উঠল,
“তোমার মাথায় কী চলছে প্রভাত? এমন কিছু করতে যেয়ো না, প্লিজ।”
“তুমি প্লিজ আমাকে আর আটকিয়ো না।”
কথাটা একটু জোরে বলে ফেলল প্রভাত। সঙ্গে-সঙ্গেই আবার নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলল,
“মৃন্ময়ী, আমার কথা শোনো। সারাজীবন তুমি এমন থাকতে পারবে না। তোমার মা তোমাকে নিয়ে কত চিন্তা করে, তা তো তুমি বোঝো। পরিবারের জন্য বিয়েতে তোমার আপত্তি, আমি বুঝি। কিন্তু আমি তো তোমাকে বারবার কথা দিয়েছি তোমার পরিবারকে আমি নিজের পরিবার বানিয়ে নেব। পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্ব, কর্তব্যে আমি কোনোদিন বাঁধা দিবো না। এমনকি আমার পরিবার থেকেও কোনোরকম বাঁধা আসতে দিবো না। এরপরও তোমার কিসের এত ভয়? দরকার পড়ে আমি নিজের মুখে স্বীকারোক্তি দিয়ে তারপর তোমাকে বিয়ে করব। বিয়ের পর আমার কথার এদিক-সেদিক হলে তুমি আমাকে শাস্তি দিয়ো। তবু আর আমাকে বাঁধা দিয়ো না। আমি আর তোমার আপত্তি শুনতে চাই না। কারণ আমি জানি তোমার মন কী চায়।”
“আমার মন কিছুই চায় না। তুমি এসব করতে যেয়ো না।”
মৃন্ময়ী কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু নিজের কথায় সে কোনো জোরই খুঁজে পেল না। নিজের কাছে নিজেকে চরম মিথ্যাবাদী মনে হলো। সত্যিই তার মন কিছু চায় না? প্রভাত নাছোড়বান্দা। সে স্পষ্ট ভাষায় বলল,
“মন কিছু চায় কি না তা বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর বুঝে নিয়ো। তখনও যদি তোমার অমত থাকে, তাহলে আমি বিশ্বাস করে নেব আমায় তুমি এক মুহুর্তের জন্যও ভালোবাসোনি।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে