মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১০+১১

0
79

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে-ইলোরা জাহান ঊর্মি

১০.
মৃত্তিকা প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়ে মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি কিনেছে। মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কী লাগবে। মৃদুলা তার থেকে এক জোড়া জুতা নিয়েছে। আর মৃন্ময়ী কিছু নিতে রাজি না হওয়ায় মৃত্তিকা নিজেই তার জন্য একটা থ্রি-পিস কিনে এনেছে। নিজেই আবার দরজির দোকান থেকে বানিয়ে-ও নিয়ে এসেছে। জামা এনে সে প্রথমে মৃদুলাকে দেখিয়েছে। মৃদুলা বলেছে ভালো হয়েছে। মৃদুলা কী ভেবে তখন মৃত্তিকাকে বলল,
“আপু, তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
মৃত্তিকা বলল,
“বল।”
“কথা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তোমাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।”
“আচ্ছা শুনছি, বল তুই।”
“বড়ো আপার বিষয়ে।”
“আপার বিষয়ে? কী কথা?”
“তুমি কি প্রভাত ভাইয়ের বিষয়ে জানো?”
প্রভাতের প্রসঙ্গ উঠতেই মৃত্তিকা বলে উঠল,
“ওই বদ লোকটা? জানিস সেদিন কী হয়েছে? আমি আর আপা যে ফুসকা খেতে গেলাম, ওই লোক-ও আমাদের সঙ্গে বসে ফুসকা খেয়েছে। আমাদের না বলে বিল-ও দিয়ে দিয়েছে। আমি তো জানতামই না ওই লোক এখনও আপার পেছনে ঘুরে বেড়ায়। সেদিন আমি এত অবাক হয়েছি, কী বলব! মানে আপা এতদিন যাবত একে কীভাবে সহ্য করেছে, কেন সহ্য করেছে আমার মাথায় ধরে না।”
মৃদুলা মৃদু হেসে বলল,
“এটাই তো আসল কথা আপু। আপা কেন প্রভাত ভাইকে এতদিন ধরে সহ্য করছে?”
মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তুই-ও জানিস উনি আপাকে বিরক্ত করে?”
“জানি। তবে তোমার জানায় ভুল আছে। উনি আপাকে বিরক্ত করে না, ভালোবাসে।”
“কী? ওই ফালতু ছেলে আবার ভালোবাসতে জানে? এতদিন ধরে আপাকে নরম পেয়ে বিরক্ত করছে, তুই তাকে ভালোবাসা বলছিস?”
“তোমার মতে প্রভাত ভাই আপাকে বিরক্ত করে?”
মৃত্তিকা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই।”
“তুমি কীভাবে বুঝলে বিরক্ত করে?”
“আপা তাকে পছন্দ করে না, তবু সে আপার পেছনে ঘোরে জানিস না?”
“এটা তো সঠিক নয়। আচ্ছা তুমি আমাকে বলো, তুমি যতটুকু সময় প্রভাত ভাইকে আপার আশপাশে দেখেছ, ততটুকু সময় প্রভাত ভাই আপাকে কোনো বাজে কথা বলেছে?”
মৃত্তিকা ভাবুক মুখে মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক বাজে কথা না, তবে আমাকে শ্যালিকা বলে খেপিয়েছে।”
“সে তো দুষ্টুমি করেছে। আচ্ছা, আপার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করতে দেখেছ?”
“না।”
“সে কি দেখতে বখাটেদের মতো?”
“না, থাকে তো ভদ্রলোকের বেশ ধরে।”
“আপাকে কি তার ওপর খুব বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেছ?”
“না।”
“তাহলে তুমি কীভাবে বুঝলে যে প্রভাত ভাই আপাকে বিরক্ত করে?”
মৃত্তিকা নিজের কথায় অনড় থেকে বলল,
“বিরক্ত না করলে এই লোক আপার পেছনে কেন ঘোরে? আপা কি তাকে পছন্দ করে?”
“এটাই কথা। আপা তাকে পছন্দ করে।”
মৃত্তিকা চোয়াল ঝুলিয়ে বলে উঠল,
“কী! আপা ওই লোককে পছন্দ করে? তুই কি পাগল হয়েছিস?”
“উঁহু, আমি ঠিকই আছি। আমি শুধু তোমার চোখের সামনে থেকে ভুলের পর্দাটা সরাতে চাইছি।”
মৃত্তিকা সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“তুই কি প্রভাত ভাইয়ের হয়ে কথা বলছিস?”
মৃদুলা হেসে বলল,
“শোনো আপু, কোনো বখাটে ছেলেরা আমাদের আপার পেছনে ঘোরার মতো ধৈর্য রাখে না, এটা অন্তত আমি বিশ্বাস করি। আপা তো কাউকে পাত্তা-ই দেয় না, আর না কারোর প্রস্তাবে সাড়া দেয়, তাহলে কোন ছেলে জেনেশুনে তার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করবে? কেউই করবে না। কারণ সবাই জানে আপার কাছে আশা রেখে কোনো লাভ নেই। কিন্তু প্রভাত ভাই আলাদা। সে আপার বিষয়ে সবকিছু জানে, আপাকে খুব ভালোভাবে চেনে, তবু সে আপাকে ছাড়তে রাজি না। আপা কিন্তু তাকে কোনোরকম আশা দেয়নি, তবু সে আপার জন্য অপেক্ষা করে আছে। অদৃশ্য আশা নিয়ে সে দিনের পর দিন আপাকে ভালোবাসা নিবেদন করছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে একদিন আপা তাকে গ্রহণ করবে।”
মৃত্তিকা বলল,
“তার জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে? আপার পেছনেই কেন পড়ে আছে?”
“সেটাই তো, তার জন্য মেয়ের অভাব নেই। সে চাইলেই খুব ভালো পরিবারের সুন্দরী কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সে তা করছে না। করবে কী করে? তার মন তো পড়ে আছে আপার কাছে। তুমি তার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে না ভাবলে কখনোই বুঝতে পারবে না আপাকে সে কতটা ভালোবাসে।”
মৃত্তিকার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। সে ভাবুক মুখে বলল,
“সত্যিই কি তাই?”
“হুম, একদম তাই। প্রভাত ভাই আপাকে খুব ভালোবাসে। সে আপাকে বিরক্ত করে না, ছায়ার মতো আপার পাশে থাকার চেষ্টা করে। আপার মন পাওয়ার জন্য রোজ চেষ্টা চালিয়ে যায়।”
“কিন্তু আপা?”
“আপা? আপার বিষয়টা ধরা খুব কঠিন কিছু না। তুমি একটু ভাবলেই বুঝে যাবে।”
মৃত্তিকা একটু চিন্তা করে বলল,
“আপা কি বিয়ের ভয়ে প্রভাত ভাইকে এড়িয়ে চলছে?”
“একদম ঠিক ধরেছ। আপা ভয় পায়। আপার ভয় আমাদের নিয়ে, এই সংসার নিয়ে। আমাদের এই সংসারের একমাত্র সম্বল সে। সে চলে গেলে এই সংসারের কী হবে, শুধুমাত্র এই চিন্তা করে আপা নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিচ্ছে। আমাদের জন্য সে তার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে পারছে না। প্রভাত ভাইকে সে অপছন্দ করে না। বরং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সে ঠিকই এতদিনে প্রভাত ভাইকে নিয়ে চিন্তা করত। তা-ও সে করতে পারছে না। সংসারের বাধ্যবাধকতা তাকে তার নিজস্ব জীবন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে,” মৃত্তিকার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
“কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আপাকে তো নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। তার এখন নিজের সংসার সাজানোর সময়। আমাদের জন্য সে আজীবন এমন থাকতে পারবে না।”
“এটাই তাকে বুঝাতে হবে। তাকে তার জীবন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এবার অন্তত তার নিজস্ব একটা সংসার প্রয়োজন। নয়তো আজীবন আমরা আপার কাছে দোষী থাকব। আপা হয়তো মুখে কিছু বলে না, কিন্তু একটা নিজস্ব মানুষ, নিজস্ব সংসারের শখ তো তার-ও আছে।”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“ঠিক বলেছিস, আপাকে এই বিষয়ে বুঝানো দরকার। এখন তো আমি চাকরি করছি, তুই-ও টুকটাক নিজের খরচ চালাতে পারিস। এবার আপাকে আমাদের মুক্তি দেওয়া উচিত।”
“তুমি একটু আপার সাথে কথা বলো না আপু। আমি ছোটো মানুষ, আপার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হয়। আপা-ও আমার সাথে মনখুলে কিছু বলবে না। তুমি বললে আপার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারবে।”
“ঠিক আছে, আমি কথা বলে দেখব। কিন্তু তোর মাথায় এত খবর এল কোত্থেকে?”
মৃদুলা মুচকি হেসে বলল,
“আমার স্পাই আছে।”
“কে?”
“বিবিসি নিউজের হেড।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলল,
“ফাজিল।”


মৃত্তিকার থেকে নতুন জামা পেয়ে মৃন্ময়ী ভীষণ খুশি হয়েছে। তার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছে সে মৃত্তিকার পরিবর্তন দেখে। মৃত্তিকা সত্যিই বদলে গেছে। আগের মৃত্তিকা আর বর্তমান মৃত্তিকার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখনকার মৃত্তিকার চিন্তাধারা অন্যরকম। একদম যেমনটা মৃন্ময়ী সবসময় দেখতে চেয়েছিল। অবশেষে মৃন্ময়ীর একটা চিন্তা দূর হলো। যদিও তার পেছনে টাকা খরচ করার জন্য সে মৃত্তিকার ওপর কপট রাগ-ও দেখিয়েছে। বলেছে তার জন্য আর কিছু না কিনতে। মৃত্তিকার এখন নিজস্ব খরচ আছে। বেশি-বেশি পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন তার। মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তুই আমার পেছনে যা খরচ করেছিস, তা তো আমি তোকে ফেরত দিতে পারব না। তোর কাছে না হয় আজীবন ঋণী থেকে যাব। আমার এটুকু খরচ যদি তোর অনেক মনে হয় তাহলে ভবিষ্যতে তুই আমার বাচ্চাকে দিয়ে শোধ করে দিস।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোর বাচ্চাকে দিয়ে শোধ করতে যাব কেন? তোর বাচ্চা কি আমার পর হবে? আমি না দিলে ওকে কে দিবে? ও আসুক, তারপর দেখবি মৃদুলা-ও ওকে তোর চেয়ে বেশি দিবে। কত বছর পর এই পরিবারে নতুন সদস্য আসবে! একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাদের হাতে বড়ো হবে। ভাবতেই আমার আনন্দ হচ্ছে। মৃদুলার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”
মৃন্ময়ীর চোখেমুখে আনন্দ। মৃত্তিকা কেবল হেসেই চলল। সে মনেপ্রাণে শুধু চায় তার সন্তান যেন সবার ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে পারে। আপাকে দিয়ে তার সেই বিশ্বাস আছে। নিজের পরিবার না পাক, তার সন্তান মাকে পাবে, মায়ের পরিবার পাবে। মায়ের পরিবার-ই হয়ে উঠবে তার পরিবার। কথায়-কথায় মৃত্তিকা বলল,
“আপা, তোকে একটা প্রশ্ন করব?”
“বল।”
“তোর নিজস্ব একটা সংসারের সাধ হয় না?”
মৃন্ময়ী খানিক থমকাল। বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস?”
“প্রয়োজন আছে বলেই করছি। বল না, তোর কি সংসারের সাধ হয় না? এই দায়িত্বের জীবন থেকে বেরিয়ে নিজের একটা মানুষকে আঁকড়ে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“উত্তরটা তো তোর প্রশ্নেই আছে।”
“কী?”
“দায়িত্বের জীবন। দায়িত্বের জীবন থেকে বেরোনোর পথ কোথায়?”
“পথ কি তুই কোনোদিন খুঁজেছিস?”
“খুঁজে কী হবে? যা সম্ভব না, তার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করে তো লাভ নেই।”
“আর তোর নিজের সাধ-আহ্লাদ? জীবন নিয়ে কি তুই একটুও ভাববি না?”
“আমার অত সময় নেই। বাদ দে তো এসব কথা।”
মৃত্তিকা প্রসঙ্গ বাদ দিতে নারাজ। সে পুনরায় বলল,
“তোর এখন নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত আপা। অনেক হয়েছে দায়িত্ব পালন। দায়িত্বের ভারে তুই নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার করতে পারিস না।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তা তুই আমার ভবিষ্যত আলোকিত করতে বলছিস কীভাবে?”
“তুই এবার বিয়েটা করে ফেল আপা। তোর একটা সাজানো সংসার হোক।”
“তারপর?”
“তারপর আবার কী? এই সংসারের অজুহাত দেখাবি তো? এই সংসারের জন্য তুই অনেক ত্যাগ করেছিস আপা। অনেক হয়েছে, আর না। আমরা এখন আর ছোটো নেই।”
“আচ্ছা? কতটা বড়ো হয়েছিস তোরা শুনি?”
“যথেষ্ট বড়ো হয়েছি। হয়তো তোর মতো করে সংসার সামলানোর মতো বড়ো হইনি, কিন্তু চেষ্টা করার মতো বড়ো তো হয়েছি। তোর অনুপস্থিতিতে আমি আর মৃদুলা আছি আপা। আমরা দুজনেই এখন উপার্জনক্ষম। দুজন মিলে ঠিক সবটা সামলে নিব। তুই প্লিজ এবার ছুটি নে।”
“তুই আমাকে ছুটি দিচ্ছিস মৃত্তিকা? একটা সংসার সামলানো তোর ভাবনার মতো এত সহজ না রে। নিজের কাঁধে দায়িত্ব পড়লে তা টের পাবি। মৃদুলার এখনও নিজের সম্পূর্ণ খরচ সামলানোর সামর্থ হয়নি। এখনই ও পড়াশোনার খরচ সামলালে হাত খরচে টানাটানি পড়ে যায়। আর সামনে তো ওর পড়াশোনার খরচ আরও বাড়বে। টিউশনের টাকায় ও কতটুকু সামলাবে? তোর এখন নিজের জন্য-ই কত খরচের প্রয়োজন। সামনে তোর বাচ্চার দায়িত্ব-ও নিতে হবে। তুই কী করে সংসারের খরচ সামলাবি? তারপর মায়ের ঔষধের খরচ? তা কী করে সামলাবি?”
মৃত্তিকা ক্ষণকাল চুপ থাকার পর অন্ধকার মুখে বলল,
“তুই তো আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছিস আপা।”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, আমি তোকে প্রকৃত সত্যিটা বুঝাতে চাইছি। তোরা আমাকে ছুটি দিতে চাইলেও এই সংসার আমায় ছুটি দিবে না। দায়িত্ব থেকে আমার মুক্তি নেই।”
“কিন্তু তোর ভবিষ্যত জীবনের কী হবে আপা?” ছলছল চোখে চেয়ে বলল মৃত্তিকা।
“আমার ভবিষ্যত জীবন? জানি না রে। আমার ভবিষ্যত আমি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কপালে যা আছে হবে।”
“কী হবে? কীভাবে হবে? তুই কি এই সংসারের দায়িত্ব পালন করেই জীবন কা’টিয়ে দিবি?”
“কপালে যদি তা-ই লেখা থাকে, তবে দিবো। বাবা তার এই সংসার আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছে রে বোন। আমি তার সেই সংসারের হাল মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার মতো স্বার্থপর হতে পারব না। বিশ্বাস কর, শত কষ্টের মাঝেও আমি তোদের নিয়ে অনেক ভালো আছি। কিন্তু তোদের ছেড়ে গিয়ে আমি কোনোদিন-ও ভালো থাকতে পারব না। অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাবে। যে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য আমি নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করে এসেছি, সেই সংসার মাঝনদীতে ডুবিয়ে দিয়ে আমি কীভাবে নিজের জন্য সুখের সংসার সাজাব বলতে পারিস? এমন দুঃসাহস তো আমার নেই রে বোন।”
মৃত্তিকা কেঁদে ফেলল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল,
“সব আমার দোষ। আমার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি যদি তোর মতো হতাম তাহলে আজ আমাদের এমন দুর্দিন দেখতে হত না। আমাকে তুই মাফ করে দিস আপা।”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে বাঁধা দিতে চাইল। মৃত্তিকা দাঁড়াল-ই না। দ্রুত তার সামনে থেকে সরে গেল। দরজার বাইরে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে ছিল মৃদুলা। মৃত্তিকা বেরোতেই সে বলে উঠল,
“প্রভাত ভাইয়ের কথা বললে না কেন?”
মৃত্তিকা নাক টেনে বলল,
“আপাকে এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই রে। আপা আমাদের কথা শুনবে না।”
“আপা তো তোমাকেই উলটো বুঝিয়ে দিলো।”
“আমাদের জীবনটা এমন কেন হলো রে মৃদুলা? আমরা কেউ কি একটু সুখের ভাগীদার না?”
মৃদুলা সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“জানি না। তুমি কেঁদো না তো। কেঁদে কোনো ফায়দা নেই। ঘরে যাও।”


প্রভাতকে দেখে আজ মৃন্ময়ীর মনে-মনে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। গতকালের ঘটনা আর মৃত্তিকার কথা মিলিয়ে তার মনটাই বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। প্রভাত তার মুখোভাব লক্ষ্য করে শুধাল,
“মুখটা অমন করে রেখেছ কেন? কী হয়েছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“কিছু না।”
“পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা?”
মৃন্ময়ী না-বোধক মাথা নাড়ল। প্রভাত বলল,
“তাহলে?”
“বললাম তো কিছু না।”
“তোমার মুখ তো বলছে কিছু হয়েছে।”
“উঁহু, আমি ঠিক আছি।”
প্রভাত পালটা জবাবে বলল,
“তুমি ঠিক নেই। তোমার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করে বসল,
“কেন বুঝতে পারো?”
“ভালোবাসি তাই।”
“তোমাকে এত বুঝতে হবে না।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আর কত নিষেধাজ্ঞা জারি করবে?”
“জারি করেই বা লাভ কী হচ্ছে? তুমি তো এক ঘাড়ত্যাড়া।”
“সেটাই। লাভ নেই জেনেও এই এক কথা হাজারবার বলার কী দরকার?”
“তুমিও তো এক কথা লক্ষ বার বলো। তোমার কী দরকার?”
“আমার তো দরকার আছেই। আমি লক্ষ বার না বললে তোমাকে পাব কীভাবে?”

মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। চোখ জোড়া এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার শরীর কেমন?”
“ভালো। ভেবেছিলাম জ্বর-টর আসবে, কিন্তু আসেনি। অসুখ-ও বুঝে গেছে আমার সেবা করার মানুষ নেই।”
হাসল প্রভাত। মৃন্ময়ী বলল,
“তোমার মায়ের সাথে তোমার সম্পর্ক এতই খারাপ?”
“আমার কোনো মা নেই।”
মৃন্ময়ী দেখল প্রভাতের মুখের রং বদলে গেছে। তাই ওই প্রসঙ্গ আর সামনে টানল না। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটল।‌ মৃন্ময়ী হঠাৎ ডাকল,
“প্রভাত?”
“হুঁ?” সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিলো প্রভাত।
“এতদিনে যদি আমি হ্যাঁ বলে দিতাম, তাহলে তুমি আমার জন্য কী করতে?”
“তুমি যা চাইতে তা-ই।”
“যেমন?”
“তোমার পরিবারের কথা বুঝাতে চাইছো তো? আমি জানি তুমি তোমার পরিবার ছাড়া আর কিছু চাইতে না। তাতে আমি কোনোদিনই আপত্তি করতাম না। তোমার পরিবারকে তুমি সাপোর্ট দিবে, সব জেনেবুঝে তাতে বাঁধা দেওয়ার মতো অত খারাপ মানুষ-ও আমি নই। আমি তো সবসময় বলি, তোমাকে পেয়ে গেলে আমি তোমাকে সাপোর্ট দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করব। তুমি যাতে খুশি থাকবে, ভালো থাকবে, আমি তা-ই করব।”
“কিন্তু আমি তো তোমাকে এমন সুযোগ দিয়ে খুশি করতে পারব না।”
প্রভাত মলিন হাসল। বলল,
“আমি অপেক্ষা করব।”
“আর কতদিন প্রভাত?”
“যতদিন না তুমি আমার নামে কবুল পড়ছো।”
“ভালোবাসায় জেদ চলে না।”
“উঁহু, ভালোবাসায় জেদ নয়, জোর চলে না। তাই তো আমি তোমাকে জোর করছি না। তবে জেদ আমি ছাড়ব না। ভালোবাসায় এটুকু জেদ না থাকলে ভালোবাসা জয় করব কীভাবে?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার সঙ্গে তর্ক করাই আমার ভুল।”
প্রভাত দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“চিন্তা কোরো না। এখন তর্ক করতে হচ্ছে আমার ভালোবাসা জয়ের প্রয়োজনে। বিয়ের পর তর্ক করব না। তখন তোমার বিজয়-ই আমার বিজয়।”
মৃন্ময়ী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“দুঃস্বপ্ন দেখো।”
প্রভাত বলল,
“দুঃস্বপ্নে হলেও তো আমাকে বিয়ে করে নিতে পারো।”
একটা ধারালো দীর্ঘশ্বাস মৃন্ময়ী অতি সন্তর্পণে চেপে নিল। দুঃস্বপ্নে বিয়ে? কেন? এটা তো বাস্তব-ও হতে পারত। বাস্তবতায় রূপ নেওয়া স্বপ্ন দেখা-ও কি তার জন্য নিষিদ্ধ? তার ভাগ্যটা কি কোনোদিন তার অনুকূলে আসবে না?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১১.
সময় যেন কে’টে যায় চোখের পলকে। মৃত্তিকার প্রেগন্যান্সির তখন ছয় মাস চলছে। এরমধ্যে একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে সে তার প্রাক্তন স্বামীর সামনে পড়ে গেল। এতদিন পর হঠাৎ এভাবে দেখা হওয়ায় মৃত্তিকা একটু ভড়কে গেলেও সে নিজেকে সামলে নিল। না দেখার ভান করে চলে যাওয়া ধরল। কিন্তু শফিক তার পথরোধ করে দাঁড়ানোর ফলে সে দাঁড়াতে বাধ্য হলো। হুট করে এভাবে যেচে এসে সামনে দাঁড়ানোর মানে কী? মুখোভাব কঠিন করে মৃত্তিকা বলে উঠল,
“কী সমস্যা?”
শফিক হাসিমুখে বলল,
“অনেকদিন পর দেখা হলো। কেমন আছো মৃত্তিকা?”
লোকটার হাসি দেখে মৃত্তিকার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। সে শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি কেমন আছি তা দিয়ে আপনার কী প্রয়োজন?”
“কী যে বলো! আমি ছাড়া আর কার প্রয়োজন হবে? আমার-ই তো প্রয়োজন।”
“আমার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার কাছে, সরুন।”
মৃত্তিকা পাশ কেটে চলে যেতে চাইল। শফিক যেতে দিলো না। আবারও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
“আহা! এত তাড়া কিসের? একটু কথা শুনে যাও না।”
মৃত্তিকা বলল,
“আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা শোনার মতো সম্পর্ক আপনার সাথে আমার আর নেই।”
“জানি, জানি। সম্পর্ক তো ভেঙেই গেছে। তখন তো আর জানতাম না সম্পর্ক ভাঙার পরও আবার নতুন কোনো সম্পর্ক জন্ম নিবে।”
মৃত্তিকার বুকের ভেতর হঠাৎ কামড় দিয়ে উঠল। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ করতে লাগল। তার বিস্ময় দেখে শফিক আবারও হাসল। মৃত্তিকার সন্দেহ জাগল শফিক খবরটা জেনে গেছে কি না। মৃত্তিকার পরনের বোরখা যথেষ্ঠ ঢিলেঢালা। কেউ দেখলে বুঝতে পারে না সে অন্তঃসত্ত্বা। তবু সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“পথ ছাড়ুন, আমার দেরী হচ্ছে।”
শফিক বলল,
“দাঁড়াও, দাঁড়াও। এখনও তো আমার প্রশ্নের উত্তর-ই পেলাম না।”
“কী প্রশ্ন?”
“আমার বাচ্চার কথা তুমি আমাকে জানাওনি কেন?”

ব্যস! মৃত্তিকা যা সন্দেহ করেছিল, তা-ই হলো। খনিকের জন্য মৃত্তিকা একটু ভড়কে গেলেও নিজেকে সে সামলে নিল। উত্তরে বলল,
“কিসের বাচ্চা?”
“কিসের বাচ্চা? পেটে যে বাচ্চা নিয়ে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছ, সেই বাচ্চা। আমার বাচ্চা।”
“আমি আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসিনি। বলুন আপনারা বের করে দিয়েছেন। আর আপনাকে কে বলল আমি আপনার বাচ্চা নিয়ে এসেছি?”
“তুমি কি ভেবেছিলে, বাচ্চার খবর গোপন রাখলে আমি জানতে পারব না? হুহু, তুমি ডালে-ডালে চললে আমি চলি পাতায়-পাতায়। তোমার সব খবরই আমার জানা।”
মৃত্তিকা ধিক্কার জানিয়ে বলল,
“অপ্রোজনীয় ভেবে যাকে গলাধাক্কা দিয়ে জীবন থেকে বের করে দিয়েছেন, তার খবর রাখেন আপনি কোন প্রয়োজনে?”
“খবর না রাখলে কি এমন খুশির খবর জানতে পারতাম?”
“আপনার খুশি হওয়ার কারণ কী?”
“আমার সন্তান আসবে, আমি খুশি হব না?”
“না। এই বাচ্চা আপনার না। বর্তমানে ওর মায়ের কোনো স্বামী নেই, তাই ওর-ও কোনো বাবা নেই। মা ছাড়া ওর কেউ নেই।”
শফিক চোখ বড়ো করে বলল,
“আমাকে না জানিয়ে আমার বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, আর বলছিস বাচ্চা আমার না? তোর এত বড়ো সাহস হয় কী করে? কে দিয়েছে তোকে এমন সাহস?”
মৃত্তিকা শক্ত গলায় বলল,
“রাস্তার মাঝে একদম চেঁচামেচি করবেন না। বাচ্চা নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কিসের? আমার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই, আমার বাচ্চার সাথেও নেই।”
“এই খবরদার, বাচ্চা নিয়ে কোনো বড়োগলা করবি না। এই বাচ্চা আমার। ভালোয়-ভালোয় বাচ্চা আমাকে দিয়ে দিবি।”
কথাটা শুনেই মৃত্তিকা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। কঠিন মুখে রাগত স্বরে বলল,
“আমার বাচ্চা যাওয়ার সাহস আপনাকে কে দিয়েছে? বিয়ে করেছেন, নতুন বউ নিয়ে সংসার বেঁধেছেন, তার কাছে যান না। আমার বাচ্চার কী প্রয়োজন আপনার?”

এরপর শফিক খ্যাপা ষাঁড়ের মতো যা উত্তর দিলো, তাতে মৃত্তিকার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল তার বর্তমান বউ সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। ডক্টর বলেছে সে কোনোদিনও মা হতে পারবে না। এ কারণেই শফিক এখন তার বাচ্চার পেছনে পড়েছে। মৃত্তিকা কটাক্ষ করে বলল,
“খুব শখ করে বিয়ে করেছিলেন না? এখন বিয়ের শখ মিটে গেছে? ভেবেছিলেন অন্যায় করে পার পেয়ে যাবেন? এবার দেখুন, এটা আপনার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি। আল্লাহ্ আপনাকে যোগ্য শাস্তি দিয়েছেন।”
শফিক ধমকে উঠে বলল,
“চুপ থাক। ফালতু কথা বলবি না। তোর ফালতু আলাপ শুনতে আসিনি আমি।”
মৃত্তিকা আঙুল তুলে বলল,
“আপনিও আমাকে তুই-তুকারি করবেন না। আপনি আমার কাছে এখন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে গলাবাজি করার কোনোরকম অধিকার আপনার নেই।”
শফিক হঠাৎ মৃত্তিকার আঙুলটা মুচড়ে ধরল। মৃত্তিকা ব্যথায় ককিয়ে উঠলেও সে ছাড়ল না। চোখ বড়ো করে কড়া গলায় বলল,
“খুব বাড় বেড়েছে তোর, না? আমার সাথে একদম সাহস দেখাতে আসবি না। তোকে আমার থেকে ভালো আর কেউ চেনে না। বাচ্চা তুই আমাকে দিতে না চাইলেও আমি ঠিক নিয়ে নেব। তুই শুধু জন্ম দে।”
আঙুলের ব্যথায় মৃত্তিকার চোখে পানি চলে এসেছে। তবু সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“দুঃস্বপ্ন দেখুন। আমি মরে গেলেও আমার বাচ্চা আপনার মতো অমানুষের হাতে দিবো না। আঃ! আঙুল ছাড়ুন। আমি কিন্তু এখন লোকজন ডাকব।”
“ডাক, দেখি তোর কোন বাবা আসে।”

কাকতালীয়ভাবে জাহিদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিল। দূর থেকে মৃত্তিকাকে দেখে সে চিনতে পেরেছিল। মৃদুলার ফেসবুক পোস্টে তার আপাদের অনেকবার দেখেছে সে। ঘটনার অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরেই সে দৌড়ে এগিয়ে এল। একদল ছেলেপেলেকে আড্ডা দিতে দেখে বুদ্ধি করে সে তাদের-ও ডেকে নিয়ে এল। হঠাৎ করে একদল ছেলে এসে ঘিরে ধরে নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ায় শফিক বেশ ঘাবড়ে গেল। শফিকের হাত থেকে ছাড় পেয়েই মৃত্তিকা ছেলেগুলোকে বলল শফিক তার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। ফলস্বরূপ শফিক ছেলেগুলোর কাছে বেশ ঝাড়ি খেল। মৃত্তিকার কাছে মাফ-ও চাইতে হলো তাকে। শফিক বিদায় হওয়ার পর ছেলেগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে মৃত্তিকা-ও স্কুলের দিকে হাঁটা দিলো। জাহিদ তাকে ডেকে রিকশা নিয়ে দিলো। মৃত্তিকা রিকশা নিতে চায়নি। জাহিদ তার বারণ শুনল না। রিকশা ঠিক করে দিয়ে ভাড়াটা-ও সে দিয়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা ভীষণ কৃতজ্ঞতা বোধ করল। মৃত্তিকাকে বিদায় দিয়েই জাহিদ মৃদুলাকে কল করল। ঘটিত খবরটা মৃদুলার কানে তুলে দিতে সে দেরী করল না। মৃত্তিকা হয়তো বাসায় ফিরে কাউকে জানাবেই না। কিন্তু ব্যাপারটা তার পরিবারের জানা জরুরী মনে করল সে। যদিও মৃত্তিকা তাকে চেনে না। মৃদুলাকে খবর দিলেও সে বুঝতে পারবে না খবরটা কে দিয়েছে।
মৃদুলা এমন খবর পেয়েই সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ীকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। তবে মাকে জানায়নি। মৃন্ময়ী তখন প্রথম ক্লাসে ঢুকেছিল। খবরটা শুনেই তার মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ল। সে ভালো করেই জানে শফিক ছেলেটা মোটেও সুবিধার না। এ কারণেই ছেলেটার সাথে মৃত্তিকার সম্পর্কে সে আপত্তি জানিয়েছিল। অথচ সেই ছেলেটাই শেষমেশ মৃত্তিকার জীবনে আতঙ্ক ছড়াতে লাগল। চিন্তায় মৃন্ময়ী সারাদিন ঠিকঠাক ক্লাস-ও নিতে পারল না। মৃত্তিকাকে কল করে তার খবর নিয়েছে সে। তবু তার মনের মধ্যে শুধু ওই ভয়টাই ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ স্কুল ছুটির পর সে নিজেই উলটো পথে গেল মৃত্তিকাকে এগিয়ে আনতে। বলা তো যায় না, ফেরার পথে যদি ছেলেটা ওকে আবার বিরক্ত করে? ওদিকে প্রভাত এসে তাকে খুঁজে পেল না। পথিমধ্যে মৃত্তিকা বোনকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। আজকের ঘটনার পর তাকে মা-বোন সবাই ফোন করেছিল। এদের যে কে এই খবর দিলো বুঝতেই পারছে না সে। তবে মৃন্ময়ীকে দেখে তার অনেকটা শান্তি লাগছে। ছুটির পর স্কুল থেকে বেরিয়ে তার বারবার মনে হচ্ছিল শফিক আবারও পথ আটকাবে। মৃন্ময়ীকে পেয়ে তার সাহস বেড়ে গেছে। সে মৃন্ময়ীকে জিজ্ঞেস করল কে তাকে খবর দিয়েছে। মৃন্ময়ী নিজেও উত্তর দিতে পারল না। কারণ মৃদুলা তাকে স্পষ্টভাবে বলেনি সে কোত্থেকে এই খবর পেয়েছিল। তবে একদিনের নিরাপত্তায় মৃত্তিকার রক্ষা মিলল না। এরপরও শফিক তাকে বারবার জ্বালাতন করেছে। স্কুলে যাওয়ার সময়েই সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। মৃত্তিকা প্রতিবাদ করলেই নানান আজেবাজে কথা বলে। মানসম্মানের ভয়ে মৃত্তিকা রাস্তার মাঝে চিৎকার করতে পারে না। প্রথমদিকে ব্যাপারটা সে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। বাড়িতে সবাইকে বলেছিল শফিকের সাথে তার আর দেখা হয় না। কিন্তু একই ঘটনা যখন বারবার ঘটতে লাগল, তখন মৃত্তিকা অসহ্য হয়ে মৃন্ময়ীকে জানাল। মৃন্ময়ী শুনে অবাক হয়ে বলল,
“তুই এই কথা আমাকে আগে জানাসনি কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“তোদের দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি, তাই।”
“মানে কী? তোর কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে মৃত্তিকা? তুই কোন আক্কেলে এই রিস্ক নিয়েছিলি? ওই লোক যদি তোর কোনো ক্ষতি করে ফেলত?”
“কী করতাম বল? তোদের জানালেই কি তোরা ওর কিছু করতে পারতি?”
“আমাদের কথা বাদ দে। তুই কেন চুপচাপ সহ্য করেছিস? আশপাশের লোকজন ডাকতে পারতি। গণধোলাই না খেলে ও সোজা হবে না।”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলল,
“ও মানুষ নেই আপা, অমানুষ হয়ে গেছে। মুখের ভাষা শুনলে তুই বুঝতে পারতি। বাচ্চা দিবো না বললেই আমাকে যা-তা বলে গালাগাল করেছে। লোকজন কীভাবে ডাকব? ওর মানসম্মান না থাকলেও আমার তো আছে। রাস্তার মাঝে ও কী করে বসে তার তো ঠিক নেই। যা হিংস্র পশুর মতো ব্যবহার!”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“এখন তুই করতে বলছিস? থানায় মামলা করবি?”
মৃত্তিকা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“মামলা? মামলা করে কী হবে? আজ মামলা করব, কাল ও পুলিশকে টাকা খাইয়ে মামলা তুলে নিবে। তুই ওদের চিনিস না আপা।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এবার বুঝতে পারছিস ওই ছেলে তোর চোখে কেমন ধুলা দিয়ে রেখেছিল?”
মৃত্তিকা মলিন মুখে বলল,
“বুঝতে পারছি, এখন আর বুঝেই কী হবে? যা হওয়ার ছিল, তা তো হয়েই গেছে। এখন কী করা যায় বল তো?”
মৃন্ময়ী ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। সমাধান তো একটা বের করতেই হবে। সমাধানের কথা ভাবতেই তার প্রথমে মাথায় এল প্রভাতের নাম। ব্যাপারটা প্রভাতকে জানালে কেমন হয়? প্রভাত হয়তো কিছু একটা করতে পারবে। আবার প্রভাতের কাছে সাহায্য চাইতেও কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এদিকে তার মনের কথা মৃত্তিকা মুখেই বলে ফেলল। তার-ও প্রভাতের কথা-ই মাথায় এসেছে। সে বলে উঠল,
“প্রভাত ভাইকে বললে কেমন হয় আপা? উনি কিছু বললে হয়তো ভয় পাবে। তুই ওনাকে একবার বলে দেখবি?”
মৃন্ময়ী চিন্তিত মুখে বলল,
“আমি বলব?”
মৃত্তিকা অনুরোধ করে বলল,
“বল না আপা। তুই বললে উনি নিশ্চিত সাহায্য করবে।”
মৃন্ময়ী ভারী বিপাকে পড়ে গেল। এছাড়া আর কোনো উপায়ও তার মাথায় এল না। মৃত্তিকাকে সে আশ্বাস দিলো প্রভাতকে বলবে। পরদিন প্রভাতের সামনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার কেবল চিন্তা-ই হয়েছে। শেষমেশ প্রভাতের কাছে তাকে সাহায্য চাইতে হবে। প্রভাত মনে-মনে তার ওপর না হাসলেই হয়। প্রভাতকে কীভাবে বলবে তা নিয়ে সে চিন্তা করলেও, প্রভাত নিজেই তার জন্য ব্যাপারটা সহজ করে দিলো। প্রভাত তার মুখের অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে বসল,
“তুমি কি কোনো দুশ্চিন্তায় আছো? কদিন ধরে দেখছি একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ওই, সমস্যা একটু চলছে।”
প্রভাত আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,
“কী সমস্যা চলছে?”
“মৃত্তিকাকে নিয়ে সমস্যা।”
“মৃত্তিকা আবার কী করল?”
“কিছু করেনি, মৃত্তিকার-ই সমস্যা। ও যাকে বিয়ে করেছিল, ওই ছেলেটা ওকে খুব জ্বালাতন করছে।”
“ওই শফিক? কী করেছে ও?”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকার ব্যাপারটা খুলে বলল। মনোযোগ দিয়ে সব শুনে প্রভাত বলল,
“ওই বাটপার এত বাড় বেড়েছে, তা তুমি আমাকে আগে জানাবে না?”
“আমি একদিনের কথাই জানতাম। রোজ যে বিরক্ত করে তা তো মৃত্তিকা আমাদের জানায়নি।”
“আচ্ছা, আমি আজই দেখব ব্যাপারটা। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।”
মৃন্ময়ী কেবল মাথা দোলাল। প্রভাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আবারও তোমার মাথায় এক দুশ্চিন্তা ঢুকে গেল, না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“দুশ্চিন্তার সাথেই তো আমার আজন্মের ভাব।”
“চা খাবে? চলো, বসে একটু চা খাও, ভালো লাগবে।”
“নাহ্, বাড়ি ফিরতে দেরী হবে। রাত বাড়লে মা চিন্তা করবে।”
“চা খেতে আর কতক্ষণ লাগবে। আমি তো আছি, পৌঁছে দিয়ে আসব। চলো।”
কেমন আশ্বাস দিয়ে কথাটা বলল প্রভাত। মৃন্ময়ী রাজি হতে চাইছিল না। প্রভাত বেশ কয়েকবার বলার পর আর সে তার কথা ফেলতেও পারল না। দুজন চলে গেল চা খেতে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মৃন্ময়ীর থেকে একহাত দূরে বসল প্রভাত। মৃন্ময়ী কোনো কথা বলছে না। তার নীরব দৃষ্টি চায়ের কাপেই নিবদ্ধ। প্রভাত নিজেই তাকে ডাকল,
“মৃন্ময়ী?”
“হুঁ?” দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে সাড়া দিলো মৃন্ময়ী।
প্রভাত বলল,
“চলো না এই দূরত্বটুকু কমিয়ে নিই। তোমার মন কি চায় না তোমারও একটা দুঃখ বিসর্জনের জায়গা হোক?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কোনো দুঃখ নেই।”
“কাকে কী বুঝাচ্ছ তুমি?”
“আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছো। সুখ সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়। দুঃখ কোনোদিন ভাগ করে নেওয়া যায় না প্রভাত। যার দুঃখ সে-ই টের পায়, সে-ই বোঝে। মুখে বললেও আমরা কেউ কারোর দুঃখ অনুভব করতে পারি না।”
প্রভাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি পারব। তুমি আমার হলে আমি সব পারব।”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, কেউ কোনোদিন কারোর জায়গায় দাঁড়াতে পারে না।”
“আমি জানি আমি তোমার জায়গায় দাঁড়াতে পারব না, কিন্তু পাশে তো দাঁড়াতে পারব। আমি শুধু তোমার পাশে দাঁড়িয়ে তোমার হাতটা ধরতে চাই। যেদিন সেই মুহুর্তটা আসবে, সেদিন তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারবে মৃন্ময়ী। এখন হয়তো তোমার কাছে অসম্ভব ব্যাপার-ই মনে হবে।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এত কনফিডেন্স তুমি কোত্থেকে পাও বলো তো?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“ভালোবাসা থেকে। তুমি তো আমাকে ভালবাসো না, তাই এখন বুঝতে পারছো না। যখন ভালোবাসবে, তখন বুঝবে।”
পরক্ষণেই আবার প্রভাত বলল,
“তোমাকে আমি একটা চমৎকার বুদ্ধি দিতে পারি।”
“কী বুদ্ধি?”
“তুমি চাইলে আমার মুখের কথার প্রমাণ লিখিতভাবে রেখে দিতে পারো। আমি কথা রাখতে না পারলে কঠিন শাস্তির কথা-ও উল্লেখ করতে পারো। আমি নির্দ্বিধায় তোমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হব।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“তোমার মাথা পুরো গেছে।”
“উঁহু, আমার মাথা একদম ঠিকঠাক আছে। মজা ভেবো না, আমি সত্যি বলছি। তুমি চাইলে আমি তোমার সাথে এমন চুক্তি করতেও রাজি আছি। তবু যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, তাতে ক্ষতি কী?”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“আমি কি তোমাকে অবিশ্বাস করি?”
“করো না?”
“তাহলে এখন তোমার সাথে বসে চা খেতাম?”
প্রভাত বলে উঠল,
“তারমানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। কিন্তু বিয়ের ভয়ে স্বীকার করো না, তাই তো?”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“তা কখন বললাম আমি?”
প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“তোমাকে বলতে হবে না, আমি এমনিতেই বুঝতে পারি। চিন্তা কোরো না, বিয়ে আমি তোমাকেই করব। তুমি আমাকে অপেক্ষা করালেও আমি এই অপেক্ষার আয়তন কমিয়ে নেব। এবার বিয়ের চেষ্টায় আমাকে নামতেই হবে। আচ্ছা, বিয়েতে তুমি কোন রংয়ের শাড়ি পরতে চাও বলো তো?”
মৃন্ময়ী বলল,
“পাগলের মতো বিলাপ না করে ওঠো। আমি এখানে সারারাত বসে তোমার বিলাপ শুনতে পারব না।”
প্রভাত হেসে বলল,
“পারবে, পারবে। আজ না পারলেও খুব শীঘ্রই পারবে। এবার না হয় তুমি একটুখানি অপেক্ষা করো।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে