মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৮

0
7

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
পাঠাগারের কাজটা মৃত্তিকা খুব উপভোগ করছে। কোনো চাপ নেই, তাড়া নেই। সারাদিন বসে শান্তিতে কাজ করা যায়। অবসরে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে বই পড়ে, তখন তাদের সঙ্গে একটু আলাপ হয় তার। কোন-কোন শিক্ষার্থী বই নিয়ে যায় তাদের নাম ভালোভাবে তালিকা করে রাখে সে। তারা আবার সময়মতো বই ফেরত দিয়ে যায়। এছাড়া অঢেল সময় তার হাতে পড়ে থাকে। মৃত্তিকা তখন সেলফ থেকে বই বেছে নিয়ে পড়তে বসে। বই পড়ার অভ্যাস তার কোনোকালেই ছিল না। পাঠাগারের দায়িত্ব হাতে পাওয়ার পর অভ্যাসটা নতুন হয়েছে। সময় কা’টানোর জন্যই সে বই পড়া শুরু করেছে। ধীরে-ধীরে এখন সেটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। ব্যাপারটা তার কাছে মন্দ লাগছে না। সুযোগ পেলে আবার সে আশপাশে-ও ঘুরে আসে। স্কুলের সবাই তাকে খুব সম্মান করে। ছাত্র-ছাত্রীরা এমনভাবে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকে যে তার মনে হয় সে শিক্ষকতা করছে। আজকাল মৃত্তিকার নিজেকে খুব মূল্যবান মনে হয়। সত্যিই মানুষ নিজেকে ভালোবাসলে নিজের মূল্য বুঝতে পারে। নিজের জন্য চেষ্টা করলে সফল হতে পারে। মৃত্তিকা-ও সফল হবে। চেষ্টা সে ছাড়বে না। সারাদিন স্কুলে থাকার ফলে আজকাল আর মায়ের আহাজারি-ও তাকে শুনতে হয় না। এটা তার অনেক বড়ো স্বস্তি। সে চায় না কোনোভাবেই তার ক্ষত কাঁচা হোক। দাঁতের নিচে ধৈর্য চেপে সে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। কে জানত নিয়তি তার জন্য এতটাও সহজ হবে না?
কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর থেকে মৃত্তিকার সময়গুলো বেশ ভালো কা’টলেও, হুট করেই ভালো সময়গুলো পড়ে গেল শঙ্কার মুখে। মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট। প্রথম থেকেই খবরটা সে জানত। কিন্তু ভয়ে কাউকে জানায়নি। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। কেউই হয়তো চাইবে না বাবা ছাড়া তার সন্তান পৃথিবীতে আসুক। কিন্তু সে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়। নিজের ভুলের জন্য সে একটা নিষ্পাপ প্রাণকে কষ্ট দিতে চায় না। বাবা নেই তো কী হয়েছে? সে-ই নিবে তার সন্তানের দায়িত্ব। এ কারণেই সে এতদিন মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু এসব ব্যাপার তো আর সবসময়ের জন্য চাপা দিয়ে রাখা যায় না। আজ হঠাৎ মৃত্তিকার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। মৃন্ময়ী তাকে একপ্রকার জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তখন সে বাধ্য হয়ে সত্যিটা স্বীকার করে নেয়। খবরটা শুনে হতে নতুন করে সাজেদা বেগমের আহাজারি শুরু হয়েছে। কেঁদেকেটে একাকার করেছেন তিনি। এই ভয়েই মৃত্তিকা এ কদিন মায়ের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থেকেছে। বলা তো যায় না, কখন কোন লক্ষণ মায়ের চোখে পড়ে যায়। সাজেদা বেগমের আহাজারি মৃত্তিকা শুনেও না শোনার ভান করে থাকে। তার মনে কেবল একটাই ভয় দানা বেঁধে আছে, মা যদি বাচ্চাটার জন্ম না চায়। যদিও সাজেদা বেগম এমন কিছু স্পষ্ট করে বলেননি। তবু তার কথাবার্তায় মৃত্তিকার এমনটাই মনে হচ্ছে। পরদিন মৃন্ময়ীর স্কুল ছুটির আগে-আগে মৃত্তিকা তার স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মৃত্তিকা স্কুল থেকে বেরিয়ে আজ প্রভাতের জায়গায় দেখতে পেল বোনকে। মৃত্তিকাকে তার স্কুলের সামনে দেখে সে অবাকই হলো। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মৃত্তিকা, তুই এখানে কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
“তুই স্কুলে ছিলি না?”
“প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে ছুটির আগে বেরিয়ে এসেছি।”
“কেন?”
“এমনি, চল আজ একসঙ্গে বাড়ি যাই।”
“আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরার জন্য তুই উলটা পথে এসে দাঁড়িয়ে ছিলি? না কি অন্য কোনো প্রয়োজন আছে?”
“আহা! চল না। হাঁটতে-হাঁটতে কথা বলি।”
“দাঁড়া, গাড়ি নিই।”
মৃত্তিকা বাঁধা দিয়ে বলল,
“গাড়িতে যাব না। হেঁটে যাব, চল।”
“তোর হাঁটতে কষ্ট হবে না?”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“আরে না। এখন আমি ঠিক আছি। আমার হাঁটতে কষ্ট হয় না। চল তুই।”
“আচ্ছা চল তাহলে। কষ্ট হলে বলিস কিন্তু।”
“আচ্ছা-আচ্ছা।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের সন্ধানে চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখল প্রভাত আজ ভদ্র ছেলের মতো দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্তিকাকে দেখেই হয়তো তার এই হঠাৎ ভদ্রতা জেগে উঠেছে। সে তাকাতেই প্রভাত হাসিমুখে হাত নাড়ল। মৃন্ময়ী তাকে না দেখার ভান করে মৃত্তিকার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল।
“তোর কাজ কেমন চলছে?”
মৃত্তিকা উত্তর দিলো,
“ভালো।”
“কোনো সমস্যা মনে হয়?”
“নাহ্।”
“মৃদুলা বলল বইয়ের মধ্যে বসে থেকে-থেকে তোর-ও না কি বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে?”
“হুম।”
মৃত্তিকার সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে মৃন্ময়ী তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুই কি কিছু চিন্তা করছিস?”
মৃত্তিকা কথা বলল না। মৃন্ময়ী পুনরায় প্রশ্ন করল,
“তোর মনে কী চলছে মৃত্তিকা?”
মৃত্তিকা হাত কচলাতে-কচলাতে বলল,
“আপা, আমি অনেককিছুই চিন্তা করছি। তুই কি আমার কিছু কথা শুনবি?”
“শুনব না কেন? বল না। দ্বিধা করিস না।”
“মাকে একটু বলবি আমার বাচ্চাটার ওপর অসন্তুষ্ট না হতে? মা না চাইলেও আমি এই বাচ্চা জন্ম দিবো।”
“তুই কীভাবে বুঝলি মা চায় না? মা কি তোকে এমন কিছু বলেছে?
“মায়ের কথাবার্তায় আমি বুঝতে পেরেছি। দেখ আপা, আমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তাতে তো আমার বাচ্চাটার কোনো দোষ নেই। আমার ভুলের শাস্তি তো আমি ওকে দিতে পারি না। ও ওর বাবাকে না পেলেও, মাকে তো পাবে। ওর বাবা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না। আমি একাই ওর বাবা-মা হয়ে উঠব। আপা, আমার সন্তান আমার কোলে এলে আমি ওর জন্য যা করতে হয় করব। আরও মন দিয়ে কাজ করব। আমি নিজেই তোদের সবচেয়ে বড়ো বোঝা হয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার সন্তানের বোঝা আমি তোদের কারোর মাথায় দিবো না আপা। তুই একটু মাকে বুঝাস। আমার বাচ্চাটা সবে নিষ্পাপ, ছোট্ট একটা প্রাণ। ওর ক্ষতি করার কথা আমি ভাবতেও পারি না।”

মৃত্তিকার চোখ ভর্তি জল। মৃন্ময়ী বলল,
“আমি তোর অনুভূতি বুঝতে পারছি বোন। আমি জানি কোনো মা-ই নিজের সন্তানের ক্ষতি চায় না। আমাদের মা-ও তো একজন মা। তোর কেন মনে হয় সে একজন মা হয়ে তোর সন্তানের ক্ষতি চাইবে? সে-ও তো তোকে জন্ম দিয়েছে। মাকে তুই এত হৃদয়হীন ভাবিস?”
“তোর মনে হয় না মা আমার সন্তানের প্রতি অসন্তুষ্ট?”
“না। মা অসন্তুষ্ট তোর ভাগ্যের ওপর। মা তোর জীবন নিয়ে চিন্তিত। এতদিন শুধু তোর ভবিষ্যতের চিন্তা ছিল, এখন নতুন করে যোগ হয়েছে তোর বাচ্চার চিন্তা।”
মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“মা আমার বাচ্চার জন্য চিন্তা করে?”
“মৃত্তিকা, আমাদের মা তার স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছে। সে-ও জানে বাবা ছাড়া সন্তানদের জীবন কতটা কঠিন হয়। হতে পারে তুই মায়ের থেকে আলাদা। আমরা বড়ো হয়ে বাবাকে হারিয়েছি, আর তোর সন্তান জন্মের আগেই হারিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য মা বাইরের জগতে পা রাখতে পারেনি, কিন্তু তুই পারিস। তুই তোর সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার সাহস রাখতে পারিস। তবু সে মা তো। দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। তুই তোর বাচ্চা জন্ম না হতেই তার জন্য এত চিন্তা করছিস। আর মা তো তোকে পেলে-পুষে এত বড়ো করেছে। জীবনটা তোর ভাবনার মতো এত সহজ নয় রে মৃত্তিকা। তবু আমি চাই তুই যেন তোর সন্তান নিয়ে সুন্দর জীবন কা’টাতে পারিস।”
মৃত্তিকা চিন্তিত মুখে বলল,
“আমি কি তবে মাকে ভুল বুঝলাম?”
মৃন্ময়ী হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুই সবসময়ই মাকে ভুল বুঝিস মৃত্তিকা। দিন-দিন মা তোর চোখে ভিলেন হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে তুই মায়ের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলিস তো। সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে না থেকে মায়ের কাছাকাছি থাকিস, তার সাথে গল্প করিস। দেখবি মা এতটা-ও কঠিন না। দূর থেকে তাকে কঠিন মনে হলেও তার ভেতরটা খুব নরম।”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করব আপা।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“তোর বর কি জানত তুই প্রেগন্যান্ট?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু। ও জানবে কীভাবে? আমিই তো জানতে পেরেছি ওই বাড়ি থেকে চলে আসার পর।”
“ও। এমন খবর লুকিয়ে রাখার কোনো দরকার ছিল না। তুই অযথাই মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিলি।”
“এখন যখন তোরা জানিস, বাইরের মানুষকে জানানোর দরকার নেই। আমি চাই না খবরটা ওর কানে পৌঁছাক। আমার সন্তানের আসার খবর শোনার অধিকার-ও ও হারিয়েছে। বেঁচে থাকলে আমি আমার সন্তানকে ওর মুখ-ও দেখাব না।”
“ঠিক আছে, তোর যা ভালো মনে হয়।”

রাস্তার পাশে কতরকম খাবার বিক্রি হচ্ছে। মৃন্ময়ীর সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে মৃত্তিকার হঠাৎ তাদের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। বাবা তাদের দুবোনকে দুই হাতে করে বাজারে নিয়ে আসতেন। যে যা খেতে চাইত তা-ই কিনে দিতেন। মায়ের জন্য-ও কিছু না কিছু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। বাবা চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেসব সময়গুলো-ও তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন আর যখন যা ইচ্ছা তা-ই কিনে খাওয়া হয় না। খেতে ইচ্ছা করলে-ও কাউকে বলা যায় না। তার আগে টাকার কথা ভাবতে হয়। মৃত্তিকা বলে উঠল,
“আপা, চল ফুসকা খাই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ফুসকা খাবি? চল।”
ফুসকার দোকানে তখন ছেলে-মেয়েদের ভিড়। সামনেই একদল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ফুসকার জন্য। তারা দুবোন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সামনের ছেলেগুলো সরে যাওয়ার। ঠিক তখনই প্রভাত এসে মৃন্ময়ীর পাশে দাঁড়াল। গলা তুলে বলল,
“মামা, তিন প্লেট ফুসকা।”
তার কন্ঠ শুনে সামনের ছেলেগুলো ফিরে তাকিয়ে হাসিমুখে আলাপ জুড়ে দিলো। মৃন্ময়ীর মনে হলো এরা আলাপের চেয়ে বেশি আহ্লাদ করছে। একজন আবার অতিরিক্ত আহ্লাদ দেখিয়ে ফুসকাওয়ালাকে বলে বসল,
“এই মামা, আগে ভাই-ভাবিকে দাও।”
সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ী চোখ বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
“কে তোমার ভাবি?”
ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“রাগ করবেন না ভাবি। আপনি ভাইয়ের সাথে সময় কা’টান, আমরা না হয় পরে আসব ফুসকা খেতে।”
“আমি তোমার ভাইয়ের সাথে এসেছি যে সময় কা’টাব? আমরা দুবোন এসেছি, চোখে দেখতে পাওনি? আজাইরা চাটুকারিতা আমার সামনে থেকে সরে করো গিয়ে। আমাদের দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখার সময় নেই।”
তার কথাগুলো যেন ছেলেটার গায়েই লাগল না। বরং সে বাকিদের বলে উঠল,
“এই, ভাবির মাথা গরম হয়ে গেছে। চল, আমরা পরে আসব।”
ছেলেগুলো প্রভাতকে লম্বা সালাম ঠুকে সরে গেল। মৃত্তিকা হা করে তাকিয়ে শুধু কাহিনি দেখছিল। এবার সে মৃন্ময়ীর এক হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কী-রে আপা? এই প্রভাত ভাই কি এখনও তোর পিছু ছাড়েনি? তুই না মাকে বলেছিলি পিছু ছেড়ে দিয়েছে?”
মৃন্ময়ী উত্তর না দিয়ে তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। কর্মচারী ছেলেটা তিন প্লেট ফুসকা দিয়ে গেল। তারা দুজন বেঞ্চে বসতেই পাশে এসে প্রভাত-ও বসে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্তিকা বলে উঠল,
“আপনি কি আর কোনো জায়গা চোখে দেখছেন না? আপার পাশে বসতে কে ডেকেছে আপনাকে?”
প্রভাত ভ্রুকুটি করে মৃন্ময়ীকে প্রশ্ন করল,
“ম্যাডামের পাশে আর কার বসার কথা?”
মৃন্ময়ীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মৃত্তিকা আবারও বলে উঠল,
“আপনি অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসুন।”
“ফুসকাওয়ালা মামা কি এই বেঞ্চটা ম্যাডামের নামে লিখে দিয়েছে?”
মৃত্তিকা এবার তেতে উঠে বলল,
“আপনি তো আসলেই ঘাড়ত্যাড়া প্রভাত ভাই। এখনও আপনি আপাকে এভাবে জ্বালান? আশ্চর্য! আমি তো ভাবতেই পারছি না আপনি এখনও আপার পেছনে পড়ে আছেন। একটা মানুষ কতক্ষণ একজনের জ্বালাতন সহ্য করতে পারে? বুঝেছি, আমার আপাকে অতিরিক্ত ভদ্র পেয়ে মাথায় উঠে গেছেন, না? এরপর আপনার বাবা আমার সামনে পড়ুক, আমি যদি আপনার এই কুকর্মের কথা না জানিয়েছি তাহলে-”
মৃত্তিকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রভাত বলে উঠল,
“তাহলে তোমার নাম পালটে মৃত্তিকা থেকে মিষ্টি খা রাখা হবে। ঠিক আছে, আমি রাজি।”
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীকে বলল,
“আপা, তুই এতদিন ধরে এই অসহ্য লোকটাকে কীভাবে সহ্য করেছিস? তুই এত ভীতু? ওনার বাবার কাছে নালিশ না জানিয়ে চুপচাপ সহ্য করে নিয়েছিস? কী অদ্ভুত কাণ্ড!”
মৃন্ময়ী বলল,
“আহা! প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছিস কেন? চুপ করে খা না।”
“তুই নিজেও কিছু বলছিস না, আমাকেও বলতে দিবি না? এজন্যই তো এই লোক তোকে বোকা পেয়ে সুপারগ্লুর মতো লেগে আছে।”
প্রভাত ফুসকা চিবোতে-চিবোতে গলা তুলে বলল,
“মামা, তোমার ফুসকা খেয়ে আমার শ্যালিকার মাথা গরম হয়ে গেছে। আরেক প্লেট দিয়ো।”
“এই, কে আপনার শ্যালিকা? ফাজলামি পেয়েছেন?”
মৃত্তিকা তেড়ে উঠতে নিতেই মৃন্ময়ী তাকে ধরে বসিয়ে দিলো। বলল,
“তুই কি বাড়ি যাবি না? আগে ফুসকা শেষ কর তো।”
মৃত্তিকা বলল,
“তুই শুনলি না উনি কী বলল? আমি ওনার কোন জন্মের শ্যালিকা হই? ওনার মতো ছেলের সাথে জীবনে আমি আমার বোন বিয়ে দিবো? ফালতু লোক!”
“আচ্ছা হয়েছে। তুই আগে খা, আমি কথা বলছি ওর সাথে।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে তাকাতেই সে হাসি প্রশস্ত করল। মৃন্ময়ী চাপা গলায় বলল,
“দয়া করে মৃত্তিকার সামনে পাগলামি কোরো না। ও গিয়ে বাড়িতে বললে মা আমাকে নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করবে।”
প্রভাত-ও নিচু স্বরে বলল,
“তারমানে তুমি স্বীকার করছো আমি আসলে তোমার মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হওয়ার মতো মানুষ নই?”
“তুমি কি যাবে এখান থেকে?”
“যাব, আজ শ্যালিকার সাথেই সময় কা’টাও। আমি দুঃখবিলাস করতে-করতে চলে যাই। ফিরে আসা পর্যন্ত ভালো থেকো।”

প্রভাত বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর-ও মৃত্তিকা তাকে বিড়বিড় করে বকে চলল। মৃন্ময়ী বিল দিতে গিয়ে শুনল প্রভাত তাদেরটাসহ বিল দিয়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা তাকে বলল,
“এরপর দেখা হলে তুই ওনাকে টাকা দিয়ে দিস। আগে জানলে বিল দিতেই দিতাম না। বিরক্তিকর লোক একটা।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আচ্ছা যাক, দিয়ে যখন চলেই গেছে, তখন তো আর কিছু করার নেই। দেখা হলে টাকা দিয়ে দিবো নে। চল ওঠ।”
মৃদুলা আর মায়ের জন্য-ও ফুসকা কিনে নিয়ে তারা দুজন বাড়ি ফিরেছে। তারা যখন বাড়ি ফিরেছে তখন সাজেদা বেগম নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে ঠেলেঠুলে পাঠাল মাকে ডেকে আনতে। মৃত্তিকা মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল মা শুয়ে আছেন, কিন্তু ঘুমাননি। সে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ডাকল,
“মা?”
সাজেদা বেগম চোখ তুলে তাকিয়ে মৃত্তিকাকে দেখে শুধালেন,
“কী হয়েছে? মাত্র এলি?”
“হ্যাঁ। আপা-ও এসেছে। আপা ফুসকা এনেছে। এসে খাও।”
“ও আবার ওসব আনতে গেল কেন?”
“আমি আর আপা ফেরার সময় খেয়েছিলাম। তাই তোমার আর মৃদুলার জন্য-ও নিয়ে এসেছে।”
“তোরা একসঙ্গে এসেছিস?”
“হ্যাঁ।”
সাজেদা বেগম শোয়া থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে-নামতে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর শরীরের কী অবস্থা?”
“ভালো।”
“চেকআপ করিয়েছিস?”
“গতমাসে করেছিলাম।”
“এখন আবার করিয়ে নিস। তোদের তো কাজের বিষয়ে কোনো খেয়াল থাকে না। নিজের অযত্ন করে বাচ্চাটার ক্ষতি করবি। ভালো কথা কানে ঢুকলেই হলো।”
মৃত্তিকা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনভাবে কথা বলছে যেন সে কেবল বলার জন্যই বলছে। অথচ মৃত্তিকা এই প্রথম টের পেল মায়ের থমথমে কথার আড়ালের যত্ন। সে বলল,
“কাল-পরশু চেকআপ করিয়ে নিব আবার।”
মৃন্ময়ী প্যাকেট থেকে ফুসকা বের করে প্রস্তুত করে রাখছিল। সাজেদা বেগম এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“মৃদুলা এখনও আসেনি?”
“না।”
“ও আবার কখন আসবে? এসব খাবার-দাবার পরে আর ভালো লাগবে?”
“ও এখনই চলে আসবে। নাও, খাও তুমি।”
সাজেদা বেগম চেয়ারে বসে বললেন,
“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কী করতে? স্কুল থেকে এসেছিস, ক্লান্ত লাগছে না? যা আগে হাত-মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হ।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“আমি যাচ্ছি। তুমি তোমার মেজো মেয়েকে বলো মা। কে নিজের অযত্ন করছে দেখছোই তো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“করুক অযত্ন। যার-যার সন্তানের সুস্থতার দায়িত্ব তার-তার ওপর। মাথা আরেকজনের, ব্যথা কি হবে আমার?”
সুযোগ পেয়ে মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“তোমার ব্যথা হয় না কে বলল? ও-ও তো তোমার সন্তান। মাথাব্যথা তো তোমার-ও আছে মা।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“কথা না বাড়িয়ে হাত-মুখ ধুতে যা।”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে মৃত্তিকাকে ইশারা করে ঘরে চলে গেল। মৃত্তিকা ঘরে যেতে নিয়ে-ও আবার কী ভেবে বলে বসল,
“মা, আজ রাতে খিচুড়ি রান্না করবে?”
সাজেদা বেগম উত্তর দিলেন,
“পেয়াজ নেই। মৃদুলাকে ফোন করে বল আসার সময় নিয়ে আসতে।”
“আচ্ছা।”
মৃত্তিকার কেন জানি হঠাৎ করেই মনটা ভীষণ হালকা লাগতে শুরু করল। মা বুঝি এমনই?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে