#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
৭.
টিউশন থেকে বেরিয়ে মৃদুলা পনেরো মিনিট ধরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পনেরো মিনিটে বোধহয় পনেরোটা গাড়ি তাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপা যাইবেন? আপা, কই যাইবেন?’ অতিরিক্ত হিসেবে আবার পাশের দোকানদার-ও জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপা কি কারো জন্য অপেক্ষা করতাছেন? এমন চরকার মতো ঘুরতাছেন ক্যান?’ মৃদুলা সবার কথার উত্তরেই কেবল দুপাশে মাথা নাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে তার বিরক্তি। জাহিদ এল তার অপেক্ষার সতেরো মিনিটের মাথায়। তা-ও খালি হাতে। মৃদুলা দূর থেকেই দেখতে পেল জাহিদ দৌড়ে তার দিকে আসছে। হাতে ফুল নেই। নিশ্চিতভাবে এখন এসে সামনে দাঁড়িয়েই বলবে, ‘গাড়ি পাইনি, ফুল কেনার সময় ছিল না।’ মৃদুলা রাগ করলেই বলবে, ‘কানে ধরব?’ এই ছেলেটা যে তার প্রেমিক, মাঝে-মাঝে মৃদুলার বিশ্বাস করতে-ও কষ্ট হয়। জাহিদ তার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে ঠিক বলে উঠল,
“সরি জান, অনেক দেরী হয়ে গেল। আসলে গাড়ি পাচ্ছিলাম না। তাই-”
মৃদুলা হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, এসব জানি আমি। আপনি আগে নিঃশ্বাস ছাড়েন।”
জাহিদ সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদুলা হাতের পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানি খান।”
বোতলের অর্ধেক অংশ পানি ছিল। জাহিদ ঢকঢক করে পুরোটা পানি গলাধঃকরণ করে ফেলল। তারপর খালি বোতলটা মৃদুলাকে ফেরত দিয়ে বলল,
“উফ্! শান্তি লাগছে। জোরে দৌড়ে এসে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।”
মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপনাকে দৌড়াতে কেন হয়েছে?”
“কেন আবার? তোমার কাছে আসার জন্য।”
“আমার কাছে আসতে আপনাকে দৌড়াতে কেন হবে? টিউশন আমি করি, না আপনি? পরপর দুটো টিউশন করে আমাকে কেন আবার আপনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? আমি কি হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে থাকি?”
জাহিদ নিষ্পাপ মুখ করে বলল,
“রাগ করলে? রাগ কোরো না প্লিজ। এমন ভুল আর কখনও করব না, সরি।”
মৃদুলা রেগেমেগে বলল,
“রোজ-রোজই আপনি এ কথা বলেন। পটানোর আগে তো ঠিকই এক ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন। তখন গাড়ি কোথায় পেতেন? এখন যেই না প্রেমিকা বানিয়ে ফেলেছেন, অমনি আপনার কপাল থেকে গাড়ি উঠে গেল?”
“এই কারণেই তো বাবাকে বাইক কিনে দিতে বলছি। আম্মু-ই তো রাজি হচ্ছে না। বাইক নিয়ে রাস্তায় বোরোলেই না কি অ্যাক্সিডেন্ট করে আমি ম’রে যাব।”
মৃদুলা মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
“রাখুন আপনার বাইক। ইচ্ছা থাকলে ভ্যানগাড়িতে চড়ে-ও আগে আসা যায়। শুনুন, এরপর কিন্তু আমি এক মিনিট-ও অপেক্ষা করব না। আজ সতেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়েছেন। আমার পরীক্ষার পড়া কি আপনি পড়ে দিবেন? আমি বাড়ি ফিরে পড়ব কখন?”
“আহা! পড়তে পারবে। এখন তো এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার আরও সময় নষ্ট হচ্ছে। চলো তো, হাঁটতে-হাঁটতে যত ইচ্ছা বকো।”
মৃদুলা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটা দিলো। এই ছেলের সঙ্গে রাগ করাই বেকার। এর আছে গণ্ডারের চামড়া। কোনো কথাই গায়ে লাগে না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এই ছেলে তার পেছনে লেগেছে। কতবার করে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। মৃদুলা তখন ভয়ে রাজি হয়নি। জাহিদের পারিবারিক অবস্থান তাদের চেয়ে অনেক ওপরে। এ কারণেই সে সবসময় জাহিদকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু নিজের অনুভূতি থেকে আর কদিন পালিয়ে বাঁচা যায়? মন তো সে হারিয়েই বসেছিল। এভাবে চলতে-চলতেই কীভাবে যেন পাজি ছেলেটা তাকে পটিয়ে ফেলল। এখন আর মৃদুলা পালানোর পথ-ও খুঁজে পায় না।
জাহিদ মৃদুলার সঙ্গে সমান তালে হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“তোমার জন্য একটা সুন্দর জিনিস এনেছি।”
জাহিদ দেরী করলেই সেদিন হাতে করে ফুল নিয়ে উপস্থিত হয়। আজ তার হাতে ফুল-ও নেই। কী সুন্দর জিনিস এনেছে বুঝতে পারল না মৃদুলা। তবু অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“লাগবে না সুন্দর জিনিস।”
“লাগবে না?”
“না।”
“শিওর?”
মৃদুলার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে একটু দোনামনা করে অভিমানী সুরে বলত, জানি না। যাতে সুন্দর জিনিসটা দ্রুত তার হাতে এসে পড়ে। কিন্তু মৃদুলা তার বিপরীত। সে কপালে ভাঁজ ফেলে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এত গাধা কেন? প্রেমিকার রাগ-ও ঠিকমতো ভাঙাতে জানেন না। আপনার প্রেমিক হয়ে চরম ভুল হয়েছে। আপনার হওয়া উচিত ছিল প্রেমিকা, আর আমার হওয়া উচিত ছিল প্রেমিক। আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতাম প্রেমিক কীভাবে হতে হয়।”
“তার মানে তুমি বলছো আমি এখনও প্রেমিক হতে পারিনি?”
“না।”
“সিরিয়াসলি?”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট,” শক্ত গলায় বলল মৃদুলা।
জাহিদ ভাবুক মুখে শুধাল,
“তাহলে কীভাবে আমি প্রেমিক হয়ে উঠতে পারি মিস?”
“প্রেমিকাকে সতেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়ে খালি হাতে এসেছেন কেন? ফুল কোথায়?”
জাহিদ দ্রুত পকেট থেকে বকুল ফুলের মালাটা বের করল। মৃদুলার সামনে মালা ঝুলিয়ে ধরে বলল,
“এই তো, ফুলের মালা এনেছি। এটা কি প্রেমিকা গ্রহণ করবে?”
মুখে উত্তর না দিয়ে মৃদুলা হাত বাড়িয়ে দিলো। জাহিদ তার হাতে মালাটা পরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,
“এখন কি আমি আপনার প্রেমিক হতে পেরেছি?”
মৃদুলা বলল,
“ভেবে দেখব।”
“তাড়াতাড়ি জানালে একটু সুবিধা হয়।”
“প্রেমিকদের এত তাড়া থাকবে কেন?”
“ওহ্ আচ্ছা! প্রেমিকদের তাড়া থাকা-ও নিষেধ? ঠিক আছে, আমার কোনো তাড়া নেই। আপনার যখন ইচ্ছা জানাবেন।”
মৃদুলার ঠোঁটের কোণে মিটমিটে হাসি। জাহিদ বলল,
“তোমার আপা রাগ করে আছে জানো?”
মৃদুলা অবাক হয়ে বলল,
“আপা রাগ করে আছে? কার সাথে?”
“কার সাথে তোমার আপা রাগ করতে পারে?”
প্রশ্নটা শুনে মৃদুলার খেয়াল হলো। জাহিদের মুখে তার আপার খবর মানেই তা প্রভাত ঘটিত ব্যাপার। বয়সে ছোটো হলেও জাহিদের সঙ্গে প্রভাতের একটা ভালো সম্পর্ক আছে। প্রতিবেশি হওয়ার সুবাদে ছোটোবেলা থেকেই জাহিদ প্রভাতের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। এ কারণে বাবা-মায়ের কত বকাঝকা যে সে শুনেছে, হিসাব নেই। বাবা-মা ভাবত প্রভাতের সঙ্গে মিশলেই সে খারাপ হয়ে যাবে। যদিও সে তেমনটা হয়নি। প্রভাতের সঙ্গে মিশলেও সে প্রভাতের মাঝে তেমন খারাপ কিছু দেখেনি। মানুষ একটু বেপরোয়া, দুষ্টু স্বভাবের হলেই কি সে খারাপ হয়? বুঝে আসে না জাহিদের। তাই প্রভাতের সঙ্গ সে এখনও বেশ উপভোগ করে। তার কাছেই রোজ প্রভাত-মৃন্ময়ীর সমস্ত খবর মৃদুলা পায়। আজ মৃন্ময়ীর রাগ করার বিষয়টি শুনে সে জাহিদকে বলল,
“প্রভাত ভাইকে সুন্দর কোনো বুদ্ধি দিবে, যাতে আপুর রাগ তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়।”
জাহিদ হেসে বলল,
“প্রভাত ভাইয়ের আমার বুদ্ধির প্রয়োজন আছে? সে নিজেই বুদ্ধির জাহাজ। পারলে আমরাই তার কাছে যাই সুন্দর বুদ্ধি নেওয়ার জন্য।”
মৃদুলা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার এই ফুল নিয়ে এসে প্রেমিকার রাগ ভাঙানোর বুদ্ধিটা-ও কি প্রভাত ভাইয়ের থেকে নেওয়া?”
জাহিদ দ্রুত গতিতে ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
“এই না-না-না। একদমই না।”
“অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি বুঝে গেছি।”
জাহিদ হতাশ গলায় বলল,
“কিন্তু আমি তো অন্য বুদ্ধির কথা বুঝিয়েছি।”
•
আজ সারাদিন ধরে মৃন্ময়ীর মাথায় মৃত্তিকার কাজের কথাই ঘুরছে। যতই সে মৃত্তিকাকে বলুক এই কাজ না পেলে অন্য কাজ পাওয়া যাবে। অন্য কাজ পাওয়াটা তো আর মুখের কথা না। এই কাজটা না হলে সে মৃত্তিকার জন্য কী কাজ ঠিক করবে, এই ভাবনা-ই ঘুরছে তার মাথায়। একটার আশায় থেকে তো আর মাথা থেকে চিন্তা দূর করা যায় না। এদিকে গত তিনদিন ধরে প্রভাত তার রাগ ভাঙানোর জন্য কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে প্রভাতের ওপর তার রাগ হয়েছিল। কিন্তু তার রাগ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দুদিন রাগ করে থাকলেও এখন সে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। একে তার মাথায় চিন্তার শেষ নেই, এরমধ্যে ওসব মাথায় ঢুকিয়ে বসে থাকার সময় কোথায়? প্রভাত কি আর তা জানে? সে তো আজও আয়োজন করে এসেছে মৃন্ময়ীর রাগ ভাঙাতে। মৃন্ময়ী স্কুল থেকে বেরোনোর আগেই সে পথে দাঁড়িয়ে ছিল হাতে বড়ো একটা ফুলের তোড়া নিয়ে। গোলাপ ফুলের তোড়া। বাচ্চাদের অভিভাবকরা যাওয়ার পথে এ দৃশ্য দেখে খুব ফিসফিস করছে। এক বাচ্চা ফুল দেখে বায়না ধরল তার ফুল চাই। প্রভাতের কাছে সে ফুল চেয়ে বসল। তার মা তাকে জোর করে-ও সেখান থেকে সরাতে পারল না। প্রভাত হাঁটু মুড়ে বসে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করল,
“নাম কী পিচ্চি?”
বাচ্চাটা উত্তরে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত বলল,
“নাম না বললে ফুল দিবো না।”
বাচ্চাটা এবার সুন্দরভাবে বলল,
“আমার নাম রাইসা।”
“রাইসা? তোমার নামটা তো খুব সুন্দর। তুমিও খুব সুন্দর।”
বাচ্চাটা আবারও হাত পেতে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত বলল,
“ফুল দিবো। আগে বলো তো এই ফুল কার মতো দেখতে?”
বাচ্চাটা বোকা চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না।”
“জানো না?”
“না।”
“জানতে হবে।”
বাচ্চাটার বোধহয় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আহা! কাঁদে না। রাইসা না ভালো মেয়ে? রাইসাকে আমি ফুল দিবো তো। বলো তো তোমার কয়টা ফুল চাই?”
বাচ্চাটা দুটো আঙুল তুলে বলল,
“দুইটা।”
“তাহলে তো তোমাকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আচ্ছা বলো তো, মৃন্ময়ী ম্যাম আমার কে হয়?”
বাচ্চাটা আবার দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না।”
প্রভাত বলল,
“বউ হয়, বউ। এবার বলো তো কী হয়?”
বাচ্চাটা তাকে অনুসরণ করে বলল,
“বউ হয়।”
প্রভাত চমৎকার হেসে বাচ্চাটার গাল টিপে দিয়ে বলল,
“এই তো রাইসা কত্তকিছু জানে! কত্ত সুইট রাইসা! এই নাও তোমার ফুল। আর শোনো, এই ফুলটা তোমার মতো দেখতে, আর এটা মৃন্ময়ী ম্যামের মতো। আরেকটা তোমার গিফট, নাও-নাও।”
আনন্দে গদগদ হয়ে প্রভাত বাচ্চাটার হাতে দুইটার জায়গায় তিনটা ফুল দিয়ে দিলো। ফুল পেয়ে বাচ্চাটা-ও ভীষণ খুশি হলো। মিষ্টি হেসে সে প্রভাতকে ‘থ্যাংক ইউ আঙ্কেল’ বলতে-ও ভুলল না। গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে বিষয়টা মৃন্ময়ী দেখল ঠিকই, কিন্তু ধরা দিলো না। বাচ্চাদের সাথে-ও মানুষ এমন বাচ্চামি করে? প্রেমে পড়লে মানুষ কী আজব-আজব কাজ করে! রাইসা চলে যেতেই মৃন্ময়ী সামনে পা বাড়াল। প্রভাত তাকে দেখামাত্র ছুটে এল। ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে ধরে একগাল হেসে বলল,
“ম্যাডামের জন্য।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ধন্যবাদ, আমার ফুল লাগবে না।”
“কিন্তু আমি এটা তোমার জন্যই এনেছি। সেদিনের ব্যাপারটার জন্য সরি। আর রাগ করে থেকো না প্লিজ।”
“আমি তোমার ওপর রেগে নেই।”
“আমি জানি তুমি রেগে আছো। ফুলটা নাও না।”
“বলছি তো আমি রেগে নেই। আমি তোমার ওপর রাগ ধরে রাখার কে? আগ বাড়িয়ে বেশি ভেবো না প্রভাত।”
“ঠিক আছে, তাহলে এটা নাও। তাহলেই আমি বিশ্বাস করব তুমি আমার ওপর রেগে নেই।”
“আচ্ছা আমি এত বড়ো ফুলের তোড়া নিয়ে বাড়ি ফিরব কীভাবে? এই সামান্য ব্যাপারটা কি তুমি বোঝো না? শুধু-শুধু জেদ কোরো না।”
“ফুল নিয়ে বুঝি বাড়ি ফেরা যায় না?”
“যায়, কিন্তু এতগুলো ফুল দেখলে বাড়ির মানুষ কী ভাববে তার কোনো ঠিক আছে?”
প্রভাত ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো,
“কী আবার ভাববে? তোমাকে এতগুলো ফুল দেওয়ার মতো একজন ব্যক্তি-ই আছে। সে প্রভাত তরফদার। এই সামান্য কথাটা কে না জানে?”
ওদিকে মৃন্ময়ী বাড়িতে মাকে বলে রেখেছে এখন আর প্রভাত তাকে বিরক্ত করে না। মা তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে বলেই মিথ্যেটা বলতে হয়েছে। এতগুলো ফুল নিয়ে সে কোনোভাবেই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। আর যা-ই হোক, তার মা এতটাও বোকা না। প্রভাত-ও এক নাছোড়বান্দা। ফুল সে এনেছে মানে মৃন্ময়ীকে নিতেই হবে। নয়তো ফুল গিয়ে পড়বে সোজা রাস্তার ধারের দিঘিতে। ভেবেচিন্তে মৃন্ময়ী বলল,
“ঠিক আছে, আমি তোমার ফুল নিব। কিন্তু আমি এসব বাড়িতে নিতে পারব না। তোমার ফুল নিয়ে আমি অন্য কাউকে দিলে তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
“ফুল গ্রহণ করলে এসব তোমার। তুমি অন্য কাউকে দিতে পারো, কিন্তু কোনো ছেলেকে না। তোমার প্রেমে পড়ে যাবে এমন কোনো ছেলে ছাড়া যে কাউকে দিতে পারো। চাইলে আমাকে-ও দিতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
মৃন্ময়ী ফুলের তোড়া নিল। এরপর সে পথে যে বাচ্চাকে দেখল, তার হাতেই একটা করে ফুল ধরিয়ে দিলো। অপ্রত্যাশিতভাবে অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে ফুল পেয়ে বাচ্চারা দারুণ খুশি হলো। তাদের খুশি দেখে মৃন্ময়ীর-ও মন ভালো হয়ে গেল। প্রভাত হাসিমুখে কেবল দেখে গেল। ব্যাপারটা তার কাছে মন্দ লাগছে না। মৃন্ময়ী যে আনন্দ পাচ্ছে, এতেই তার অনেককিছু পাওয়া হয়ে গেছে। সমস্ত ফুল ফুরিয়ে যাওয়ার পর প্রভাত বলে উঠল,
“আমাকে একটা-ও দিলে না। আমি তোমার এত অপ্রিয়?”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিই তো বলেছিলে আমার ফুল আমি যে কাউকে দিতে পারব।”
“আমার কথা-ও বলেছিলাম।”
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে বলল,
“তোমার জন্য ধন্যবাদ।”
“শুধুই ধন্যবাদ।”
“হ্যাঁ, শুধুই ধন্যবাদ।”
“ঠিক আছে। তোমার শুধুই ধন্যবাদের সাথে না নয় মনে-মনে আমি কিছু ভালোবাসা যোগ করে নিলাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি ধন্যবাদ ছাড়া কিছু দিইনি।”
প্রভাত হেসে বলল,
“তুমি না দিলেও আমি ভেবে নিব।”
•
পাঠাগারের কাজটা শেষমেশ মৃত্তিকা-ই পেয়েছে। খবরটা স্কুল থেকে ফোন করে মৃত্তিকাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল থেকেই তাকে ডিউটিতে ডাকা হয়েছে। খবরটা পেয়ে খুশিতে মৃত্তিকার চোখে পানি চলে এল। তখনই সে ছুটল মৃন্ময়ীকে খবরটা দিতে। মৃন্ময়ী ঘরেই ছিল। মৃত্তিকা তাকে না ডেকেই সোজা ঘরে ঢুকে গেল। সে দেখল মৃন্ময়ী জামা সেলাই করছে। তাকে দেখে মৃন্ময়ী বলল,
“কী-রে? এভাবে ছুটে এলি যে? কী হয়েছে?”
মৃত্তিকা আসল কথা না বলে প্রশ্ন করল,
“কী করছিস আপা?”
“দেখছিস-ই তো কী করছি। জামাটা কদিন আগেই বানিয়েছিলাম। আজকালকার কাপড়ের যা অবস্থা! কদিন পরতেই টান লাগতেই কীভাবে ছিঁড়ে গেল দেখ। অল্প একটু ছিঁড়েছে, তাই ভাবলাম সেলাই করে আরও কয়েকদিন চালিয়ে দিই। ফেলে দিয়ে কী হবে? বাইরে তো আর পরব না।”
মৃত্তিকা জানে জামাটা কদিন আগে কেনা না। তাকে সাথে নিয়েই গতবছর মৃন্ময়ী জামাটা কিনেছিল। হয়তো সে ভুলে গেছে। কিন্তু মৃত্তিকা জামাটা দেখেই চিনতে পেরেছে। সব খরচ সামলে সম্ভব হলে মৃন্ময়ী নিজের জন্য কিছু কিনে। সম্ভবত বেতনের সবচেয়ে কম ভাগটাই তার নিজের খরচের জন্য অবশিষ্ট থাকে। মৃত্তিকা সেটা জানে, কিন্তু কোনোদিন-ও এ বিষয়ে সে ভ্রূক্ষেপ করেনি। আজ মৃত্তিকা বলল,
“বেতন পেলে এবার নিজের জন্য দুটো নতুন জামা কিনিস আপা।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“কিনব।”
যদিও এটা তার মুখের কথা। খরচ সামলে উঠতে না পারলে সে এই মাসে-ও নতুন জামা কিনবে না। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে মৃত্তিকা আসল কথায় ফিরল। মুখে হাসি টেনে বলল,
“আপা, একটা সুসংবাদ আছে।”
মৃন্ময়ী চট করে মুখ তুলে বলে উঠল,
“তোর চাকরি হয়েছে?”
মৃত্তিকা অবাক হয়ে বলল,
“তুই বুঝলি কীভাবে?”
মৃন্ময়ী খুশিতে প্রশস্ত হেসে বলল,
“তারমানে সত্যিই তোর চাকরিটা হয়েছে? আলহামদুলিল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ্। আমি তো কদিন ধরে শুধু এটাই ভাবছিলাম। এবার তাহলে স্বস্তি পেলাম। কবে থেকে ডিউটি করতে বলেছে?”
“কাল থেকেই।”
“তাহলে তো ভালোই হয়েছে। শোন, খুব মন দিয়ে কাজ করবি কিন্তু। অন্য কোনোদিকে মন দেওয়া যাবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এ কদিনে তুই আমাকে হাজারবার বুঝিয়ে ফেলেছিস। আমি বাচ্চা না, বুঝি সব।”
“তোকে নিয়ে চিন্তা হয় বলেই তো বুঝাই। যা, মাকে খবরটা দিয়ে আয়।”
মৃত্তিকা কেমন চুপসে গেল। দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“তুই বল।”
“আমি বলব কেন? চাকরি কি আমার হয়েছে? তোর হয়েছে, তুই বলবি।”
“আমার কেমন যেন লাগছে। তুই বল না প্লিজ।”
“তুই এত বোকা কেন রে? এ কদিনে মা তোর চাকরির ব্যাপারে কতবার আমাকে প্রশ্ন করেছে জানিস? সে মনে-মনে তোর জন্য ঠিকই চিন্তা করে, তুই-ই বুঝিস না।”
“আয় না। তুই এলে কী সমস্যা?”
“আচ্ছা চল, আমিও যাচ্ছি। কিন্তু খবরটা তোর নিজের মুখেই বলতে হবে।”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে ধরে নিয়ে এল মায়ের কাছে। সাজেদা বেগম তখন রোদে শুকিয়ে আনা কাপড় গোছাচ্ছেন। মৃন্ময়ী এসে আনন্দিত গলায় বলে উঠল,
“মা, একটা আনন্দের খবর আছে।”
সাজেদা বেগম উৎসুক মুখে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,
“কী খবর?”
“আমি না, মৃত্তিকা বলবে। মৃত্তিকা, বল মাকে।”
মৃত্তিকার মুখের দিকে সাজেদা বেগম তাকিয়ে আছেন। মৃত্তিকা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করতে না পেরে বলল,
“মা, আমার চাকরিটা হয়েছে।”
সাজেদা বেগম খুশি হয়েছেন কি না বুঝতে পারল না মৃত্তিকা। তিনি কেবল ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলেই আবার কাপড় গোছানো ধরলেন। মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকাল। মৃন্ময়ী মাকে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি খুশি হওনি মা?”
সাজেদা বেগম বললেন,
“খুশি হব না কেন?”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে কনুইয়ের গুঁতা মে’রে ফিসফিসিয়ে বলল,
“খুশি হয়েছে। হেঁয়ালি করা এনার স্বভাব।”
মৃত্তিকা মৃদু হাসল। বোনের কথাটা সে বিশ্বাস করে নিল। মাকে সে কবেই বা বুঝতে পেরেছে?
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।