#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
৬.
মৃন্ময়ী খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছে তাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন পাঠাগার হয়েছে। পাঠাগারের দায়িত্ব পালনের জন্য লোক নেওয়া হবে। খবরটা পেয়ে মৃন্ময়ী দেরী না করে দ্রুত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করেছে। স্যার তাকে ভালোভাবেই চেনেন। রোজ সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে স্যারের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে সালাম দিলেই স্যার হাসিমুখে তার খোঁজ-খবর নেন। মৃন্ময়ীর বোনের কথা শুনে তিনি বললেন মৃত্তিকার বিষয়ে তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন। আরও বললেন মৃত্তিকা যেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ নিয়ে একবার স্কুলে আসে। মৃন্ময়ী মনে-মনে খুব করে চাইছিল এই কাজটা যেন মৃত্তিকা পায়। তার জন্য এমন কাজ-ই দরকার। এরচেয়ে ভালো কাজ তার জন্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। মৃত্তিকা-ও শুনে মনেপ্রাণে চাইছিল সে যেন কাজটা পেয়ে যায়। এসএসসি আর এইচএসসির সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে সে মৃদুলাকে সঙ্গে করে স্কুলে-ও যায়। স্যার শুধু মৃত্তিকার কাগজপত্র চেক করে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন। এরপর বলে দিয়েছেন মৃত্তিকার আগেও তিনজন কাগজপত্র জমা দিয়ে গেছে। সময়মতো তারা জানিয়ে দিবেন কাকে নেওয়া হবে। অবশ্য মৃন্ময়ী জানত বিষয়টা এত সহজ হবে না। এসব কাজ যে পর্যায়ের-ই হোক, মানুষের লাইন পড়বেই। মৃন্ময়ী তার স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে-ও এই বিষয়ে কথা বলে তাকে অনুরোধ করেছে সে যেন স্কুলে একটু কথা বলে দেখে। প্রিন্সিপাল স্যার তাকে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি কথা বলবেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মৃত্তিকার স্বামীর সাথে তার দেখা হয়ে গেল। স্বামীকে দেখেই সে থমকে দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু তার স্বামী যেন তাকে দেখলই না। বলাবাহুল্য দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল। মৃত্তিকার কলিজাটা মনে হলো ফুটা হয়ে গেল। বুকে একরাশ ব্যথা আর চোখে ছলছল জল নিয়ে মৃত্তিকা বাড়ি ফিরল। বাকি দিনটা কা’টল তার কেঁদে-কেঁদে। মৃন্ময়ী বাড়ি ফিরে মৃত্তিকার খবর নিতে গিয়ে দেখল তার বোনের এমন অবস্থা। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারল স্বামীর অমন অপরিচিত আচরণে সে কষ্ট পেয়েছে। মৃন্ময়ী শুনে আবাক হলো। যে লোক দ্বিতীয় বউ ঘরে তুলে মৃত্তিকাকে বিদায় করে দিয়েছে, তার অপরিচিত আচরণ কি অস্বাভাবিক কিছু? মৃত্তিকার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না? কী আশ্চর্য! অথচ মৃত্তিকাকে এ কথা বলতেই সে আবারও বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলল। আহাজারি করে বলল,
“আমি তো ওকে ভালবেসেছি। ওর জন্য আমি নিজের পরিবার ছেড়েছিলাম। সংসারের হাজারটা ঝামেলার মাঝেও আমি শুধুমাত্র ওর জন্য টিকে ছিলাম। ওর সাথে আমার একটা বছরের সংসার, এত-এত স্মৃতি। আমি ওসব কী করে ভুলে যাব রে আপা?”
মৃন্ময়ী বলল,
“কষ্ট হলেও ভুলে থাকতে হবে বোন। নইলে যে তুই তোর জীবনে সামনে এগোতে পারবি না।”
“কী করে ভুলব আপা? ভালোবাসার মানুষকে মাথা থেকে মুছে ফেলা কি এত সহজ?”
“হতে পারে কঠিন। তার চেয়েও বেশি কঠিন তোর বর্তমান জীবন। এটাও তোকে বুঝতে হবে। তোর বর্তমান জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখ। তোর জীবনটা এখন সম্পূর্ণ অগোছালো। তোকেই তা গুছিয়ে নিতে হবে। পিছুটান নিয়ে তুই নতুন করে জীবন সাজাবি কীভাবে? পিছুটান রেখেই বা কী লাভ? কোনো লাভ নেই, বরং এতে তোর কষ্ট বাড়বে। তোর জীবনটা নিয়ে পুতুল খেলে যে জিতে গেছে, নতুন করে জীবন সাজিয়ে তাকে তুই হারিয়ে দে।”
“ওকে চোখের সামনে দেখলে যে আমি ভেঙে পড়ি আপা।”
“ভেঙে পড়া চলবে না। শক্ত হতে হবে। তোর সঙ্গে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার নিজেকে নিয়ে ভাব মৃত্তিকা। নিজেকে ভালোবাসতে শেখ। যারা ঠকিয়েছে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে, তাদের ছাড়াও তুই একটা সুন্দর জীবন কা’টানোর সাধ্য রাখিস। দেখি, চোখ মোছ। এখন থেকে একদম কাঁদবি না। খারাপ মানুষদের জন্য নিজের মূল্যবান চোখের জল ঝরানোর কোনো মানেই হয় না। ওরা চোখের জল পাওয়ার-ও যোগ্য না,” মৃত্তিকার চোখের পানি মুছতে-মুছতে বলল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা নাক টেনে বলল,
“আমি চেষ্টা করব আপা।”
“অবশ্যই চেষ্টা করবি। চেষ্টা করলে সব সম্ভব। এখন থেকে তোর লক্ষ্য শুধু একটাই, নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা। আর কোনোদিকে তুই তাকাবি না। দৃষ্টি রাখবি শুধু নিজের লক্ষ্যের ওপর। দেখবি, একদিন তোর জীবন এত সুন্দর হয়ে উঠবে, এত সুন্দর উঠবে যে খারাপ মানুষগুলো-ও তোকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবে। মনে-মনে আফসোস করবে। তখন আর তুই তাদের দিকে ফিরে তাকানোর-ও প্রয়োজনবোধ করবি না।”
মৃত্তিকা বলল,
“আপা, তোর কথা শুনে আমার কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।”
“কেমন অনুভূতি? মনে সাহস জাগছে না? সত্যি-সত্যি কিছু করে দেখাতে ইচ্ছা করছে না?”
মৃত্তিকা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“ইচ্ছা করছে, খুব ইচ্ছা করছে। আমার সত্যিই এই অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। আমি সবকিছু পেছনে ফেলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করতে চাই। নিজের জীবনকে উপভোগ করতে চাই।”
মৃন্ময়ীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“তুই পারবি। আমি তোকে সম্পূর্ণ সমর্থন করব। তোর এই রূপটা দেখার অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার। ফাইনালি আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো। আমার বোন সঠিকভাবে ভাবতে শিখল। শোন, তুই মন দিয়ে কাজ করবি। কাজের মাঝে থাকলে দেখবি আস্তে-আস্তে এমনি মাথা হালকা হয়ে যাবে। তারপরও কখনও মন খারাপ হলে তা মনে চেপে রাখবি না। আমি আছি, মৃদুলা আছে। আমাদের সঙ্গে শেয়ার করবি। সবার সঙ্গে সময় কা’টালে ভালো লাগবে।”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“আপা, তুই এমনভাবে বলছিস যেন কাজটা আমি অলরেডি পেয়ে গেছি।”
মৃন্ময়ী আশা না হারিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
“পাবি, পাবি। তুই-ই পাবি, দেখিস। আর এটা না পেলে কি দুনিয়াতে অন্য কোনো কাজ নেই? কিছু একটা ঠিক জোগাড় করে দিবো। আমার ওপর ভরসা রাখ। আমি তোকে হতাশায় ভুগতে দিবো না।”
মৃত্তিকা-ও দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“তোর ওপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।”
“শুধু আমার ওপর না, নিজের ওপর-ও থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। মনোবল বাড়াতে হবে। নিজেকে বুঝাতে হবে তোকে দিয়ে সব সম্ভব, নিজের জন্য তুই সব করতে পারবি। কী-রে? পারবি না?”
মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে মাথা দুলিয়ে বলল,
“পারব আপা।”
টিউশন থেকে ফিরে মৃদুলা নিজের ঘরে ঢোকার পথে দুই বোনের কথোপকথন শুনে থেমে গিয়েছিল। মাঝখানে ঢুকে সে তাদের মনোযোগ নষ্ট করতে চায়নি। বিধায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথোপকথনের কিছু অংশ সে শুনতে পেয়েছে। বলা যায় ইচ্ছা করেই শুনেছে। মৃন্ময়ী ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে মৃদুলাকে দেখে শুধাল,
“কী-রে? তুই কখন এলি?”
“একটু আগেই। তোমাদের কথা বলতে দেখে মাঝখানে ঢুকিনি। আজকের ব্যাপারটা নিয়ে আপুর মন খারাপ, না?”
“হ্যাঁ। আমি তো বুঝিয়ে বললাম। শোন না, তুই-ও একটু বুঝাস ওকে। ওর কাছাকাছি যখন থাকবি, তখন ওকে সাহস যোগাবি। সামনে ওর অনেক পথ হাঁটতে হবে। ভাঙাচোরা মন নিয়ে বসে থেকে তো সেটা সম্ভব না।”
মৃদুলা তাকে আস্বস্ত করে বলল,
“ঠিক আছে, আমি যতটুকু পারি বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা কোরো না।”
•
মৃন্ময়ীর স্কুলে আজ একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান আছে। এতদিন ধরে মৃদুলা বোনকে তার কেনা নতুন শাড়িটা পরতে বলার উপলক্ষ খুঁজছিল। আজ কোনোমতে একটা ছোটোখাটো উপলক্ষ পেয়েই সে বোনকে চেপে ধরল শাড়ি পরানোর জন্য। কিন্তু মৃন্ময়ী নারাজ। সে কোনোমতেই শাড়ি পরবে না। মৃদুলা-ও কম যায় না। সে-ও জেদ ধরে বসল সে আজ বোনকে শাড়ি পরিয়েই ছাড়বে। মৃন্ময়ী এত করে বলল বড়ো কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সে অবশ্যই শাড়িটা পরবে, মৃদুলাকে কোনো কথাই শোনানো গেল না। সে মেয়ে জেদ ধরে বোনকে শাড়ি পরাতে রাজি করল। তারপর শাড়ি পরতে নিজেই সাহায্য করল। মৃন্ময়ী সাজগোজ খুব একটা করে না। করলেও যৎসামান্য। মৃদুলা তাকে হালকা সাজিয়ে-ও দিলো। মৃন্ময়ী বারবার শুধু বলছিল ‘বেশি সাজাস না, ভালো লাগবে না, আমার লজ্জা লাগে।’ অথচ সাজগোজ শেষে মৃদুলা তার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলল,
“তোমাকে দারুণ লাগছে আপা।”
মৃন্ময়ী আয়নায় নিজেকে দেখল। মৃদুলার ভাষায় তাকে‘দারুণ’ লাগছে কি না বুঝে উঠতে না পারলেও, নিজের কাছে তাকে সত্যিই একদম অন্যরকম মনে হলো। মৃদুলা তাকে জিজ্ঞেস করল,
“ভালো লাগছে না?”
মৃন্ময়ী কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলল,
“ভালো, কিন্তু সাজটা কি একটু বেশি হয়ে গেল?”
“এইটুকু সাজ বেশি? বলো কম হয়েছে।”
“আমার তো অভ্যাস নেই, তাই কেমন যেন লজ্জা লাগছে।”
“সব মেয়েরাই একটু হলেও সাজে। তোমার এত লজ্জার কী আছে?”
“তুই বুঝবি না। বাইরে বেরোলে মানুষ অদ্ভুতভাবে তাকাবে।”
“কোন মানুষ?”
“বাইরে কি মানুষের অভাব?”
“বাইরের মানুষের কথা বলছো, না প্রভাত ভাইয়ার?” ঠোঁট টিপে বলে উঠল মৃদুলা।
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কথায়-কথায় তুই ওকে টানিস কেন?”
“এছাড়া আর কাকে টানব? তুমি কি একজনকে পেছনে ঘুরিয়ে অন্য কাউকে টানতে চাও?”
“আমি ওকে পেছনে ঘুরাই? এসব কে বলেছে তোকে?”
“তুমি না ঘুরালেও সে ঘোরে, আমি সব খবর জানি।”
“এত খবর রাখিস কোত্থেকে তুই?”
মৃদুলা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“আমার স্পাই আছে।”
“স্পাই আবার কে?”
“বিবিসি নিউজের হেড।”
মৃন্ময়ী আর মৃদুলার কথায় মাথা ঘামাল না। এই মেয়ে সত্য কথা তো বলেই না, অযথা রহস্য করে।
সারাদিন স্কুলে সুন্দর সময় কা’টলেও, ছুটির পর স্কুল থেকে বেরোতে মৃন্ময়ীর ভীষণ লজ্জা লাগতে শুরু করল। প্রভাত নিশ্চয়ই আজ তাকে নিয়ে কিছু না কিছু মন্তব্য করে তাকে লজ্জায় ফেলবে। গতবছরে-ও এমনটা হয়েছিল। স্কুল থেকে পিকনিকে নেওয়া হয়েছিল। বাকি ম্যামরা শাড়ি পরবে বলে তারা মৃন্ময়ীকে-ও শাড়ি পরতে রাজি করিয়েছিল। সেদিন প্রভাত তাকে দেখে এমন-এমন মন্তব্য করেছিল যে লজ্জায় পড়ে সে আর শাড়ি পরে স্কুলে আসেনি। অবশ্য তার দিক থেকে তার মন্তব্য সুন্দর-ই ছিল। মৃন্ময়ী নিজেই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। আজ স্কুল থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল শাড়ি পরেও তার একটা-ও সিঙ্গেল ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি। অনুষ্ঠানের মাঝে যা ছবি তোলা হয়েছে, সবগুলোই গ্রুপ ছবি। আশপাশে তাকিয়ে সে ফোন বের করে দুটো সেলফি তুলল। কিন্তু নিজের তোলা সেলফিতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না। স্কুল গেইট দিয়ে এক ম্যাম আর স্যার বেরোনোর সময় তাকে ছবি তুলতে দেখে এগিয়ে এল। স্যারের নাম ফুয়াদ। বয়সে তার চেয়ে একটু বড়ো। তবে লোকটা খুব মিশুক প্রকৃতির। মৃন্ময়ীকে খুব স্নেহ করে। ফুয়াদ স্যার সহাস্যে বললেন,
“ম্যাডাম, ছবি তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই?”
মৃন্ময়ী কিছুটা লজ্জা পেয়ে ফোন নামিয়ে নিয়ে বলল,
“না স্যার, এমনি সেলফি তুললাম।”
“থাক, লজ্জা পেতে হবে না। আপনি যে এক বছরে একটা ছবি তোলা মানুষ, তা আমরা জানি। আপনার জন্য ছবি তুলতে ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। দিন, ছবি তুলে দিই।”
মৃন্ময়ী যেন আরও লজ্জায় পড়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল,
“না-না স্যার। আমি আর ছবি তুলব না। ধন্যবাদ আপনাকে।”
ফুয়াদ স্যার তবু বারবার করে বললেন,
“আরে লজ্জা পাবেন না। দিন তুলে দিই। আমি কি অপরিচিত মানুষ?”
মৃন্ময়ী শেষে তার হাতে ফোন দিয়ে দিলো। এমনিতেই তার ফোনের ক্যামেরাটা-ও খুব একটা ভালো না, ফোনটা পুরোনো হয়ে গেছে যে। ফুয়াদ স্যারের হাতে ফোন দিয়ে মনে-মনে তার আরও লজ্জা লাগল। তবু ম্যামের কথায় সে ছবি তুলতে দাঁড়াল। ফুয়াদ স্যার বোধ হয় একটার বেশি ছবি তুলতে পারলেন না, কোত্থেকে প্রভাত এসে বলে বসল,
“আমার অনুপস্থিতিতে ছবি তোলার জন্য ধন্যবাদ স্যার। এবার আপনি ছুটি নিতে পারেন।”
ফুয়াদ স্যার অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। প্রভাত আর মৃন্ময়ীর ব্যাপারটা কারোরই অজানা নয়। ফুয়াদ স্যার একবার মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। বললেন,
“সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের আগমন। আমি তবে ছুটি নিলাম। আল্লাহ্ হাফেজ।”
এই বলে তিনি প্রভাতের হাতে ফোন দিয়ে ম্যামের সঙ্গে চলে গেলেন। তারা চলে যেতেই মৃন্ময়ী বিরক্ত চোখে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা কী করলে তুমি?”
প্রভাত যেন কোনো দোষ-ই করেনি, এমনই ভাব করে উলটা প্রশ্ন করল,
“কী করলাম?”
“স্যার ছবি তুলছিল, তোমার এসে এভাবে বাঁধা দেওয়াটা কি খুব দরকার ছিল?”
“অবশ্যই দরকার ছিল, খুবই দরকার ছিল। আমি থাকতে তোমার ছবি অন্য কেউ তুলবে কেন? এটা তো শুধুমাত্র আমার দায়িত্ব।”
“তোমাকে আমি দায়িত্ব দিলাম কবে?’
“কোনো একদিন তো দিবেই। আপাতত প্রাকটিস করার চেষ্টা করছি। দেখি, সুন্দর করে দাঁড়াও তো, ছবি তুলি,” পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে মৃন্ময়ীর দিকে তাক করে বলল প্রভাত।
সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে বলল,
“আমার ছবি তোলা হয়ে গেছে। আমার ফোন দাও।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর ফোনটা নিজের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। হাসিমুখে বলল,
“ছবি তুলতে না দিলে ফোন ফেরত পাবে না।”
“পুরোনো ফোন নিয়ে তোমার দুই টাকার-ও লাভ হবে না।”
“না হোক। আমি কি বিক্রি করতে নিব? ফোনটা আমার দরকার না হলেও তোমার তো দরকার আছেই, তাই না?”
“প্রভাত, ফাজলামি কোরো না তো। অনেকক্ষণ ধরে স্কুল ছুটি হয়েছে। সবাই চলে গেছে। ফোন দাও, বাসায় যাব।”
প্রভাত পুনরায় বলল,
“তোলো না দুটো ছবি। আমি ছবি তুলে দিলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“আমার ইচ্ছা করছে না।”
“তোমার ইচ্ছা না করলে ফুয়াদ স্যার তুলল কীভাবে?”
মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলল,
“কী মুশকিল! সবকিছু নিয়ে তুমি এত বাড়াবাড়ি কেন করো?”
“আমার স্বভাব-ই এমন। যাও, দাঁড়াও। ছবি তুলেই ফোন ফেরত দিয়ে দিবো।”
মৃন্ময়ী হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, তোলো ছবি। তাড়াতাড়ি করবে।”
মৃন্ময়ী ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে খেয়াল করল প্রভাত তার নিজের ফোন তাক করে আছে। সে বাঁধা দিয়ে বলল,
“তোমার ফোনে তুলছ কেন?”
প্রভাত বলল,
“আমার ফোনে তোমার ছবি সুন্দর উঠবে তাই। আমি তোমাকে ছবি পাঠিয়ে দিবো, চিন্তা নেই।”
মৃন্ময়ী আর কথা বাড়াল না। প্রভাত ছবি তুলতে-তুলতে বলল,
“একটু হাসো না। মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি বুঝি তোমাকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি।”
লজ্জা দূরে ঠেলে মৃন্ময়ী ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলল। প্রভাত-ও দুটো ছবির কথা বলে দশটা ছবি তুলে ফেলল। এরপর আর মৃন্ময়ীকে দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব হলো না। বাড়ি ফেরার পথেই প্রভাত ছবিগুলো মৃন্ময়ীকে সেন্ড করে ফোন ফেরত দিয়ে দিলো। মৃন্ময়ী ফোনে ছবিগুলো দেখতে লাগল। প্রভাত সত্যিই সুন্দর ছবি তুলেছে। ছবিতে তাকে দারুণ লাগছে। ঠিক যেমনটি মৃদুলা বলেছিল। তার মুখোভাব লক্ষ্য করে প্রভাত শুধাল,
“ছবি কি ম্যাডামের পছন্দ হয়েছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভালো ছবি।”
“শুধু ভালো নয়, বলো চমৎকার ছবি।”
প্রত্যুত্তরে মৃন্ময়ী বলে বসল,
“তোমার ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়ো।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
“তোমার রাখার কী দরকার?”
“তোমার ছবি আমার দরকার নয় তো কি ফুয়াদ স্যারের দরকার?”
মৃন্ময়ী চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
“ফুয়াদ স্যার আবার তোমার কোন পাকা ধানে মই দিলো?”
প্রভাত সঙ্গে-সঙ্গে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
“তোমাকে কি কেউ বলেছে তোমাকে আজ দারুণ সুন্দর লাগছে?”
“বলেছে?”
“কে?”
মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“যে-ই হোক, ফুয়াদ স্যার না।”
প্রভাত হেসে উঠে বলল,
“আমি তার কথা বলিওনি।”
“হ্যাঁ, একদমই বলনি।”
“শরবত খাবে?”
মৃন্ময়ী তাড়া দেখিয়ে বলল,
“উঁহু, বাড়ি ফিরতে হবে।”
“সে তো রোজই ফিরো। একদিন ভুল করে আমার বাড়ি ফিরে গেলে-ও তো পারো।”
মৃন্ময়ী প্রভাতের সামনে থেকে সরতে তাড়াহুড়া করে হাঁটতে যেয়ে বেখেয়ালে এক ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল। ছেলেটা বোধহয় বদমেজাজি। ধাক্কা খেতেই কেমন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বলে উঠল,
“প্রেম-পিরিতির ঠেলায় কি অন্ধ হয়ে গেছেন? রাস্তায় চোখ খুলে হাঁটতে পারেন না?”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“আশ্চর্য! আমি না হয় আপনাকে খেয়াল করিনি, আপনিও কি আমাকে খেয়াল করেননি? এমনভাবে কথা বলছেন কেন?”
ছেলেটা ত্যাড়া গলায় আবারও বলে উঠল,
“নিজে অন্ধের মতো হেঁটে আবার আমাকে বলেন? রাস্তাঘাটে প্রেম করা বন্ধ করুন, চোখ এমনিতেই খুলে যাবে। যত্তসব আজাইরা পাবলিক।”
সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত এগিয়ে এসে ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“কে আজাইরা পাবলিক? আবার বল তো কী বললি?”
ছেলেটা-ও প্রভাতের মুখের ওপর বলল,
“কী বলেছি শুনতে পাননি?”
প্রভাত ধমকে উঠে বলল,
“নিজের ভুল স্বীকার না করে আবার মুখে-মুখে কথা বলছিস? সমস্যা কী তোর?”
ছেলেটার বুকে হাত ঠেকিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফেলল প্রভাত। ছেলেটা তাতে আরও তেতে উঠল। রেগেমেগে বলে উঠল,
“আপনার সমস্যা কী? রাস্তায়-রাস্তায় মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ান, আবার মাস্তানি করতে এসেছেন? আপনাকে ভয় পায় কে?”
“এই, ছোটো ছোটোর মতো কথা বল। বেয়াদবি করবি তো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এলাকা থেকে বের করে দিবো?”
“আপনি এলাকার কে? চেয়ারম্যান, না মেম্বার? আমিও দেখি আপনি আমার সাথে কী করতে পারেন।”
তর্কাতর্কিতে ছেলেটা কয়েকটা গালি-ও দিয়ে ফেলল। শেষে রাগ সামলাতে না পেরে প্রভাত ছেলেটাকে দু-চারটা থাপ্পড় দিয়ে বসল। মৃন্ময়ী তর্ক তো থামাতেই পারল না, মা’র দেখে সে ভয় পেয়ে দ্রুত প্রভাতকে টেনে সরিয়ে দিলো। ছেলেটা তবু থামছেই না। মা’র খেয়ে সে পা’গলা কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ শুরু করেছে। তাদের মা’র দেখে সেখানে কয়েকজন ছেলেপেলে জড়ো হয়ে গেছে। প্রভাতকে তারা চেনে বলে ছেলেটাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাঁধা দিয়ে সরিয়ে নিল। মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি গায়ে হাত তুলতে গেলে কেন? এতে ছেলেটা আরও খেপেছে।”
প্রভাত ত্যাড়া গলায় বলল,
“খেপুক। ওর সাহস কী করে হয় বড়োদের সাথে এমন ব্যবহার করার? এটাই ওর জন্য উপযুক্ত শাস্তি। হাঁটুর বয়সী ছেলে হয়ে উলটা-পালটা কথা বলে, কত্ত বড়ো কলিজা।”
“ওর মানসিকতা খারাপ বলে খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওকে এসব কথা বলার সুযোগটা কে তৈরি করে দিয়েছে প্রভাত?”
প্রভাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুমি কি এখন এতে-ও আমার দোষ দিবে?”
“আমি দোষ না দিলেও লোকে আমাকে নিয়ে এমন মন্তব্য-ই করে। ছেলেটা সামনে করেছে, অন্যকেউ হয়তো পেছনে এই একই কথা বলে বেড়ায়। আমি তোমাকে এই কথাটা বারবার বলেছি, কিন্তু তুমি কোনোদিন-ও আমার কথা গ্রাহ্য করনি।”
প্রভাত বলল,
“আমি তো বারবার বলেছি লোকের কথায় আমার কিছু যায় আসে না।”
“তোমার এই বেপরোয়া স্বভাবটার জন্যই আমাকে আজ হাঁটুর বয়সী ছেলের মুখে অমন কথা শুনতে হয়েছে। এ-ও কি তুমি বুঝতে পারছো না? দয়া করে আমাকে একা ছাড়ো, আমার ভালো লাগছে না।”
কথাটা বলেই মৃন্ময়ী নিজের পথে হাঁটা দিলো। প্রচণ্ড রাগে চোখমুখের ভাব পালটে গেছে তার। প্রভাত চুপসানো মুখে একপা দু’পা করে হাঁটতে-হাঁটতে বিড়বিড় করল,
“জি ম্যাডাম। যত দোষ প্রভাত ঘোষ। বাকি সব সাধু সন্ন্যাসী।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
•