#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১০]
-তামান্না
এরপর রিহান মাথা তুলে বসে।এবং একবার আড় চোখে নিরুকে ও দেখে নেয়।যা দেখে আপনা আপনি মুখ টা ঠিক হয়ে যায়।খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে।ফটাফট সবাই মিলে এক সাথে ছবি তুলে অনেকক্ষণ।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই নিরুপমার কান্নার শব্দ ভেসে ওঠে।নিশা দৌড়ে এসে বোন কে জড়িয়ে ধরে। এক মিনিটের ভিতরে পুরো বাসায় একেক করে সবাই কান্না করতে থাকে।নিশা আর নিরুর কান্না কোনো ভাবেই থামাতে পারছে না।
–অতঃপর বিদায় নিয়ে যেতে হয় নতুন গন্তব্যে।যেখানে অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত নিয়তি পরিস্থিতি এবং চারপাশ।ভালো হলে তো খুশির শেষ নেই।তবে খারাপ হলে গোটা জীবন শেষ হয়ে যায়।একটা খারাপ সম্পর্কে পুরুষের থেকে ও বেশি কলঙ্ক বহন করতে হয় একজন মেয়ে কে।এতে যে পক্ষেরই দোষ থাকুক না কেন।পুরুষ মানুষের কোনো কলঙ্ক থাকে না তারা সব সময় শুদ্ধই থাকে।অবশ্য সমাজের চোখে।
–রিহান চুপচাপ বসে আছে নিরুর পাশে।ড্রাইভারের পাশে রিফা আর কেউ নেই এই গাড়ি তে।নিরু কান্না করেই যাচ্ছে।রিহান কিছু বলতে ও পারছে না।ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরতে তার প্রিয়তমা স্ত্রী কে।কিন্তু ভাগ্য এতো সুন্দর আর সহজ যে রাখে নি।
***********
–বিয়ে বাড়ি হলেও বাসাটা একদম ফাঁকা।কোনো মেহমান সাজসজ্জা রুম কোনো কিছুই নেই।রিহান নিয়ম শেষ করে যে রুমে গেছে আর বেরই হয় নি।নিরুকে ও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নি।তবে নিরুর অভিমান হচ্ছে রিহান আসছে না দেখে।
–সবাই মিলে একসাথে খাবার খায় রাতের।তখন রিহান ও উপস্থিত ছিলো তবে মাথা তুলে একবার ও তাকায় নি।নিরু বিয়ের শাড়ি পাল্টে থ্রি পিছ পড়ে আছে।মাথায় লম্বা করে ঘুমটা।
–রিফা:ভাইয়ার কি মন খারাপ?এভাবে মনমরা হয়ে আছো কেন?
রিফার কথায় নিরুর বুকটা কেঁপে ওঠে।মন খারাপ হয়ে যায় আরও।
–রিহান :মাথা তুলে জোর পূর্বক হেসে বলে,, তেমন টা না।মাথা টা ধরে আছে,,একটু রেস্টের প্রয়োজন।কথাটা বলেই হাত ধুয়ে উঠে চলে যায়।
–খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিরুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে শ্বাশুড়ি।কিছু জামা কাপড় শাড়ি আর গয়না তুলে দেয় ওর হাতে।নিজ হাতে গহনা আর শাড়ী পড়িয়ে তারপর রিফাকে দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয় অন্য কিছু বলে নি।যদিও ওনাদের ও মন খারাপ এমন টা হওয়ায়।
–রিফা:ভাইয়া আসবো?
–রিহান:তাড়াতাড়ি করে উঠে দরজা খুলে স্বাভাবিক হয়ে বলে আয়!আর নিরুপমা কে কোন রুমে থাকতে দিয়েছিস?সব কিছু হাতের কাছে আছে তো?
–রিফা:নিরুকে নিয়ে রুমে চলে আসে।হাত থেকে জিনিস পত্র গুলো বিছানায় রেখে বলে,, আম্মু বলেছে ভাবি আজ থেকে এই রুমে থাকবে আর তুমি গেস্ট রুমে।অবশ্যই তাড়াতাড়ি মন জয় করে যেন এই রুমে আসতে পারো সেই দোয়ায় করবে।কথাটা বলেই রিফা রুম থেকে বের হয়ে যায়।
–রিহান:ওয়ালেট ফোন আর ব্লুটুথ টা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে নিলে…।
–নিরু:দরকার নেই।অযথা এতে আব্বু আম্মুর চিন্তা বাড়বে।আপনি এখানেই থেকে যান আমি লাইব্রেরি রুমের সোফায় ঠিক মানিয়ে নিবো।
–রিহান:আচ্ছা!তবে আমি লাইব্রেরি রুমে চলে যাচ্ছি তুমি বরং এখানেই থেকে যাও।তারপর পাশের রুমে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলে,, রুম সাজাতে আমিই বারণ করেছি।সমস্যা নেই তুমি যা চাও না তা হবে না।আমি যথেষ্ট মানিয়ে নিতে পারবো।
–রিহান পাশের রুমে গিয়ে দরজা আটকে ফেলতেই নিরু বসে পড়ে বিছানায়। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।ইচ্ছে করছে নিয়ম পরিস্থিতি পৃথিবী সব ছেড়ে চলে যেতে।
লাইট টা অফ করে এভাবেই কাপড় না পাল্টে শুয়ে পড়ে।প্রিয় মানুষের গায়ের গন্ধ মিশে আছে বিছানায় পুরো রুমটায়, কেমন যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।অর্ধেক রাত অব্দি কান্নাই করে।আজ কে ভীষণ আব্বু কে মনে পড়ছে।আব্বু মা-রা যাওয়ার সময় যেমন কষ্ট হয়েছিলো আজ কে ও সেই রকম কষ্ট হচ্ছে।
একা একটা বিছানায় কখনো শুয়া হয় নি হয়তো পাশে আম্মু নয়তো নিশা থাকতো।তাই আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে।
**********
–রিহান ভোরে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।এসব আর ভালো লাগছে না সুতরাং যেতে হবে এসব থেকে দূরে।ব্যবসার অযুহাত দেখিয়ে দূরে থাকবে কয়েক দিন।সারারাত না ঘুমুতে পাড়ায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।চুপচাপ রুমে এসে দেখে নিরু শুয়ে আছে।এদিকে না তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
একটা ভালো টিশার্ট আর পেন্ট ওয়ালেট ফোন আর হাতে ঘড়ি।গায়ে কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ।
আস্তে করে এগিয়ে আসতে নিলে আচমকা উঠে বসে নিরু।রিহান ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিরু কাপড় টাও চেঞ্জ করে নি।সাজ গহনা সব কিছু এখনো শরীরেই।চোখ নামিয়ে বিছানার পাশে থাকা ড্রয়ার থেকে নিজের আইডি কার্ড নিয়ে বের হয়ে আসে।
কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে এসে বলে,,তোমাকে ছুটি দিয়ে যাচ্ছি।ফিরবো না আপাতত তবে তোমার বিশ্রাম শেষ হলে জানিয়ে দিও।আসছি বলে আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায় নি।
–নিরু চুপচাপ বিছানায় হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে।চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে তা না করে কি না রিহান দূরত্ব টানছে?কিন্তু দূরত্ব যে সংসার সম্পর্ক মজবুত নয় বরং নষ্ট করে দিবে।
মিনিট পাঁচেকের ভিতরে রিহান রুমে ফিরে আসে।সোফায় হেলান দিয়ে হাত রেখে বসে আছে।
–রিফা:ভিতরে আসবো?
–নিরু:হাত দিয়ে চোখ মুছে বিছানা থেকে নেমে বলে আসো।
–রিফা:তুমি কি গো ভাবি?বিয়ের পরদিন বরকে ছেড়ে দিচ্ছো অমঙ্গল ডেকে আনার জন্য?কথা গুলো বলতে বলতে রুমে ঢুকে মুখ টা হা হয়ে যায়। কপালে হাত দিয়ে বলে এখনো কাপড় ও চেঞ্জ করো নি?তাড়াতাড়ি যাও,কিছু নিয়ম আছে।আর হ্যা শাড়ী পড়ে নিও আলমারি তে রাখা আছে।একেবারে গোসল করে দুই জন বর বউ মিলে একসাথে নিচে আসবে।আর তোমাদের দেখে আমাদের চোখ দুটো জুড়াবে।
–রিহান :চুপ!আমি তোর বড় নাকি তুই আমার বড়?সেই কখন থেকে ভাষণ শুনে যাচ্ছি।
–রিফা:ভেংচি কেটে বলে এহহ বুঝে না কিছু আবার আসছে!এরপর আর পায় কে সোজা এক দৌড়ে বাইরে।
–নিরু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রিহানের দিকে। রিহান জোর পূর্বক হেসে বলে,, যেতে দেয় নি তো!তোমার শ্বাশুড়ি আর ননদ কান্না কাটি জুড়ে দিয়েছে।ফিসফিস করে বলে কই বউ কেঁদে ভাসাবে তা না।
–নিরু:আচ্ছা!মুখে আচ্ছা বললেও মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছে।
**********
–শ্বাশুড়ি :আমাদের বংশের নিয়ম বিয়ের পরদিন নতুন বউকে নিজ হাতে রান্না করে সবাই কে খাওয়াতে হয়।তোকে কিছু করতে হবে না নিরু আমি মরিয়মের মাকে সব রান্না করে ফেলতে বলেছি।সব সময় তো সে-ই রান্না করে।
–নিরু:এগিয়ে এসে শ্বাশুড়ির ঘা ঘেঁষে বলে আমি পারবো।তুমি শুধু রেসিপির নাম টা ফটাফট বলে দাও।
–রিফা:আর সাহায্য করার জন্য আমি আছি তো।তারপর নিরুকে জড়িয়ে ধরে।আজকে ভীষণ মিস করছে নিশাকে।মেয়ে টা নিরুকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না।মন খারাপ এটা ওটা সবটাই জুড়ে থাকতো নিরু।একটু আগে ও মা বোনের সাথে কথা হয়েছে নিশা ভীষণ কান্না করেছে।
–নিরু রিফা রান্না ঘরে আড্ডা দিতে দিতে রান্না করছে।নতুন গিন্নী রা রান্না করছে তার আভাস ড্রয়িং রুম থেকেই পাওয়া যাচ্ছে।রিহান হাসতে হাসতে বের হয়ে যায় বাসা থেকে।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে ওদের ও আসতে বলেছে দুপুরে,, নিশা আর শ্বাশুড়ি কে ও নিয়ে আসবে।তাহলে নিরু এবং ওদের পরিবার সবাই খুশি হবে।
–এদিকে মিতা নিশাকে নিয়ে শুয়ে আছে।বাচ্চা মেয়েটার ভীষণ মন খারাপ।পুরো বাড়িটাই একদম ফাঁকা হয়ে গেছে।দুই বোন মিলে সারাদিন কতোই না খুনসুটি করতো।স্বামী মা-রা যাওয়ার পর আজকের মতো মন খারাপ কোনো দিন হয় নি।
রিহান বন্ধুদের নিয়ে সাথে নীলাকে ও নিয়ে সবাই এক সাথে চলে আসে নিরুদের বাড়িতে।কলিং বেলের শব্দে মিতা চোখ টা মুছে দরজা টা খুলে দেয়।রিহান কে দেখে অনেক টাই অবাক হয়ে যায়।
–রিহান:হা করে আছো কেন?ছেলেকে ঘরে আসতে বলবে না?
–মিতা:এবার কান্না করে দেয় রুম থেকে দৌড়ে চলে আসে নিশা,দুজনকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রিহান।মুখে হাসি রেখে বলে,, যখন ইচ্ছে করবে মেয়ের কাছে চলে যাবে এখানে নিয়ে আসবে,,মন খারাপ করছো কেন?শুধু মেয়ের পিছন পিছন আমাকে ও রেখো।
–মিতা:হাসতে হাসতে চোখের পানি মুছে দিয়ে সবাই কে ভিতরে নিয়ে বসায়।
–মিতা:তোমরা বসো আমি নাস্তা আনছি বলে ভিতরে চলে যায়।
–নিশা:আপুকে আনলে না কেন?
–রিহান:আপু কিন্তু এখন আমার সম্পত্তি মাঝে মধ্যে খানিকটা সুযোগ দিতে হবে নাকি?
–নিশা:হাসতে হাসতে বলে কাগজ পত্র ঠিক হলেও আশা করি সম্পত্তির মধ্যে খানিকটা ময়লা ঝড়া পাতা জমে আছে,, পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ো।
–রিহান:তোমার কি মনে হয় পরিষ্কার করা যাবে?
–নিশা:অবশ্যই!সুন্দর এবং নরম মনের মানুষের মনে রাগ জমে থাকে না তবে অভিমান জন্মে আর সেটা ভালোবাসা দিয়ে দূর করা যায়।
–নীলা :নিশার কানটা টেনে দিয়ে বলে,বেশি পাকা হয়ে গেছিস তাই না?
–নিশা:হাসতে হাসতে বলে,,বেশি না একটু।বড়দের থেকে শিখেছি।সবাই এক সাথে হেসে ওঠে।
–সবাই মিলে আড্ডা দেয় অনেকক্ষণ।রিহান শ্বাশুড়ির সাথে রুমে বসে আড্ডা দেয়।
–মিতা:খারাপ ব্যবহার করেছে নিরু?
–রিহান:নাহ্।তবে দূরত্ব অনেক অনেক।
–মিতা:বুঝিয়ে বলবো?
–রিহান:থাক!জোর করে কোনো কিছু স্থায়ী হয় না।এরচেয়ে ভালো আমি না হয় ভালোবেসে আগের নিরুকে ফিরিয়ে আনবো।আগের নিরু হলেই হবে কোনো কমতি থাকবে না।
–মিতা:দোয়া করি সব কিছু তাড়াতাড়ি করে ঠিক হয়ে যাক।
–রিহান:এতো কিছু জানি না।তুমি এখন আমাদের সাথে যাবে।
–মিতা:এখন?এখন কিভাবে যাবো বাবা?
–রিহান :হাত ধরে টেনে দাড় করিয়ে বলে,, তোমার মেয়ে প্রথম বার রান্না করছে শ্বশুর বাড়ি তে আর সে খাবার তুমি খাবে না তা কি করে হয়?
–নিরু রান্না শেষ করে রুমে এসে শুয়ে আছে।ভয় হচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক হলো তো?রিফা তো বললো হয়েছে। রিহান ও বাসায় নেই কোথায় গেছে বলে ও যায় নি।শ্বশুর বাড়িতে যতই বিশ্বস্ত মানুষ থাকুক না কেন।স্বামী ছাড়া কি থাকা যায়? স্বামী বিহীন শ্বশুর বাড়ি তে কেমন জানি এতিম এতিম লাগে।
#চলবে