নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-০১

0
5

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১]
-তামান্না

–তুই এখানে?সবাই বাইরে কি বলাবলি করছে নিরু?প্রিন্সিপাল স্যারের হাতে নাকি কি সব ভিডিও দেওয়া হয়েছে?
–নিরু:কিসের ভিডিও? আর আমিই বা কি করে জানবো?দেখতেই তো পাচ্ছিস নোট করছি।
–নীলা :হাত ধরে টানতে টানতে অফিস রুমের সামনে চলে আসে।হালকা ভীড় ঠেলে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখিয়ে বলে এসব কি?আচমকা এমন কিছু দেখে মাথা ঘুরে যায় নিরুপমার।সে কি দেখছে?আর সবাই ও দাঁড়িয়ে এসব দেখছে?

–প্রিন্সিপাল :ছিহ!কমপক্ষে নিরুপমার থেকে এটা আশা করি নি। কলেজের ফাস্ট গার্ল হয়ে কি-না,, আমার ছেলের সাথে এমন করলো?তারপর ধমক দিয়ে সবাই কে পাঠিয়ে দেয়।নিরুপমা দৌড়ে একটা রুমে চলে আসে।নিজের মুখ খামছি দিয়ে কান্না করতে থাকে।
–নীলা:কি করে হলো নিরু?এমন জঘন্য কিছু হতে পারে?
–এরমধ্যে রিফাত রুমের সামনে এসে বলে প্রিন্সিপাল স্যার তোমায় ডাকছে নিরু।তাড়াতাড়ি এসো।
–নিরু:দৌড়ে গিয়ে রিফাতের সামনে দাঁড়িয়ে বলে আপনার বন্ধু কই রিফাত ভাই?এমনটা কিভাবে হলো?তারপর ফোন নিয়ে কয়েকবার কল করতেই রিসিভ হয়।
–প্রিন্সিপাল :কোথায় তুমি? অফিস রুমে এসো।তোমার সাহস তো কম নয় আমার ছেলেকে আবার ফোন করছো?
তারপর হাত থেকে ফোন টা পড়ে যেতেই ধপ করে বসে পড়লো নিরু।চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।রিফাত তাড়া দিয়ে চলে গেছে।
–নীলা:রিহান ভাই কই?এমন একটা পরিস্থিতিতে ও তোকে খোঁজ করতে আসছে না??

–নীলা:স্যার যখন ডাকছেন তুই অফিসে যা নয়তো হিতে বিপরীত হবে।
–নিরু:আমি কি বলবো নীলা? স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে স্যারের ছেলের সম্পর্কে কিছু বলা যায়?
–নীলা:চিন্তা করিস না।আমি জানি তুই খুব ই ব্রিলিয়ান্ট ঠিক মোকাবিলা করতে পারবি।

–এদিকে রিহান অফিস রুমে এসে আরামে বসে আছে। তার এসব মজাই লাগছে।যে বাবা এতো দিন যে মেয়ের জন্য কান ঝালা পালা করে ফেলতো আজকেই তার বিরক্তি আসছে সে মেয়ের প্রতি।

************
–নিরু:কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,, মে আই কামিং স্যার?
–প্রিন্সিপাল :এসো!
–নিরু ভিতরে প্রবেশ করতেই অবাক হয়ে যায় এখানে বসে আছে রিহান?তবে ভয়ে আর মাথা তুলতে পারে নি।
–প্রিন্সিপাল :তোমাকে অনেক ভালো জানতাম।আমরা কেউ তোমার থেকে এটা আশা করি নি।তুমি আমার ছেলেকে ডেকে নিয়ে জোর জবরদস্তি করতে পারলে?
–রিহান:শুধু আজকে না পাপা।আমাকে গত এক বছর যাবত বিরক্ত করে আসছে এই মেয়ে।আজ কাল তো কলেজে এলে একে এড়িয়ে থাকতাম। তবে আজকে আমি পারি নি।রিহানের মুখ থেকে এমন কথা শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে নিরু।

–স্যার:ছিহ্ নিরুপমা তোমার থেকে এটা আশা করি নি।অনেক জনে অনেক কথা বলে।নিরুপমা মাথা নুয়ে চোখের পানি ফেলছে।
–রিহান:চরিত্র নষ্ট মেয়ে,, আজকে তোমার জন্য আমাকে অপমানিত হতে হলো।নেক্সট টাইম এই কলেজে যেন না দেখি।আর আমি চাইবো এই মেয়ে কে যেন কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়।
–প্রিন্সিপাল :এমনটা হয় না।নিরুপমা একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আর দুই তিন মাস পরেই ফাইনাল পরীক্ষা।তবে এটুকু বলবো তোমার আচরণে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।
–ম্যাম:আজকে বুঝলাম ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকলেই সারাজীবন সেরূপে থাকা যায় না।
তারপর নানা ধরনের অপমান জনক কথা শুনে #নৈশব্দে_নিরুপমা বেড়িয়ে আসে।

–অফিস থেকে বের হয়েই রিহান বন্ধুদের সাথে হাত মিলিয়ে বলে,, অবশেষে মিশন সাকসেসফুল।
–তৃণা:এটা কিন্তু ঠিক হলো না।একজন ভালো মানুষ কে ভালোবাসা দেখিয়ে আবেগ তৈরি করে এভাবে খারাপ বানিয়ে ছুঁড়ে ফেলাটা।
–সাগর:সেটা তোকে ভাবতে হবে না।
–রিহান:কষ্ট তো কম করতে হয় নি।ছয় মাস পিছনে ঘুরে ফাঁদে ফেলে তারপর ছয় মাসের প্রেম।বাপরে গোটা একটা বছর আমার অভিনয়ের মধ্যেই চলে গেলো।
–আমান:তবে যাই বলিস মেয়ে টার ক্যারিয়ার আর লাইফে একটা দাগ পড়ে গেলো।
–রিহান:এটাই তো চেয়েছিলাম।আমি এই মেয়ের জন্য পাপার কথা শুনেছি প্রতিনিয়ত।কলেজে আমাদের এড়িয়ে চলতো নিজের সস্তা এট্রিটিউড আমার সাথে দেখায়!ভাবা যায়?

–নিরু:আমি বাসায় যাবো নীলা।তবে যাওয়ার আগে প্লিজ একবার রিহানের সাথে দেখা করে যেতে চাই।
–নীলা:দরকার নাই।তুই আমার সাথে বাসায় চল।তোকে কতোবার বারণ করেছি রিহানের কথায় গলে যাস না।কিন্তু ফলস্বরূপ কি হলো?এই বাজে ভিডিও গুলা এই রিহানই করেছে এখন আমি শিউর।
–নিরু:চোখের পানি মুছে বলে তবে এগুলো সত্যি না।আমি কেমন আমি জানি আর রিহান ও জানে।হয়তো ভয়ে রিহান এমনটা বলেছে।রিহান এমন নয় বিশ্বাস কর,,একটুও এমন না।গত এক বছর যাবত আমি ওকে দেখছি।অন্য ছেলেদের মতো গায়ে পড়া স্বভাবের অশ্লীল সে নয়।সে সত্যি আমাকে ভালোবাসে।

–নীলা :বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে ভালোবাসলে কেউ অন্যের সামনে অপমান করতে পারে না।শুধু ভালোবাসলেই হয় না আগলে রাখতে জানতে হয়।নিরুর দুই গালে হাত দিয়ে ধরে বলে তুই ঠকে গেছিস নিরু,,বাজে ভাবে ঠকে গেছিস।

–এক হাতে চোখের পানি মুছে রিহান কে কল করে নিরু।দুই তিন বার রিং হওয়ার পর কল করে।
–রিহান:আবার কল করেছো?স্যার রা এতো কিছু বললো লজ্জা হয় নি?
–নিরু:কান্না করতে করতে বলে,, এখন আমি কি করবো রিহান।বাসা অব্দি এই নিউজ চলে গেলে কি জবাব দিবো?পড়াশোনা কিভাবে কন্টিনিউ করবো?তুমি তো জানো এমন কিছু না।তাছাড়া আমি এমন কিছু করি নি বরং তোমায় আটকাচ্ছিলাম।পিছন দিক থেকে খারাপ দেখা যায় মানলাম তবে খারাপ কিছু তো হয় নি।এতো বাজে ভাবে কে এমনটা করলো?
–রিহান:সেটা তোমার ব্যাপার।আর হে শুনো মরে যাও তুমি।নেক্সট আমার পিছনে লাগতে আসলে না বাকি ইজ্জত টুকুও ফিনিশ করে দিবো।কথা টা বলেই ফোন কেটে দেয়।

–রিফাত :সব কিছু ভালো হচ্ছে তো রিহান?তোর অপরাধ বোধ জাগছে না?মেয়ে টা যদি কোনো কিছু করে বসে?
–রিহান:তাহলে তুই বলে দে!এখন আমার কি করা উচিত?কোলে করে বাসায় নিয়ে বসিয়ে রাখা উচিত নাকি?
রিহানের এমন তাচ্ছিল্য কথায় রিফাত চুপ হয়ে যায়।
–এরমধ্যেই নীলা আর নিরুপমা কলেজ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে আসে।
–একজন:প্রিন্সিপালের ছেলের সাথে প্রেম করার শখ না,,একদম ঘুচে গেছে।
–অন্যজন:আমি আগেই বুঝে ছিলাম এতো সুন্দর ছেলে কি-না,, নিরুর পিছনে ঘুরছে?যদিও মেয়ে টা ভালো তবে ফর্সা তো আর নয়।একেক জনের একেক কথায় চোখ টলটল করে উঠে।সেই ছোট বেলা থেকে আজ অব্ধি নিজের গায়ের রং কিংবা চেহারা নিয়ে কোনো কথা শুনে নি।কারণ তার আশে পাশে সব সময় ভালোবাসার মানুষ গুলোই থাকে।এমন টক্সিক মানুষের সাথে পরিচয়ই হয় নি।
নিরুপমা সব কিছু উপেক্ষা করে গেইটের সামনে আসতেই রিহানদের আড্ডা দেখতে পায়।এবং ওকে দেখে টিটকারি করার শব্দ টা ও কানে আসে।
–নীলা :বাদ দে,, বাসায় চল।
–নিরু:চোখ টা মুছে বলে,, বাদই দিবো তবে মন কে বুঝানোর জন্য হলেও আমার রিহানের সামনে দাঁড়ানো উচিত।নাহলে আমি শান্তি পাবো না অস্বস্তি হবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হবে।

–নীলা কে পিছনে ফেলে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গিয়ে রিহানের সামনে দাঁড়ায়।
–রিফাত :নিরুপমা?আবার কেন?বাসায় চলে যাও সব ঠিক হয়ে যাবে।
–আমান:সবাই আরও তাচ্ছিল্য করবে এর থেকে ভালো বাসায় চলে যাও আর গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করো।
–নিরু:খুব সহজ?কই গত এক বছর আগে তো সবাই মিলে আপনাদের গড়ানো নাট্য মঞ্চে নিখুঁত ভাবে অভিনয় করে গেলেন।আমি তো কোনো সম্পর্কে যেতে চাই নি।আর কোনো অশ্লীলতা করি নি।তাহলে এতো বড় বদনাম কেন আমার জীবনে যুক্ত করে দিলেন?
–রিহান:বাব্বাহ!বদনাম হয়ে গেলো বুঝি?এখন কি করবে?মরে যাবে?এতো ভাব কোথায় রাখো?এমনিতেই তো ভাবে থাকতে যে কোনো ছেলে মানুষ সয্যই হয় না তারপর বড়লোক ছেলে পেয়ে ঠিকই তো গায়ে ঘা ঘেঁষে প্রেমে নেমে গেলে।কই? এখন কই গেলো ভাব?

–নিরুপমা :একজন কে ভালোবাসলে আদৌও এমন কুৎসিত ইঙ্গিত করা যায়?
–রিহান:সরি!ভালোবাসা সস্তা জিনিসে আসে না। একটু ভালো করে চেহারা টা দেখো,,আর তোমার ব্রিলিয়ান্ট মেধা ধুয়ে পানি খেও কেমন?
–নিরু:চোখের পানি মুছে জোর পূর্বক হেসে বলে বেশ।আমার বেঁচে থাকার রাস্তা টা সহজ করে গেলাম।তবে তুমি ভীষণ ভালো অভিনয় করতে জানো,,আমি মেধাবী হয়ে ও ধরতে পারি নি।প্রশংসা পাওয়ার মতো,,তারপর ভালো থেকো আমি না হয় তোমাদের সবার জীবন থেকে নৈশব্দে চলে গেলাম।
তারপর রিহানের মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে চলে গেলো।এবং মনে মনে ঠিক করে নিলো এটাই হবে রিহানের সাথে তার শেষ দেখা।চুপচাপ সবার জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আলাদা জায়গায় বসবাস করবে।
চোখ মুছতে মুছতে মাথা নুয়ে কলেজ ছেড়ে চলে যায়।

–রিহান:আমার ভালো লাগছে না আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।কালকে কলেজে আসবো না তোরা চলে আসিস।
–এদিকে নিরু ও নীলা কে নিয়ে রিকশায় চড়ে বাসায় চলে যায়।

*******
–আব্বু :সবটা কি সত্যি রিহান?
–রিহান:খাবারের প্লেট থেকে মাথা টা তুলে বলে কোনটা?
–আব্বু :নিরুপমা সত্যিই এমন করেছে?আমার তো এমন মনে হচ্ছে না।তাছাড়া সব কিছু চুপচাপ কোনো বাঁধা আপত্তি শব্দ ছাড়া মেনে নিলো।একজন খারাপ মানুষের পক্ষে আদৌও সম্ভব?
–রিহান:মাথা নুয়ে খাবার নাড়াচাড়া করে বলে তবে কি তুমি আমায় অবিশ্বাস করছো আব্বু?
–আব্বু :করা যেতেই পারে।কারণ আমি নিরুপমা কে ও বিশ্বাস করি।তুমি জানো সে আমাদের পরিবারে ও কতোটা আদরের।তোমার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে,,আমি কিভাবে ওদের সামনে পড়বো?

–রিহান এবার রেগে উঠে দাঁড়ায়।তারপর চেয়ার ছেড়ে দূরে গিয়ে বলে,, তাহলে আমিই বরং বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।তোমরা সবাই মিলে ঐ মেয়ে কে নিয়ে থাকো।
–আম্মু :বেশি করছো রিহান।তাছাড়া তুমি অনেক কিছুই জানো না।
–রিহান:এতো জানতে পারবো না।একজন খারাপ মেয়ে কে সাপোর্ট করছো আ…এরপর আর কিছু বলতে পারে নি।ঠাস করে এক থাপ্পড় দিয়ে দেয় ওর আব্বু।
–আব্বু :বেয়াদব!তুমি বললেই কেন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?তোমার কি মনে হয় আমি বোকা?একজন মেয়ে একজন ছেলের সাথে জবরদস্তি করতে পারে?এটা শুনতে ও কিন্তু হাস্যকর।যদি এমন সস্তা ক্লো দিয়ে মাথা খারাপ করতে চাও তাহলে বলবো আমি অতোটাও বোকা আর সহজ নই।তোমার আর নিরুপমার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো আমরা জানি।
–রিহান:যা জানার গিয়ে জানো।আমি আর এই বাড়িতেই থাকবো না।তোমরা বরং ঐ নিরুকেই ছেলে বানিয়ে নাও।
–আব্বু :থাকা লাগবে না।আমি এমনিতেই তোমার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।এক সপ্তাহের মধ্যে তোমাকে আমি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবো।যেদিন একজন ভালো মন মানসিকতার মানুষ হতে পারবে সেদিনই দেশে আসবে এর আগে নয়।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে