অনির পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
13

অনির
শেষ পর্ব

ঘরে ঢুকে আমি চমকে গেলাম। সকাল থেকে যে পরিস্থিতি ছিল তাতে আমার ঘর কেউ সাজাবে এটা আমি একেবারেই আশা করিনি। শুধু যে সাজানো তাই নয় অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়েছে। নিশ্চয়ই হাসিবের কাজ, এজন্যই তাহলে অনুষ্ঠানে আসতে দেরি হয়েছে অথচ দেরি হয়েছে বলে ওকে কত কথাই না শোনালাম। একবার কথা প্রসঙ্গে ওকে বলেছিলাম বেলি ফুল অনিমার খুব প্রিয়। পুরোটা ঘরে বেলি ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। ভালো লাগল দেখে।

তাকিয়ে দেখি অনিমা খাটের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। টুকটুকে বউ বলতে যা বোঝায় ওকে মোটেও সেরকম লাগছে নাঃ যদিও ওর পরনে লাল টুকটুকে বেনারসি গা ভর্তি গয়না, মাথায় জড়ির ওড়না। দেখে মনে হচ্ছে ওর ভীষণ রকম অস্বস্তি হচ্ছে। ডিসেম্বরের শীতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। যে ওকে এখানে বসিয়ে গেছে সে ফ্যানটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে যায়নি। আমার অসম্ভব বিরক্ত লাগলো। চারিদিকে তাকিয়ে ওর কোন ব্যাগ দেখতে পেলাম না। আমি নাজমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম
ওর ব্যাগ কোথায়, চেঞ্জ করবে কি দিয়ে?
ব্যাগ নিচে, সবাই খুলে দেখছে ভাবি কি কি নিয়ে এসেছে
আমি বলার মতন কিছু খুঁজে পেলাম না, বাধ্য হয়ে আলমারি খুলে ওর জন্য কেনা শাড়িটা বের করে নাজমা কে দিয়ে বললাম ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। ওরা বেরিয়ে গেলে আমিও গোসল করতে চলে গেলাম। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। যদিও আমাদের আমাদের দিক থেকে কোন আয়োজন ছিল না শুধু অনুষ্ঠানটাতে যাওয়া তবুও এত রকম ঝামেলা গেছে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়॥

প্রত্যেক অনুষ্ঠানেই বোধহয় এমন একজন মানুষ থাকে, যার মান ভাঙাতে ভাঙাতেই পুরো অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না॥ বড় ফুফুকে কেন আগে থেকে সবকিছু জানানো হয়নি তাই তিনি বেকে বসেছিলেন অনুষ্ঠানে থাকবেন না। এ কথা শুনে মা এবং রেহানা ফুপু খুব খুশি হলেও বাবার মাথায় হাত পড়েছে; তার মাতৃতুল্য বড় বোন অনুষ্ঠানে না থাকলে ছেলের বিয়ে কেমন করে হবে। বারবার ফোন করার পরও তিনি আসতে রাজি হচ্ছিলেন না অবশেষে বাবার ওখানে গিয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হয়েছে।

বাড়িতে ঢোকো মাত্রই বড় ফুপু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। অতিথিরা কে কোথায় থাকবে, কোথায় ঘুমাবে, কাদের জন্য কি রান্না হবে সেই সব কিছু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে কামাল ভাই তাঁর বউ তিন বাচ্চা নিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয় কামাল ভাইয়ের শাশুড়ি, তার দুই মেয়ে এবং দুজন কাজের লোকও এসেছে। বড় ফুপুর ভাষ্যমতে বিয়ের বাড়ি অনেক কাজকর্ম থাকবে ওরা সঙ্গে থাকলে উপকার হবে।যদিও তারা দুজন আসা মাত্রই মেহেদি লাগাতে বসে গেছে। কাজ যা করার তা ছোট ফুপু আর মা-ই করছে আর সঙ্গে আমাদের পুরনো কাজের মহিলা। বাড়ি ভর্তি লোকজন বেশিরভাগই এসেছে ঢাকার বাইরে থেকে আজ তারা এখানেই থাকবে। চাচাতো মামাতো ফুফাতো ভাই বোনদের মধ্যেই আমি সবার বড়। ভাই বোনেরা আনন্দে মেতে আছে সবাই কিন্তু দায়িত্ব নেবার মতন কেউ নেই।

বড় ফুফু আসায় একটু সুবিধা হবার কথা ছিল কিন্তু সেটা না হয়ে বরং উল্টোটা হচ্ছে, উনি সঙ্গে করে তার বেয়াইনকে নিয়ে এসেছেন তার আবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, কিছুক্ষণ পর পর খাবার দিতে হচ্ছে। বড় ফুপু রান্নাঘরে গিয়ে নানান রকমের খাবার তৈরি করার নির্দেশ দিচ্ছেন। যেগুলো ইতোমধ্যে রান্না হয়েছে সেগুলো কি করলে আরো ভালো হতে পারত তাই নিয়ে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। মা আগে থেকেই যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে আছে এসব দেখে সেটা চরম মাত্রায় পৌঁছালো।

আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি অন্যমনস্ক হয়ে থাকার। আজ আমার বিয়ে আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন আমার জীবনের চিরকালের জন্য আসবেই এই বোধটা মনের ভেতর আনার আপ্রান চেষ্টা করছি, কিছুতেই পারছি না। নানান রকমের দুশ্চিন্তা আমাকে পেয়ে বসছে॥ এরকম একটা পরিবেশে অনিমা কিকরে মানিয়ে নেবে এই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। আমি অন্যমনস্ক হয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম হঠাৎ করেই কেউ একজন পেছন থেকে খোঁচা দিয়ে বললো
ঘর সাজানোর কি ঠিক করলি?
পিছন ফিরে দেখলাম হাসিব। হাসিব আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। আমরা দু বছর একসঙ্গে একই কলেজে পড়েছি। এইচ এসসির পর হাসিব ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে আর আমি চিটাগং চলে গেছি। ও এখানেই শহীদুল্লাহ হলে থাকে। গতবার এসে ওর হলেই উঠেছিলাম। আমার আর অনিমার ব্যপারটা ও শুরু থেকেই সব জানে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল
কিরে লজ্জা পাইতেছিস নাকি?
আমি ম্লান হাসলাম, বললাম
আর ঘর সাজানো
ও ফিচেল হাসি হেসে বলল
তোদের না প্রেমের বিয়ে। তোদের আর ঘর সাজানোর কি দরকার? জঙ্গলে রাইখা আসলেও তোরা..
এই মুহূর্তে এইসব রসিকতা শোনার মতন মনের অবস্থা নেই। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
চুপ কর! কি সব ফালতু কথা বলছিস
তোরে দিয়া হবে না। আমি নাজমার সাথে কথা বলতেছি
যা ইচ্ছা কর। আমার কিছু ভালো লাগছেনা
কেন, কি হইছে?
আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে
ফার্স্ট নাইট নিয়ে সবারই টেনশন থাকে। ভেরী ন্যাচারাল। কোন সাজেশন লাগলে বল
ধুর! তোর সঙ্গে কথা বলাই বেকার
আমি বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে এলাম। বাড়ির ভেতর কেমন দম বন্ধ লাগছে। রাস্তায় কিছুক্ষণ এলোমেলো হাঁটলাম। কেবল আড়াইটা বাজে। আমাদের রওনা দেবার কথা সাড়ে সাতটায় এখনো অনেক সময় বাকি আছে। আচ্ছা, অনিমা কি করছে এখন, পার্লারে গেছে কি? একবার ওকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। ওর জন্য কোন উপহার কেনা হয়নি। চট করে একটা কিছু কিনে ফেললে কেমন হয়? কি কিনব বুঝতে পারছি না। টাকাও নেই বিশেষ। ওর জন্য অনেক কিছু কিনতে ইচ্ছা করছে। একটা সময় হয়তো আমার কাছে অনেক টাকা থাকবে, আমি চাইলেই ওকে অনেক কিছু দিতে পারব কিন্তু আজকের দিনটা তো আর ফিরে আসবেনা।

কথাটা মনে হতেই হঠাৎ ভীষণ হাসি পেল। এই ধরনের প্রতিজ্ঞা মনে হয় পৃথিবীর সব ছেলেরাই করে এবং একটা সময় যখন তাদের সামর্থ্য হয় তখন আর আলাদা করে এই কথাটা মনে থাকে না। এই কথাটা আমি বলছি অভিজ্ঞতা থেকে। আমার মনে আছে অষ্টাশির বন্যার সময় আমি খুব ছোট, স্কুলে পড়ি সে সময়ে বাবার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তখন আমাদের এই বাড়িটা ছিল না। আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। অবস্থা এমন ছিল যে বাড়ি ভাড়া দিতে পারতাম না। বাবার অনুরোধে মা তাঁর সমস্ত গহনা বিক্রি করে বাবাকে ব্যবসার জন্য দিয়েছিল। আজও মনে আছে বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিল যখন টাকা হবে মাকে আবার সেই সব গয়না গড়িয়ে দেবে। একসময় বাবার হাতে টাকা এসেছে, আমাদের নতুন বাড়ি করা হয়েছে কিন্তু আলাদা করে বাবা কখনোই মাকে আর সেই গয়নাগুলি গড়িয়ে দেয়নি। মা সংসারে টাকা বাচিয়ে আবার গয়না গড়িয়েছে কিন্তু বাবা তার কথা রাখেনি, কিংবা সেটা প্রয়োজনীয় বোধ করেনি অথবা মনেই রাখিনি।

আমার কেমন মন খারাপ লাগছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটে চলে গেলাম। কি কেনা যায় ওর জন্য বুঝতে পারছি না। ভালো কোন বই দেয়া যায়। এটা বোধহয় ঠিক হবে না। বিশেষ একটা কোন উপহার দিতে ইচ্ছা করছে। আমাদের দিক থেকে ওকে কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি একটা আংটি পর্যন্ত না। রানু ফুপু উপহার হিসেবে একজোড়া আংটি কিনেছে। বিয়ে পড়ানোর পর সেটা পরানো হবে আমাদেরকে। ব্যস অতটুকুই, আর কিছুই না। আমার কিছুই মন মতো হচ্ছে না। ওকে অসম্ভব অসম্ভব সুন্দর কিছু উপহার দিতে ইচ্ছা করছে অথচ আমার সামর্থ্য এত কম। নিজের অক্ষমতায় নিজের উপরই রাগ হলো ভীষণ।

বইয়ের মার্কেটে কতক্ষণ এলোমেলো ঘুরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এদিকটায় কয়েকটা বেকারি তারপর গহনার দোকান। চট করি একটা জিনিস খুব চোখে লেগে গেল। মনে হল এটা বোধহয় ওর জন্যই তৈরি। সে সময় রুপার দাম খুব কম ছিল মাত্র সাড়ে ৭০০ টাকা ভরি। একজোড়া নূপুর নিলাম। এক জোড়া বালা খুব পছন্দ হয়েছিল। বেশ পুরনো আমলের ডিজাইন কিন্তু টাকা না থাকাই নিতে পারলাম না।

বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যা পার করে। ভেবেছিলাম বাড়ির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হবে। ফিরে দেখলাম অবস্থা আগের চেয়ে আরো খারাপ। বড় ফুপু আর মায়ের মধ্যে বোধহয় এক প্রস্থ ঝামেলা হয়ে গেছে। দুজনের মুখই থমথমে। আমি পাত্তা না দিয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। অনিমাদের ওখান থেকে আমার জন্য পোশাক পাঠানোর কথা ছিল। আমি রাজি হইনি। মা আমাকে সঙ্গে দিয়ে শেরওয়ানি কিনতে যেতে চেয়েছিল সেটাও আমার ইচ্ছে করেনি। ছোট মামা একটু জোরাজুরি করার চেষ্টা করেছিল লাভ হয়নি। এর প কেউ আর মাকে বিশেষ একটা ঘাটায়নি। সবাই জানে আমি সবার কথাই শুনি তবে শেষমেষ যেটা আমার ইচ্ছে করে সেটাই করি।

আমি সাধারণ একটা পাঞ্জাবি পরেই অনুষ্ঠানে গেলাম। অনুষ্ঠান সাদামাটা ভাবে হলেও আয়োজন যথেষ্টই ভালো ছিল। ওদের পক্ষ থেকে আমি তেমন কোনো জাঁকজমক দেখতে পেলাম না। সবারই পরনে সাধারণ পোশাক। তাদের পক্ষ থেকে খুব বেশি লোকজনও আসেনি। নিকট আত্মীয় ছাড়া কাউকেই যেমন দেখতে পেলাম না। বাবা বিয়েতে কোন কিছু দিতে না পারলেও ১০০ জন লোক খাওয়াতে হবে এই কথাটা তাদেরকে জানাতেই মোটেও কুন্ঠা বোধ করেননি।

আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। ঢাকায় যেহেতু ওদের কেউ নেই অনুষ্ঠানের পর সমস্ত খাবার আমাদেরকে সঙ্গে করে দিয়ে দেয়া হলো। সেই সব খাবার নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা হুলুস্থুল বেধে গেল। মা বাবা আর বড় ফুপু সবাই তখনই খাবার প্যাকেট করে প্রতিবেশী এবং যে আত্মীয়দের নিমন্ত্রন করতে পারিনি তাদের পৌছে দেবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল। যাকে উপলক্ষ করে এত কিছু তার কথা বোধহয় কারো মনেই রইল না। সহায্য করার মত তেমন কেউ নেই তাই আমাকেও কাজে লাগে হাত লাগাতে হলো। অনিমাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না। বোধহয় ওকে আমার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।

আমি ঘরে যেতে পারলাম রাত বারোটারও পরে। এতক্ষণ পর্যন্ত বেচারী ওই ভাবেই বসেছিল। আমি ওকে নাজমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে গোসলে ঢুকলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করলাম। ঘরে পা রাখতেই চমকে গেলাম। লাল বেনারসি শাড়িতে যাকে টুকটুকে বউ মনে হয়নি আমার কেনা সাধারণ সুতি শাড়িতেই তাকে রাঙা বউ লাগছে। অনিমা খাটের উপর বসে ভেজা চুল ছড়িয়ে। বোধহয় শুকানোর চেষ্টা করছে। ওর যে এত সুন্দর আর লম্বা চুল আগে কখনো লক্ষ্য করিনি তো। আমি এগিয়ে এসো ওর পাশে বসলাম। বললাম
দাও আমি করে দিচ্ছি
ওর চুলগুলোতে হাত দিতেই মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এলো। কেমন বুনো ফুলের মতন একটা গন্ধ। এই গন্ধতেই পেয়েছিলাম যেদিন প্রথম ওকে দেখেছিলাম। আমি ওর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিলাম। এই গন্ধটা আমি আমার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই। গন্ধতো কৌটায় কিংবা বাক্সে করে নিয়ে যাওয়া যায় না, আমি বোধহয় আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। ও আচমকাই আমার দিকে ফিরে ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল। কমেক মুহূর্ত মাত্র। আমি বিস্ময়াবিভূত হয়ে কিছু বুঝে উঠবার আগেই ও মুখ নামিয়ে আমার বুকের মধ্যে মুখ গুজে বলল
থ্যাঙ্ক ইউ মুনির
কি জন্য?
এই যে আমার জন্য এত ঝামেলা করলে, এত কষ্ট করলে
তোমার জন্য করিনি
ও মুখ তুলে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। ওর আয়তাকার বিশাল চোখ গুলো কেমন ছলছল করছে। ও অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল
আমার জন্য না?
আমি দুই হাতের করতলে ওর মুখটা তুলে ধরে বললাম না তোমার জন্য না। যা করেছি সব নিজের জন্য। এই যে দুই হাতে তোমার মুখটা ধরে আছি, এই জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে আমি হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মরে যেতাম।

এক মুহূর্তে সব কেমন বদলে গেল। যে আমি ঠিক করেছিলাম আজ রাতে ওকে একটুও বিরক্ত করবো না, শুধু আমার মনের মধ্যে জমে থাকা সব কথা বলে ওকে বলবো, কিছুতেই নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারলাম না। ও এমন ভাবে আমার কাছে এলো, মনেই হলো না যে আমরা এই প্রথমবার গভীর সান্নিধ্যে এলাম। মনে হল যেন যুগ যুগ ধরে আমরা এভাবেই একে অন্যের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে ছিলাম।

রাত্রির শেষ প্রহরে যখন ও আমার বুকের সঙ্গে মিশে ছিল, আমি আস্তে আস্তে বললাম
সামনে আমাদের খুব খারাপ সময় আসবে অনিমা। আমাদের অনেক ধৈর্য রাখতে হবে। আমি জানি, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি কিন্তু বিশ্বাস করো আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব যেন তোমার কোন কষ্ট না হয়। যে কয়দিন আমারা একসঙ্গে…। ও আমার কথা শেষ হতে দিল না আমার বুকের মধ্যে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল

এখন এসব কঠিন কঠিন কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না
তাহলে কি শুনতে ইচ্ছা করছে?
অন্য কিছু বল
অন্য কি?
সুন্দর, মন ভালো করা কিছু
একটা কবিতা শুনবে?
হু
আচ্ছা শোন

একে একে বানিয়ে তুলব সব, তুমি দেখে নিয়ো।
বাড়িঘর, খেতখামার,
উঠোনে লাউয়ের মাচা, জানলার পাশে
লতানে জুঁইয়ের ঝাড় –
একে একে সমস্ত বানাবো, তুমি
দেখে নিয়ো

দক্ষিণে পুকুর থাকলে ভাল হয়, তুমি বলেছিলে।
অবশ্য থাকবে।
পুকুরে হাঁসের স্নান দেখতে চাও, সে আর এমন
কী বেশী কথা,
সাদা ও বাদামী হাঁস ছেড়ে দেব।

যা চাও সমস্ত হবে,
একই সঙ্গে হয়ত হবে না, কিন্তু
একে-একে হবে।
ভালবাসা থাকলে সব হয়।

দেখো, সব হবে।
যা-কিছু বানানো যায়, আমি সব
দুই হাতে
দিনে-দিনে বানিয়ে তুলব, তুমি দেখে নিয়ো।

কবিতার নাম “তুমি দেখে নিয়ো” লিখেছেন
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে