ষষ্ঠ পর্ব
যে কদিন আছি প্রতিদিন ওর সঙ্গে দেখা করব ঠিক করলেও সেটা হয়ে উঠলো না। বাড়ি ফিরে দেখলাম তুলকালাম কান্ড। সকালবেলা বড় ফুফু এসেছে। নাজমার কাছে শুনলাম দুপুর নাগাদ নাকি মায়ের সঙ্গে তার তুলকালাম ঝগড়া বেধেছে, তারই সূত্রই ধরে মা ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে নানা বাড়ি চলে গেছে।
সদর দরজার কাছেই বড় ফুপু বোরকা পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা ফিরেছেন কেবলই, উচ্চ স্বরে বাকবিতণ্ডা চলছে। নাজমা দাড়িয়ে আছে কাছেই, যদিও কিছু বলছে না। বাবা বারবার বড় ফুফুকে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন কিন্তু উনি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন এত বড় অপমানের পর আর কিছুতেই এ বাড়িতে থাকবেন না, কিছুতেই না। আমি নাজমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও মিটিমিটি হাসছে। এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা বোঝা গেল। দুপুর বেলা মা বেরিয়েছে, দুপুর থেকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই অপমানবোধ জেগে ওঠেনি ঠিক বাবা আসার আগ মুহূর্তে একেবারে শিরস্ত্রাণ পরে রনমঞ্চে অবতীর্ণ হওয়াটা যে পূর্বপরিকল্পিত তাদের সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
এই ধরনের পারিবারিক কূতনৈতিক মঞ্চ নাটক বরাবরই ভীষণ রকম অসহ্য লাগে তাই আমি পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। তবে সেদিন বুঝতে পারিনি যে অনতিবিলম্বে আমাকেই হতে হবে এই ধরনের মঞ্চ নাটকের প্রধান কুশীলব।
ঘন্টাখানেক পর নাজমা আমার ঘরে এসে বিস্তারিত ঘটনা জানালো। মায়ের সঙ্গে বরাবরই বড় ফুফুর বনিবনা হয় না। যেহেতু উনি বাবার চেয়ে বছর দশকের বড়, মায়ের প্রতি তার আচার আচরণ অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপূর্ণ। মা সেটা কখনোই মেনে নিতে পারেন না॥ নাজমা জানালো এবারও তাই হয়েছে, তরকারিতে আলুর সাইজ ছোট না বড় এই নিয়ে শুরু হয়েছিল তারপর কথা গড়াতে গড়াতে অনেক দূর চলে গেছে।
বড় ফুফু বিধবা । যশোরে উনি আমাদের দাদা বাড়িতেই থাকেন ছেলে পুত্রবধূ এবং নাতি নাতনিদের নিয়ে। আমরা কালে ভদ্রে সেখানে যাই। ছোট চাচা রাজশাহীতে থাকে, উনি যান না বললেই চলে। আর হালিমা ফুফু মানে আমার ছোট ফুফুর সঙ্গে তো তার মুখ দেখা দেখিই বন্ধ। যেহেতু দাদা বাড়িতে থাকেন তাই হিসেব মত প্রতি বছর আমারা সব চাচা ফুফুরা সেখানে যাব, আনন্দ হবে হইহুল্লোড় হবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না উনার কারণেই। গ্রামের বাড়ি থেকে যেটুকু আয় হয় তার পুরোটাই উনি ছেলে নিয়ে ভোগ করেন। এ নিয়ে ভাই-বোনদের কোন অভিযোগ নেই কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ভাই-বোনদের বাড়িতে চলে যান। সেখানে যাবার পরেও তাঁর আবদার অভিযোগের শেষ থেকে না। বাড়ীর অবস্থা ভালো নয়, দেয়াল ধ্বসে পড়েছে, মেরামতের জন্য টাকা দরকার, সবকিছু উনাকেই দেখতে হয, বাকিরা কেউ ফিরেও তাকায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকিরা রীতিমতো অতিষ্ঠ, তাই অত্যাচারটা এই বাড়িতেই বেশি হয়।
মাকে অসংখ্যবার ফোন করে ফিরে আসছে অনুরোধ করা হলো কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যতদিন বড় ফুপু আছেন তিনি ফিরে আসবেন না। বাবাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।একদিকে মাতৃতুল্য বড় বোন অন্যদিকে স্ত্রী। অন্য কোন লোক হলে হয়তো এতটা বিচলিত হতেন না কিন্তু আমার বাবা মায়ের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। আমি ছোটবেলা থেকেই বাবাকে দেখেছি শুধু মায়ের হাতে টাকা দিয়েই তার সব দায়িত্ব শেষ। বাকি সব কিছু মাকেই করতে হতো।
আমার নানা বাড়ি কুমিল্লায়। নানা ভাই এখনো বেঁচে আছেন এছাড়াও দুই মামা আছেন তাই মায়ের দাপটই অন্যরকম। রাতের বেলা মা বাড়ি ফিরলেন না। পরদিন সকালের নাস্তার পর আমি আর নাজমা আমার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলাম সেই সময়েই বাবা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলবেন
– তোর মা তো আসতে চাচ্ছে না, কি করি বলতো
নাজমাট ফট করে বলল
– না আসলে নাই, থাকুক কিছুদিন
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। নাজমা বরাবরই মায়ের খুব ন্যাওটা, ওর কাছ থেকে এরকম একটা কথা আমি আশা করিনি। বাবাকে খুব একটা আশ্বস্ত মনে হল না কোনমতে বললেন
– তোর বড় ফুফু সবটা সামলে নেবে বলছিস
– নেবে না কেন, অবশ্যই নেবে। কদিন পর দেখবে কামাল ভাই চলে এসেছে বউ বাচ্চা নিয়ে, তারপর থেকে এখানেই থাকা শুরু করবে। ভাইয়া তো চলেই যাবে আমাকেও মনে হয় হোস্টেলে উঠে যেতে হবে। দেখি আজ কলেজে গেলে হলের সিটের জন্য এপ্লাই করে দেব
বাবা একটুখানি খড়কুটো ধরার আশায় এখানে এসেছিলেন নাজমার কথা শুনে কেমন মুষড়ে পড়লেন। আমতা আমতা করে বললেন
– তাহলে কি করতে বলিস
– বড় ফুপুকে বিদায় করো তাহলেই মা চলে আসবে
– এভাবে মুখের উপর একজনকে কি করে চলে যেতে বলি, বল
– তুমি না পারলে আমাকে বলো আমি বলি
– না না তোর কিছু বলার দরকার নেই, আবার কি থেকে কি ঝামেলা বাঁধে
– তোমার যা ইচ্ছা কর তবে আমার কথা শুনলে এক ঘন্টার মধ্যে বিদায় করতে পারবে
নাজমার বৈষয়িক বুদ্ধি অসাধারণ এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই তাই বলে এতটা আত্মবিশ্বাস ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়
আমি ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম॥ এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম দেড় ঘন্টার মধ্যে বড় ফুফু সত্যি সত্যি ব্যাগ বস্তা গুছিয়ে রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত।
নাজমা কি এমন বুদ্ধি দিয়েছে সেই কথা ওর কাছ থেকে বার করতে আমাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হলো। অবশেষে মেপাল ওয়ালনাট আইসক্রিম খাওয়াবো এই প্রতিশ্রুতি দেবার পর ও জানালো যে, বিশেষ কিছুই করতে হয়নি শুধু বাবাকে বলতে হয়েছে, মা নেই তাই কিছুক্ষণ পর হালিমা ফুপু আমাদের বাড়িতে আসছেন। যতদিন মা না আসছে ততদিন থাকবেন। হালিমা ফুফুকে উনি যমের মতন ভয় পায়। এর কারণটা অবশ্য আমি জানি। আমার দাদা বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি বড় ফুফু ভোগ করছেন॥ দুই ভাই মানে আমার বাবা আর ছোট চাচা তাদের অংশ বিক্রি করে অনেক আগেই নিয়ে গেছেন। ওই টাকা দিয়েই আমাদের এই বাড়ি বানানো হয়েছে বছর দশেক আগে। এখন বসতবাড়ি আর যেটুকু সম্পত্তি আছে তা দুই বোনের। কিন্তু বড় পুকুর তার থেকে কানাকড়ি ও ছাড়তে রাজি নন॥ হালিমা ফুফুর সাথে এই নিয়ে অনেকদিন ধরেই ঝামেলা চলছে। বড় ফুফু পারতপক্ষে তার সামনে পড়তে চান না। এরকম একটা কূটনৈতিক চাল নাজমার মাথায় কি করে এলো তাই ভেবে আমি চমৎকৃত হলাম।
যাইহোক বড় ফুফু চলে যাবার খবর মাকে জানানোর পরেও মা আসতে রাজি হলেন না। মাঝখান থেকে আমার আরো একটা দিন নষ্ট হল। বাবা অফিস কামাই করতে পারবেন না তাই পরদিন আমি আর নাজমা সকালবেলা মাকে আনতে গেলাম। আমি কয়েকবার অনিমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বেচারি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে বসে ছিল। আমি আসবো না সেটাও জানাতে পারিনি ওকে।
মাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল অনেকদিন পর নানা বাড়ি গেছি তাই না খাইয়ে আমাদের কেউ ছাড়লো না॥
পরদিন সকালে আমি আর কোন ঝুঁকি নিলাম না। সকাল সকালই ওর হলের কাছে গিয়ে বসে রইলাম। প্রথম দিনের মতো আজ ভাগ্য সহায় হলো না। নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কল দেবার পরও ওকে পেলাম না। আরো দু বার কল দেবার পর জানা গেল, ও রুমে নেই॥ আমি হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আজ আবহাওয়া খারাপ, ভ্যাপসা গরম। এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমি ওর ডিপার্টমেন্টে চলে গেলাম। সেখানেও ওকে পাওয়া গেল না। ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি লাইব্রেরীতে যদি পাওয়া যায়। আরো ঘন্টাখানেক চেষ্টা করেও ওকে না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হল কেউ আমাকে পেছন থেকে ডাকছে।
পেছন ফিরে দেখলাম ও দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাধে বিশাল ব্যাগ, মাথার চুল এলোমেলো। আমার কাছে এসে হাঁপাতে হাপাতে বলল
– আরেকটু হলে তোমাকে মিস করে ফেলতাম। সব ঠিক আছে তো ? ওর উৎকণ্ঠা দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম
– তোমার এই অবস্থা কেন?
– কালকে একটা পরীক্ষা আছে। এই দুইদিন কিছু পড়া হয়নি
– কেন?
ও এই প্রশ্নের কোন জবাব দিল না, মাথা নিচু করে ফেলল। আমি বললাম
– রিক্সা নেই? তোমার ব্যাগটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে
– আচ্ছা, তোমার তাড়া নেই তো?
– একেবারেই না
– তাহলে একটু হলে যাই? ব্যাটটা রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে নেই
হলের গেটে পৌঁছে আমি রিকশা ছেড়ে দিলাম। ও বলল
– একদম সময় নেব না
– সময় নাও, কেন সমস্যা নেই
আজ ও এলো একটু দেরি করে । পোশাক পাল্টে এসেছে, ভেজা চুলে চিকন আভা। বোঝা গেল, স্নান সেড়ে এসেছে। কাছে এসে বলল
– দুপুরে খাওয়া হয়নি তো তাই না
– না ভেবেছিলাম একসঙ্গে নাস্তা খাব, এখন মনে হচ্ছে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে
আমরা দুজনেরই হেসে ফেললাম। রিক্সা নিয়ে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। আহামরি কিছু না। সাধারণ মানের রেস্তোরা, দুজন দুটো সেট মেনু খেলাম সময় নিয়ে। সে সময় এই বয়সী ছেলেমেয়েদের সময় কাটানোর মতন জায়গা খুব একটা বেশি ছিল না ঢাকা শহরে। কিছুক্ষণ আমরা রিক্সা করে ঘুরলাম তারপর আবার টিএসসি চলে এলাম। গল্প হলো অনেক। সন্ধ্যে নামার আগে আমি বললাম
– আমি কাল ফিরে যাচ্ছি
ও বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল, বলল
– তার মানে আর দেখা হবে না
– দেখা হবে না কেন? আমি তো সেপ্টেম্বরেই আসছি
– তুমি সত্যি সেপ্টেম্বরে আসবে
– কেন তোমার বিশ্বাস হয়না
– তোমার পরীক্ষারা আর দুই মাস থাকবে, তাই জানতে চাইলাম
– পরীক্ষা যেন ভালো হয় সেজন্যই তো আসবো। বল কি চাও তুমি তোমার জন্মদিনের উপহার
– তুমি আসবে সেটাই তো বড় উপহার, আর কি চাইব
– আমি কিছু চাই, দেবে?
– বলো কি চাও
– সেদিন শাড়ি পড়ে এসো। তোমাকে শাড়িতে কেমন লাগে দেখতে ইচ্ছা করছে
শেষ বিকেলের আলোয় আমি দেখলাম লজ্জায় ওর গাল লাল হয়ে গেছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো একবার ছুঁয়ে দিতে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
– আসবে তো
– আসবো
সন্ধ্যে নামার পর আমরা হাটতে হাটতে ওর হলের দিকে চলে গেলাম। ও বলল একটু দাঁড়াও তোমাকে কিছু দেবার আছে। ও ফিরে এসে আমার হাতে একটা ব্যগ তুলে দিয়ে বলল
– এগুলো তোমার জন্য
আমি বাড়ি ফিরে ওর উপহার দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। একটা কারুকার্য করা কাঠের বাক্স, দুটো কলম আর একটা চিঠির প্যড। এর চেয়ে ভালো উপহার আর কিছু হতেই পারত না।
পরদিন ভোরে আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়েই চট্টগ্রাম ফিরে গেলাম। ফেরার পর প্রথমেই কাঠের বাক্সটার মধ্যে ওর সব চিঠিগুলো যত্ন করে গুছিয়ে রাখলাম। আমরা দুজন যখন একসঙ্গে থাকবো, যখন আর আমাদের চিঠি লেখার প্রয়োজন পড়বে না তখন এই বাক্সে আমাদের দুজনের চিঠি গুলোই রেখে দেব। মানুষ যেমন ছবির অ্যালবাম রাখে তাদের বিশেষ মুহূর্ত ধরে রেখে স্মৃতিচারণ করবে বলে, আমরা না হয় ছবির বদলে কথা ধরে রাখলাম। অনেক অনেক বছর পর পুরনো স্মৃতি গুলো আবার ঝালিয়ে নেবার জন্য।
চলবে…….