তৃতীয় পর্ব
আমার সময় জ্ঞান সবসময়ই বেশ প্রখর। চারটা বাজার দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম। তখনো দুজনের কেউই এসে পৌঁছায়নি। লেকের পাশের এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। একটা বাঁধানো চত্বর, আশেপাশে কিছু ছোটখাট দোকান। আমার ডানদিকে একজন বসেছে ফুল নিয়ে অন্যদিকে একজন বিশাল আকৃতির ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করছে। এখনকার মতন এত রেস্টুরেন্ট তখন ছিল না। ঝকঝকে বিকেল হলেও রাতের নানান ঘটনার কারণেই বোধহয় পার্কে খুব বেশি কপোত কপোতি দেখা গেল না।
আমার সময় কাটছিল না, বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। প্রথমবার দেখা করতে এসেছি বলে আমি ওর জন্য একটা বই নিয়ে এসেছিলাম, সেটাই খুলে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। খুব আহামরি কোন বই না হুমায়ূন আহমেদের “তোমাকে”, আমার ভীষণ প্রিয় একটা বই। পড়তে পড়তেই টের পেলাম কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব মৃদু একটা সুগন্ধ ভেসে এলো, অনেকটা বুনো ফুলের মতন। আমি মুখ তুলে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এত মায়াবী, সারল্যে ভরা মুখ আমি আগে কোনদিন দেখিনি। মেয়েটা খুব সাধারণ পোশাক পরে এসেছে, সাদার উপর হলুদ ফুল তোলা জামা, শীত বলেই বোধহয় একটা বাসন্তী রঙের শাল জড়িয়েছে। ওকে দেখে আমার মনে হল একগুচ্ছ সোনালু ফুল। আমাকে অবাক করে দিয়েও ও হাসিমুখে বলল
– নাসিম ?
আমি বিব্রত মুখে বললাম
– আমি নাসিম নই, নাসিম এক্ষুনি চলে আসবে
– তাহলে তুমি কে?
আমি নাসিমের বন্ধু। আমার নাম মুনির। তুমি নিশ্চয়ই অনিমা। তোমার কথা অনেক শুনেছি নাসিমের কাছে
মেয়েটা কেমন অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। ৪ টা ২০ বাজে। নাসিমটা যে কেন এখনো আসছে না। বললাম
– তুমি বসো। চা খাবে?
আমি পাশের চা ওয়ালাকে ডেকে বললাম
– ভাই বেশি করে লেবু দিয়ে একটা রং চা দেন তো
অনিমা কাপ হাতে নিয়ে বসতে যাবে তখন আমি বললাম
– অনিমা একটু দাড়াও, এখানে বাদামের খোসা পড়ে আছে, তোমার না বাদামে এলার্জি। আমি হাত দিয়ে ঝেড়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলাম। ও বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল
– এই খেলাটা তুমি আর কতক্ষণ খেলবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম
– কিসের খেলা?
– তুমি নাসিম না এটা প্রমান করার খেলা
আমার নিজের উপরই বিরক্ত লাগছে। কেন যে এসব বলতে গেলাম। এলার্জির ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস বলেই বলেছিলাম, তা না হলে কোনদিনও বলতাম না। আমি পরাজিত ভঙ্গিতে বললাম
– অনিমা, আমি সত্যিই নাসিম না। আমি আর নাসিম একই রুমে থাকি। ও তোমার ব্যাপারে অনেক গল্প করে সেই থেকেই তোমার ব্যাপারে আমার একটু ধারণা জন্মেছে
– ধারণা?
একথা বলে ও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আর কিছু বলবো না বলে ঠিক করলাম। যত কথা বলছি ততই জড়িয়ে যাচ্ছি। নাসিমের বাচ্চাটা যে কেন এখনো আসছে না।
অনিমা কিছু বলল না, চুপচাপ চা খেতে লাগল।
একবার ভাবলাম বইটা ওকে দেই, পরমুহূর্তেই মনে হলো, না থাক, এই বইটা নিয়ে চিঠিতে একবার ওর সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছিল, আবার কি থেকে কি বুঝে ফেলে।
বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। আমি বারবার ঘড়ি দেখছি। সাড়ে চারটার বেশি বেজে গেছে এখনো নাসিমের আসার কোন নাম নেই। অনেকক্ষণ পর অনিমা হঠাৎ করে বলল
– আকাশে কি সুন্দর মেঘ দেখেছো
আমি আনমনা হয়ে বললাম হু
– তুমি একবার আমাকে ক্লাউড হান্টিং এর কথা লিখেছিলে মনে আছে? আচ্ছা তুমি কি এখনও ওই পুকুরটার মধ্যে আমাকে দেখতে পাও?
আমি জবাব দিলাম না। অনিমা মন খারাপ করা গলায় বলল
– ঐ পুকুরে আমাকে যেমন দেখতে, আমি কি তেমন না? তার থেকে খারাপ?
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম, ও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম
– অনিমা, আমি নাসিম না
মুহূর্তে ওর চোখ ছল ছল করে উঠলো। ও ভেজা কন্ঠে বলল
– আমাকে কি তোমার এত খারাপ লেগেছে যে তুমি নাসিম এটা স্বীকার করতেও তোমার ইচ্ছা করছে না। আমি তো তোমার কাছে কিছু চাইনি কিন্তু এই মিথ্যা নাটকের তো কোন দরকার নেই। অনিমা উঠে দাঁড়ালো
আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কারণে ওদের প্ল্যানটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার ঘড়ি দেখলাম, পাঁচটা বেজে গেছে। নাসিম এখনো আসছে না। কি যে করি। আমি ওর হাত ধরে বললাম
– আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কাঁদতে হবে না, বসো। উই ক্যন টক আবাউট ইট
অনিমা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল
– তোমার হাতে ওটা কি?
– বই। তোমার জন্য এনেছিলাম। এই বলে আমি বইটা এগিয়ে দিলাম। বইটা হাতে নিয়ে ও উল্টেপাল্টে দেখল। বলল
– তুমি এখনো বলবে তুমি নাসিম না?
আমি অসহায় কন্ঠে বললাম
– আমি আসলেই নাসিম না অনিমা
– আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে এখানে এটা লিখে দাও।
ও বইটা খুলে উৎসর্গের পাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল, সেই সঙ্গে একটা কলমও দিল
আমি লিখলাম “অনিমা অনিমা, আমি সত্যি বলছি আমি নাসিম নই”। বইটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, এবার নিশ্চয়ই ও বিশ্বাস করবে। ও অনেকক্ষণ লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর মুখের মেঘ কেটে গেছে। পুরো মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে। তখন বিকেলের আলোর মরে আসতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলের কমলা রঙয়ের রোদ ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। সেই কনে দেখা আলোয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি দিশেহারা বোধ করলাম।
ও আমার চোখে চোখ রেখে বলল
এখনো স্বীকার করবে না? এই এক বছর ধরে আমি তোমার হাতে লেখা দেখছি, আর আমি চিনতে পারব না।
আমার মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তার মানে ওই বদমাইশের বাচ্চা নাসিম আমার চিঠিগুলো কপি করেনি, যেমন ছিল তেমনি পাঠিয়ে দিয়েছে। আর আমার কোন পথ নেই। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
আমি চলে যাবার জন্য উদ্যত হতেই ও উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল
– চলো।
আমি মোহগ্রস্থের মতন ওর সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। ও আমার হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে পার্কের ছায়া ঘেরা পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। যতবারই ওকে বলার চেষ্টা করেছি যে আমি অন্য কেউ ও কিছুতেই বিশ্বাস করেনি এবং এখন ওকে বিশ্বাস করানোর আর কোনো উপায়ও আমার নেই।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিক সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। বড় রাস্তায় উঠে ও বলল
– চলো রিকশা নেই।
আমি যন্ত্রচালিতের মতন রিকশায় উঠলাম। রিক্সাওয়ালা কোথায় যাব জানতে চাইলে ও বলল
– কোথাও যাবো না, এমনিই চলেন।
রিকশা ধানমন্ডির অলিগলি দিয়ে ঘুরতে লাগলো। তখনকার ধানমন্ডি এখনকার মতন ছিল না, বেশ নিরিবিরি ছায়া ঘেরা একটা পরিবেশ ছিল।সন্ধ্যা নেমেছে বলে রাস্তায় রিক্সার সংখ্যা কম। হঠাৎই একটা স্পিড ব্রেকারে ধাক্কা লাগায় ও আমার হাত আঁকড়ে ধরল। আমি রিক্সাওয়ালাকে বললাম আস্তে চালাতে। রিক্সাওয়ালা গতি স্লথ করলো। অনিমা হাত সরিয়ে নিল না। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে বসে রইল।
আমরা কেউই কোন কথা বলছিলাম না। আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা সময় ও নীরবতা ভেঙে পড়ল
– আমাকে হলে নামিয়ে দিয়ে তুমি চলে যাও।
আমি রোকেয়া হলে সামনে এসে রিক্সা ছেড়ে দিলাম। জায়গাটা অন্ধকার। ওর মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, যাবার আগে ও শুধু খুব আস্তে করে একবার বললো “আসি”। একবার পেছন ফিরেও তাকালো না। ও চলে যাবার পর আমার মনে হল পুরো শহরটা যেন অক্সিজেন শূন্য হয়ে গেছে; নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ, অমুল্য কিছু হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। আমি উদ্ভ্রান্তের মতন হাটতে আরম্ভ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে এলাম। চারিদিকে অনেক আলো ঝলমলে করছে, তবু আমার মনের অন্ধকার দূর হচ্ছে না। আমি বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
ঢাকায় আমার আর মন টিকছিল না তাই পর দিন সকালের ট্রেনেই চট্টগ্রাম ফিরে গেলাম।
রুমে ঢুকে রীতিমত ধাক্কা খেলাম।
চলবে………।