#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৭ (পরিসমাপ্তি)
৩০.
এপ্রিলের তপ্ত দুপুরে আমি তখন ফ্যান না ছেড়ে গায়ে কাঁথা দিয়ে শুয়ে আছি। হালকা আওয়াজে দাদুভাই আমার ঘরে ঢুকলেন। আমি কোনোমতে চোখ খুলে তাকে দেখলাম। কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম না। আমি ঘরবন্দী দীর্ঘ এক মাস যাবত। এই এক মাসে ঘটে গেছে অনেককিছু। আমার টিমমেট বাবা হয়ে উঠলেন আচমকা আমার অজানা শত্রু। তিনি শুদ্ধর কথা তো সহ্যই করতে পারলেন না পরিবর্তে তিনি আমাকে আটকে ফেললেন এই চার দেয়ালের মাঝে। কেউ একটু টু শব্দ করার সাহস পেলো না। আমি দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে উঠলাম। ওজন কমেছে নয় কেজি। আমাকে দেখা যাচ্ছে কঙ্কালসার। কে কখন খাইয়ে দিচ্ছে, কি দিয়ে খাওয়াচ্ছে, গোসলের পর কোন কাপড় পরাচ্ছে আমি কিচ্ছু বলতে পারছি না। পাগল বনে যাচ্ছি।
দাদুভাই এসে পাশে বসলেন। গায়ের উপর থেকে কাঁথাখান সরিয়ে আমার দিকে দু’মিনিট চেয়ে রইলেন। তার চোখ থেকে দু’ফোটা পানি পরলো। আমার গায়ের জ্বর চেক করে ভাঙা আওয়াজে বললেন,
‘আমার প্রিয় দাদুভাই, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।’
আমি অবুঝ নয়নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে শুধালাম,
‘আমাকে এই জেলখানা থেকে বের করবে, দাদুভাই?’
দাদুভাইয়ের চোখ থেকে আরো দুই ফোঁটা পানি পরলো। তিনি ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘করবো, সোনা। তুমি উঠো। আজ আমি তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবো। তারপর তোমার ভালোবাসার মানুষের হাতে তুলে দেবো।’
দাদুভাই আমাকে ধরে উঠালেন। আমি তার কাধে মাথা ঠেস দিয়ে বসলাম। আমার গায়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকার মতোও তখন বিন্দুমাত্র শক্তি নেই।
‘বাবা আমাকে আর ভালোবাসে না কেনো, দাদুভাই? বাবা এমন কেনো করলো?’
‘আমার সোনা দাদুভাই, তোমার বাবা এই পৃথিবীর সবথেকে বেশি তোমাকে ভালোবাসে। তোমার এই অবস্থা তোমার বাবাকেও অসুস্থ করে তুলেছে। বাড়িটা মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। সে কাজে যায় না দীর্ঘদিন। তুমি ঘুমিয়ে থাকলে তোমার বাবা সারারাত তোমার পাশে বসে থেকে পাগলের মতো শুধু বলে যায় ‘সরি আম্মু’।’
আমার শরীর’টা কেঁপে উঠলো। অগ্নিপিণ্ডের ন্যায় জ্বলন্ত চোখ থেকে পানি ঝরলো অঝোরে। দাদুভাই আমাকে খাবার খাইয়ে দিলেন। আমি বাধ্য মেয়ের মতো খেলাম। খাওয়ার পর আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। এরপর বললেন,
‘সন্ধ্যার পর শুদ্ধ আসবে। তোমার ব্যাগপত্র আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। তুমি ওর সাথে চলে যেয়ো। কি কি নিবে বলো?’
এই মুহূর্তে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কোনো কথা বলতে পারলাম না। কেবল নির্বোধের মতো চেয়ে রইলাম। দাদুভাই নিজেই ব্যাগ গুছাতে লাগলেন। উল্টেপাল্টে কি তুললেন কে জানে!
এরপর যখন সন্ধ্যে নামলো গেটের বাইরে এসে দেখলাম শুদ্ধ দাঁড়িয়ে। দাদুভাই আমার সাথে আমার ব্যাগ এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। শুদ্ধ শুকিয়েছেন। দাড়ি বড় হয়েছে আরো অনেকটা। তার গায়ের পাঞ্জাবি এলোমেলো। উদভ্রান্ত চোখের রক্তিম দৃষ্টি। দাদুভাই আমাকে ধরে ধরে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
‘সুখী হও, দাদুভাই। বাবাকে ভুল বুঝো না। তোমার বাবাই শুদ্ধকে ডেকেছেন। তোমাকে শুদ্ধর কাছে তুলে দিচ্ছেন।’
আমার পা দুটো থমকে দাঁড়ালো। আমি পেছন ঘুরে আমার চিরচেনা বাড়িটার দিকে চাইলাম। এই বাড়িতে আমি আর কক্ষনো ফিরবো না। ও বাড়ি এখন আমার জন্য অস্বস্থিকর! দমবন্ধকর! আমি দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার ঘরের বেলকনিতে। তার চোখ ভেজা তা আমি দূর থেকে বুঝতে পারলাম। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
দাদু শুদ্ধর কাছে কাঁপা হাতে ব্যাগ’টা ধরিয়ে দিলেন। এ বাড়ির এতো আদরের মেয়েকে যে কখনো এমন ভাবে বিদায় দিতে হবে তা কে জানতো? দাদুভাই কি জানতো তার আদরের নাতনি’টা সবার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে? তার পরিবার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? তার দুটো কলিজার টুকরোর মধ্যে একজনকে সে কীভাবে বাছাই করতো তার প্রাণপ্রিয় নাতনির জন্য? কীভাবে সে এই নিকৃষ্ট গর্হিত কাজটি করতো? সেই নাতনি যখন আবার অন্য কাউকে মন দিয়ে বসেছে? এ যে ঘোর বিপত্তি! তার থেকে এই ভালো না পছন্দের মানুষের সাথে বহুদূর গিয়ে ভালো থাকুক!তবুও তো তার নাতি দুটোর চোখের সামনে থেকে আড়াল হবে। তাদের শূন্যতা পাবে কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণা পাবে না।
৩১.
ভোরের রাঙা আলোয় পূব দিকের আকাশ’টা ছেয়েছে। তরু এখন ঘুমোতে যাবে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে আড়মোড়া ভাঙলো। অদূরে মস্ত বড় সবুজ পাহাড়ের মাথায় সূর্য সিংহাসন গেড়ে বসেছে। তরুর বাবা তরুকে ডেকে উঠলেন। ভোর ভোর উঠা তার অভ্যাস। তরু বললো,
‘জি বাবা।’
‘নামাজ পড়েছো, আম্মা?’
‘হ্যাঁ বাবা।’
‘ঘুমিয়ে যাও। একটু পর অফিস আছে না?’
তরু মাথা দুলালো। ঘুমাতে গেলো না। বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হেমন্তের মাস! বাতাসে শীত শীত আরাম আবহাওয়া। তরু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। পার হয়ে গেছে চারটি হেমন্ত! তরু দূরে চেয়ে রইলো আনমনে। তারা থাকে শ্রীমঙ্গলে। তরুর চাকরি হয়েছে। চাকরির পোস্টিং সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই নিলো এই দূর্গম, অচেনা অঞ্চলে। বাবা-মা দুজনকে সাথে আনলো। বাবা লোক দেখানো অযুহাতে এলেন ‘ব্যবসার প্রসার করতে হবে।’ সিলেটে তাদের পারিবারিক ব্যবসার ছোট একটা ব্রাঞ্চ খোলা হলো। জীবনটা কেমন অন্যরকম দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌছালো! যা তরু কোনোদিন কল্পনাও করেনি। কখনো ভাবেনি শুদ্ধ’কে ছেড়ে ও বাঁচতে পারবে। তরু কি সত্যি বেঁচে আছে? হ্যাঁ, শ্বাস তো পরছে। কিন্তু তরুর মন’টা কি বেঁচে আছে?
তরু একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শূন্যে। সে সত্যি আর কখনো সে বাড়িতে ফিরেনি। ওই শহরে মা’র পিতৃ সম্পত্তি থেকে পাওয়া একটা ফ্ল্যাট ছিলো। তারা গিয়ে উঠলো সেখানে। তরু সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে এলো এই পাহাড়ে। দাদু মাসের পনেরো দিন নিজের বাড়িতে থাকতেন বাকি পনেরো দিন থাকতেন তরুর কাছে। ফ্ল্যাটে আনাগোনা ছিলো পরিবারের সবার। শুধু ছিলো না শুভ্র, ধ্রুবর।
তরু কতরাত নির্ঘুম কাটায়! কতদিন কাজে অন্যমনস্ক হয়ে পরে! কতসময় পুরোনো স্মৃতি মনে হয়ে আনমনে হেসে উঠে! কেমন আছে শুদ্ধ? কেমন আছে শুভ্রভাই, ধ্রুবভাই? তরুর নেত্র সজল হয়। মৃদু সরে আওড়ায়,
‘ক্ষমা করো, প্রকৃতি। আমি সার্থপর হতে পারিনি। আমার পুরুষ’টি আমাকে সার্থপর হতে দেয়নি।’
তরুর অশ্রু গাল বেয়ে ঠেকলো গলা অবধি। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠলো। সে রাতে তরুর হাত ধরে শুদ্ধ বললো,
‘ক্ষমা করো, অঙ্গনা। সবার মনে দুঃখ দিয়ে তোমাকে নিয়ে সুখী হতে চাইনা। আমার কাছে থাকা অবস্থায় তোমার দুঃখ আমি সইতে পারবো না। তুমি আমাকে ছাড়া দুঃখী হও তবুও সুখী হও। আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচো।’
তরুর চোখের তারায় তখনো কেবল বাবা, দাদুর কান্নারত মুখমণ্ডল। ও শুদ্ধর দিকে অবাক চোখে তাকালো। শুদ্ধ তখন তরুর কপালে তপ্ত চুমু খেলো। হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিলো। নষ্ট ঘড়ি! তরু তখনো বুঝে উঠছে না সারাদিন কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। শুধু জানে ওরা সবাই কষ্ট পাচ্ছে!
‘আমি তোমাকে নষ্ট সময় উপহার দিলাম। যেনো তোমার মূহুর্তগুলো কখনো নতুন করে নষ্ট না হয়।’
তরুর চোখ বেয়ে ধীর গতিতে অবিশ্রান্ত নীর পরলো। এক পা এগিয়ে শুদ্ধকে ঝাপটে ধরলো। শুদ্ধ এই প্রথমবার তরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ফাঁকা আওয়াজে তরু ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো। নাক টানার তীব্র শব্দ নিস্তব্ধ রাস্তায় ঝংকার তুললো। দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যপটের সাক্ষী হয়ে রইলেন দাদুভাই। শুদ্ধ ভাঙা আওয়াজে ধরা গলায় বললো,
‘তরু, তোমাকে কখনো বলা হয়নি…
এ বলে শুদ্ধ থামে সেকেন্ড কয়েক। এরপর তরুর মাথায় পরপর তিনবার চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘আমি তোমায় হেমন্তের মতো ভালোবাসি, প্রিয় তরু। কিংবা তার থেকেও অধিক, যার সাথে কোনোকিছুর তুলনা হয়না। তোমাকে আমার দুঃখ ছাড়া আর কোনো দুঃখ স্পর্শ করার স্পর্ধা না দেখাক।’
তরু মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে তাকালো। চোখের জলে হাত দুটোও ভিজে একাকার। সেই সন্ধ্যে কবে পার হয়ে গেছে তবুও কত জীবন্ত! শুদ্ধর সেই জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি কথাটা তরুর আজীবনের পুঞ্জি। তরু সেই স্মৃতিটুকু আঁকড়ে সারাজীবন অনায়াসে পার করতে পারবে। তরু কান্নার মাঝে মৃদু হাসলো। তার হাতে ধরা সেই ঘড়ি। ঘড়ি’টা বুকের মাঝে চেপে ধরে বিরবির করে আওড়ালো,
‘আপনার থেকে বড় কোনো দুঃখ নেই আমার।’
এরপর মিনিট খানেক পর এই হেমন্তের সকালের শূন্যে হাহাকার করে তরু খুব আক্ষেপ নিয়ে বললো,
‘আপনি আমার হেমন্তের নীড়। হাত বাড়ালেই যদি ছুঁতে পারতাম,
অথচ কী আশ্চর্য! সেই নীড়ে আমি কখনো এক দণ্ড জুড়োতে পারলাম না।’
‘সমাপ্ত’