হেমন্তের নীড় পর্ব-১৬

0
2

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৬
২৮.
আজকে সকালটা ভীষণ সুন্দর! সুন্দরের আঁচে দুপুরটাও ভারী চমৎকার হয়ে উঠলো। আমি ভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে দেখলাম শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! পনেরো দিন পর উনার সাথে আমার দেখা। তাও আবার শুদ্ধ নিজে এসেছে। এতো বড় স্বপ্ন আমি কীভাবে দেখছি? এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধকে একটা চিমটি কাটলাম। শুদ্ধ বেশ ভাবসাব নিয়ে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গম্ভীর মুখে বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার চিমটিতে সে খুব বিরক্ত চোখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ধমকে উঠলো,

‘এই মেয়ে, চিমটাচ্ছো কেনো?’

আমি উৎফুল্ল চোখে মুখে উত্তর দিলাম, ‘ভালো লাগছে তাই।’

উনি নিরস মুখে বিরস বদনে বললেন, ‘উঠো।’

আমার মুখটা পাঙ্গাস মাছের মতো হা হয়ে গেলো। আমি এবার নিজের হাতে চিমটি কেটে বললাম,

‘কি বললেন? আপনার বাইকে উঠবো? আমি?’

শুদ্ধ চু আকারে বিরক্তসূচক শব্দ করে বাইকে উঠে চাবি ঘুরালেন। হেলমেট পরতে পরতে আমার হাতে আরেকটা হেলমেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তাড়াতাড়ি উঠো। আজ তোমাকে আমি মার্ডার করবো।’

তার কথায় আমি কিছু মনে করলাম না। তার হাতে খুন হতে আমি রাজি। হেলমেট পরতে গিয়েও থেমে গেলাম। আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেললো। আহ্লাদী কণ্ঠে বললাম,

‘হেলমেট পরতে পারছি না। একটু পরিয়ে দেন।’

শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চাপলো কিন্তু আমি না দেখার ভান ধরলাম। উনি বললেন,

‘এই জনসম্মুখে চপেটাঘাত খেতে না চাইলে উঠে পরো, মেয়ে।’

‘আচ্ছা উঠছি। তার আগে বলুন আমাকে মার্ডার করতে আপনার কষ্ট হবে না?’

শুদ্ধ উত্তর দিতে চাইলো। কিন্তু তার উত্তর আমার আগে থেকেই জানা। নিশ্চয়ই ধমকে একটা ত্যাড়া জবাব দিবেন। বিধায় আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে মুখটাকে দুঃখী দুঃখী করে বলে উঠলাম,

‘থাক! আমি জানি আপনি অনেক কষ্ট পাবেন। তারপর দেখা যাবে আমাকে খুন করে আপনি নিজেও সুইসাইড করে বসেছেন। আপনার কষ্টে আমি কষ্টিত, শুদ্ধ সাহেব।’

বলে আমি হিহিহি করে দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। শুদ্ধর কাছে আমার হাসি সহ্য হলো না। তিনি রাম ধমক দিয়ে বললেন,

‘এই মেয়ে উঠো, তোমার যন্ত্রণায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। অসহ্য মেয়ে মানুষ একটা!’

আমার মুখটা ফাটা বেলুনের চুপসে গেলো। চুপসানো মুখে বললাম,

‘আমি আপনার সাথে যাবো না।’

শুদ্ধ বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগকে ধাতস্থ করে বললো, ‘ওকে, তবে যা বলার এখানেই বলছি।’

আমি চোরা চোখে আশেপাশে তাকালাম। আমরা দাঁড়িয়ে আছি একদম গেটের সামনে। পোলাপান আসছে যাচ্ছে আর আমাদের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। বেয়াদব ছেলে-মেয়ে। এছাড়াও আমি বুঝতে পেরেছি শুদ্ধ কি বলতে চায়। এইখানে ওসব কথা তিনি আমাকে ধমকে ধমকে বলার পর এই জনসম্মুখে আমার ইজ্জতের যে ফালুদা হবে তা ভেবেই আমার অস্থির লাগলো। আমি গাল ফুলিয়ে তার পেছনে উঠলাম। এই প্রথম আমি তার বাইকের পেছনে উঠলাম। তার কাধে হাত রাখলাম। আমার একবার ইচ্ছে করলো তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু এতো লোকের সামনে নিজেকে বেহায়া প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছে আমার হলো না। তাই জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখলাম।

আমার মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। লুকিং গ্লাসে শুদ্ধর দাড়িতে আচ্ছন্ন গালের একাংশ দেখে আমার বুকটা ধকধক করে উঠলো। কাধ থেকে হাত নামিয়ে একবার তার পেটে রাখলাম। তারপর আবার তার কাধে রাখলাম। শুদ্ধ বিরবির করলেন। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম,

‘আমার ভুল। আমার ভুল। আমি পাগল। কোন কুক্ষণে যে এই মেয়েকে সাজা দিতে এসেছিলাম। এখন আমি নিজেই ভুক্তভোগী।’

আমি হাসলাম নিঃশব্দে। কাধ থেকে হাতটা নামিয়ে আবার তার পেটে রাখলাম। শুদ্ধ দাঁত কিড়মিড় করে ডাকলেন,

‘তরু?’

আমি লজ্জা মাখানো হাসি দিয়ে মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘হু…।’

‘আমাকে হাতানো বন্ধ করবে নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো তোমায়?’

আমার লজ্জা মাখানো হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠলো আলাভোলা নাদান ফেস। আমি আনমনে তাকে বললাম,
‘জি?’

সে আর কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ি টান দিলো। আসার পথে হঠাৎ দেখতে পেলাম রাস্তার ওপাশে ধ্রুব ভাই দাঁড়িয়ে। আমার চোখজোড়া থমকে গেলো। ভালোমতো দেখে বুঝলাম ওটা ধ্রুব ভাই-ই। পাশে ধ্রুব ভাইয়ের বাইক। কিন্তু ধ্রুব ভাই কেনো এসেছেন? আমাকে নিতে?

আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। চোখ সরিয়ে লুকিং গ্লাসে শুদ্ধর দিকে চেয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখটা আমার ঝাপসা হয়ে উঠলো। হেলমেটের আড়ালে তা কেউ বুঝলো না।

,
তরু যদি বুঝতো সানগ্লাসের নিচে ওই অপেক্ষয়মান চোখদুটো ওর দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে! যদি বুঝতো ওর জন্য ধ্রুবর মন কাঁদে! যদি বুঝতে পারতো ওর জন্য ধ্রুবর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়! তরু’টা কেনো ধ্রুবর ক্ষেত্রে অবুঝ হলো? কি এমন ক্ষতি হতো ধ্রুবকে একটু ভালোবাসলে? কি বা এমন ক্ষতি হতো যদি ধ্রুব তরুকে না ভালোবাসতো? ধ্রুব বাইকে উঠে বসলো। ধুলো উড়িয়ে রোদ্রের উজ্জ্বল দ্যুতিকে সঙ্গে নিয়ে পথ চললো। সূয্যিমামা আরামসে চলন্ত ধ্রুবর মাথায় তাপ দিতে দিতে বলে গেলো,

‘অবহেলায় রাখা বাগ্মী শুদ্ধ’রা জিতে যায়, হেরে যাওয়ার যাতাকলে নিষ্পেষিত হয় অঘোষিত ধ্রুবরা।’

ধ্রুব উত্তর করে,

‘ওহে সূর্য, জ্ঞান দিও না। তোমার তাপের মাত্রা’টা কমাও। মস্তিষ্ক যে আর তোমার তাপ সহ্য করতে পারছে না। অযাচিত কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে পাছে কিন্তু দোষ দিতে পারবে না।’

২৯.
শুদ্ধর বাইকটা এসে থামলো একটা নির্জন জায়গায়। সামনে নদী। তীরে নৌকা বাধা। শহর থেকে খানিকটা দূরে। এতোটা পথ ঘুরিয়ে এখানে কেনো নিয়ে এলো শুদ্ধ তা আমার মাথায় ঢুকলো না। প্রশ্ন করে বসলাম,

‘আসলেই মার্ডার করবেন?’

শুদ্ধর মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। সে হিমশীতল গলায় প্রশ্ন করে,

‘তুমি আমার বাড়িতে গিয়েছিলে?’

জানতাম! আমি জানতাম এটাই জিজ্ঞেস করবে শুদ্ধ। তাই উত্তর আগেই রেডি করে রেখেছি,

‘হ্যাঁ, আপনার বাবা বললেন, মা আসো, আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরে যাও।’

সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি কাঁপিয়ে ধমক এলো। ধমকের শব্দে আমার কানের ভেতর টা পু পু শব্দ করে উঠলো।

‘থাপড়ে তোমার দাঁত-পাটি সব ফেলে দেবো, বেয়াদব মেয়ে। আরো বলেছো আমি তোমাকে বিয়ে করার নাম করে বিয়ে করিনি? আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি? এই মেয়ে, তোমার সাথে আমার বিয়ের সম্পর্ক?’

নিজেকে ধাতস্থ করে একটু সাহসী হয়ে উঠার চেষ্টা করে বললাম,

‘ভুল কি বলেছি? আপনি আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেননি? ওই রাতে আমাদের ঢাকায় এসে কাজী অফিসে যাওয়ার কথা ছিলো আর আপনি আমায় বাসায় পৌছে দিয়ে চলে গেলেন। তারপর আমাকে কথা দিলেন বছরের প্রথম দিন দেখা করবেন। তাও করেননি। ধোঁকা হলো না এটা?’

শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি চোখ মুখ কুচকে পিছিয়ে গেলাম এক পা। শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু নরম হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

‘তরু, তোমাকে আগেও বলেছি আমার পেছন ছাড়ো।’

‘আপনি আগে আমায় একবার ভালোবাসুন। একবার ভালোবাসি বলুন।’

সানগ্লাস খুলে এক চটকানা মেরে তা নদীর পানিতে ফেলে দিলেন উনি। আমি ভয় পেলাম না। আমি খুবই সাহসী মেয়ে। কিন্তু ভীত হলাম এই ভেবে যদি তিনি বলেন তিনি আমাকে ভালোবাসেন না। তখন? নদীর পানিতে তখন ধীর স্রোত। শীতল বাতাস। রোদ্রের মাঝে তা মন্দ লাগছে না। ওড়না বাতাসে উড়ছে। চুল উড়ে আমার চোখে মুখে ছড়িয়ে পরেছে। শুদ্ধ হঠাৎ এগিয়ে এলো। এসে আমার মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো প্রথমবারের মতোন। তার স্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম। সে বরফ শীতল কণ্ঠে মৃদু আওয়াজে বললো,

‘আমার নিকট এলে অযত্নে পুষ্প মরে যায়।’

আমি স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলাম। সূর্যের আলো নদীর পানিতে রূপোলী ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সেই ঝিলিকে চোখ রাখা দায়। শুদ্ধর নেমে যাওয়া হাতটা খপ করে ধরে বললাম,

‘তাতে কি? আমি পুষ্প নই। তরু! আবার নাহয় আরেকটা পুষ্প’র অবজ্ঞায় জন্ম হলো!’

শুদ্ধ আমার হাতে ধরা তার হাতটার দিকে অনিমেষ চেয়ে হাত’টা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। আমি ছাড়লাম না। আঁকড়ে ধরে কাতর গলায় বলে উঠলাম,

‘আমি একটু আপনার স্পর্শ চাই।’

শুদ্ধ তার মুখটা আমার কানের কাছে এগিয়ে আনলেন। তার ফিসফিসানি স্বর আমার কানে ফসফস ধ্বনি তুললো। সারা শরীর কেঁপে উঠলো তীব্র থেকে তীব্রতর।

‘আমার স্পর্শে তোমার অঙ্গ কলংকে ঝলসে যাবে। অশুদ্ধতা লেপ্টে যাবে রন্ধে।’

আমার চোখ জ্বলে উঠে। জ্বলন্ত চোখ দুটো তার চোখে নিবদ্ধ করে ধীর স্বরে বললাম,

‘অথচ আপনি শুদ্ধ।’

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে