#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৫
২৬.
শুদ্ধ নতুন বাসায় উঠেছে। বাবা-মাকে নিয়ে আসবে প্রথম মাসের স্যালারি’টা পেয়েই। ডাক্তার দেখিয়ে যদি শুদ্ধর সাথে থাকতে চায় থাকবে নাহলে গ্রামে চলে যাবে। শুদ্ধ ঠিক করেছে শুদ্ধ বিয়ে করে ফেলবে। একটা সুশ্রী, শান্ত-শিষ্ট মেয়ে দেখে শুদ্ধ ওর ঘরের রানী করে নিয়ে আসবে। তৎক্ষণাৎ শুদ্ধর ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। বললো,
‘বটে? তরুর মতো দস্যি মেয়ে ছাড়া শুদ্ধর চলবে?’
শুদ্ধ আপনমনে উত্তর করে, ‘খুব চলবে।’
‘চললে কেনো মেয়েটাকে দেখতে গেলি?’
‘দেখতে গিয়েছি। দেখা তো দেইনি।’
‘কথা দিয়ে তুই কথা রাখতে জানিস না।’
শুদ্ধ বারান্দার খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে শূন্যে দৃষ্টি রাখলো। মিনিট কতক চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বললো,
‘জানি। কিন্তু আমাকে চাইলে ওকে সব ছেড়ে আসতে হবে যে!’
‘ও আসতে পারলে তোর কি?’
‘আমি চাই না এতো আদরে বাদর হওয়া মেয়েটা শুধু শুদ্ধর আদর নিয়ে বাঁচুক।’
আর কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া গেলো না। একটা বাবুই পাখি বারান্দার ভেন্টিলেটরে বাসা করেছে। শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে বাবুই পাখির বাসা দেখলো। শুদ্ধ সেদিন পাঞ্জাবি পরেছিলো। ইচ্ছে ছিলো তরুর কথা রাখার। কিন্তু রমনায় গিয়ে দূর থেকে ল্যাভেন্ডার শাড়িতে তরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে শুদ্ধ থমকে দাঁড়ালো। এরপর দূর থেকেই কতক্ষণ চেয়ে রইলো কে জানে! চোখ ঘুরিয়ে এদিক সেদিক নজর বুলাতেই হঠাৎ অদূরে সে ধ্রুবর বাইক আবিষ্কার করলো। তরু তখনো শুদ্ধর অপেক্ষায় ছলছল নয়নে মুখ ভার করে বসে।
ও দুই পুরুষের কষ্ট আর বাড়াতে ইচ্ছে করে না শুদ্ধর। অথচ তার রমণীর কষ্ট সে ঠিকই বাড়িয়ে চললো। একবার ভাবলো ফোন করি। আবার কি মনে করে করলো না। থাক না একটুখানি কষ্ট! কিছু অপূর্ণতা শুদ্ধর বুকপকেটেও জমুক। এই যে তার অপেক্ষাময়ী কে সে দূর থেকে ঝাপসা দেখে চলে এলো একি কম কষ্টের? অদেখার চেয়ে দেখেও না দেখে চলে আসা যে ঢের যন্ত্রণার! শুদ্ধ একটা সিগারেট ধরালো। বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে উপহাস্যে অনুচ্চ স্বরে বললো,
‘আমি দেখে নিলে যদি তুমি দুঃখ পাও?
আমি ছুয়ে দিলে যদি তুমি অকালে নষ্ট হয়ে যাও?’
উত্তর আসে না তো। শুদ্ধ নিজেই বলে,
‘আমি তোমায় দূর থেকে ছুঁই। আমি তোমায় দূর থেকে চেয়ে দেখি। সুন্দরতম তুমি আমার জন্য দুর্লভ হয়ে রও। আমি বেদনায় পিষ্ট হয়ে রই। তুমি আরেকটু শুদ্ধময় যাতনার প্রশ্রয় দাও।’
২৭.
চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটাতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাসে অভ্যস্ত হতে হতে এখন এই বদ্ধ বড় ঘরটায় শুদ্ধর হাঁসফাস লাগে। আজ ছুটির দিন। তরুকে না দেখার আজ বায়ান্ন তম দিন। ঘরের তল্পিতল্পা গুছিয়ে বিকেলে শুদ্ধ ছাদের উদ্দেশ্যে গেলো। কে জানতো ছাদে যে এতো বড় চমক অপেক্ষায় ছিলো?
ছাদের চাপানো দরজা পেরিয়ে আসতেই কয়েকজন রমণীর কন্ঠের শোরগোল শুনা গেলো। শুদ্ধ পা এগিয়েও পিছিয়ে নিলো। নারীর উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করলো? কোথাও দু’দন্ড শান্তি নেই শুদ্ধর জন্য? ছাদে এসে চেঁচামেচি করতে হবে কেনো? মেয়ে, তোদের ঘর নেই? শুদ্ধ পেছন ঘুরেছে ওই মূহুর্তে কানে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর। শুদ্ধর পা দুটো থমকে ভ্রু দ্বয় কুচকে গেলো। কণ্ঠের অনুসরণ করে তাকাতেই শুদ্ধর ভ্রু’র সাথে সাথে চোখদ্বয়ও কুচকে গেলো।
তরু বিহ্বল। এতোটাই হতবাক যে অনুভূতিশূন্য। পাশে থাকা বন্ধুদের ধাক্কাতে ওর ঘোর ভাঙলো। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে বললো,
‘তোরা যা। আমি একটু পর আসছি।’
এরপর কিছু একটা ইশারা করলো। শুদ্ধ দেখলো তিনজন রমণী তরুর ইশারায় যথা আজ্ঞা করে চলে গেলো। তরুর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। মরুভূমির বুকে জল পাওয়ার ন্যায় তৃপ্ত বৃক্ষ সে। তার চোখ দুটো জুড়িয়ে যাচ্ছে। একধ্যানে পলক বিহীন সে শুদ্ধকে দেখে গেলো। কত খুঁজেছে এর মাঝে! শুদ্ধর বাড়িতে ফোন লাগিয়েছে। শুদ্ধর ফেলে দেওয়া সিমে অহরহ বার ফোন দিয়ে গেছে। পুরাতন অফিসে গিয়েছে। কোথাও নেই। শুদ্ধ তরুকে উপেক্ষা করলো না। ছাদের বসার জায়গাতে বসে তরুকে বসতে বললো। তরু বসলো শুদ্ধর মুখোমুখি। শুদ্ধ মৃদু ধমকে বলে,
‘এই মেয়ে, পলক ফেলো।’
তরু ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। বললো,
‘আরেকবার ধমক দিন। কতদিন ধমক খাই না! দেখুন কেমন শুকিয়ে গেছি আমি!’
শুদ্ধ এবার পরিপূর্ণ চোখে তাকালো। তরুর গায়ে সাদা, কালো শাড়ি। ওর বাকি বান্ধবীদের গায়েও তাই ছিলো। হয়তো গ্রুপ ফটো তুলছিলো। শুদ্ধ আরো দেখলো মন দিয়ে। তরু শুকিয়েছে বটে! তবে খুব ফর্সা হয়েছে। আগের চেয়ে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নাকি এই পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলোয় শুদ্ধর কাছেই পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যময়ী সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে?
শুদ্ধ চোখ সরালো। অপ্রস্তুত কেশে বললো,
‘এখানে তোমার কোনো বান্ধবী থাকে?’
তরু হেসে মাথা নাড়ায়,
‘আপনার বাড়িওয়ালার মেয়ে আমার বান্ধবী। আগে প্রায়ই আসা হতো। লাস্ট দুই-তিন মাস ধরে আপনার বিরহে আসা হলো না। ভাগ্যিস আপনি বেছে বেছে এ বাড়িতে উঠেছেন।’
শুদ্ধ কপাল কুচকে বলে, ‘বেছে বেছে উঠিনি।’
তরু আবার হাসে মৃদুমন্দ। এ হাসি মন খারাপের। শুদ্ধ চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। দিনের আলোটা মরে যাচ্ছে। গোধূলির সোনালি আলোয় শুদ্ধ অনেকক্ষণ পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমায় মন খারাপে মানায় না, তরু।’
এসময়ে তরুর গলাটা ধরে এলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
‘এলেন না কেনো? আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একা!’
শুদ্ধর বুকে সূচের মতো বিধলো ‘একা’ শব্দটি। সে নিচুস্বরে বললো,
‘আমি জানি, তরু। আমি গিয়েছিলাম।’
তরুর অভিমানী স্বর, ‘তবে দেখা দিলেন না কেনো?’
শুদ্ধ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কয়েক মুহূর্ত কেটে যাবার পর বললো,
‘তোমার জন্য অনেকে অপেক্ষায়, তরু। এক শুদ্ধ না এলে তোমার এতো যায় কীসে?’
‘অনেকজনের অপেক্ষা তো আমার দরকার নেই, শুদ্ধ। আমি যে কেবল আপনার অপেক্ষায়।’
তরু বোধ হয় শুদ্ধর সামনে এই প্রথম শুদ্ধর নাম ধরে ডাকলো। শুদ্ধ আজ কথা বলতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে থমকাচ্ছে। তার থমকানোর মাঝে তরু আকুতি করে উঠলো,
‘আমি আপনাকে একটু ছুঁই? আপনার হাত’টা একবার ধরি, শুদ্ধ?’
বাতাস থমকে গেলো। সে সাথে আবারো থমকে দাঁড়ালো শুদ্ধ। থমকে গেলো শুদ্ধর হৃদয়। সে কয়েক সেকেন্ড পর ফিসফিস করে বললো,
‘এই নষ্ট মানব’কে ছুঁতে চাইলে নিশ্চিত তোমার মরণ।’
তরু চোখ বন্ধ করলো। সাথে সাথে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে গেলো গলা অবধি। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,
‘হোক না মরণ তাতে কি?’
তরুর গলা কেঁপে উঠলো। সেকেন্ড কয়েক থেমে বললো,
‘আমি বিরল রাঙা হালতি,
হেমন্তের নীড় খুঁজতে এসেছি।’
বাতাসে শুদ্ধর চুল উড়ছে। উড়ে যেতে চাইছে মনের উপর পর্দাটা। শুদ্ধর আকড়ে ধরলো। কণ্ঠ কঠিন করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে বলে চললো,
‘হৃদয় ব্যথা কিন্তু সাড়ে না, মেয়ে। আফসোসের দানা সেথায় লেগে আজীবন অমসৃণ হয়ে রবে।’
‘আপনাকে না পাওয়ার থেকে পেয়ে হৃদয় ব্যথা হওয়া ভালো।’
শুদ্ধ বড় করে শ্বাস নিলো। সূর্য ডুবছে। লাল-কমলা আলোয় পশ্চিমের আকাশ ছেয়ে গিয়েছে। অদূরে চেয়ে সে বললো,
‘তুমি এতো শুকিয়েছো কেনো, তরু?’
তরু ধীরে জবাব দেয়, ‘উত্তর’টা তো আপনি জানেন।’
‘জানি। কিন্তু আমি চাই উত্তর’টা তুমি বদলাও।’
‘কেনো চান?’
তরুর মুখটা থেকে হলুদ সোনালি দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বাতাসে শাড়ির আঁচল খানি উড়ে যাচ্ছে। সাদা-কালো মিশেলে চুড়ির টুংটাং শব্দ সেথায় ছন্দ ছড়াচ্ছে। প্রেমের ছন্দ! শুদ্ধ ঠোঁটের কোণে অনিচ্ছার হাসি টেনে বললো,
‘কারণ আমি চাই না আমাকে পেয়ে তুমি বাকিসব কিছু হারাও। তুমি অনেক আদরের তরু। এক ব্যথা সইতে পারছো না। সহস্র ব্যথা কীভাবে বইবে?’
তরু কিছু বলতে চায়। শুদ্ধ ওকে থামিয়ে আবারো বলে,
‘আমি না থাকলে তোমার একটা কষ্ট। আমি থাকলে তোমার হাজারটা কষ্ট, তরু। সেই কষ্ট তখন আমি সইবো কেমন করে?’
তরু স্নিগ্ধ হাসি দেয়। কী ভীষণ সুন্দর দেখায় তখন তাকে!
‘কেনো? আমার কষ্টে আপনার কষ্ট হয়?’
‘তোমার জায়গায় যে কেউ থাকলেই হতো। ইউ আর নট স্পেশাল।’
সূর্য ডুবে গিয়েছে। তরু ঠোঁট প্রসারিত করে আবারো হেসে উঠলো। আজ তো তার হাসিরই দিন। কতদিন সে হাসে না। তরু একদম ফিসফিসিয়ে বললো,
‘মিথ্যে কথা! আমি আপনার কাছে মূল্যবান! তাই তো আপনি আমার সুদূরপ্রসারী দুঃখ নিয়ে ভাবেন।’
চলবে