হেমন্তের নীড় পর্ব-১৩

0
10

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৩
অপেক্ষা করতে করতে ঘটনাটি গিয়ে ঘটলো রাতে। শীতের মাঝে অপ্রিয় ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল সে রাতে। শুদ্ধর মন বড় অস্থির হয়েছিলো। ঘড়ির কাটা যখন রাত ১০ টার ঘরে তখন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘরের দরজায় ধুপধাপ শব্দ হলো। শুদ্ধ ভয় পেলো না তবে বুঝতে পারলো অঘটন’টি ঘটে গিয়েছে। শীতের রাত তারউপর আবার গ্রামের। মরার উপর খারা হয়ে এসেছে এই বৃষ্টি। সব মিলিয়ে গ্রামে একটা সূচ পরলেই যেনো শোনা যাবে। এই সময় এই নিস্তব্ধতা ভেঙে দরজায় অনবরত করাঘাত শুদ্ধকে একটু বিচলিত করলো। বাবা-মা না উঠে যায়!

দরজা খুলতেই শুদ্ধ রাজুকে আবিষ্কার করলো। ছাতা মাথায় রাজু ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো,

‘শুদ্ধ ভাই, তোমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।’

‘আস্তে কথা বল।’

রাজু গলার স্বর নামিয়ে বললো, ‘চলো। একটা মেয়ে আছাড় খেয়ে পরেছে। আমি গিয়েছিলাম ক্ষেতের আইল কাটতে। অসময়ের বৃষ্টি। মেয়েটা এসে পরলো আমার সামনেই। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই কেমন ভূতের মতো তোমার নাম জপছিলো।’

শুদ্ধ বেজায় বিরক্ত হলো। রাজু পড়াশোনা করছে। ক্লাস টেনে পড়ে। খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কলেজে উঠলে ঢাকায় পড়ার ইচ্ছে। সময় পেলেই বাবার কাজে সাহায্যে লেগে পরে।

শুদ্ধ লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরতে পরতে বললো,

‘তুই ছাড়া আর কেউ দেখেনি তো?’

রাজু উত্তর দেয়, ‘না।’

‘খবরদার কাউকে বলবি না।’

রাজু মাথা নাড়ায়। শুদ্ধ মোটা একটা গেঞ্জি পরে উপরে আরেকটা জ্যাকেট পরে। বাইরে মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা। বড় একটা ছাতা নিয়ে তটস্থ, ব্যস্ত পায়ে হাটা দেয়।

২৩.
এই যে আমি রাত-বিরেতে বৃষ্টিতে ভিজে এতো পাগলামো করলাম। বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার জন্য ছুটে এলাম। জুবুথুবু ভিজে তখন আমার গায়ের জ্বর যে তরতর করে বাড়ছে এবং আমার চোখ জ্বলন্তিতে নিভু নিভু হয়ে আসছে তবুও তার প্রতি আমার উৎকন্ঠা, উদ্বেগ আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু আমার এতো অনুভূতির, কষ্টের বিন্দুমাত্র মূল্য না দিয়ে শুকনো খটখটে আওয়াজে কেবল সে শুধু এইটুকু বললো,

‘কেনো এমন করছো?’

তার এইটুকুন প্রশ্নে আমি কোনো কিছু বলার ভাষা পেলাম না। আমার জ্বরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া চোখ দিয়ে কেবল তার দিকে উদাসীন ভাবে তাকালাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নির্লজ্জ চোখ উপচে পানি এলো এবং আমার চোখে চোখ রেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তা সে কেবল দেখে গেলো। কষ্টে তখন আমার বুক ফেঁটে যাওয়ার জোগাড়। এতো অপমানের পরও আমি কীভাবে তার কাছে ছুটে আসি? কীভাবে? আমি কি মানুষ? তবুও আমি নিজেকে অমানুষ, একজন বেহায়ার বস্তা, অপমানের বকরি বানিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় তাকে বললাম,

‘ভালোবাসি তো। তাই এমন করি।’

সেই প্রথম! আমি তাকে ভালোবাসি বলেছিলাম! এর আগে আর কক্ষনো বলিনি। সে বুঝেছে। আমি তাকে নানানভাবে বুঝিয়েছি আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু সর্বনিকৃষ্ট বেহায়া আমি আমার নামমাত্র লজ্জার গন্ডিটুকু পার করে কখনো তাকে ভালোবাসি বলতে পারিনি। পাছে আরো বেশি অপমানিত হই! অজ্ঞাত প্রত্যাখান মানা যায় কিন্তু মুখের উপর ভালোবাসার প্রত্যাখান কি করে সহ্য করা যায়? তখন আমি পরবর্তীতে আবার কীভাবে বেহায়া হবো? কীভাবে দ্বিতীয়বার তার কাছে ভালোবাসার আবদার নিয়ে দাড়াবো? যে আমার মুখের উপর বলে দিবে আমি তোমাকে ভালোবাসি না। এ নির্মম, পাষাণ, হৃদয় ভাঙা সত্যের উপর আর কি হতে পারে?

কিন্তু সেদিন আমার হৃদয় ভেঙে সে একবারের জন্যও বলেনি আমি তোমাকে ভালোবাসি না বরং বাকরুদ্ধ নয়নে কেবল চেয়ে থাকলো মিনিট দুয়েক। সে খুব কম অবাক হয়। আমি সবসময় চাই তাকে আশ্চর্য করে দিতে। আচ্ছা, আমার সব চাওয়া পাওয়া কেনো তাকে ঘিরে? আমি কেনো এতো পাগল তার জন্য? আমার থেকে একটু পাগলামি কেনো শুদ্ধতে ট্রান্সফার হয় না? আমার মাথা ঘুরে উঠলো। পা দুটো টলে উঠতেই সে চমকে হালকা হাতে আমার বাহু ধরলো। আমি ভরসায় তার বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম। সে তৎক্ষণাৎ আমার মাথা তুলে দিয়ে কপালে হাত রাখলো। গম্ভীর গলায় বললো,

‘তরু…।’

এটুকু বলতেই আমি তটস্থ পায়ে পিছিয়ে গেলাম। কানে দু হাত চেপে কাঙালের মতো চিৎকার করে উঠলাম,

‘প্লিজ বলবেন না ভালোবাসি না। প্লিজ। দোহাই!’

হ্যাঁ, আমি কাঙাল। শুদ্ধর ভালোবাসার কাঙাল। ঝুম বৃষ্টিতে আমি তখন স্পষ্ট দেখছি শুদ্ধ’র চোখে অসহায়ত্ব। কিসের বেড়াজাল? তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন,

‘তোমার জ্বর, তরু।’

‘হোক জ্বর।’

‘জোরে কথা বলো না। এটা গ্রাম।’

‘আপনি কেনো বলেছিলেন আমি আপনার কাছে হেমন্তের মতো প্রিয়?’

শুদ্ধ ভ্রু কুচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালেন। আমি তার বুকে কিল ঘুষি মেরে উদভ্রান্তের ন্যায় বললাম,

‘কেনো বলেছিলেন? নাহলে তো আমি আপনাকে ভালোবাসতাম না।’

শুদ্ধ আমার দু হাত চেপে ধরে চাপা গলায় ধমকে উঠলো,

‘আস্তে কথা বলতে বলেছি না? ভুলে বলে ফেলেছিলাম। শুনেছো?’

আমার কান্না বৃষ্টির জলে মিশে একাকার। তবুও রক্তলাল নিষ্প্রাণ ভেজা চোখ দুটো দিয়ে চেয়ে মৃদু স্বরে ভাঙা আওয়াজে বললাম,

‘কিন্তু আমি তো আপনাকে ভুলে ভালোবাসিনি।’

বলেই তার বুকে হামলে পরলাম। সে বাকরুদ্ধ। তার বুক থেকে আমাকে উঠালো না। আবার আমার পিঠে হাত রেখে জড়িয়েও ধরলো না। আমি তার দুটো হাত বারংবার নিয়ে আমার পিঠের উপর রাখলাম। সে হতাশ শ্বাস ফেলে শুধালো,

‘কেনো পাগলামো করছো?’

আমি আবারো উন্মাদের ন্যায় তার বুকে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলাম,

‘আমি বাঁচবো কীভাবে? আপনাকে ছাড়া বাঁচবো না।’

আমার কাঁপুনি দেখে শুদ্ধ একটা হাতে আমায় জড়িয়ে নিলো। মৃদু ধমকে বললো,

‘এই শীতে এভাবে এসেছো কেনো? এটলিস্ট একটা শাল তো গায়ে জড়াবে।’

‘আমি তাকিয়ে থাকতে পারছি না।’

‘পারবে কীভাবে? যে জ্বর বাধিয়েছো!’

বলে শুদ্ধ নিজের জ্যাকেট খুলে তরুর গায়ে পরিয়ে দিলো। তারা একটা বন্ধ দোকানের ছাউনির নিচে এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে। তরু জ্যাকেট’টা পরে ঝড়ের গতিতে আবারো শুদ্ধের বুকে মাথা রাখলো। শুদ্ধ হতভম্ব। তরু বলে,

‘আমায় নিজের থেকে ছাড়াবেন দেখে জ্যাকেট দেওয়ার নাম করলেন, না?’

‘তরু, গ্রো আপ। তুমি নিজের সেন্সে নেই। চলো তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। রাইট নাও।’

তরু মাথা উঠালো। ছিটকে দূরে সরে বললো,

‘কক্ষনো না। আগে আপনি বলুন চিলেকোঠায় ফিরে যাবেন।’

‘সম্ভব নয়।’

‘তাহলে বলুন ভালোবাসেন।’

শুদ্ধ চোখ দুটো মেলে পূর্ণ চোখে তরুর দিকে চাইলো। চার চোখ এক হলো। ওই শুদ্ধ দুই চোখের মায়ায় শুদ্ধ আটকে গেলো। চাপা শ্বাসে ধীর কণ্ঠে বললো,

‘শুনো মেয়ে, ধ্রুবরা তোমার অপেক্ষায়।’

‘আর আমি আপনার প্রতিক্ষায়।’

‘শুভ্ররা তোমায় ভালোবাসে।’

‘অথচ শুদ্ধ’রা আমায় অবহেলা করে।’

‘আর তোমার নির্লজ্জ চিত্ত সেই অবহেলা’কে দিনরাত ভালোবেসে যায়।’

‘এবার আপনি একটু ভালোবাসুন।’

শুদ্ধ এ কথার পেছনে আর কোনো কথাই খুঁজে পেলো না। এগিয়ে এসে আবার কপালে হাত রেখে বললো,

‘জ্বর বাড়ছে। চলো।’

‘কোত্থাও যাবো না। বিয়ে করবো, চলুন।’

‘আগে সেন্সে ফিরো।’

‘আমার সেন্স আছে।’

‘এই বৃষ্টির রাতে কোনো কাজী তোমার জন্য বসে নেই।’

‘আমার সাথে চলুন। এইটা কোনো রাত হলো? ঢাকায় কাজী বসে আছে।’

‘সাট আপ, তরু।’

‘করবো না সাট আপ। কি করবেন? মুখের উপর দরজা তো এখন আর লাগাতে পারবেন না।’

বলে তরু হিহিহি করে হেসে উঠলো। মুখে বললো, ‘আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? এমন অদ্ভুত আচরণ করছি কেনো?’

‘চলো। ঢাকাতেই যাবো।’
‘কাজী অফিসে?’
‘হ্যাঁ।’
‘সত্যি?’

শুদ্ধ চোখ পাকিয়ে তাকায়। এরপর তিনি আমার হাত ধরলেন। হাত ধরে পাড়ি দিলেন অনেকটা রাস্তা, অনেকটা সময়। পথ মাড়াতে মাড়াতে বৃষ্টির ঝাপটা কমে এলো। পথে আমাকে তিনি খাবার খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালেন। এরপর স্টেশনে এসে আমরা ট্রেন ধরলাম। ঘন্টা খানিক ট্রেনে ঘুমানোর পর আমার জ্বরটা একটু নামলো। কিন্তু সে রাতে আমরা কাজী অফিসে গেলাম না। তিনি আমায় বাড়ি পৌছে দিলেন। তবে কথা দিলেন ১ তারিখ সে আমার সাথে দেখা করবেন। আমি বাড়িতে ঢুকলাম চুপিচুপি। সবাই জানে আমি ঘরে দোর দিয়ে ভেতরে আছি। কিন্তু আমি গেছো ইঁদুর। বিকালেই আমার বারান্দার সামনে একটা মই এনে রেখেছিলাম। বারান্দার রেলিং টপকে মই দিয়ে নেমে সোজা শুদ্ধর কাছে। এই মূহুর্তে আমি আমার কাছে থাকা চাবি দিয়ে আমার ঘরের দরজা খুলে রুমে ঢুকলাম। জ্বরটা ছাড়েনি। আবার যেনো তড়তড় করে বাড়ছে। তবুও গিজার অন করে গোসল করে কাপড়গুলো ধুয়ে দিলাম। তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাক। যাতে আম্মু টের না পায়। শুদ্ধর জ্যাকেট’টা যত্ন করে রেখেছিলাম গোপনে, নিভৃতে। তা আজও আছে যত্নে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে