#হেমন্তে_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১১
১৮.
সুপ্রিয় পাঠকমন্ডলী,
আমি বহু গবেষণার পর উদঘাটন করেছি আমার দাদু, বাবা এদের শুদ্ধকে অপছন্দ করার পেছনের কারণ মূলত এটাই যে তারা মনে করেন যেকোনো সময় শুদ্ধর সাথে আমার প্রেম ট্রেম হয়ে মহাকান্ড ঘটে যাওয়ার চান্স আছে। সেই মহাকান্ড মানতেই নারাজ আমার বাপ-দাদা।
তাদের এই মনোভাবে আমি কিছু মনে করি না। আমি আবার খুব উদার কি না! সে যাই হোক, বন্ধুরা মিলে ট্যুর প্ল্যান করা হলো রাঙামাটি। একদিনের জন্য। সেটা কোনো প্রবলেম নয়। একদিন তেমন কোনো ব্যাপার নয়। আমি গেলাম মহা আনন্দে। তবে ফিরে আসার পর আমার জন্য যা অপেক্ষা করছিলো তাতে আমার পায়ের তলায় মাটি আর থাকলো কই?
শুদ্ধ চলে গিয়েছেন। তার যাবতীয় সরঞ্জাম, আসবাবপত্র কিচ্ছু নেই। গোটা ধরণী যেনো আমার মাথায় ভেঙে পরলো। আমি নিস্তব্ধ চোখে মেঝেতে বজ্রাহতের ন্যায় বসে পরলাম। না.. চোখ দিয়ে পানি পরছে না তবে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। গলায় কান্না, ব্যাথা উথলে উঠছে। এতোটা ঘৃণার পাত্রী আমি? আমাকে একবার বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না? শেষদেখাও করলেন না? আমার এতো কষ্ট….! মনে হচ্ছে আমি আজ মারা যাবো।
দিন গড়িয়ে যখন ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তখন আচমকা আমার কাধে কারোর হাত পরলো। আমি ওভাবেই বসে চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। এক সেকেন্ডের জন্য আমার মনে হলো শুদ্ধ… শুদ্ধ বোধ হয় এসেছে। কিন্তু নাহ! দাদুভাই!
‘সারাদিন ধরে এ ঘরে বসে আছিস কেনো?’
আমি নিষ্প্রাণ চোখ দুটো মেলে ধরা গলায় বললাম,
‘তোমরা সবাই খুব খুশি হয়েছো না?’
দাদুভাই জবাব দিলেন না। শুধু আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। ওতো চেয়ে আমার মুখে কি গুপ্তধন খুঁজে বেড়ালেন আমি জানি না। অতঃপর এলো পায়ে উঠে আমি চলে এলাম নিজের ঘরে। দরজার সামনে মা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি একটা টু শব্দ না করে ভেতরে ঢুকে পরলাম। কাউকে সহ্য হচ্ছে না আমার। কাউকে না। কোথায় খুঁজবো আমি শুদ্ধকে? সে কোথায় থাকতে পারে? চিন্তায় আমার মাথা ফেটে পরছে। মা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমি তার বুকে মাথা রাখলাম।
‘ওকে সবাই মিলে তাড়িয়ে দিলে কেনো মা?’
মা আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
‘শুদ্ধ নিজে থেকে চলে গেলো যে। আমিও জানতাম না। যাওয়ার আগমুহূর্তে এসে আমার বললো। তোকে বলে যায়নি বলে খুব খারাপ লাগছে? লাগাটাই স্বাভাবিক। কতদিন ধরে ছিলো! ছেলেটা খুব ফ্যামিলি পার্সন।’
আমি উত্তর করতে পারলাম না। আমার চোখ থেকে টপ করে পানি পরলো। আমি বলতে পারলাম না ‘মা, আমার শুধু খারাপ না বরং সাথে খুব কষ্ট হচ্ছে। শূন্যতায় বুকটা মনে হচ্ছে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।’
‘আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি, মা।’
মা সেকেন্ড কতক চুপ থাকলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ বললেন,
‘তুই শুদ্ধকে অনেক পছন্দ করিস?’
এমন প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তবে তেমন আশ্চর্যও হইনি। আবার বলতেও পারলাম না ‘শুধু পছন্দ নয় আমি তাকে খুব ভালোবাসি।’
মা আবার শুধালেন, ‘শুদ্ধ তোকে পছন্দ করে?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না করলাম। মা যেনো শুনে খুব স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। স্বস্তি টা বেরও করলেন,
‘যাক! পছন্দটা ক্ষণিকের! দেখবি না দেখতে দেখতে কেটে গেছে। আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। তোর দাদা, বাবা শুদ্ধকে একদম পছন্দ করে না। শুদ্ধকে নিয়ে আর ভাবিস না তুই। আয় খাইয়ে দেই।’
আমি খেলাম না। মাকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এরপর কি হলো জানি না…. আম্মুর কথাগুলো বারবার আমার কানে বাজলো। কেউ কেনো আমার সাথে শুদ্ধকে দেখতে চায় না? সে হোক! সবাই দেখতে না চাক। পুরো পৃথিবী দেখতে না চাক। শুদ্ধ কেনো চায় না? কেনো? আমি দুনিয়া ভেঙে কেঁদে উঠলাম। রুমে ফ্যান ছেড়ে, ওয়াশরুমের ট্যাপ ছেড়ে আমি হিড়িক দিয়ে কেঁদে উঠলাম। কান্নার বেগ থামাতে না পেরে হাত কামড়ালাম, চুল টেনে ধরলাম, বালিশে মুখ চেপে ধরলাম। কোনো কিছুতেই কাজ হলো না। তারপর দুই দিন আমি ঘর ছেড়ে বেরোলাম না। তা নিয়েও কত কেচ্ছা হলো!
১৯.
ভিটে পাকা ঘর। সামনে ছোট উঠান। পেছনে যতদূর চোখ যায় সবুজ চাষাবাদের ক্ষেত। বাড়ির সূচনায় খড়ের পাল্লা তার পাশেই একটা বড় চাড়ি। চাড়ির দু’পাশে দুটি বড় দামড়া বাধা। শীতল বাতাসের হুল্লোড়। শুদ্ধ এলো কাধে ঘাসের ভার নিয়ে। ঝাঁকা টা উল্টো করে ঘাসগুলো ফেললো চাড়িতে। ক্লান্ত হয়ে পা ভাঁজ হয়ে বসে পরলো ঘরের সামনে। লুঙ্গি হাটু পর্যন্ত বাধা, গায়ে ময়লা শার্ট, মাথায় বাধা গামছা খুলে শরীর ঝাড় দিয়ে তা কাধে ফেললো। অনেকদিন পর কাজ করে শরীর টা ব্যাথা করছে খুব। শুদ্ধ হাত পেছন দিকে নিয়ে কাধ রাউন্ড করে ঘুরিয়ে এক্সারসাইজ করলো। শুদ্ধর মা এসে ছেলেকে পানি দিলেন। পাশে বসে বললেন,
‘কত্ত বড় হইছোস রে, গেন্দা। এহন কি কামলার খাটন তোরে লাগে?’
শুদ্ধ পানি খেয়ে প্রাণ ভরে হাসলো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলেই মাথা পেছনে সরিয়ে নিলো।
‘মাথায় ময়লা। শরীরে ময়লা। গোসল করে আসি।’
‘হ, আহই। আমি পানি জাইতে দেই।’
‘না আম্মা লাগবে না। তুমি গরম ভাত বাড়ো। আমি দুই মিনিটে আসছি। একটা শ্যাম্পুর পাতা দিয়ো।’
গোসল সেরে এসে শুদ্ধ গরম ভাত খেলো লাউ শাক দিয়ে সাথে মাসকলাই ডাল। তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে শুদ্ধ মায়ের দিকে চেয়ে একগাল হাসলো।
‘রান্ধন মজা হইছে বাপ?’
‘খুব।’
‘আর যাইবি না ঢাকাত?’
শুদ্ধ মায়ের কথাটা বুঝলো। মূলত সবকিছু নিয়ে বাড়িতে এসে উঠেছে বলেই এই প্রশ্ন। কি আর করবে? আজ মাসের ২৮ তারিখ। নতুন বাসায় উঠতে হবে ১ তারিখ। এর আগে তো আর জিনিসপত্র গুলো নতুন জায়গায় নিতে পারবে না।
‘যাবো মা।’
‘তোর বাপের বুকের ব্যথাখান বাড়ছে।’
শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কি করলো জীবনে? না পারলো বাবা-মাকে সচ্ছলতায় মুড়িয়ে রাখতে না পারলো ভালোবাসার মানুষটাকে আদরে রাখতে। সে মৃদু আওয়াজে জবাব দেয়,
‘জানি আম্মা। তোমার কাশি টাও বেড়েছে। চিন্তা করো না। এবার তোমাদের আমি ঢাকায় নিয়ে যাব। বড় বাসা নিয়েছি। একটা ভালো বেতনের চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। কাল রাত কনফার্ম করেছে। তোমাদের আর কোনো কষ্ট থাকবে না আম্মা।’
শুদ্ধর মা মোলায়েম হাসি দিলেন প্রাণ ভরে।শুদ্ধ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো। তার মায়ের হাসিটা এত্তো সুন্দর!
শুদ্ধ জানে তার মা তার অর্ধেক কথাই বুঝতে পারেননি। তবুও তিনি শুদ্ধকে দোয়া দিয়ে বললেন,
‘না বাপ। ঢাকাত যায়ে থাকবার পামু না। তুই ভালা থাক। অনেক কষ্ট করছস বাপ। নিজের লাইগে কিছু জমাইস।’
‘জমাতে হবে না। আমি সব তোমাদের পিছনে উড়াবো।’
শুদ্ধর মা হাসলেন, ‘পাগলা! বিয়েশাদি করতে হইবো না?’
‘কি জানি! আদেও কপালে আছে কি না।’
বলে শুদ্ধ একটু উদাস চোখে জানালা গড়িয়ে বাইরে তাকালো। সবুজ বিস্তর ধানক্ষেত পেরিয়ে বহুদূর চোখ রাখলো। কেমন আছে তরু? কান্নাকাটি করছে অনেক? একটা ফোন দিয়ে বলে আসলেও পারতো শুদ্ধ। আর কখনো তরুর সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কি আছে? তাহলে সেদিনের মিথ্যার জন্য শুদ্ধ ক্ষমা চাইবে। বলবে,
‘তরু, আমি সেদিন বাসা পেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ওই দিঘির মতো টলটলে আকৃষ্ট দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কি যেনো হলো। আগে কখনো হয়নি। তোমার প্রলুব্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আমাকে মিথ্যার প্রলোভনে পেলো। আমি নিজের অজান্তে মিথ্যে বলে ফেললাম। বলে আমি আফসোস করলাম না। তোমার সেই হাসির জন্য হাজারটা মিথ্যে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, তরু। কিন্তু তোমার সেই হাসি’র মুখোমুখি আমি হতে চাই না। তোমার ওই চোখের দিঘি আমার জন্য সর্বনাশ। তুমি বলো, আমি যাদুকর। কিন্তু তুমি মস্তবড় ঐন্দ্রজালিক, সম্বন্ধীয়, মায়াবিনী। আমার কেনো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে, তরু? আমি যে তোমাকে দেখতে চাই না।’
শুদ্ধর কি একটু কষ্ট হলো? বোধহয় না! কারণ সে কষ্ট বুঝে না। তার বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। সে ঠাওর করতে পারলো না। তরুর পাগলামি বিহীন সে যে নিশ্চল, শূন্য, মৃত তা ভাবতেই চাইলো না। বহুদূর চেয়ে সে ফিসফিস করে বলে উঠলো কেবল,
‘তরু,
তুমি আমার হেমন্তের অগ্রহায়ণের কারণ,
আমার অঘোষিত প্রেমে পরা তোমার বারণ।’
চলবে