হেমন্তের নীড় পর্ব-১০

0
6

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১০
১৬.
শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই এর বাবাদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো না। ধ্রুব ভাই ছোট জেঠুর সাথে টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা বললেও শুভ্র ভাই টোটালি বড় জেঠুর সাথে কথা বলেন না। এর কারণ অবশ্য আমি জানি না। তবে ইদানীং শুভ্র ভাইয়ের সাথে বড় জেঠীরও মনমালিন্য দেখা গিয়েছে। তারা কথা বলছে কম। জেঠী যখন তখন চোখের পানি ফেলছে। কি যেনো হয়েছে আমাদের বাড়ি’টার মধ্যে!

কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ছোট জেঠী আমার সাথে শীতল আচরণ করছেন দিন দুয়েক থেকে। আমি ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন না, ঠিকমতো কথা বলছেন না, আদর করছেন না, আমায় খাবার দিচ্ছেন না। আমি আলাভোলা নাদান বাচ্চা একটা মেয়ে। এদের ঝামেলার মধ্যে আমার সাথে এই আচরণের কারণ আমি মোটেও বুঝতে পারছি না। আর আমি বুঝতে চাইও না। আমার বিশ্বাস সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।

সকালে শুভ্র ভাই আর আমি একসাথে খেতে বসলাম। ছোট জেঠী শুভ্র ভাইকে খাবার দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। তবুও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে ছোট জেঠীর আচঁল টেনে ধরে বললাম,

‘আমার খিদে পেয়েছে তো, জেঠি। আমাকে খাবার দিবে না?’

জেঠি আমার দিকে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে থেকে চলে গেলেন। আমি স্পষ্ট দেখলাম টেবিলের নিচে শুভ্র ভাই হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছে। বস্তুত যত যাই হোক, শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই দুজন আমাকে খুবই স্নেহ করেন, ভীষণ ভালোবাসেন। ওই মূহুর্ত’টায় আমার কান্না পেয়ে গেলো। আমি কি করেছি? এরমাঝে আম্মু এলো আমার আর আব্বুর খাবার নিয়ে। আব্বু নামবে আর মিনিট পাঁচেক পরে। আমি খানিক ধরা গলায় বলেছি,

‘আম্মু আমার না খেতে ইচ্ছে করছে না। নিয়ে যাও।’

আম্মু কিচ্ছু বললেন না। পাশে বসে খাবার মুখের সামনে ধরলেন। তারপর কি হলো জানি না আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। আশেপাশে কাউকে না দেখে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে আম্মুর বুকে মুখ লোকালাম। আমি তো এই বিহেভিয়ার গুলোও অভ্যস্ত না। হঠাৎ কি হচ্ছে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার মা বুঝতে পারছে। শুধু আমার মা না এই বাড়ির সবাই জানে কি হচ্ছে। শুধু আমিই জানি না। আমি নিশ্চিত চিলেকোঠার ঘরের ওই বেয়াদব লোকটাও জানেন। মঈনুল আংকেলও জানেন। শুধু আমাকেই বলা হচ্ছে না।

শুভ্র ভাই পাতের খাবার রেখে থমথমে মুখে বেরিয়ে গেলেন।

১৭.
বাড়ি ফিরে এসে দেখি পরিবেশ থমথমে। আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম। দুয়ার খোলার পর থেকে কোনো কাকপক্ষীও দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কি? তবে তার চেয়েও অবাকের বিষয় হলো নিস্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে মুঠোফোন টা চেচিয়ে জানান দিলো শুভ্র ভাই ফোন করেছে। আমি যারপরনাই হতবাক। বস্তুত শুভ্র ভাই আমাকে সচরাচর তো দূরে থাক কখনোই ফোন দেয় না। তারউপর ফোন ধরে সে বলছে,

‘বাড়ি পৌছেছিস।’

‘হুম।’

‘সোজা ঘরে ঢুকে রেস্ট কর।’

বলেই রেখে দিলো। আজব! এটুকু বলার জন্য ফোন দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো। দরজার সামনে দেখলাম ধ্রুব ভাইয়ের জুতা। সে কি এসেছে? ধ্রুব ভাই তো এসময়ে বাড়িতেই আসে না। নিজের ঘরে এসে দেখলাম স্নেহা চুপচাপ বসে আছে। গালে চোখের পানির একটা ধারা। আমি বিশেষ পাত্তা দিলাম না। তবুও আড়চোখে একটুখানি আহ্লাদ নিয়ে বললাম,

‘কি হয়েছে, বাবু?’

স্নেহা উত্তর দিলো না। আমার সকালের ঘটনা মনে পরলো। ছোট ছোট চোখে চেয়ে বললাম,

‘ছোট জেঠী মেরেছে নাকি?’

স্নেহা মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘ভাইয়ার না কি যেনো হয়েছে। মা অনেক কাদলো।’

আমার ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো। স্নেহার কাছাকাছি এসে বললাম,

‘তোর ভাইয়া কি এই মূহুর্তে তার ঘরে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেনো?’

‘জানি না। আসার পরেই জিনিসপত্র ভেঙে মার সাথে চিল্লাচিল্লি করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।’

স্নেহার কথা শুনে আমার চোয়াল ঝুলে পরলো। এ বাড়িতে কখন কি হচ্ছে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কাল উড়োভাবে বড় জেঠুর সাথে শুভ্র ভাইয়ের কথা কাটাকাটি শুনলাম। আজ আবার ধ্রুব ভাই? আমি কতক মিনিট বিষয়গুলো নিয়ে ভেবে উঠে দাড়ালাম। বস্তুত আমাকে কোনো কিছু নিয়ে অবগত করার আগ পর্যন্ত আমি সে বিষয় নিয়ে একদমই মাথা ঘামাই না। তবে এ বাড়িতে যে অনেক কিচ্ছু হচ্ছে এবং তা একমাত্র আমিই জানি না এ আমি ঢের বুঝতে পারছি।

ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আমি ছাদে গেলাম। ঘরের ভেতর কেমন ভুতের বাড়ি হয়ে আছে। দমবন্ধ লাগছে। ছাদের রেলিঙে বসে আমি শুভ্র ভাইকে ফোন দিলাম,

‘বল।’

‘সকালের ঘটনা কি তুমি ধ্রুব ভাইকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলে, শুভ্র ভাই?’

‘তুই খেয়েছিস?’

‘না। আমি তো কোনো কাকপক্ষীকে দেখছিই না। যে যার ঘরে দরজায় খিল মেরে আছে।’

‘তুই কোথায়? তোর ঘরে?’

‘না। ছাদে।’

‘রেলিঙে বসে আছিস?’

প্রশ্ন শুনে আমি চট করে রেলিং থেকে নিচে নেমে বললাম,

‘নাহ। আচ্ছা, আমি কি ধ্রুব ভাইয়ের ঘরে যাবো একবার?’

‘একবার কেনো একশবার যাবি। গিয়ে দেখ যদি একটা দুটো জিনিস তোর উপরেও ফিক্কা মারে।’

আমি চোখ উল্টালাম। শুভ্র ভাই কক্ষনো ভালো কথা বলতে পারে না। রাখছি বলে ফোন কেটে নিচে নামতে ধরেও কি মনে করে যেনো চিলেকোঠার ঘরের সামনে এলাম। দরজায় টুকা দিতেই লুঙ্গি পরনে সাদা গেঞ্জি গায়ে ঘুম ঘুম চোখে শুদ্ধ বেরিয়ে খুবই বিরক্তির গলায় বললেন,

‘তোমার কি কোনো কাজ নেই, তরু? ভরদুপুরে পেত্নীর মতো ঘুরাঘুরি করছো কেনো?’

তার এই পোশাক দেখলেই আমি রাঙা হয়ে যাই। তাই এইমুহূর্তেও আমি লজ্জায় চোখ নিচে নামিয়ে শুধালাম,

‘ঘুমাচ্ছিলেন?’

‘চোখটা মাত্রই লেগে এসেছিলো।’

‘সমস্যা নেই। এক আধবার আমার জন্য ঘুম ভাঙলে আর কি হবে?’

‘অনেক কিছু হবে। তুমি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নও।’

‘হতে কতক্ষণ?’

‘তুমি কি যাবে? নাকি তোমার মুখের উপর দরজা লাগাবো আমি?’

‘না একদম না। আমি যাবোও না। আপনি দরজাও লাগাবেন না। একটা কথা বলবো।’

‘বলো।’

‘আমার খিদে পেয়েছে।’

শুদ্ধ পূর্ণচোখে আমার দিকে চাইলো এবার। হালকা আওয়াজে বললো, ‘তুমি এখনো খাওনি?’

‘না।’

‘যাও গিয়ে খেয়ে নেও।’

‘কেউ নেই। সবাই সবার ঘরে।’

‘নিজে নিয়ে খাও।’

‘খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনার কাছে খাবো।’

‘তরু, আমি খুবই টায়ার্ড। অযথা কথা না বাড়িয়ে ঘরে যাও।’

‘কিসের টায়ার্ড আপনি? কাজেও তো যাননি। খাওয়াবেন কি না বলুন?’

শুদ্ধ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

‘দোলনায় বসো যাও।’

‘ভেতরে আসি?’

উনি দাঁত চেপে বললেন,

‘ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে তোমাকে ফেলে দেই। যাও মেয়ে।’

আমি বাধ্য মেয়ের মতো দোলনায় বসে পা দুলিয়ে গেলাম। একটুপর শুদ্ধ খাবার নিয়ে এলো। পরনে টাওজার। তাকে দেখে আকি মুখ টানা মারলাম। খাবারে আছে লাল শাক ভাজি, সজনার তরকারি। একটাও আমার খাওয়ার জিনিস না। তবুও আমার প্রিয় পুরুষের হাতের বিষ খেতেও আমি রাজি। আমি একটু আহ্লাদ নিয়ে বললাম,

‘খাইয়ে দেন না।’

উনি এমনভাবে চোখ পাকিয়ে তাকালেন আমার দিকে তা দেখেই আমার আত্মা ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে আবার সুরুৎ করে ফিরে এলো যখন উনি দোলনায় আমার পাশেই বসলেন। আমি খেতে খেতে বললাম,

‘জানেন, আমাদের বাড়িতে না কি জেনো হয়েছে? ধ্রুব ভাই আজকে নাকি জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে।’

শুদ্ধ খুব মনোযোগের সাথে শুনলো। কিন্তু অমনোযোগী হয়ে মৃদু গলায় উত্তর দিলো,

‘তাই?’

‘হ্যা। শুভ্র ভায়েরও জেঠুর সাথে কিছু নিয়ে তর্ক হয়েছে আই এম প্রিটি সিউর। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ওদের ঝগড়া হলেই মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়।’

শুদ্ধ আর কোনো উত্তর করলো না। বহু দূর নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে রইল। শুষ্ক বাতাসে ওর চুল এলো হলো। ফুল হাতা নেভিব্লু রঙের গেঞ্জির হাতা গুটানো। ফর্সা বাহু দুটো রোদে চিকচিক করছে। শুদ্ধ ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আপনমনে খাওয়া তরুর মুখের দিকে এক নিমিত্তে চেয়ে রইলো। হাওয়ায় হাওয়ায় যেনো ভেসে বেড়ালো,

‘যেই শহরে শুভ্র, ধ্রুবরা অবহেলিত। সেই শহরে শুদ্ধরা টিকে যেতে পারবে?’

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে