হেমন্তের নীড় পর্ব-৭+৮

0
8

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৭
১১.
শুভ্র ভাই হলেন লাউড এবং রুড। তার কোনো রাখঢাক নেই। তার মুখে যেটা আসবে সেটাই বলবেন। হাই ভোল্টেজের মেজাজের অধিকারী হওয়ায় বাড়ির বড়-ছোট সবাই একরকম তাকে কুর্নিশ করে চলে। তিনি খুবই পরিবারমুখী। তিনি চান তার পরিবার’টাকে সবসময় আগলে রাখতে। পারেন কি পারেন না সেই হিসেবে আমরা যাচ্ছি না। কিন্তু চেষ্টা তো করেন! যাই হোক আমার সমস্যা’টা এখানে না। আমার সমস্যা হলো আমার ব্যাপারে অন্য কারো যেকোনো হস্তক্ষেপ আমার একদম পছন্দ নয়। আমি আবার তার থেকে এক কদম লাউড বেশি কি না! এ সম্পর্কে বাড়িতে কড়া নোটিশ জারি করা রয়েছে তবুও শুভ্র ভাইয়ের এক ডিগ্রি বেশি মাতাব্বরি না করলে পেটের ভাত হজম হবে না।

আজ ড্রয়িংরুমেই আমি রাত ১০ টার দিকে শুভ্র ভাইকে পাকড়াও করে মেজাজ দেখিয়ে বললাম,

‘তোমার সমস্যা কি, শুভ্র ভাই?’

শুভ্র ভাই মাত্র কাজ থেকে ফিরলেন। তিনি তার সমস্যার কথা তো আমাকে অবগত করলেনই না বরং দিগুণ মেজাজে বললেন,

‘হু গেভ ইউ দ্য ডেয়ার? তুই কোন সাহসে আমার উপর মেজাজ দেখাস? এক থাপ্পরে সব দাঁত ফেলে দিবো।’

আমি থতমত খেয়ে বসলাম। বুঝতে পারলাম না কি করলাম। শুভ্র ভাইয়ার প্রশ্নে কি আর বলবো উল্টে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। বস্তুত, শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই রুড হলেও কখনো কঠিন অভিব্যক্তি নিয়ে আমাকে বকেনি। শুভ্র ভাইয়ের চিৎকারে বড় জেঠি এসে আমায় আগলিয়ে নিলেন। ওই যে আমি এ বাড়ির খুব আদরে বাদর হয়ে যাওয়া মেয়ে! শুভ্র ভাই আর কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আকস্মিক ধমকে আমার কেবল একটু মন খারাপ, বেশি কিছু নয়। দাদুভাই লাঠিতে ঠুকঠুক আওয়াজ তুলে পাশের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে আমার থুতনি ধরে নিচু মাথা উপর দিকে তুলতেই আমি ফিক করে হেসে দিলাম। দাদুভাই তবুও মুখ ভার করে জিজ্ঞাস করলেন,

‘মন খারাপ হয়েছে, দাদুভাই?’

আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম,

‘না দাদুভাই। দেখছো না আমি হাসছি। ওরা তো সবসময় বকে।’

‘না না। সব বকা এক হয় না। ওই বেটা কোথায় লুকালো? কোন সাহসে আমার দাদুভাইয়ের সাথে এমন আচরণ করলো?’

তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে শুভ্র ভাই চিল্লিয়ে উত্তর দিলো,

‘শুভ্র লুকায় না। একজনকে স্যরি বলে দিয়ো, দাদুভাই। আর আমার কাছে এসেও যেনো তার বেয়াদবির জন্য এপোলোজাইস করে যায়।’

আমিও এখান থেকে উচ্চস্বরে গলা ফাটিয়ে বললাম,

‘মরে গেলেও না। দাদুভাই, বলে দাও আমার এই ব্যবহারের যথেষ্ট কারণ ছিলো। তার ওই দুর্ব্যবহারের যথাপোযুক্ত কারন দেখাতে না পারলে স্যরি ইজ নট এক্সেপ্টেবল।’

‘কি হয়েছে, বল?’

এখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। শুভ্র ভাইয়া নিশ্চয়ই মাথাটা ঠান্ডা করে এসেছেন। কিন্তু এই ভ্যাপসা গরমে আমার মাথা যথেষ্ট গরম আছে। আমি বারান্দার বেতের চেয়ারে দুই পা উঠিয়ে ফোনের নোটপ্যাডে শুদ্ধ’র ছবি এড করে তার আজকের সমস্ত কীর্তিকালাপ লিখছিলাম। প্রত্যেকদিনই করি। শুভ্র ভাই এলেন। বসলেন। আমি লেখা শেষ করে তারপর তার দিকে তাকালাম। তিনি ভ্রু কুচকে আমাকে বললেন,

‘তোর টাইপিং বেশি ইম্পোর্টেন্ড?’

‘হ্যাঁ।’

আমার বেপরোয়া উত্তরে শুভ্র ভাই কোনো উত্তর দিলো না। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বারান্দার ফুল গাছ গুলো থেকে একটা অপরাজিতা ফুল ছিড়ে আরেকটা বেতের চেয়ারের উপর রাখলেন। আমি নাকের পাটাতন ফুলিয়ে চাইলাম,

‘ফুল ছিড়লে কেনো? কাল আমাকে তিন’টা ফুলের গাছ কিনে এনে দিবে।’

শুভ্র ভাই মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা।’

এবার আমি আসল কথা পাতলাম, ‘তুমি এতো রুড কেনো, শুভ্র ভাই?’

শুভ্র ভাই ভ্রু নাচালেন। বললেন, ‘তোকে ডিস্টার্ব করেছে রুড না হয়ে উপায় আছে।’

শুভ্র ভাইয়ের কথায় আমি বিন্দুমাত্র অবাক হলাম না। এ আমার ধারণাতে ছিলো যে, শুভ্র ভাই এই দেড় ঘন্টা ঘরে বসে ইনভেস্টিগেশন করে বের করে ফেলেছে আমার রাগের কারন। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর করলাম

‘মোটেও না। আমাকে সে ভালোবাসে, ডিস্টার্ব কখনোই করেনি। আমি তোমার কাছে এসে কখনো বিচার দেই নি।’

‘তুই না বললেই কি আমি জানবো না?’

‘তুমি ওর দুই গালে দুইটা করে চারটা থাপ্পড় মেরেছো। তোমার যে দানবের মতো হাত আর ওর ফর্সা গাল দুটোর আকর্ষণ ঘটে আমার উপর ব্লাস্ট হয়েছে।’

‘কেনো? ছেলেটা কি তোকে কিছু বলেছে?’

আমি চু শব্দ করে উঠলাম,

‘আহা! ছেলেটা হলো অতিভদ্র, আলাভোলা। এই বলদ চর খেয়ে আবার আমাকে জেরা করবে এই বুকের পাটা থাকলে তো পাল্টা চর একটা তুমিও খেয়ে আসতে। এমন একটা পেবা মার্কা ছেলেকে তুমি কি করে চারটে থাপ্পড় মারলে সেটাই ভাববার বিষয়। তোমার একটুও মায়া কাজ করলো না?’

‘না করলো না।’

‘ওর মা এসে আমাকে কত অপমান করেছে জানো?’

এই পর্যায়ে এসে শুভ্র ভাই সুর করে শিষ বাজিয়ে বিদ্রুপ করে বললো,

‘মাম্মা’স বয়! কীভাবে অপমান করলো তোকে?’

‘স্টপ বিহেভিং লাইক দ্যাট। যতটা না অপমানিত হয়েছি তার থেকে ছেলেটার জন্য আমার বেশি খারাপ লেগেছে। চর খেয়ে ছেলেটার ভয়ানক জ্বর!’

‘তাই নাকি? আমার হাতে তো ভালো জোর রে, তরু! আয়, একটা খেয়ে দেখ তো কত ডিগ্রি।’

আমি মুখ ভেঙিয়ে বললাম,

‘দানব একটা! ছেলেটার মা আমাকে বলেছে আমি নাকি ভাড়া করে গুন্ডা নিয়ে গিয়ে তার ছেলেকে পিটিয়ে গালের ছাল তুলে ফেলেছি। সে কর্তৃপক্ষকে বিচার দিবে। থানায় যাবে।’

শুভ্র ভাই পাত্তা না দিয়ে প্রাউড ফিল করে বললেন,

‘মরুক গিয়ে! বলিসনি ‘বেশ করেছি?’ তার ছেলে ওতো নাদান হলে আবার মেয়েদের প্রেমপত্র দেয় কীভাবে? আবার লিখে ‘প্রিয়তমা তরু, তুমি আমার প্রেমে না পরলে আমি রাস্তায় শুয়ে থাকবো। নাওয়া, খাওয়া, বাথরুম সব বাদ দিয়ে বসে থাকবো।’ মদনে বাথরুম পর্যন্ত লিখেছে। হোয়াট রাবিশ!’

আমি নিচুস্বরে বললাম,

‘ঠিকই তো লিখেছে। বাথরুমও মানুষের জীবনে আবশ্যক একটা বিষয়। তুমি বাথরুমে যাওয়া ছাড়া কয়দিন বাঁচবে?’

পরমুহূর্তেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,

‘ওয়েট, হোয়াট? আমি না থাকলে তুমি আমার রুম সার্চ করো, শুভ্র ভাই?’

শুভ্র ভাই দু’কানে দু’হাত চেপে ধরে বললেন,

‘না জেনে আরেকবার চিল্লালে তোর চাপায় আর একটা দাঁতও খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিঠি’টাকে আমি খুঁজিনি চিঠিটাই আমাকে খুঁজে নিয়েছে।’

আমাকে আর বলে দিতে হলো না চিঠিটা কীভাবে শুভ্র ভাইকে খুঁজে পেলো। চিঠির তো আর হাত পা নেই তাই না! শুভ্র ভাইয়ার ওয়ার্নিং কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমি একচোটে উঠে দাঁড়িয়ে আবারো চিল্লিয়ে উঠলাম,

‘স্নেহার বাচ্চা…..!’

স্নেহা আর আমি এক ঘরেই থাকি। কাজেই আমার ডাকে সে মাথা নিচু কিরে বারান্দায় এসে দাড়ালো। শুভ্র ভাই দাঁতে দাঁত চেপে আমার চুল টেনে ধরলো,

‘এই, তোকে আমি বলেছি স্নেহার নাম?’

আমি ব্যথা পেয়ে আরো জোরে চিল্লিয়ে উঠলাম,

‘আমাকে এসব বলে দিতে হয় না। আমি মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারি।’

‘ওরে বাপরে! তা একটা টিয়া পাখি কিনে মাজারের সামনে বসে যা না! দুই চার টাকাও ইনকাম করতে পারবি।’

আমি মুখ টানা মেরে বললাম,

‘হুহ! আমার ক্লাস এতোটাও নিচু নয়। আমাকে একটা উটপাখি কিনে দাও। আমি উটপাখি নিয়ে বসবো।’

স্নেহা বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,

‘হিহিহি। তার থেকে শুভ্র ভাইয়া আর ধ্রুব ভাইয়া কে নিয়ে বসে যাও। একদিনে দুই চার লাখও কামাতে পারবে। যা ড্যাশিং আমার ভাইয়ারা।’

স্নেহার কথায় আমি বমির ভান করলাম সাথে হাত বাড়িয়ে ওর গালে একটা থাপ্পড় দিলাম। বললাম,

‘ডোন্ট শো ইউর ডার্টি টিথ। ক্লোজ ইউর মাউথ।’

স্নেহা থাপ্পড় খেয়ে ঠোঁট ফুলালো। ফলস্বরূপ শুভ্র ভাই আরো জোরে আমার চুল টেনে ধরলেন,

‘তুই আমার বোনের গালে চর মারলি কোন সাহসে?’

আমি ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে বলে উঠলাম,

‘যেই সাহসে তুমি আমার চুল টেনে ধরেছো। আমিও তো তোমার বোন। ওর বেলায় ভালোবাসা আর আমার বেলায় নো নাথিং? শুধু ধমক আর মাইর?’

‘না। তুই আমার বোন নস।’

এই বলে শুভ্র ভাই তার হাত হালকা করলেন। ছাড়া পেয়ে আমি একটানে চুল ছাড়িয়ে হাতখোপা করলাম। ছোট ছোট চুল ললাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেপ্টে গেলো। শুভ্র ভাই খুব মনোযোগ নিয়ে আমার হাতখোপা করা দেখলেন। আমিও তার দিকে আগুন গরম চোখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি। তারপর কেবল-ই প্রশ্ন করতে যাবো, ‘তবে আমি তোমার কি?’ তার আগেই শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,

‘তুই একটা শাকচুন্নি।’

আমি নাকের পাটাতন ফুলিয়ে ফেললাম,

‘আমি কারোর শাক চুরি করিনি।’

স্নেহা আবার পেত্নী মতো হিহিহি করে দাঁত কেলিয়ে উঠলো। আমি ওর দিকে কড়া চোখে তাকালাম। শুভ্র ভাই চলে যেতে যেতে বললেন,

‘এই চুন্নির কাজ শুধু মানুষের হৃদয় চুরি করা। নইলে ওমন আলাভোলা ছেলেটাও তোর প্রেমে মগ্ন হয়? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব পরলো নাকি!’

চলবে

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৮
১২.
রৌদ্রময় সকাল! আমি বাবার সাথে দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির বড় গেটে। আমার দাদুভাই এর মান্দাতা আমলের গাড়ি’টি হেচকি তুলতে তুলতে এগিয়ে আসছে। আমি খুব কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে বাবার পাশে লক্ষী বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে আছি। হেচকি তুলতে তুলতে আসা গাড়িটির নাম হলো ‘বুলেট’। আমার দাদুর বাবার জীবনদ্দশার গাড়ি এটি। বাপের স্মৃতি মনের বেদনার বেড়ায় ধরে রাখতে চাওয়ায় আর দাদুর একগুঁয়ে স্বভাব এবং ত্যাড়ামির জন্য বাড়ির কেউ আর নতুন গাড়ির নাম মুখ থেকে উচ্চারণ করতে পারলো না। গলা পর্যন্ত এসে তা মৃত হয়ে সবাই ক্লান্তচিত্তে যে যার মতো বাইক কিনে চলাফেরা শুরু করলো। এ নিয়ে আমার দাদুর কোনো আফসোস নেই। তিনি নিত্যদিন সাবান থেকে শুরু করে নিজের থুতু পর্যন্ত দিয়ে গাড়ি ঝকঝকে তকতকে করতে করতে সবাইকে মূর্খের দল বলে গালিগালাজ করেন।

মঈনুল আংকেল খুবই আন্তরিকতার সহিত বললেন,

‘আবদুল, মামনিকে নিয়ে উঠো।’

মঈনুল আংকেল এ বাড়ির কেয়ারটেকার, ড্রাইভার, মালি, দারোয়ান। এক কথায় একের ভেতর সব। বাবা সহ আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। কিন্তু দেখা গেলো আমাদের গলধঃকরন করতে না পেরে বুলেট দুই তিনবার হেচকি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। আমি এবার রাগে হন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,

‘আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাবা। এই নকশা’র সাথে তুমি অফিস যাও। আমি রিক্সা করে চলে গেলাম।’

মঈনুল আংকেল আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার সহিত বললেন,

‘মামনি রাগ করো না। গাড়িটা একটু ধাক্কা দিলেই দেখবে ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে।’

আমার রাগের পারদ আরো বেড়ে গেলো। বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,

‘এখন কি আমি গিয়ে ধাক্কা দেবো?’

মঈনুল আংকেল আমাদের পরিবারের একজন। আমার বাপ-চাচার মতোই। তিনি অত্যধিক স্নেহের স্বরে কিছু বলার আগেই সেই স্থানে শুদ্ধ’র দেখা মিললো। ঠোঁট গোল করে শিস বাজাতে বাজাতে হাতে চাবির রিং ঘুরাতে ঘুরাতে তিনি চলছেন। আমি উনাকে দেখেই কি কারণে কে জানে একদম শান্ত হয়ে বসলাম। তখন কারণ না জানলেও এখন এসে বুঝতে পারছি আসলে শুদ্ধ’কে দেখে নয়, বাবা যে শুদ্ধকে একদম পছন্দ করতো না তাই আমি তাকে দেখে কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার শান্ত হওয়ার মাঝেই বাবা শুদ্ধ’কে অদ্ভুত সম্বোধন করে বললেন,

‘এই, চিলেকোঠার বেয়ারা ছেলে। কাম হেয়ার।’

শুদ্ধ এগিয়ে এলেন। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললেন,

‘আসসালামু আলাইকুম, আংকেল। নিড এনি হেল্প? ধাক্কা দেবো?’

শুদ্ধর কথা আমার বাবার সম্ভবত পছন্দ হলো না। আরো পছন্দ হলো না ওর দাঁত কেলিয়ে হাসি’টা। আরে বেটা সালাম পর্যন্ত ঠিক আছে আগ বাড়িয়ে খুচিয়ে তোর এতো কথা বলতে হবে কেনো? এরজন্যই তোকে আমার বাপ দেখতে পারে না তুই বুঝিস না? তরুর মন উত্তর দিলো, ‘আরে এই বেটা তো এইসব ইচ্ছেকরে করে। মহাপাজি লোক।’ বাবা কপালে ভাঁজ ফেলে চুপচাপ নিজ স্থানে বসে রইলেন। আমি গরমে হাঁসফাস করে উঠলাম। মঈনুল আংকেল অতি আন্তরিকতার সহিত বললেন,

‘শুদ্ধ বাবা। একটু সাহায্য করো। তরু মামনির দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

আমার দেরি হচ্ছে কি হচ্ছে না তাতে শুদ্ধ’র যে কোনো মাথা ব্যথা নেই তা আমার শিরা উপশিরা পর্যন্ত জানে। কিন্তু বিধিবাম! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এই ছেলে বুলেটের চেয়েও নকশাবাজ। সে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে আমার বাবাকে আবারো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

‘আংকেল, হেল্প লাগবে? আসলেই লাগবে?’

কথার ভাষ্য দেখো! মনে হচ্ছে ইহজগৎ এ ওর সাহায্য ছাড়া সবাই থমকে থাকবে। আমার বাবা নাক ফুলালেন। আমি তা দেখে সিটের সাথে খিচে বসে রইলাম। আজ যে কি হবে তা আল্লাহ জানেন! বাবার উত্তর দেওয়া না দেখে শুদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে একদিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,

‘আংকেল আপনি এক থেকে পাঁচ গুণুন আর এই চিলেকোঠার বেয়ারা ছেলের শক্তি দেখুন। কীভাবে আপনাকে আর আপনার মেয়েকে নাড়িয়ে দেয়!’

বলেই নিজের মাসেল দেখিয়ে শুদ্ধ পেছনে চলে গেলো। আমার বাবার নাক ফুলে আগের চেয়ে তিনগুণ হলো। যেকোনো সময় ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সত্যি সত্যি পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় গাড়ি স্টার্ট নিলো। মঈনুল আংকেল উইন্ডো দিয়ে মাথা বের করে শুদ্ধকে দুই আঙ্গুল দিয়ে হ্যাটস অফ দেখিয়ে গাড়ি টানলেন।

১৩.
আমার ক্লাস শেষ হলো সাড়ে বারোটায়। বের হয়ে এসে দেখি শুদ্ধ দাঁড়িয়ে। আমি অবাকতার শীর্ষে চলে গেলাম। বোয়াল মাছের মতো মুখটা হা হয়ে গেলো। চোয়াল ঝুলে পরার যোগাড়। শুদ্ধ আমাকে নিতে আমার ভার্সিটি এসেছে? দু’চোখ আমাকে এই দিনও দেখালো? আমি থমথম পায়ে আশ্চর্য নিয়ে তার চোখের সামনে হাজির হয়ে তাকেও আশ্চর্য করে দিয়ে বললাম,

‘ওহ মাই গড! আমি কি দেখছি এসব?’

শুদ্ধ ভ্রু কুচকালো। পাত্তাহীন গলায় বললো,

‘কি দেখছো?’

‘আপনি আমাকে নিতে এসেছেন?’

আমার কথা শুনে শুদ্ধ যেনো আমার থেকে আরো চারগুণ বিস্মিত হলো। দুই গালে হাত রেখে অবাকতার ভঙ্গি করে বললো,

‘ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।’

পরক্ষণেই ধমক দিয়ে বললো,

‘তোমার কি মনে হয় আমার আর কাজ নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি? রোদ মাথায় নিয়ে এখানে তোমাকে নিতে এসেছি?’

অপমানে আর মন চুরমারের শব্দে আমার মুখটা চুপসে গেলো। আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘তাহলে কেনো এসেছেন?’

‘তোমাকে বলতে হবে?’

‘না বললে বুঝবো আমাকে নিতেই এসেছেন। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আই ডোন্ট মাইন্ড! আমার আবার একটু লজ্জা সরম কম।’

এই বলেই আমি তার বাইকের পেছনে চরে বসে তার কাধে হাত রাখলাম। সে সেকেন্ড দশেক সময় নিলো বিষয়টা বুঝতে। এরপর তার কাধ থেকে আমার হাত ঝারি দিয়ে ফেলে ধমকে ধমকে আমার কানের বারোটা বাজিয়ে দিলো,

‘এই ফাজিল মেয়ে। নামো তাড়াতাড়ি। তোমার বাবা নিজের মেয়ে রেখে আমাকে বেয়ারা ছেলে ডাকে কোন আক্কেলে? আজই গিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করবে। আর বলবে এখন থেকে যেনো তোমাকে নির্লজ্জ ডাকে।’

আমি কানের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দুই সেকেন্ড খুচানোর ভান করে হাসিমুখে বললাম,

‘বাবার হয়ে আপনি ডাকুন। আমি কিছুই মনে করবো না।’

উনি দিলেন আমাকে আরেক রাম ধমক,

‘এই মূহুর্তে নামবে তুমি। জলদি। নাহলে একটা আছাড় দেবো। আমি এক থেকে তিন গুনবো। এক……. দুই……….

‘নামছি নামছি। অভদ্র মানুষ একটা!’

‘আমি অভদ্র? নাকি বলা নেই কয়া নেই হুট করে অন্যের বাইক চেপে বসা তুমি অভদ্র?’

‘অন্যের বাইকে তো বসিনি। আমি আপনার বাইকে বসেছি।’

আমার কথার মাঝেই একজন এসে শুদ্ধকে প্রায় হাজার পনেরো টাকা দিয়ে গেলো। টাকা গুণে মানিব্যাগে রেখে শুদ্ধ বললো,

‘একজনের কাছে ধার পাই। সেই টাকা নিতে এসেছিলাম। মাসের এক তারিখ হতে না হতেই তো তোমার দাদু আবার ভাড়া ভাড়া করে আমার মগজ চিবিয়ে খাবে। আজব এক বাড়িতে উঠেছি। রাতদিন বুড়ো থেকে ছুরি সবাই আমার মগজ চিবিয়ে খাচ্ছে। আমার মগজের যে কতই টেস্ট…! উফফ!’

উনার কথায় আমি মুখ টানা মারলাম। শুদ্ধকে পছন্দ করে না বলেই তো দাদু মাসের এক তারিখ হতে না হতেই ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল শুরু করে। পাঁচ তারিখে মধ্যে ভাড়া দেওয়া শুদ্ধর জন্য ফরজ। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,

‘যেই কাজেই আসুন। তাই বলে আপনি এই রাস্তায় আমাকে ধমকে আপনার বাইক থেকে নামিয়ে দেবেন? আমি বসলে কি আপনার গাড়িতে ফোসকা পরবে?’

‘অবশ্যই।’

‘আমি আজ বুঝতে পারছি কেনো আমার বাবা আপনাকে পছন্দ করে না। আপনার কথার ধরনের যে ছিরি!’

‘শুনো মেয়ে, তোমার বাবার পছন্দে অপছন্দে আমার কোনো যায় আসে না।’

‘কিন্তু আমার আসে।’

শুদ্ধ সেকেন্ড কতক থামলো। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার ব্যর্থ শ্বাস ফেলে মলিন স্থির কণ্ঠে বললো,

‘সুরম্য মসৃণ মেঠোপথের ক্ষেত্রপতি তুমি। দূর্গম কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দেওয়ায় কেনো এতো পক্ষপাত তোমার?’

আমি তার প্রশ্নের উত্তর দেবো তার আগেই হাওয়ায় ভেসে এলো ধ্রুব ভাইয়ের কণ্ঠস্বর,

‘তরু…। এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’

বলে ধ্রুব ভাই নিজের বাইক ছেড়ে নেমে আমার পাশে এসে দাড়ালো। জোরপূর্বক হেসে শুদ্ধর সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো,

‘ভাইয়ের এখানে কি কাজ?’

‘এইতো তেমন কিছুনা। একজনের থেকে টাকা পেতাম সেটাই নিতে এসেছিলাম।’

‘ওহ আচ্ছা।’

ধ্রুব ভাই আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে খপ করে আমার হাতটা ধরলো। আমি চমকে উঠলাম। ধ্রুব ভাইয়ের বোধ হয় এই একটাই কাজ। হাত মুচড়ে ছাড়াতে গেলেই ধ্রুব ভাই ব্যস্ততার সহিত বললেন,

‘আসি তাহলে।’

বলে আমাকে টানতে টানতে বাইকে উঠালেন। অদূরে শুদ্ধ মৃদু হাসলো। বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বিরবির করলো,

‘তোমার অপেক্ষায় তারা অথচ তুমি চেয়ে দেখো না। কাঠবেলী, আমার পেছন ঘুরো না।’

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে