দূরত্বের আড়ালে পর্ব-০২

0
29

#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_২
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন

বাড়ি ফেরার পর থেকে অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে প্রণীতা। যন্ত্রণার অনলে তার হৃদয় পুড়ে ছারখার হচ্ছে। একটা মানুষকে ভালোবেসে সে আর কতো কষ্ট পাবে? আর কতো তীব্র বেদনা মনে পুষবে? আজ বাবা-মায়ের সাথে বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছিল মন ভালো রাখার উদ্দেশ্যে। অথচ ভাগ্যের কী অদ্ভুত লীলা! তাকে ফিরতে হলো একটি চূর্ণবিচূর্ণ মন নিয়ে,রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে।

সহসা সে মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব করলো। এই স্পর্শটা তার খুব চেনা,খুবই মমতাময়ী একটি স্পর্শ। সে বালিশ থেকে মাথা তুলে মুখ ঘুরিয়ে অস্ফুটস্বরে ডাকলো,“মা!”

হাফিজা কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে ভাঙা গলায় বললেন,“আসার পর থেকে কিচ্ছু খাসনি। এবার একটু খেয়ে নে।”

প্রণীতা হাফিজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর মায়ের বুকে মাথা রেখে বলতে থাকে,“খেতে মন চাচ্ছে না,মা। আমার গলা দিয়ে যে এখন এক বিন্দু খাবারও নামবে না।”

-“একজনকে মনে করে আর কতো কষ্ট পাবি তুই? আমাকে বোঝা তো? ছেলেটাকে তুই এতো ভালোবাসলি কিন্তু বিনিময়ে কী পেলি? অবহেলা,কষ্ট,বেদনা এসব ছাড়া তুই কিছু পেয়েছিস? তিনবছর আগে যখন বাইরের দেশে গেলো তখনও তোকে কিছু জানায়নি,তোর সাথে এই তিনবছরে একটা বারের জন্যও যোগাযোগ করেনি। আর এখন যখন দেশে ফিরলো তখন তোকে চিনলোই না। তাহলে তুই-ই বল এই ছেলে তোকে আদৌ ভালোবেসেছিল? তোর মনে হয়না ছেলেটা তোর সাথে বিশ্বামঘাতকতা করেছে?”

প্রণীতা নিশ্চুপ। সে খুব মনোযোগের সহিত মায়ের কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু এটা বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে যে ফারাজ তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেনি। সেই তিনবছর আগে ফারাজের চোখ দেখে তা মনে হয়নি। মনে হয়নি সেই চোখদুটোতে ভালোবাসার বদলে বিশ্বাসঘাতকতা ছিল। ফারাজের বলা এক একটি প্রেমময় কথা,সেই আবেগঘন মুহূর্তগুলো যে মিথ্যা হবে তা তো সে কখনো কল্পনাতেও আনেনি। প্রণীতার মাঝে যা ছিল তার সবটুকুই ছিল বিশ্বাস,ভরসা আর ভালোবাসা। এই অনুভূতিগুলোকে আকড়ে ধরেই সে তিনটি বছর কাটিয়েছে। প্রতিটা ক্ষণ কেটেছে তার ফারাজের অপেক্ষায়। মনে হলো মানুষটা এই বুঝি তার কাছে চলে এলো,তাকে এসে জড়িয়ে ধরে বুকে আগলে নিলো। কিন্তু সেই যখন ফিরলো তখন তার প্রেমিক পুরুষের জীবনে তার আর কোনো অস্তিত্ব থাকলো না। হাফিজা প্রণীতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,“আয়,খেয়ে নে।”

-“মা,এখন খাবো না। আমাকে একটু তোমার বুকে থাকতে দাও।”

-“দেখ,তুই যদি এখনো সেই ছেলেটাকে মনে করে কষ্ট পাস,আর ফলস্বরূপ নিজেকে না খেয়ে,না ঘুমিয়ে খালি কেঁদে কেঁদে কষ্ট দিস তাহলে তুই আমার আর তোর বাবার মরা মুখ দেখবি। এখন তুই ভেবে দেখ তোর জীবনে কার গুরুত্ব বেশি।”

-“মা! এসব কী বলছো তুমি?”

প্রণীতা আশ্চর্যের সহিত মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে। চোখেমুখে অঢেল বেদনার ছাপ। হাফিজা নিজের থেকে প্রণীতাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কঠোর গলায় বললেন,“তোর বাবারও একই কথা। তুই আর এখন ছোট নস যে তোর ভালোমন্দ বুঝার বয়স হয়নি। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। বিবেক দিয়ে ভাবতে শিখ।”

শেষ কথাটায় দাঁড়ি টেনে তিনি রুম ত্যাগ করেন। তিনি এতো চড়াও হয়ে কথাগুলো বলতে চাননি কিন্তু এছাড়াও যে কোনো উপায় নেই। চোখের সামনে মেয়েটা না খেয়ে আছে,কষ্টে গুমরে মরছে। একজন মা হয়ে কীভাবে সন্তানের এই কষ্ট সহ্য করবেন তিনি? একটামাত্র মেয়ে উনার,হীরের মানিক সে। সেই হীরের মানিকের বিন্দুমাত্র কষ্টও যে তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রার্থনা করলেন,“হে আমার রব,আমার মেয়েটার জীবনের সমস্ত দুঃখ,কষ্ট তুমি দূর করে দাও। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে,আর কতো কষ্ট পাবে সে? তাকে তুমি সুখের ঠিকানা দেখাও। সমস্ত বেদনা তুমি দূর করে দাও।”

প্রণীতা ফের বালিশে মুখ গুঁজে দিল। কান্নারত কণ্ঠে বলল,“মা,তুমি এভাবে বলতে পারলে আমায়? আমার কষ্টটা একটু বোঝার চেষ্টা করলে না?”

একসময় প্রণীতা এই অবস্থায় নিদ্রার দেশে পাড়ি জমায়। মানসিক অবসাদগ্রস্ততার সাথে শারীরিকভাবেও সে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেল টেরই পেলো না সে। এভাবে কাটল কিছুক্ষণ। মাঝে ইসহাক,হাফিজা খাওয়ার জন্য ডাকতে এলে মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আর ডাকেননি।

-“যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছে,
দুঃখের পরই সুখ আসে।
কষ্ট তোমার কেউ নাই বা বুঝুক,
আল্লাহ কিন্তু ঠিকই বুঝে।”

কেমন একটা ধোঁয়াশাময় পরিবেশ। অস্পষ্টতায় মিইয়ে যাচ্ছে সব। চারিদিকের প্রশান্তিময় হাওয়ায় জুড়াচ্ছে দেহমন। অকস্মাৎ একটি অপরিচিত কণ্ঠে ভেসে আসে উপরোক্ত বাক্যগুলো। প্রণীতা এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই মানুষটিকে খোঁজার প্রয়াস চালায়। তখনই সে দেখতে পায় সামনের দিকে এই ধোঁয়াশায় কেউ ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে,আর বাক্যগুলোর পুনরাবৃত্তি করছে। প্রণীতা তৎক্ষনাৎ লোকটির পিছু নেয়। যতোই সামনের দিকে সে পা বাড়াচ্ছে,ততোই যেন লোকটি ধোঁয়াশায় হারিয়ে যাচ্ছে। লোকটির আবছা অবয়ব ব্যতীত সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শেষে সে চিৎকার করে বলল,“কে আপনি?”

প্রণীতা ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে। শরীর তরতর করে ঘামছে। তার মানে সে এতোক্ষণ স্বপ্নে বিভোর ছিল। মাথায় এখনো লোকটির বলা সেই চারটি লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে বাক্যগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। নাহলে হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখার কী মানে? সে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে। অতঃপর ভাবতে থাকে,আমাদের দুঃখ আল্লাহ ব্যতীত কেই বা ভালো বুঝতে পারে? আমরা যখন একাকীত্বে ভুগি তখন তো মহান পাক রাব্বুল আলামিনই হয় আমাদের সাথী। তিনি সর্বদায় আমাদের সাথে আছেন,থাকবেন। সে ভাবলো,এই উছিলায় দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা যাক। ভাবনা অনুযায়ী বিছানা ছেড়ে সে ওযু করে আসে। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
নামাজ আদায় করার পর এখন কেমন শান্তি শান্তি লাগছে তার। স্বপ্নে শোনা সেই চারটি বাক্যের মর্মার্থ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো সে। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। এমনটা নয় যে,প্রণীতার কেউ নেই। তার তো বাবা আছে,মা আছে তবুও জীবনে কেমন একটা শূণ্যতা তৈরি হয়েছিল,মনে হয়েছিল জীবনে কী যেন নেই। তবে এখন আর তেমন লাগছে না। আল্লাহ তো আছে। এতোক্ষণ পর্যন্ত চিন্তাভাবনায় নিজেকে শেষ করার যে কৌশলগুলো রপ্ত করেছিল সেগুলো এখন আবর্জনার মতো মাথা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। একজন বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার মূল্যবান জীবন নষ্ট করবে সে? এটা কখনোই সম্ভব নয়। বাবা,ঠিকই বলেছে বিশ্বাসঘাতককে মনে করে সে আর কষ্ট পাবে না। সে ও দেখিয়ে দিবে ফারাজকে ছাড়া প্রণীতা ভালো থাকতে পারে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে উঠলো,“তুমি আমার নাম ভুলে গেলে আমি পুরো তুমিটাকেই ভুলে যাবো। আর যদি আমায় সম্পূর্ণরূপেই ভুলে যাও তাহলে আমার জীবনে তোমারও কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।”

এটুকু বলে থামলো সে। মনের কষ্ট ছাপিয়ে ভালোবাসার সাথেই যুদ্ধ করতে হবে। খুব কষ্ট হবে,কলিজা ছিঁড়ে যাবে তবুও সে ফারাজকে ভুলার চেষ্টা করবে। সে ফের বলল,“তুমি এতোদিন আমার নরম সত্তাটাই দেখলে যেটা ভালোবাসা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল কিন্তু এখন দেখবে তোমার প্রতি এক আকাশসম ঘৃণায় পরিপূর্ণ একটি নতুন সত্তা।”

প্রণীতা কিছুক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ সে বাবা-মার ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পায়। তন্মধ্যে কিছুকথা তার কানের কাছে এসে বারি খায়।

-“আমার মনে হয়,এখন মেয়েটাকে এসব বলা ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ আগেও আমি গিয়ে ওর যা অবস্থা দেখলাম তাতে মনে হয় না সে কোনোদিন ওই ছেলেকে ভুলতে পারবে।”

-“কিন্তু এভাবে সে আর কতোদিন থাকবে? আমি বাবা হয়ে ওর এমন কষ্ট আর সহ্য করতে পারব না। চলো,এখন।”

-“বলছি কি আর কয়েকটাদিন যাক…

-“চুপ করো তুমি। এখন চলো। গিয়ে দেখি ঘুম থেকে উঠেছে কিনা।”

মিনিট কয়েকের মাঝেই তারা রুমে প্রবেশ করে। প্রণীতাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে তারা যেন খুশিই হলো। প্রণীতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে তাদেন। কী বলতে চাইছে তারা? ইসহাক হাসিমুখে এগিয়ে এসে প্রণীতার মাথায় হাত বুলান। স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বলেন,“ঘুম থেকে উঠে পড়েছিস,মা? বোস এখানে।”

প্রণীতা বিছানায় বসলো। তার একপাশে বসে ইসহাক অপরপাশে হাফিজা। ইসহাক কিছুক্ষণ চুপ থেকে গলা ঝেড়ে বলতে লাগল,“দেখ মা,মানুষ মাত্রই ভুল। আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। জীবনে ছোটবড় অনেক ভুলই করে থাকি আমরা। তেমনই ধরে নে,ফারাজকে ভালোবাসা তোর জীবনের একটা ভুল। তো এখন সেই ভুলটাকে শুধরে নেওয়াটাই উত্তম কাজ তাই না বল?”

প্রণীতা কিছু না বলে মাথা নাড়ায়। সেদিক চেয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে হাসেন তিনি। তারপর কিছুটা রয়েসয়ে বললেন,“জানি না তুই এখন বিষয়টাকে কীভাবে নিবি কিন্তু তোর ভালোর জন্যই বলছি,তুই ফারাজকে ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে সব শুরু কর। তোর পুরো জীবনটাই তো পড়ে রয়েছে। তোরও তো একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। আর কতোদিন ওই বিশ্বাসঘাতককে মনে করে কষ্ট পাবি? তাই বলছি কি,আমরা না তোর জন্য একজন ছেলেকে পছন্দ করেছি। না,মানে তুই চাইলে ছেলেটার সাথে আগে দেখা করে কথা বলতে পারিস। ওইযে তোর রহমান চাচা আছে না? তার ছেলে আহিয়ান। ছেলেটা না বড্ড ভালো। তাকে বিয়ে করলে তুই সুখী হবি,মা।”

এই বলে ইসহাক দম ছাড়লেন। এখন শুধু মেয়ের প্রতিক্রিয়া দেখার পালা। হাফিজা বললেন,“মা,তুই কি রাজি? দেখ তোকে আমরা জোর করছি না। তোর ইচ্ছে অনুযায়ী সব হবে। তুই চাইলে সময় নিতে পারিস।”

প্রণীতা এতোক্ষণে মূল বিষয় বুঝতে সক্ষম হলো। তার মা-বাবা তাহলে এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিল? মা-বাবার দিক থেকে চিন্তা করলে বিষয়টাই যৌক্তিকতা আছে। কোনো বাবা-মা তার সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সন্তান কীভাবে সুখে থাকবে সেই ভাবনায় মত্ত থাকে। তার বাবা-মাও তো তার সুখের কথাই ভাবছে। সে কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে। তারপর তাদেরকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠে,“আমি রাজি।”

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে