তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
6

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
শেষপর্ব
মাহবুবা বিথী

অনেক দ্বিধা থাকা সত্বেও যুবরাজ সুজানাকে সানজানা ভেবে সংসার করে যাচ্ছে। সুজানাও আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে যুবরাজকে সুখী করতে। সে কারণে যুবরাজও সবকিছুতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর মাঝে জীবনের ন’মাস সময় গড়িয়ে গিয়েছে। সুজানা কনসিভ করেছে। ওদের বেবির আটমাস সময় পার হয়েছে। শুরু থেকেই সুজানার প্রচন্ড বমি হতো । সে কারনে দুবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে স্যালাইন দিতে হয়েছে। শারীরিক কন্ডিশন খুব খারাপ থাকাতে ডাক্তার যুবরাজকে বলেছে, ওকে যেন কোনো প্রকার মানসিক চাপ দেওয়া না হয়। এতে মা এবং বাচ্চার জীবনহানির শঙ্কা দেখা দিতে পারে। সে কারনে সুজানাকে নিয়ে অনেক অসঙ্গতি দেখা দিলেও ও চুপ থাকতে বাধ্য হয়। এর মাঝে ওর ফ্রেন্ড মেহদি ফোন করে ওকে বলে,
—সানজানা ইউকে তে গেল তোরা একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?
কথাটা শুনে যুবরাজ যেন বিষম খেলো। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকলো। ওর নিরবতায় মেহদি মজা করে বললো,
—-সমস্যা নাই। এই কারনে তোর কাছে ট্রিট চাইবো না। এতো টেনশন করিস না।
যুবরাজ নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো,
—-আসলে অনেক তাড়াহুড়া ছিলো সে কারনে তোদের সবাইকে বলে যেতে পারেনি।
—-তোদের বিয়ের পরপর চলে গিয়েছে?
—-হুম, তুই কোথা থেকে খবর পাইলি?
—-তুই তো জানিস ও আর আমি একই স্যারের আন্ডারে থিসিস জমা দিয়েছি। গতকাল স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানেই শুনলাম।
—আচ্ছা,আমার একটু ব্যস্ততা আছে দোস্ত। এখন রাখছি পরে কথা হবে।
ফোনটা রেখে অফিসে ও কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। ভাবছে ওর সাথে এটা কি হলো? কেন সানজানা ওর বোনকে ওর কাছে গছিয়ে দিয়ে এভাবে প্রতারণা করলো। কি এমন কারণ ছিলো যার কারনে ওকে এইভাবে ফেলে রেখে চলে গেল। মনে মনে ও সুজানার উপরও খুব রেগে গেল। ঐ বা কেন এতোদিন ধরে ওর সাথে সানজানার অভিনয় করলো? ওকে এভাবে থম মেরে বসে থাকতে দেখে ওর এক কলিগ আকিব চৌধুরী কাছে এসে বললেন,
—- এভাবে মুখ ভার করে বসে আছেন কেন? ভাবির জন্য খুব টেনশন হচ্ছে।
আকিব চৌধুরীর ডাকে ভাবনার অতল থেকে যুবরাজ ফিরে এসে বললো,
—-টেনশন কিছুটা হয় বৈকি! ওর শরীরটা খুব একটা ভালো থাকে না। কনসিভ করার কারনে কিছু কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে।
এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে ওর মা ফোন দিয়েছে। এই অসময়ে ওর মায়ের ফোন দেখে অবাক হলো। সুজানার শরীর আবার খারাপ করলো নাকি? চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে বললো,
—-আম্মু তুমি হঠাৎ এ সময়ে ফোন দিলে?
—সানজানা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমরা ওকে নিয়ে ইউনাইটেট হাসপাতালে যাচ্ছি। তুইও চলে আয়।
ফোনটা রেখেই বসের কাছে ছুটি নিয়ে যুবরাজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। হাসপাতালে পৌঁছাতে ওর দুপুর দুটো বেজে যায়। সুজানাকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয়েছে। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত বমির কারনে ওর এমনটা হয়েছে। তখনও ওর জ্ঞান ফিরে আসেনি। এর মাঝে সুজানার বাবা মা চলে আসে। ওদিকে যুবরাজের বাবা মায়ের লাঞ্চ করা হয়নি। লাঞ্চ করার পর দুজনেরই প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে। এসব নানাবিধ কারনে যুবরাজ ওর বাবা মাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তাছাড়া সানজানার বিষয়ে কথা বলার এটাই একটা বড় সুযোগ। ওর বাবা মা চলে যাবার পর যুবরাজের শ্বশুর ওর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে,
—-সানজানার জ্ঞান ফিরেছে বাবা?
যুবরাজ ওর শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললো,
—সানজানার তো জ্ঞান হারায়নি তো ফেরার কথা উঠছে কেন?
—-আমি বুঝতে পারছি বাবা তুমি মানসিকভাবে একদম ভালো নেই। সে কারনে তোমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। এতো চিন্তা করো না। সানজানা ঠিক সামলে উঠবে।
—-আপনার এই বয়সে মিথ্যা বলা উচিত না। কেন আপনারা আমার সাথে এমন খেলা খেললেন? আর সানজানাই বা কোন অধিকারে আমার ভালোবাসাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমাকে যদি গ্রহন নাই বা করবে তবে আমাকে স্বপ্ন দেখালো কেন? কি দোষ ছিলো আমার? যার কারনে আমাকে এভাবে ঠকালো।
সানজানার মা যুবরাজের মুখে এই কথাগুলো শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-ও তোমাকে ঠকায়নি বাবা। বরং ওর ভাগ্য ওকে ঠকিয়েছে।
—-শুধু শুধু ভাগ্যের ঘাড়ে দোষ দিবেন না মা। মানুষ যখন কোনো কারনের অজুহাত খোঁজে তখন খুব সহজে ভাগ্যের উপর চাপিয়ে দেয়। সত্যি বলতে কি যে মানুষটাকে ঘিরে আমি আমার পৃথিবীটা গড়তে চেয়েছি অথচ আমি কোনোদিনই তার পৃথিবীর অংশ ছিলাম না। সেকারনে বিনা দ্বিধায় সে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছে। মানুষের অনুভূতীগুলো কোনো ছেলে খেলা নয়। অথচ সানাজানার কাছে আমার অনুভূতীগুলো ছেলেখেলায় রুপান্তরিত হলো। আমি তো ওর জীবন সঙ্গিনী হতে চেয়েছিলাম অথচ ও আমাকে ওর জীবনের অংশ হতে দিলো না। ওর ভালোবাসাকে যতটা খাঁটি আমি ভেবেছিলাম বাস্তবিক অর্থে ততটা খাঁটি ছিলো না। সে কারনে এতো সহজে ভেঙ্গে গেল।
এবার সানজানার বাবাও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—তুমি এভাবে আমার মেয়েটাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিও না। আগে ওর জীবনের ঘটনাগুলো শুনো তারপর তুমি এর বিচার বিবেচনা করবে। আমার মেয়েটা পরিপূর্ণ নারী ছিলো না। জন্মগতভাবে ও ত্রুটিযুক্ত।আরো সহজ করে বলতে গেলে ও একজন হিঁজড়া। ওর ধারণা ওর শারীরিক অপূর্ণতার কারনে তুমি কখনও সুখী হবে না। সেকারনে সেদিন ওভাবে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো।
যুবরাজ ওর শ্বশুরের মুখে একথা শুনে বললো,
—-এখানে তো ওর কোনো দোষ নেই। তাছাড়া আমি ওকে শরীর দেখে ভালোবাসেনি। প্রতিটি মানুষের বায়োলজিক্যাল নিড থাকে। কিন্তু সেটা জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হতে পারে না।
—কিন্তু তুমি আবেগের বশবর্তী হয়ে আজ এই কথাগুলো বলছো। কিন্তু একটা সময় পর আবেগ যখন ফুরিয়ে যাবে তখন বাস্তবতা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে। তখন তুমি তাকে অস্বীকার করতে পারবে না।
—-বুঝলাম মা আপনার কথায় যুক্তি আছে। তবে আমার কথা হচ্ছে শরীর দেখে যে ভালোবাসা হয় সেটাকে ভালোবাসা বলে না। সেটা হলো লালসা।
এমন সময় ডাক্তার এসে বললো,
—-এখানে পেশেন্ট সানজানার কে আছেন?
যুবরাজ দৌড়ে এসে বললো,
—আমি পেশেন্টের স্বামী। আমার পেশেন্ট কেমন আছে?
—খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। ওর প্রিক্লাম্পশিয়া দেখা দিয়েছে। ওর অতিসত্বর সিজার করতে হবে। তা,নাহলে বাচ্চা এবং মায়ের জীবন হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। আপনাকে বন্ড সই দিতে হবে। এরপর পেশেন্টকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে। হাতে সময় খুব কম। আপনাকে এখুনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় যুবরাজ যেন খেই হারিয়ে ফেললো। ডাক্তারের কথায় রোবটের মতো পেপারসগুলোতে সই করে গেল। সুজানাকে ওটিতে নেওয়ার সময় যুবরাজ সুজানা বলে ডাকে। সাথে সাথে সুজানার চোখের পাতাটা নড়ে উঠে। দুচোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা পানি দুচোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সুজানার বিষাদমাখা মুখটা দেখে যুবরাজের বুকের ভেতরটা ব্যথায় মুঁচড়াতে থাকে। ও মনে মনে ভাবে সুজানা এই বিপদ পার হয়ে যখন ওর কাছে ফিরে আসবে তখন যুবরাজ ওর সমস্ত সত্তা দিয়ে ওকে ভালোবাসবে। যে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে তার কথা ও আর কখনও ভাববে না। কারণ ও কখনও যুবরাজের ছিলো না।

আলো ঝলমল নগরী লন্ডন। এর বুকচিরে এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে রাজপথ। তার পাশে রেলপথ। হুসহাঁস করে কখনও বাস যাচ্ছে আবার কখনও বা ট্রেন যাচ্ছে। শহরের বড় বড় হাইরাইস বিল্ডিংগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর রাতেও এই শহরে ব্যস্ততার শেষ নেই। রবিবার হওয়াতে শহরের দামী পানশালাগুলোতে উপচে পড়া ভীড়। হালকা মেজাজে মিউজিক বেজে চলেছে। এখন সময়টা সামারের। কিছু মানুষ ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেও কেউ কেউ শরীরটাকে গরম করতে পানশালাতে চলে এসেছে। স্বল্পবসনা কিছু তরুনী অ্যালকোহলের পেয়ালা হাতে শরীরি বিভঙ্গে পানশালার পরিবেশটাকে মাদকতায় ভরিয়ে রাখছে। পাশের রেস্তোরায় বসে সানজানা এই দৃশ্যগুলো দেখে নিজের কষ্টগুলোকে ভুলে থাকতে চাইছে।
সানজানা ভাবছে মানুষের ভালোবাসার ক্ষেত্রে শারীরিক চাহিদা কি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নাকি ওর এটা ভুল ধারণা?কিন্তি এটাও তো সত্যি সানজানা কখনও যুবরাজকে নারীত্বের কাঙ্খিত সুখ দিতে পারবে না সে কারনে ও নিজ থেকেই যুবরাজের জীবন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ওর জীবন যতই পরিহাসের স্বীকার হোক কিন্তু ও সেই পরিহাসের কাছে হার মানেনি। বরং নিজেকে যুবরাজের জীবন থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের মতো বাঁচতে শিখে গেছে।এটা ভেবে সানজানা খুব প্রশান্তি অনুভব করে।

সুজানার শারীরিক কন্ডিশন ভালো না। খবরটা জানার পর থেকে ও খুব অস্থিরতায় ভুগছে। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ পর ওর ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা ফোন দিয়েছে। কম্পিত হাতে ফোনটা রিসিভ করে বলে,
—-আব্বু সুজানা কেমন আছে?
আশরাফ চৌধুরী সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
—-সুজানার একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে।
—বাবা, সুজানা কেমন আছে?
—-সুজানা আর বেঁচে নাইরে মা।
একথা বলে আশরাফ চৌধুরী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
সানজানা ফোন রেখে আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে টিকিট কেটে দেশের পথে পা বাড়ায়। যদিও ও জানে সুজানাকে দেখতে পাবে না তারপরও ওর মনে হয় এই সময়টায় ওর বাবা মায়ের পাশে ওর থাকা উচিত। তাছাড়া যুবরাজ বাচ্চাটা কিভাবে সামলাচ্ছে কে জানে? ঐ শিশুটি এখন সুজানার একমাত্র চিহ্ন।

সকাল থেকে বাচ্চাটা অনবরত কেঁদে চলেছে। গতকাল ওর মায়ের দাফন হয়েছে। যুবরাজ ভাবছে, হয়তো এই মাসুম বাচ্চাটা বুঝতে পেরেছে ওর মা দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে। যুবরাজ ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বাচ্চাটাকে কোলে হাঁটছে আর অবাক হয়ে নিজের ভাগ্য নিয়ে ভাবছে। যাকেই ও ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতে চায় সেই ওর জীবন থেকে হারিয়ে যায়। কি অদ্ভূত জীবন ওর! হঠাৎ ওর কাঁধের উপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। আর বহুদিন পর ওর ভীষণ পরিচিত একজন প্রিয় মানুষের সুঘ্রান ওর নাসিকা গ্রন্থিতে এসে লাগে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সানজানা ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সানজানা যুবরাজের কাজ থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। সাথে সাথে বাচ্চাটার কান্না থেমে যায়।

তিন মাস পর——
আজ যুবরাজ আর সানজানার বিয়ে। একরকম জোর করেই যুবরাজ সানজানাকে বিয়ে করেছে। কারণ ওর কাছে ভালোবাসা মানে এক স্বর্গীয় অনভূতী। যেখানে শারীরিক অসঙ্গতি কোনো ম্যাটার করে না। ওর তিনজন আজ একসাথে বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে। ছোটো রাজপুত্র সানজানার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। সানজানা ওকে বিছানায় শুয়ে দিলো। বাচ্চাটাকে মাঝখানে রেখে ওরা দুজন দুপাশে বসলো। যুবরাজ সানজানার দিকে তাকিয়ে বলে,
—আজকে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনটা আজ পরিপূর্ণতা পেলো।
সানজানা যুবরাজের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
—-বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরে ঠেলিয়া দেয়।
আর মনে মনে বললো,সুজানার ছেলেটার কথা ভেবেই আমি তোমার সাথে আমি আমার জীবনটাকে জড়িয়ে নিলাম।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে