#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
সানজানা যুবরাজের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই থেকে যুবরাজের জীবনে সানজানা অপরিহার্য অংশ হতে শুরু করলো। সানজানাও মনে মনে ভাবলো আর কিছু করতে পারুক না পারুক মানুষটার বুকের উপর চেপে থাকা কষ্টের পাথরটা যেন ও সরিয়ে দিতে পারে। ওর কাঁদার কারনটা সানজানা জানতে চাওয়া মাত্রই যুবরাজ সাথে সাথে বললো,
—-আমার ভালোবাসার মানুষটা অন্য কাউকে বিয়ে করে পরবাসী হতে চলেছে।
ওর কথা শুনে সানজানা মনে মনে বললো,
“সত্যিকারের ভালোবাসা কি কখনও ছেড়ে যেতে পারে।”
কৌতূহল দমন করতে না পেরে সানজানা বলেই ফেললো,
—-ও যদি তোমাকে ভালোইবাসতো তাহলে তো ছেড়ে যেতে পারতো না,তাই না?
—-ও নিজ থেকে যায়নি। ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
—-ওতো আটকাতে পারতো?
—-চেষ্টা করেছিলো। আমার কথা ওর বাবা মাকে বলেছিলো। কিন্তু ওর বাবা মা বেকার ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে নারাজ। তুমি কি পারবে আমার হয়ে কাকলীকে বুঝাতে?
যদিও সানজানা কাকলীকে চিনতো না এমনকি কাকলী ওর কথা শুনবে কিনা ও জানতো না। তারপর ও যুবরাজের ঐ করুন চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
—-ঠিক আছে তুমি আমাকে ওর কন্ট্রাক নাম্বারটা দিও। আমি চেষ্টা করে দেখবো।
সানজানার কাছ থেকে এরকম আশার কথা শুনে যুবরাজ সানজানার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলো,
—-সত্যিই তুমি কাকলীর সাথে কথা বলবে?
—-বলবো,তবে এবার তুমি একটু শান্ত হও।
তবে যুবরাজের কথামতো সানজানা কাকলীর সাথে কথা বলেছিলো। কিন্তু কাকলী ওকে বলেছে,পরিবারের কথার বাইরে গিয়ে ওর পক্ষে যুবরাজকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। সানজানার সহযোগিতায় যুবরাজ সেই ট্রমা থেকে খুব সহজেই বের হতে পেরেছিলো। তবে সানজানা সেসময় যুবরাজের দুচোখে ওর প্রতি এক ভালো লাগা লক্ষ্য করেছিলো। বিষয়টা অনেকটা এমন, উত্তাল সাগরে কোনো মানুষ যখন ডুবে যায় তখন শেষ মুহুর্তে সে সামান্য খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। সানজানা সেদিন যুবরাজের কাছে খড়কুটোর সমতুল্য ছিলো। সানজানাও যুবরাজের বন্ধুত্বের হাতকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। যা পরবর্তীতে একটা ভালোলাগার সম্পর্কে রুপ নেয়। তবে যুবরাজ যতই সানজানার উপর নির্ভর হয়ে যাচ্ছে ভয় আর অনিশ্চয়তা সানজানাকে গ্রাস করছিলো। কারণ সানজানা জানতো তেল আর পানিতে যেমন মিশে না তেমনি যুবরাজের সাথে ওর ভালোবাসা কোনোদিন সফলতার মুখ দেখবে না। সে কারনে ও যুবরাজের কাছ থেকে সবসময় একটু দুরত্ব বজায় রেখে চলতো। সেটা বুঝতে পেরে যুবরাজ একদিন খুব দুঃখ করে সানজানাকে বলেছিলো,
—-জানো সানজানা,আমি যাকেই আঁকড়ে ধরতে চাই সেই আমাকে ফেলে রেখে চলে যায়। তুমি আমাকে কথা দাও, কোনোদিন আমাকে ফেলে রেখে চলে যাবে না।”
কথাটা মনে হতেই সানজানা আকুল হয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। আর মনে মনে বললো,”যুবরাজ আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না। আমি তোমাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে এসেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
এর পর রুম থেকে বের হয়ে লঞ্চের ডেকে পেতে রাখা চেয়ারে বসলো। ঘড়িতে দেখলো রাত বারোটা বাজে। বেশ গভীর রাত। চাঁদের আলোয় চারিদিকে সব ফকফকা। আজ তো পূর্ণিমা। যুবরাজ চেয়েছিলো,ওর বাসর যেন চাঁদনি রাতে হয়। সেকারনেই পূর্ণিমায় ওর বিয়ের তারিখ ঠিক করে নেয়।
পূর্ণ চাঁদের ছবিটা নদীর পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। কি অপরুপ এই দৃশ্য! আহা,যুবরাজ যদি পাশে থাকতো এই রাত কতো না মধুর হতো?
সাথে সাথে সানজানার মনে হলো,এ ও কি ভাবছে? যাকে নিজ হাতে বোনের কাছে সঁপে দিয়ে আসলো তাকে আজ আবার কেন নিজের করে পেতে চাইছে? এ যে পাপ! শুধু পাপ নয় মহা পাপ। ফোনটা বেজে উঠলো। সানজানা যেন একটু চমকে উঠলো। কার ফোন আসলো। মোবাইল ওপেন করতেই দেখে বাবা ফোন দিয়েছে।
—+হ্যালো সানজানা,কোনো সমস্যা হচ্ছে নাতো? সব ঠিক আছে।
—-হা বাবা,আমি ঠিক আছি। বিয়েটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে? বাবা ওরা কিছু বুঝতে পারেনিতো?
—-,না, এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে। তবে ওরা সুজানার খোঁজ করেছিলো।
—-তুমি কি বলেছো?
—-বলেছি চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে।
—-যাক ভালোই বলেছো। ফোন রাখছি।
—-সাবধানে থাকিস মা।
—-আচ্ছা,আমাকে নিয়ে অত ভেবো না। তোমরা নিজেদের শরীরের যত্ন নিও।
ফোনটা রেখে সানাজানা ভাবছে,যুবরাজ নিশ্চয় এতোক্ষণে বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে। সুজানা সামলে নিতে পারবে তো। সানজানার প্রচন্ড শীত লাগছে। ও ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে মনে মনে ভাবলো, সবার জীবন হয়তো একই সরল রেখায় চলে না। যেমন হাতের পাঁচটা আঙ্গুল একসমান নয়। তেমনি ও আর সুজানা দেখতে একই রকম হলেও ওদের জীবনটা এক নয়। চোখটা যেন একটু লেগে এসেছে।
সুজানা বাসর খাটে বসে পৌষ মাসের শীতেও দরদর করে ঘামতে লাগলো। ওর শুধু ভয় হতে লাগলো যুবরাজের কাছে ধরা পড়ে যাবে নাতো? এমন সময় দরজাটা কে যেন নক করছে। সুজানা খাটে বসে অবাক হয়ে ভাবছে,
এসময় দরজা আবার কে নক করছে? রাত বারোটা বেজে গিয়েছে অথচ যুবরাজের পাত্তা নেই। ও খাট থেকে নেমে দরজা খুলে দেখে যুবরাজ দাঁড়িয়ে আছে। সুজানার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এরই মাঝে ভুলে গেলে আমাদের কি কথা ছিলো?
—-না,মানে বিয়ের ঝামেলায় আমার মাথা কাজ করছে না।
—আচ্ছা তোমার হাতটা বাড়িয়ে দাও।
সুজানা হাত বাড়িয়ে দিলো। যুবরাজ সুজানার হাত ধরে রুমে প্রবেশ করে বললো,
—তোমার অনুমতি নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকবো। তুমিই তো বলেছিলে। আর এখন তুমি ভুলে গিয়েছো।
সুজানা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। প্রসঙ্গ এড়াতে বললো,
—বলেছি তো অনেক কিছু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘুমানোটা জরুরী। মাইগ্রেনের ব্যথাটা উঠেছে। না ঘুমালে কিছুতেই কমবে না।
যুবরাজ জানে সানজানার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে বেশ প্রকট হয়। তখন ওর বমিও হয়। সে কারনে ও একটু নার্ভাস ফিল করতে লাগলো। সুজানার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তুমি পোশাক বদলে ফ্রেস হয়ে আসো। ওজু করে নিও। আমরা দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে নিবো। এরপর তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
ওয়াশরুমে গিয়ে সুজানা মনে মনে বললো,
“আপুরে তুই আমাকে এই কোন ঝামেলায় ফেলে দিয়ে চলে গেলি। আমি কি করে পরিস্থিতি সামলাবো বুঝতে পারছি না।”
তবে প্রথম দেখাতে যুবরাজকে সুজানার বেশ ভালো লেগেছে। মাথা ভর্তি কোকড়া চুল, শ্যামলা রং ছ,ফিটের মতো লম্বা বেশ ম্যানলি চেহারা। পুরো অবয়বে একটা মায়া ছড়িয়ে আছে।
সুজানা ওয়াশরুম থেকে ওজু করে আসলো। এরপর দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করে নিলো। যুবরাজ সুজানার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-বুঝতে পারছি,মাইগ্রেনের ব্যথায় তুমি সব ভুলে গিয়েছো। তোমার মনে আছে আমি তোমাকে বলেছিলাম,সোনার গয়না তোমায় আমি এখন গড়িয়ে দিতে পারবো না। তবে একমাত্র ছেলের বউ হিসাবে আমার বাবা মা তোমাকে প্রচুর দিবে। তবে আমি দিবো বেলী ফুলের গয়না।
একথা বলে একটা সুন্দর প্যাকেট যুবরাজ সুজানার হাতে তুলে দিয়ে ঘরের পাশে লাগোয়া বেলকনিতে গিয়ে বসলো। সুজানা প্যাকেটা খুলে দেখে বেলী ফুল দিয়ে তৈরী হাতেরচুড়ি কানেরদুল গলারহার মাথার টিকলি সাথে একটা সাদা রংয়ের জামদানি। যুবরাজের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো এতো আবেগ মিশ্রিত উপহারটা মর্যাদা দেওয়া উচিত। এই ফুলগুলো সকাল হতেই নেতিয়ে পড়বে। আর বেচারা এতো শখ করে আনলো। গয়নাগুলো ওর পরা উচিত।
সুজানা ওয়াশরুমে গিয়ে সাদা জামদানীটা পরে নিলো। বেলী ফুলের গয়নায় নিজেকে সাজিয়ে যুবরাজের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঝুল বারান্দার চাঁদের আলো এসে সুজানার উপর পড়েছে। সেই আলোতে সুজানাকে যুবরাজের কাছে জান্নাতের হুর মনে হতে লাগলো। ও সুজানার কাছে এসে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো,
—আমাদের এতো বছরের সম্পর্কে এই প্রথম আমি তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম।তবে কি জানো তোমার একটা পরিচিত সুবাস আছে। যেটা আমি আজকে পাচ্ছি না।
যুবরাজের স্পর্শে সুজানা শিহরিত হলো। তবে কেন যেন ওর মনে হতে লাগলো যুবরাজ এ সব কিছুই করছে ওকে সানজানা ভেবে। তাহলে কি যুবরাজের জীবনে ওর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না?
চলবে