#ব্রহ্মকমল
৩
________________
এতটুকু জীবনে নিজের পরিবার থেকে এত জঘন্য একটা অভিজ্ঞতা হওয়ার পর সম্পর্ক, বিয়ে, ভালোবাসা এসবের ওপর আমার আগ্রহ পুরোপুরি হারিয়ে গেল। একটা লম্বা সময়ে ওসব নিয়ে ভাবা হয়নি বলে কেউ আসেওনি জীবনে। যখন আসার সময় হলো, তখন চোখের সামনে সুস্থ স্বাভাবিক একটা সম্পর্ককে ইলিউশন হতে দেখা অপ্রত্যাশিত ছিল আমার জন্য।
কাউকে বলিনি কখনো, বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পরপর দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্নে দুটো হাত দেখতাম। দেখতাম একে অপরের আঙুল ছোঁয়ার বাহানায় কী তৃষার্তের মতো তারা ছুটছে তো ছুটছে সময়ের সমস্ত খেয়াল ভুলে। জানতে পারছে না তাদের সাথে পাল্টে যাচ্ছে প্রকৃতি। বুঝতে পারছে না কি করে একজোড়া হাতকে ছুঁয়ে যাচ্ছে অবারিত ঝড়-জলের ঝাপ্টা কিংবা ঋতুর পরিবর্তন। শুধু দেখছে অসহায় দুটো হাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দেয়ালসম এক বাঁধা৷ যে বাঁধার সামনে হাত দুটোর মালিকেরা সম্পূর্ণ নিরুপায়।
শুরু শুরুতে স্বপ্নটাকে আমি তেমন পাত্তা দিতাম না। মনে হতো বাবা-মায়ের এসব ছাড়াছাড়ি নিয়ে বেশি ভাবছি বলেই হয়ত..
কিন্তু একাধারে টানা স্বপ্নটা দেখে যাওয়ার পর কিছু একটা আমায় একটু একটু করে খোঁচাতে লাগল। মনে হলো কোনোভাবে নিজের ভবিষ্যৎ কি দেখতে পারছি? আদৌ একটা মানুষের পক্ষে নিজের ভবিষ্যৎ দেখা সম্ভব! তাও আবার স্বপ্নে। যতবার এমন সন্দেহ হতো, ততবারই তাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য অস্থির হয়ে যেত ইপশার অন্য আরেক সত্ত্বা। পুরোটা ঝেড়ে ফেলতে পারতাম না যদিও।
কারণ স্বপ্নে মেয়ের হাতটা দেখে বারবার মনে হতো ওটা আমি; দেয়ালের এপারে বহুকাল অপেক্ষা করছি কারোর জন্য যাকে চিনি না, দেখিনি কখনো। যার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ধূসর স্বপ্নে আবছা হয়ে চোখে লাগত শুধু বুড়ো আঙুলের কাছে লম্বা করে কাটা দাগ। এর বাইরে কিচ্ছু না, কিচ্ছু না।
স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতাম বারবার। ভাবতে বাধ্য হতাম। কারণ ওর কারণেই কতরাত ঘুম হতো না ঠিক করে। প্রায় সময়ই মাঝরাতে জ্বরগ্রস্তের মতো ঝাঁকি দিয়ে ঘুম ভেঙে যেত আমার। কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে টের পেতাম ঘুমের ঘোরে কোন গোপন কান্নায় ভেসে মাথার বালিশটা ভিজে গেছে অনেকটা। বুকের ভেতর এত এত আশংকার পূবালী হাওয়া বইত! দু চোখের পাতা আর এক করা হতো না।
নিজেকে নিয়ে ভাবনার সময় আমার ছিল শুধু এতটুকু।
কল্পনা তো কত রকমের হয় মানুষের। তাবলে মিছে স্বপ্নের পৃথিবী থেকে এভাবে না বলে না কয়ে উঠে আসতে পারে কেউ? এ কেমন কো-ইন্সিডেন্স! নাকি একে বলব আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ম্যাজিক! অন্যসব দুর্ঘটনার ভীড়ে যে ম্যাজিককে আমি একদম প্রত্যাশা করিনি; কোনোদিন না।
ঘটনা সে বছরেরই শেষের দিকে। অংকর ইন্টারের পরপর দাদুর দেয়া সম্পত্তিগুলোর বিরাট অংশ বিক্রি করে আমরা ভাইবোন পাড়ি জমালাম অ্যাডমান্টন, অ্যালবার্টা;দু’জনের থেমে থাকা পড়াশোনাগুলো আবার শুরু করতে।
যদিও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ততদিনে চলে গিয়েছে পুরোটাই৷ অংকই জোর করে ফর্ম ফিলাপসহ যাবতীয় কাজ ঠেলেঠুলে করাল আমাকে।
রেজাল্ট ভালো ছিল। স্টাডি গ্যাপের কজ হিসেবে কিছু লিগ্যাল ডকুমেন্টস সাবমিট করতে গিয়ে আমার সময় লেগে গেল কিছুটা। অংকর অবশ্য ততদিনে ভর্তি ডান। ক্লাসও শুরু হবে হবে করছে। আমার কাগজপত্র সাবমিশন হয়ে গেলে দু’জন একসাথে গুছিয়ে উঠে যাব।
সাইন্স ফ্যাকাল্টির সাবজেক্টগুলোতে প্রফেসরদের পেছনে ধর্না দিয়ে থাকতে হয় অনেক। মেডিক্যাল মিস হয়েছে বলে আমার ইচ্ছে ছিল ফার্মেসি কিংবা অ্যাপ্লাইড ক্যামেস্ট্রিতে যাওয়ার। কিন্তু ইচ্ছের নাকের ডগা দিয়ে শেষে ভর্তি হতে হলো বায়োলজিক্যাল সাইন্সেস’এ। অন্যদিকে অংক ওর নামের মতই ম্যাথামেটিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসে।
সম্পূর্ণ ভিন্ন শহরে নতুন রকমের পড়াশোনা। যাওয়ার আগে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম আন্ডারগ্র্যাডে আমাদের ডিপার্টমেন্টমেট কতজন আছে বাংলাদেশী৷ অনলাইনে খোঁজ করে বিশেষ সুবিধে হলো না। যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অথৈ সাগরে ভাসতে যাচ্ছি বলেই মনে হচ্ছিল আমার। যদিও ভয়ডর কিছু টের পাচ্ছিলাম না, শুধু বুক ভরে ভেসে বেড়াচ্ছিল অচেনা অজানা দীর্ঘশ্বাসের কুণ্ডলী। যেগুলো অদৃশ্যভাবে আঁকড়ে ধরে আমার সাথে সাথেই চলছিল অজানা যাত্রাপথে।
চলে আসার দিন এয়ারপোর্টে আমাদের ছাড়তে এসেছিল অনেকে। দাদি, ফুপু, চাচা; নানিরাও এসেছিল অবশ্য। আর এসেছিল মা।
মা কিন্তু পুরোটা সময় আমার সাথে কোনো কথা বলেনি, শুধু অংকর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একাধারে বোঝানোর চেষ্টা করেছে,
“মায়ের ওপর অভিমান করে যেতে হয় না এভাবে। মা, সেতো জন্ম দিয়েছে। ভুলভ্রান্তি কিছু হয়েই গেছে না-হয়। তাবলে এভাবে ছেড়ে যাবে চিরকালের মতো রাগ করে?”
অংক মায়ের সিনক্রিয়েটে একদম পার্টিসিপেট করেনি। পুরোটা সময় মুখ অন্ধকার করে মাথা নামিয়ে বসেছিল।
আমিও আগ বাড়িয়ে বলিনি কিছু। আমার বোধহয় একটু কান্না করা উচিৎ ছিল। এতবড় অপমানের সাক্ষী হয়েও প্রাণহীন পুতুলের মতো কীভাবে যে ছিলাম এমন প্রতিক্রিয়াহীন!সত্যিই৷
অবশ্য প্রতিক্রিয়াহীন কথাটা পুরোপুরি বোধহয় সঠিক নয়। আমি কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম কাঁদতে; পারিনি। শুধু বুকের ভেতরটা অচেনা সুরে ঢিপঢিপ করছিল। বিশাল একটা পাথরসাদৃশ্য কিছু আমার বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা মাংসপিণ্ডে একটু একটু করে চাপ দিচ্ছে টের পাচ্ছিলাম, মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না কাউকে।
তবে অন্যকেউ আমার দোলাচল অবস্থা বুঝতে না পারলেও দাদি আর নানি বুঝতে পেরেছিল কিছুটা। খুব অদ্ভুতভাবে মা যতক্ষণ অংককে অনুনয় বিনয় করে থেকে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি করছিল, ততক্ষণ এই দুটো মানুষ দুদিক থেকে আমার হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। কেউ কিচ্ছু বলেনি, মুখ ফুটে একটা সান্ত্বনা বাক্যও নয়। তবু তাঁদের উষ্ণ স্পর্শে ইপশা বুঝতে পারছিল, বাবা মা নাহোক, কিন্তু অভিভাবক হয়ে তার পাশেও আছে কেউ, তাকে জড়িয়ে সবসময়।
মিট অ্যান্ড গ্রিটের সময়টা অথোরিটি থেকে বেঁধে দেয়া ছিল। এর বাইরে এক মিনিট ব্যয় করার সুযোগ নেই। মা ততক্ষণে অংককে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত। অংকও যে মায়ের কথায় একদম কান দেবে না, সেটা প্রমাণ করতে সময়ের আগে লাগেজ টেনে আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল। আমি বিশেষ তাড়াহুড়ো করলাম না। স্বাভাবিকভাবে দাদি আর নানির কাছে বিদায় নিয়ে ওর সাথে পা বাড়ালাম। যেতে যেতে অনেক উপদেশের সাথে সবার আড়ালে হঠাৎ এক টুকরো কাগজ গুঁজে দিল দাদি আমার মুঠোর ভেতর। অবাক হয়ে তাকালে কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বলল,
— খুব বিপদে পড়লে কাগজের লেখা ঠিকানায় যোগাযোগ করিস। মনে রাখিস, পৃথিবীর সবাই তোকে ফিরিয়ে দিতে পারলেও এই ঠিকানা থেকে কখনো ফিরিয়ে দেবে না।
পাল্টা প্রশ্নের জন্য ঠোঁট নড়ে উঠলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে দাদিই আবার বলল,
— কিছু জানতে চাস না বুবু। বলতে পারব না। শুধু তোরা ভালো থাকিস, পুরনো সবকিছু ভুলে আনন্দে থাকিস কেমন?
উত্তরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানানো ছাড়া কিছু করার ছিল না। মনের ভেতর নতুন প্রশ্ন ইতোমধ্যে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু করেছিল। বৃথা চেষ্টায় তাকে থামাইনি আর। তাণ্ডব যা খেলার খেলে নিক বরং।
সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ে উত্তর অপেক্ষা করছে তো আমাদের জন্য। পৌঁছুতে যতটা দেরি।
________________________
অ্যালবার্টাতে আসার আগেও যে অসম্ভব ভাবনাগুলো ভয় হয়ে আমার বুকে চেপে শ্বাস বন্ধ করতে চাইছিল, সেসব হালকা হয়ে গেল কয়েকমাস কাটানোর পরপরই দেশীয়দের সাহচর্যে। রক্তের না হয়েও একাকী এই ভাইবোন দুটোকে সবার আগে যেভাবে আপন করে নিলো ওখানের BSACU- Bangladesh Student Association of Canada at the University of Alberta তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আসলে শেকড় ছাড়ার পরেই বোধহয় বোঝা যায় শেকড়ের প্রতি কত টান।
এবং কথাটা আরও বিশেষভাবে বুঝিয়ে দিতেই হয়তো অ্যাডমান্টনে পা রাখার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারদের অতিথিয়ানা হলো এক্কেবারে বলবার মতো। গুছিয়ে বলতে গেলে তো লিস্ট শেষ হওয়ার নয়।
একদম আমাদের থাকার ব্যবস্থা পছন্দ না হওয়ায় কয়েকজন দলবেঁধে রি- অ্যাকোমোডেশনের সুবিধে করে দেয়া থেকে শুরু করে, ওখানের জীবনাচার, স্টুডেন্ট হেল্পডেস্কসহ সমস্ত রকমের ভালো-মন্দের খোঁজখবর এত দায়িত্ব নিয়ে ওরা দেখতে শুরু করল! আমি আর অংক অবাক হয়ে গেলাম এই ভেবে, পর হয়েও কেউ কীভাবে এতটা করতে পারে কারোর জন্য৷
শুধু ওরাই নয়, এই সাহায্যের জন্য আসলে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে হতো আমার প্রফেসরকে। তিনি নিজে যেভাবে হাতে ধরে এই মানুষগুলোর কাছে আমাদের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন!
তিনি না থাকলে মাঝদরিয়ায় পড়ে ভয়াবহ দশা হতো আমার, অংকর। নিশ্চিত।
_____________
বিদায়ের সময় দাদি বলেছিল নতুন জীবনে পুরনোর ছাপ রাখিস না ইপশা। জায়গা ছাড়লে সব স্মৃতি ফেলে রেখেই ছাড়তে হয়। এতে স্বস্তি মেলে।
আমি কতটা ছাড়তে পারলাম তা জানি না; তবে নতুন শহর, সদ্য হাতে পাওয়া পড়াশোনার চাপ আর সেসব নিয়ে নতুনভাবে গুছিয়ে নেয়ার ঝক্কি সামলাতে সামলাতে দীর্ঘদিন ওসব আর মনে পড়ল না৷ খারাপ লাগার মধ্যে একটা প্রশ্নই শুধু ছিল,
“এই যে জন্মস্থান ছেড়ে একা এতটুকু বয়সে কোন মুলুকে এসে বসে আছি দু’জন। শখ করে কিংবা মন খারাপেও আমাদের বিশেষভাবে মনে করার কেউ নেই। এতটা একা মানুষ সত্যিই হতে পারে কখনো?”
ফ্রেন্ডদের বাসায় কথা বলতে দেখলে মাঝেমধ্যেই পুরনো কষ্ট মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। সেসময়গুলোতে অংককে ডেকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। তখন একদম মনে থাকত না আমি ওর বড়বোন। উল্টো, ওকে বড়ভাই অবলম্বন করে নিজের সব যন্ত্রণা ভুলতে চাইতাম যেন৷ আফসোস হতো এই ভেবে, এতটাবছর কেন বাবা-মায়ের ওমে থেকে অভ্যেস খারাপ করে ফেললাম! ওরা ঝেড়ে ফেললেও ভেতরের ইপশার যে আজও ওদেরই চাই;আগের মত করে। এটা ওরা কখনো জানবে?
অংক বুঝত আমার মনের ভেতরের সবটা। শুরু শুরুতে রাগলেও একটা সময় পর আর রাগত না ও। চুপচাপ শুধু বসে থাকত ক্যাম্পাসের এককোণে আমাকে সঙ্গ দিতে। কে জানে ওর মনের ভেতরটা কেমন করত তখন। ও তো প্রকাশ করত না কিছুই। আচ্ছা ওরও কি আমার মতই মন কাঁদত?
চলিবে?