প্রাণ বসন্ত পর্ব-১১

0
6

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১১
#রাউফুন

তাওহীদার জীবন যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। মফিজ উদ্দিন তার জন্য স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন। গ্রাম থেকে তার পুরোনো সার্টিফিকেট এনে শহরের একটি দাখিলিয়া নুরানি মাদ্রাসায় ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়েছেন। যদিও পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে এই বিষয়ে নানা রকম গুঞ্জন চলতে থাকে, তাওহীদা তার মনে স্থির করে নেয়, আল্লাহর ওপর ভরসা করেই সে এগিয়ে যাবে।

সকালবেলা তাওহীদা তার নামাজ সেরে পড়ার টেবিলে বসে। তার হাতে নতুন বইয়ের মিষ্টি গন্ধ। বইয়ের পাতাগুলো স্পর্শ করে সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়।
“হে আল্লাহ, আমাকে সঠিক পথে চালিত করুন। এই শিক্ষা যেন আপনার পথে ব্যয় করতে পারি।”

সকালের সব কাজ তাওহীদা পূর্বেই করে রেখেছে। তার সংসার আর পড়াশোনা দুটোই এগিয়ে নিতে হবে। রওশন আরাও এমনই শর্ত আরোপ করে তাওহীদার পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু টা মত দিয়েছে। খাবার শেষে মফিজ উদ্দিন তাওহীদাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন মাদ্রাসায়। তাওহীদার প্রথম দিন। মাদ্রাসার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তার মনে একধরনের অস্বস্তি শুরু হয়। এত মানুষ, এত ভিড়। এতগুলো বছরের পর আবারও সে শিক্ষার আলোয় ফিরেছে।

ক্লাসে ঢুকে একটি কোণার বেঞ্চে গিয়ে বসে। বই নিয়ে পডতে থাকে, এমন সময় একটি মেয়ে এসে তার পাশে বসে। শুরুতেই মেয়েটি হাসিমুখে বলল,
“আমি রুশদা। তুমি নতুন এসেছো?”
তাওহীদা প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। আচমকা একটা মেয়ে এসে এভাবে কথা বলায় ভড়কে যায় সে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বই বন্ধ করে। মেয়েটি তার পাশে বসেই বললো,“আসলে নতুন কাউকে দেখলেই আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চলে আসি। তোমাকে দেখেই নতুন বুঝেছি। তাই বন্ধুত্ব করতে এলাম। আমি কারোর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারি না।

তাওহীদা প্রথমে অস্বস্তি বোধ করলেও মেয়েটির বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে স্বস্তি পেয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“হ্যাঁ, আমি তাওহীদা।”

রুশদা কথা বলতে বলতে তাকে পুরো মাদ্রাসার নিয়মকানুন আর শিক্ষকদের সম্পর্কে জানায়। তাওহীদা নিজের ভেতরে যেন এক নতুন শক্তি অনুভব করে।
লাঞ্চ টাইমে তাওহীদা আর রুশদা মাদ্রাসার ক্যান্টিনের দিকে হাঁটছিল। হঠাৎ তাওহীদার মনে হলো কেউ তাকে দূর থেকে দেখছে। সে পেছনে তাকিয়ে দেখে, দূর থেকে একটি ছায়ামূর্তি। পুরো মুখ ঢাকা। শুধু চোখ দুটো দৃশ্যমান। সেই চোখ যেন কোথায় দেখা।

তাওহীদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। রুশদা জিজ্ঞাসা করে,
“কী হলো? তুমি থেমে গেলে কেন?”
“ও কিছু না,” তাওহীদা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে।

তবে তার মনের ভেতর অস্থিরতা বাড়তে থাকে। কে সে?? সে কি ভুল দেখলো? এখানে সে একদম নতুন তবে কে ছিলো ওখানে? কেন তার মনে হচ্ছিলো ছায়ামূর্তি টা তাকেই দেখছিলো।

“তাহু, তুমি কি সব সময় এমন অল্প কথা বলো?”
“হু?”
“তুমি ওমন ভড়কালে কেন? আমি এমনই। সবার নাম শর্ট করে নামের দফারফা করে ফেলি। তুমিও কিন্তু আমাকে রুশদা না বলে রুশু ডাকতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।”
“আচ্ছা।” তাওহীদা নিকাবের নিচে সামান্য হাসলে রুশদা টের পেয়ে বললো,“তুমি হাসতে জানো তাহলে!”

তাওহীদা ভ্রুকুটি করে তাকালে রুশদা খিলখিল করে হাসলো। তাওহীদা মনে মনে বললো,“বাহ বেশ মিষ্টি হাসি তো মেয়েটার!”

বাড়িতে সালমা আর পারভীন নতুন এক ষড়যন্ত্র আঁটছে। তাদের মনে হচ্ছে, তাওহীদার পড়াশোনায় সফলতা পেলে তারা পরিবারের গুরুত্ব হারাবে। তারা ঠিক করে, তাওহীদাকে এখন থেকে কাজে আরও বেশি ব্যস্ত রাখবে।

“কি করা যাই বল তো? এই মেয়ের এখনি যে রওয়াব। এরপর পড়াশোনা শিখলে আমাদের সমান হবে না? তখন দেখবি আমাদের মাথায় উঠে নাচবে। আমাদের পাত্তায় দেবে না। বাড়ির সব কাজ আমাদের করতে হবে! ”
“আমরা করবো কেন? ঐ বুড়িকে দিয়েই করাবো!”

উহুম উহুম করে কেশে উঠলেন রওশন আরা। দুজনেই হেসে অপ্রস্তুত হয়ে বললো,“মা আপনি এখানে? কিছু বলবেন?”
“বুড়ি মানুষ কি বলবো বলো তো? চা করে দিও তো আমাকে।”
“আমরা কেউ-ই চা করতে জানি না। আপনার চা আপনি করে খান।”
“আমার প্রেসার বেড়েছে, আগুনের ধারে যেতে পারি না। সামান্য চা করে দিতে বলেছি আর আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?”

পারভীন বললো,”দেখেন মা, আমরা না এই বাড়িতে চাকরানী করতে আসিনি। এই বাড়িতে অর্ধেক খরচা আমার স্বামী দেয়৷ তাই কাজ করার প্রশ্নই আসে না।”

“তোর স্বামী একা দেয় নাকি? বাড়ির কারেন্ট বিল থেকে শুরু করে পানির বিল, গ্যাস বিল সবই আমার স্বামী দেয়৷ এই এতো বাড়ির এসব খরচা তো আর কম না।”

সালমার কথা শুনে রওশন আরা বললেন,“আর আমি বুঝি ভেসে এসেছি? তোমাদের শ্বশুর বাড়ির প্রত্যেক বিষয় টেকেল দেন। আমি কেন কাজ করবো? তোমাদের কথামতো তো এই কথায় আসছে!”

“দেখেন মা, চা খাবেন আপনি আপনার চা কেন আমরা বানাবো?”

মূহুর্তের মধ্যে রওশন আরার তাওহীদার কথা মনে পড়লো। বলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বিনাবাক্যে সকলরেই সব কাজ করে দেয়। তখনই পারভীন ফোড়ন কেটে বলে,“যার স্বামী এই সংসারে আগাছার মতো পড়ে আছে তার বউয়ের নতুন ডানা গজিয়েছে। তার ডানা কেটে দিন মা। দেখবেন আপনার স্বামান্য চায়ের জন্য এর ওর কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে হবে না।”

রিমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,“আমার বুঝি ছোটো ভাইয়াকেই পেতে ধরেছে? বড়ো ভাইয়া আর মেজো ভাইয়া কি মাটি ফে’টে বের হইছে? ছোটো ভাইয়ার বউ যদি আমার মায়ের সেবা করতে পারে তাহলে তোমরা কেন পারবে না?”

“তুমি তো কথায় বলো না। চোর কোথাকার। লজ্জা করে না এখানে আমাদের সামনে এসে বড়ো বড়ো জ্ঞান দাও?”

“নাহ করে না। আমি একটা ভুল করেছি তার মানে এই না যে তোমরা আমাকে মাটিতে ফেলে পিষ্ট করবে আর আমি মেনে নেবো। আমি যেমন এখন ভালো হয়েছি তেমনই আগে কিন্তু জঘন্য ছিলাম। সেই আগের রূপ তোমাদের জন্য দরকার হলে আবার নিজের মধ্যে ইনক্লুড করবো। কারণ শয়তানকে শয়তানি দিয়েই শায়েস্তা করতে হয়।”

এক কথা দুই কথায় তুমুল ঝামেলা হলো এখানে। সামান্য চা করা নিয়ে কি পরিমাণ ঝামেলা দেখতে হচ্ছে রওশন আরাকে। রওশন আরার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো তাওহীদার উপর। এই মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করাতেই হবে তাকে। রোজ রোজ এই ঝামেলা নিতে পারবেন না এই বয়সে।

মাদ্রাসা থেকে ফিরে তাওহীদা ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢোকার আগে অবশ্য শাশুড়ীর গম্ভীর রাগী মুখটা নজর এড়াইনি তার। এসব যে হবে তার সেই ধারণা আছে। তাই সে সম্পুর্ন ভাবেই প্রস্তুত আছে। আসরের নামাজ পড়ে রান্না ঘরে ঢুকতেই দেখে শাশুড়ী এখনো গোমড়া মুখে বসে আছে। তাওহীদা চা করে শাশুড়ীর সামনে ধরতেই গরম চা নিয়ে সোজা তাওহীদার মুখে ছুড়ে মারলো। আকস্মিক ঘটনায় আহত তাওহীদা চিৎকার করে উঠলো। রিমি চিৎকার শুনে ছুটে এলো। দেখলো তাওহীদা মুখে হাত দিয়ে আর্তনাদ করছে। মায়ের হাতে চায়ের কাপ দেখে রিমির আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে। দ্রুত ডিম ভেঙে তাওহীদার মুখে মেখে দিলো। তাওহীদার ডিমের গন্ধে গা গুলিয়ে বমি করে দিলো। রিমি বললো,“ডিম না দিলে তোমার মুখে ফোসকাল উঠবে ভাবি। প্লিজ একটু সহ্য করো।”

“তুমি কি মানুষ মা? এতোটা নির্দয়া, পাষবিক কেউ হয়? তোমাকে আমার মা বলতে ঘেন্না হচ্ছে। আমাকে বলো না আমি দুশ্চরিত্রা মেয়ে? দুশ্চরিত্রা হওয়াও বোধহয় ভালো তোমার মতো নিষ্ঠুর হওয়ার চাইতে।”

হনহনিয়ে চলে গেলেন রওশন আরা। মনে মনে রাগ জমেছিলো এখন কিছুটা শান্তি লাগছে তার। রিমি বললো,“কেঁদো না ভাবি। আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ভাগ্যিস চোখ বন্ধ করেছিলে। চোখে গরম চা পড়লে মারাত্মক ক্ষতি হতো!”

তাওহীদা ডিমের গন্ধে আরেক দফায় বমি করলো। রিমি নিজেই তাওহীদার মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে রান্না ঘর পরিষ্কার করলো। আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে সে। তাওহীদার মুখের এক পাশে গরম চা লেগে লাল হয়ে গেছে। রিমির এতো কষ্ট হচ্ছে দেখে৷ সেও তো এই নিরীহ মেয়েটার উপর কতটা অমানবিক জুলুম করতো। মনে মনে সে অনুতাপে দগ্ধ হতে লাগলো।

তাওহীদা ঘরে ঢুকলো। আহসান বসে বসে কি যেনো খুঁজছে। তাওহীদা আলতো স্বরে বললো,

“তুমি এখানে কী করছো?”
আহসান উত্তর দিয়ে বলে,
“ওষুধ খুঁজে পাচ্ছি না!”
“কিসের ওষুধ?”
আহসান খুঁজতে খুঁজতে কাঙ্ক্ষিত ওষুধ পেয়ে বললো,“এটাই খুঁজছিলাম।”

তাওহীদা কিছু না বলে বিছানায় বসলো। আহসান আলতো হাতে ফু দিচ্ছে তার গালে। তাওহীদা চমকে তাকালো তার দিকে। আহসান বললো,“তোমার গালে ব্যথা। ওষুধ দেবে না?”

তাওহীদা এতক্ষণে চেপে রাখা কান্না এবারে স্বশব্দে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আহসানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। আহসান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে আসতেই তাওহীদা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে আহসানের দিকে। আহসান জানলো কিভাবে তার মুখে পুড়েছে?
তার মনে অদ্ভুত এক খটকা তৈরি হয়। আহসানের এই আচরণ কি সত্যি পাগলামি, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে?

“ওষুধ নাও। গালে ব্যথা, ব্যথা!”
“তুমি জানলে কিভাবে আমার মুখ পুড়েছে?”
আহসান স্বাভাবিক তবে পাগলামি করতে করতে বললো,“আমি সব দেখেছি।ঐ ডাইনি টা তোমাকে আগুন লাগিয়ে দিলো!”
“কিভাবে দেখলে?”
“আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। দেখলাম তোমার মুখে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে এক ডাইনি!”
“তুমি স্বপ্ন দেখেছো, আহসান!”

আহসান মাথা নাড়লো। তাওহীদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“তাই এমন অস্থির হয়ে ওষুধ খুঁজছিলে?”

তাওহীদার কথায় আহসান আবারও মাথা নাড়লো। তারপর ওষুধ এগিয়ে দিলো। তাওহীদা ওষুধ হাতে নিয়ে দেখলো আহসান একদম সঠিক ওষুধ টাই তাকে দিয়েছে। মনের মধ্যে আবারও একটা সন্দেহের বীজ বপন হতে লাগলো। কি হচ্ছে এসব?

“তুমি জানলে কিভাবে এই ওষুধই লাগাতে হয় মুখ পুড়লে?”
“আমি জানি তো। এই দেখো, আমারও পুড়েছিলো!”

তাওহীদা তাকিয়ে দেখলো আহসানের হাতে পুড়নো পোড়া দাগ! লম্বা করে শ্বাস ফেললো তাওহীদা। আহসান যত্ন করে তাওহীদার পুড়ে যাওয়া মুখে মলম লাগাতে লাগলো। আহসানের কম্পনরত হাতের স্পর্শে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিলো তাওহীদার। সর্বাঙ্গ শিরশির অনুভব হলো। স্বামীর স্পর্শ বুঝি এমনই? ওর দুচোখ ভরে উঠলো কিছু না পাওয়ার বেদনায়। একটা অদ্ভুত শুন্যতায়। আহসানের এই যত্নে সে আরও বেশি আবেগী হয়ে কান্না করতে লাগলো। আহসান কেমন হাসফাস করতে করতে তার দুচোখ মুছে দিচ্ছে। যেনো তার কষ্ট এই মানুষটারও কষ্ট।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে