প্রাণ বসন্ত পর্ব-১০

0
7

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১০
#রাউফুন

রিমি একসময় সবকিছু নিয়ে পালিয়েছিল, সেই জমানো টাকার পাহাড় নিয়ে সে তার প্রেমিকের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই পাহাড় গলে যায়। প্রেমিক তার থেকে টাকা নিয়ে এক রাতে চুপিসারে পালিয়ে যায়। রিমি যখন বুঝতে পারে সে পুরোপুরি প্রতারিত, তখন তার পৃথিবী যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।

শহরের এক কোণে, নোংরা এবং ভাঙাচোরা এক ঘরে বসে রিমি চোখের জল ফেলছিল। কিছু খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। শরীর দুর্বল, মাথা ঘুরছে। তার মনের ভেতর শুধুই একটাই প্রশ্ন, “এ কি করলাম আমি? নিজের পরিবারের এত ক্ষতি করে আমি আজ একা, নিঃস্ব। মা-বাবাকে ফেলে, ভাইয়ের বউকে ফাঁসিয়ে নিজের জীবনে আগুন দিলাম। আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন?”

হাহুতাশ করতে করতে রিমি ঠিক করল বাড়ি ফিরে যাবে। সেখানে তার শাস্তি হবে, অপমান হবে—তবু অন্তত নিজেকে শুধরে নিয়ে কিছুটা হলেও পাপ মুক্ত হতে পারবে। অনেক কষ্টে ভাঙা শরীর নিয়ে সে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

বাড়িতে তখনও সবাই রিমিকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। পারভীন আর সালমার ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বাড়ছিল। তারা নিজেরাই বুঝতে পারছিল, তারা তাওহীদাকে অকারণে অপমান করেছে, এই জন্য তাদের মাঝে কোনো অপবাদ নেই বরং তাওহীদা এই অপবাদ থেকে নিস্তার পেয়ে যাবে এটাই যেনো মানতে পারছে না তারা। তারপর নিজেদের অনেক দামী গিফট, মূল্যবান জিনিস হাত ছাড়া হওয়ায় কপাল চাপড়াচ্ছে।

সেদিন দুপুরে রিমি বাড়ি ফিরে আসে। তার চেহারা দেখে কেউ চিনতে পারছিল না। চুল এলোমেলো, চোখে কালো দাগ, শরীর ক্লান্ত। বাড়ির সবাই রিমিকে একত্রে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করল। রওশন আরা এক দৌড়ে এসে বললেন, “তুই এ কী অবস্থা করেছিস রিমি? তুই কোথায় ছিলি?”

রিমি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে।

“মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাদের সবার সঙ্গে অন্যায় করেছি। আমার যে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি একবারের জন্যও ভাবিনি আমার করা বোকামো, আর ভুল এত বড় শাস্তি নিয়ে আসবে আমার জীবনে।”

মফিজ উদ্দিন কড়া স্বরে বললেন, “তোর এ অবস্থার জন্য তুই নিজেই দায়ী। আমরা তোকে কতবার সাবধান করেছিলাম, তাও শুনিসনি। এখন আবার কী চাস? তুই কি করেছিস গয়না, টাকা পয়সা, কার সঙ্গে গিয়েছিলিস তা আদ্যোপান্ত কিছুই জানতে চাইনা৷ শুধু এটা জানি তোর এই বাড়িতে জায়গা হবে না। যেখানে গেছিলি সেখানেই ফিরে যা৷”

রিমি মুখ নিচু করে বলল, “বাবা, আমি কোনো কিছু চাইতে আসিনি। আমি শুধু তাওহীদার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমি তার সঙ্গে যা করেছি, তার কোনো ক্ষমা নেই।”

রওশন আরা হতবাক হয়ে বলল,
“তুই এমন করলি কেন? তুই আমাদের এভাবে বিশ্বাস ভাঙলি?”

রিমি অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“আমি শুধু নিজের কথা ভেবেছিলাম, ভালো থাকতে চেয়েছিলাম। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।”

সালমা তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিমির দিকে৷ পারভীনও আক্রমনাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। আনোয়ার সানোয়ারও কম না। বোনের এমন অধঃপতন দেখে রাগে, ক্রোধে মাথা জ্বলে যাচ্ছে দুই ভাইয়ের। সালমা তেড়ে এসে বললো,

”তোমার উপায় ছিলো কি ছিলো না তা দেখা আমাদের কাজ নয় রিমি। আমাদের যা কিছু চুরি করে নিয়ে গেছিলে সবকিছু আমাদের ফিরিয়ে দাও।”

পারভীনও রিমিকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে বললো,“আমার হিরের নেকলেস টা এক্ষুনি ফেরত দেবে। তোমার এতো বিষ? মনে মনে এই ফন্দিই করতে আমাদের বাজারে পাঠিয়েছিলে। নোংরা মেয়ে ছেলে। এখন তো মনে হচ্ছে এসব চোরেদের জন্য এই বাড়িতে থাকা দায় হয়ে যাবে।”

আনোয়ার বোনের দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে নাক ছিটকে বললো,
“মা, তোমার মেয়েকে বেরিয়ে যেতে বলো। না জানি কার সঙ্গে নোংরামি করে ফিরে এসেছে তোমার মেয়ে। ঘেন্নায় বমি আসছে আমার। ওকে নিজের বোন বলতেও ঘেন্না হচ্ছে।”

রওশন আরা বড়ো ছেলের কথা শুনে নিজের নিয়ন্ত্রণ করা রাগ, দুঃখ কষ্ট সব উগড়ে দিলেন যা এতক্ষণ নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিলেন তিনি। মেয়ের কাছে এসে দমাদম কিল, থাপ্পড় মা’র’তে লাগলেন। কেউ কিছু বলার মতো বা আঁটকানোর মতো সাহস পেলো না৷ মফিজ উদ্দিন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের আদরের কন্যার এ কি অবস্থা? মেয়ের নোংরা কর্মকাণ্ড পিতা মাতার জন্য যে কতটা পীড়াদায়ক তা কেবল সেইসব পিতা মাতায় উপলব্ধি করেন যারা এই পরিস্থিতি ফেস করেন। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে রওশন আরা দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়েন। সালমা আর পারভীনের যেনো ক্রোধ কমে না। সানোয়ার ব্যতীত সবাই একের পর এক কটুবাক্য ছুড়তে থাকে। সানোয়ার বোনকে একটু বেশিই ভালোবাসে।

সবার কথা যেনো রিমির হৃদয়ে তীরের ফলার ন্যায় আঘাত করে। তাওহীদা স্তব্ধ হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। রিমির করুণ অবস্থায় দেখে তার চোখেমুখে দয়া আর ক্ষমার ছাপ। রিমি তার পায়ের কাছে বসে পায়ে রাখতে নিলে দু কদম পিছিয়ে গেলো সে। রিমির এই অবস্থা দেখে তার ভেতরটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইশ কি নিষ্ঠুর পরিনতি। রিমি বলল, “তাওহীদা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমাকে এত অপমান করেছি, তোমার জীবন বিষিয়ে তুলেছি। আমি তোমাকে ফাঁসাতে তোমার নুপুর জোড়া নিয়ে আলমারির কাছে রেখেছিলাম। কিন্তু সবকিছু করেছি, আমিই দোষী, আমাকে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।”

তাওহীদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আপু, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভুল ক্ষমা করেন। তবে তাঁর কাছে ক্ষমা পেতে হলে নিজের অন্যায়ের জন্য তওবা করতে হয়। আমি তোমাকে মাফ করলাম। কিন্তু আজ থেকে এই ঘরে আর কোনো মিথ্যা, অপবাদ, এবং অন্যায় থাকবে না। আমরা সবাই মিলে নতুন ভাবে শুরু করব।”

রিমি মাথা নিচু করে বলল, “তোমার কথাই সত্য, তাওহীদা। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, নিজের জীবন আল্লাহর পথে নিয়ে যাব, তুমি আমাকে একটু শিখিয়ে দিও।”

সবাই একে একে শান্ত হলেও রাগ যেনো কমলো না কারোর। মফিজ উদ্দিন বললেন, “ তোমার মতো মেয়েকে এই বাড়িতে দেখতে চাই না আমি। বের হয়ে যাও।”

তাওহীদা মফিজ উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,“বাবা, আপু নিজের ভুল বুঝে ফিরে এসেছে এটাই কি অনেক না? ভুল মানুষ মাত্রই হয়, আপুকে ক্ষমা করে দিন বাবা। আমি জানি আপনি আমার এই কথাটা রাখবেন। আপুকে আর একটা সুযোগ দিন বাবা। ফাসির আসামীও কিন্তু একটা সুযোগ পায়।”

মফিজ উদ্দিন কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আর সঙ্গে বাকিরাও যে যার যার ঘরে ফিরে গেলো। রওশন আরা কতক্ষণ স্থব্ধ হয়ে বসে ছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তাওহীদা এবং সবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর রিমি নিজের ঘরে ফিরে যায়। তবে ঘরে ঢুকেই সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। মাথায় আজেবাজে চিন্তা ভড় করতে থাকে। বাইরে থেকে যতই সব ঠিকঠাক মনে হোক, তার অন্তর এক অজানা কষ্টে ভেঙে পড়ছে।

সালমা আর পারভীন তাওহীদার দয়া ও ক্ষমার কথা শুনলেও, তাদের মনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং তারা মনে মনে নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের ছক কষছিল। এমনকি রওশন আরাও তাওহীদার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখলেও, তার মনে একটা গোপন অস্বস্তি কাজ করছিল। পরিবারের এই দ্বন্দ্ব যেন থামবার নয়।

এদিকে মফিজ উদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন, তাওহীদার গ্রামে গিয়ে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, মেয়েটার জীবন অনেক কষ্টে কেটেছে, এখন তাকে একটু হলেও এগিয়ে দিতে হবে। গ্রামে গিয়ে তিনি তাওহীদার মা, মমতাজ বেগমের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি মমতাজকে বললেন, “আপনার মেয়ে খুবই সৎ আর মেধাবী। আমি ওর পড়াশোনা আবার শুরু করাতে চাই। আপনি ওর সার্টিফিকেটটা আমাকে দিন, আমি ওকে শহরে ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়ে দেব।”

প্রথম বার মেয়ের শ্বশুর তার বাড়িতে এসেছে, তাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করবেন তা নিয়ে ভাবছিলেন৷ শরবত হাতে নিয়ে সামনে রেখে অল্প আলাপ করেই মফিজ উদ্দিন নিজের মনোভাব প্রকাশ করলেন। মমতাজ বেগম কেঁদে ফেললেন। বললেন,

“আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালো করুক। আমার মেয়ে যে কত কষ্ট করেছে, তা শুধু আল্লাহই জানেন। আপনার এ সাহায্য ওর জীবন বদলে দেবে।”

মমতাজ বেগম নিজের সাধ্যের মধ্যে মেয়ের শ্বশুরকে আপ্যায়ন করতে ভুললেন না। সেদিনই মফিজ উদ্দিন তাওহীদার এইটের সার্টিফিকেট নিয়ে শহরে ফিরে আসেন। বাড়ি ফিরে তিনি তাওহীদাকে ডেকে বললেন, “তাওহীদা, তোর পড়াশোনা শুরু করার সময় হয়েছে। তুই এখন ক্লাস নাইনে ভর্তি হবি। আর পরীক্ষায় ভালো ফল করে দেখাবি, যাতে সবাই বুঝতে পারে তুই কতটা মেধাবী।”

তাওহীদা প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও মফিজ উদ্দিনের দৃঢ়তা দেখে সাহস পেল। সে মৃদু হেসে বলল, “আপনার কথা মতো আমি চেষ্টা করব। আল্লাহ যদি চান, তাহলে অবশ্যই আমি পড়াশোনা শুরু করবো।”

তাওহীদা এবার থেকে পড়াশোনা করবে ভাবতেই তার অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে। মফিজ উদ্দিন নিজে তাওহীদার পড়াশোনার ব্যবস্থা করলেন এবং নিশ্চিত করলেন, যেন সে সব বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে।

আহসান ও তাওহীদার মধ্যে ছোটখাটো কিছু মুহূর্ত তৈরি হচ্ছিল, যা তাদের সম্পর্কের মাঝে এক নতুন মাত্রা যোগ করছিল। আহসান তার স্বভাবসুলভ পাগলামি চালিয়েই যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তে তাওহীদার মনে অদ্ভুত সন্দেহ জাগছিল।

একদিন বিকেলে তাওহীদা বারান্দা দিয়ে দেখল আহসান নামাজ পড়ছে। বিষয়টি দেখে সে কিছুটা অবাক হলো। এতদিন তো এমন কিছু সে দেখেনি! মনের মধ্যে খটকা লাগল, আহসান কি আসলেই পাগল নাকি সে অন্য কিছু লুকাচ্ছে?

তাওহীদা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। এরপর সোজা গিয়ে আহসানকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি নামাজ পড়ছো? তুমি নামাজ পড়তে জানো?!”

আহসান তার পাগলামী ভাব বজায় রেখে বলল, “তাওহীদা, তোমাকে নামাজ পড়তে দেখেছি, তুমিও তো এরকম করে নামাজ পড়ো তাই না? তাই ভাবলাম আমিও এভাবে দোয়া করবো!”

তাওহীদা কোনো কথা না বলে শুধু তাকিয়ে রইলো আহসানের দিকে। তার মনের সন্দেহটা পুরোপুরি দূর হলো না। আহসানের আচরণে যেন কিছু একটা লুকানো আছে, কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না।

এদিকে পরিবারের মধ্যে নতুন নতুন ঝামেলা চলতেই থাকে। সালমা আর পারভীন নিজেদের মধ্যে কথা বলে নতুন কোনো পরিকল্পনা করছে। রওশন আরাও তাদের সাথে মাঝে মাঝে যোগ দেয়। রওশন আরার ধারণা এখন তাওহীদার সঙ্গে কোনো ভাবেই পাওয়া যাবে না। তাওহীদাকে হাতে না রাখতে পারলে যে এই সংসারে তার দাম শুন্যে ভাসবে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে