#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৭
#রাউফুন
গ্রামের এক কোণে ছোট্ট মাটির ঘর। ঘরের বারান্দায় বসে মমতাজ বেগম কোরআনের আয়াত উচ্চারণ করছেন। তার সামনে একদল শিশু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তাওহীদার মা মমতাজ বেগম কেবল একজন মা নন, তিনি এলাকার মানুষের জন্য একজন মমতাময়ী অভিভাবক। নিজের দুঃখ-কষ্টের জীবন ভুলে প্রতিদিন মানুষকে ভালো কিছু শেখানোর চেষ্টায় লেগে থাকেন। পর্দাশীল, সততা আর ঈমানদারি হলো তাঁর জীবন চালনার যে লড়াই তা সর্বোত্তম উদাহরণ।
মমতাজ বেগমের তৎকালীন সময়ে মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়। প্রথম সন্তান হয় তার বিয়ের তিন বছর পরেই। পর পর তিনটি কন্যা সন্তান হওয়ার পর শাশুড়ী, পাড়া প্রতিবেশি সবার থেকে নানান কটূক্তি শুনেছেন তিনি। তাওহীদার বাবা মারা যাওয়ার সময় মমতাজ ছিলেন মাত্র মাত্র বিশ বছর বয়সী। তিনটি কন্যা সন্তান আর গর্ভে অনাগত সন্তান নিয়ে দুনিয়ার বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার ছোটো ছেলে জন্মের পূর্ব থেকেই জীবন তাকে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
প্রতিদিন সকালবেলা বাচ্চাদের কোরআন শেখানো তার কাজের অংশ। যা সামান্য টাকা আয় হয়, তাতে কোনোরকমে দিন চলে। বাকি সময় নিজের জমিতে সবজি চাষ করেন। নিজের হাতে ফলানো লাউ, কুমড়ো, বেগুন বিক্রি করে সংসার চালান। তবুও গ্রামে মানুষ তাকে নিয়ে নানা ধরনের কটূক্তি করতে ছাড়ে না।
“স্বামী হারা মেয়ে, একটু মেপে চলা উচিত, তার আবার কি না বাজারে সবজি বিক্রি করেন, পুরুষ মানুষ তো পাগলা হইবোই।” কিছু কিছু মহিলারা এসব বলে হাসাহাসি করে। মূলত তারা অকারণেই মমতাজকে হিংসে করে।
বিকেলে মমতাজ বাজার থেকে ফেরার সময় রাত হয়। এমন সময় মমতাজ এর সামনে গ্রামের চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। মমতাজের সারা শরীর রাগে কাঁপতে থাকে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। তিনি শামসুজ্জামানকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে সাইড কেটে সামনে অগ্রসর হয়। শামসুজ্জামানের লেলিহান দৃষ্টিতে ঘৃণায় ভেতরটা রগরে উঠছে। উগ্র স্বরে চেয়ারম্যান বলে উঠলো,
“মমতাজ, তুমি আর কত দিন এইভাবে একা থাকবে? একটু ভেবে দেখো তো। তোমার বয়সই বা কত? জীবনে নতুন করে শুরু করতে দোষ কী? আমি কি দেখতে খারাপ? আমি কি তোমাকে সুখ দিতে পারবো না?”
মমতাজ কোনো জবাব দেন না। চোখ নামিয়ে কেবল নিজের পথে হাঁটেন। শামসুজ্জামান দুদুর এমন কথা শুনতে শুনতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, কিন্তু আজকের ঘটনা ভিন্ন। এমন কদাচিৎ, বিশ্রি বাক্য মন খারাপ টা তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এদিকে মেয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি তারপর এই লোকের অসহ্য রকমের কথা। শামসুজ্জামান দুদু প্রায়ই তাকে বাজে প্রস্তাব দিয়ে অস্বস্তিতে ফেলে। যা তিনি অনেক দিন থেকেই সহ্য করে আসছেন। আল্লাহ তার প্রতি সদয় না হলে হইতো তিনি এই গ্রামে টিকতে পারতেন না।
বিকেল তিনটাই বাজারে গিয়েছিলেন মমতাজ। বাজারের মাঝখানে হঠাৎ চেয়ারম্যান তার পথ রোধ করে দাঁড়াবে তিনি ভাবতে পারেন নি।
“তোমার মেয়েদের নিয়ে তো অনেক কষ্ট করলে, আমি ওদেরও দায়িত্ব নেবো। এবার তোমার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবো।” বলে হাত বাড়িয়ে তার পথ আবার আটকায়।
মমতাজ কঠোর কণ্ঠে বলেন, “চেয়ারম্যান সাহেব, আল্লাহ আমাকে সব দিক থেকেই সামলানোর শক্তি দিয়েছেন। দয়া করে আমার পথ ছাড়ুন। আমাকে আর কখনোই এই ধরনের কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেবেন না৷ আর যদি আপনি এমন কিছু করেন তবে আমি গ্রামের সবাইকে এসব জানাতে বাধ্য হবো। নিশ্চয়ই এটুকু জানেন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আমাকে সম্মান করেন, আর এটাও জানেন আমি আজগুবি কিছু তাদের বলবো না।”
মমতাজের জোরে বলা কথায় চারপাশে লোকজন জড়ো হতে থাকে। চেয়ারম্যান লোকজন থেকে কেটে পড়লেন। তার একটা ইমেজ আছে, তা তিনি খোয়াতে চান না।
সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে তিনি খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেলেন। জোহরা আর মানহা দুই মেয়ে এবং ছেলে স্বাধীনকে দেখে তার মন খারাপ কিছু টা দূর হলো। ওরা তিন ভাই বোন হাসাহাসি, খুনসুটি করতে ব্যস্ত। মাকে দেখেই তারা ছুটে এলো।
“মা কিছু এনেছো? খিদে পেয়েছে।”
“চুপ কর স্বাধীন, সব সময় খাই খাই করিস না। মা এখন ক্লান্ত। ” মেজো মেয়ে জোহরার কথায় মৃদু হাসলেন মমতাজ। মাঝখান থেকে সেজো মেয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি স্বরে বললো,“মা এই নাও পানি। এরপর হাত মুখ ধুয়ে এসো খাবে।”
মমতাজ বেগম ভ্রুকুটি করে চাইলেন জোহরার দিকে। বললেন,“রান্না কে করলো? রান্না তো করা ছিলো না!”
“আপু আর আমি করেছি মা। আমরা ঠিক করেছি আজ থেকে আমি আর আপুও তোমাকে কাজে সাহায্য করবো যেভাবে বড়ো আপু করতো।”
মমতাজের দুচোখ ভিজে উঠলো। তিনি ছেলে মেয়েদের আদর করে কাছে ডেকে গল্পের মতো করে বলেন, “মা, দুনিয়াটা কঠিন। মেয়ে হয়ে জন্মালে লড়াই করা শিখতে হয়। দেখো, আমি তোমাদের জন্য কত কিছু সহ্য করি। কিন্তু একদিন আমরা আমাদের লড়াইয়ের দাম পাব।”
জোহরা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বোঝে, তার মা কতটা কষ্টে সংসার চালান। গর্বে জোহরার বুকটা ফুলে উঠে। মমতাজ পর্দাশীল থাকার কারণে গ্রামের অনেক মেয়ের কাছে অনুপ্রেরণা। বাচ্চাদের কোরআন শেখানোর সময় তিনি প্রায়ই বলেন, “মেয়েরা পর্দায় থাকলে তাদের সম্মান বেড়ে যায়। আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, মেয়েদের শালীনতা তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।”
নিজের সংগ্রাম ভুলে তিনি গ্রামে শান্তি আর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যান। তবে দিনশেষে, চোরাগোপ্তা বাজে প্রস্তাব আর অপমানের কথা ভাবলে তার বুকের ভেতর পুড়ে যায়।
•
রাতের খাবারের পর মফিজ উদ্দিন চুপচাপ তাওহীদার জন্য খাবার নিয়ে উপরে উঠতে থাকেন। দরজার সামনে গিয়ে তিনি তাওহীদাকে ডাকলেন।
“তাওহীদা, একটু দরজাটা খুলবি মা। বাবা এসেছি!”
তাওহীদা এলোমেলো হয়ে শুয়ে ছিলো। শ্বশুরের ডাক কর্ণকুহরে পোঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই উঠে ভালো ভাবে মাথা ঢেকে বেরিয়ে এলো। দরজা খুলতেই মফিজ উদ্দিন তাওহীদার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার।
“মা, তোর জন্য আমি খাবার এনেছি।”
“বাবা, আপনি আবার কষ্ট করে এসব করতে গেলেন কেন? আমিই যেতাম।”
“আমি জানি তুমি যেতে কি না যেতে না। আমি তোর সঙ্গে যে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি রে মা। জানি, আহসানকে এমন অবস্থায় তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমি তোর জীবন নষ্ট করেছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন কিনা জানি না।”
তাওহীদা মৃদু হেসে শ্বশুরকে ঘরে আসার জন্য জায়গা করে দিলো। ঘরের চেয়ারে বসতে দিয়ে কোমল স্বরে বলল,
“বাবা, আপনি কেন এমন কথা বলছেন? আপনি কি জানেন, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়? আমার জীবনে যা হয়েছে, তা আল্লাহর পরিকল্পনা। এখানে আপনার কোনো ভুল নেই। বরং আপনি তো আমার অভিভাবক। আপনার ছেলের সঙ্গে যদি না বিয়ে দিতেন তাহলে কি খুব ভালো থাকতাম? আমার পরিবারের অবস্থাও তো খুব একটা ভালো ছিল না। আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তাছাড়া নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম কিছুই আমার জন্য ভেবে রেখেছেন বলেই এই বাড়িতে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার দ্বারা যদি ভালো কিছু হয় তবে তা তো আমার জন্য অনেক পূন্যের কাজ হবে। হইতো এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যের হিদায়াতের জন্য সঠিক পথের সন্ধান আমার দ্বারাই আল্লাহ দিতে চান।”
তাওহীদা আহসানের দিকে তাকালো। মানুষ টা ঘুমাচ্ছে। মফিজ উদ্দিন হতভম্ব হয়ে তাওহীদার দিকে তাকালেন। এমন ভাবেও কেউ ভাবতে পারে? তার চোখে জল ভরতে শুরু করল। তিনি বললেন,
“তোর মতো মেয়ে আমার সংসারে এনে আমি হয়তো একটা বড় পুণ্য করেছি। তুই এই সংসারটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে পারবি, এই বিশ্বাসটা আমাকে বারবার সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু তাওহীদা, সবার এত অপমান, এত খোঁটা, তুই কীভাবে সহ্য করিস?”
তাওহীদা মাথা নিচু করে মৃদু হেসে বলল,
“বাবা, অপমান কেউ মরে সহ্য করে না। আমি তো বাঁচি ভালোবাসার জন্য। আমার স্বামী, তার সরলতা, তার হাসি – এগুলো আমার জীবনের শক্তি। আর আপনি তো আছেন আমার পাশে। তাই অপমান আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।”
মফিজ উদ্দিন তাওহীদার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
“তুই যদি এমন করে আমাকে সাহস না দিতিস, তাহলে আমি এতদিনে হয়তো নিজের ভুলেই মরে যেতাম। আল্লাহ তোর মঙ্গল করুক।”
তাওহীদা মিষ্টি হেসে বললো,“বাবা আমাকে খাইয়ে দেবেন না?”
মফিজ উদ্দিন এবারে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন৷ তাওহীদা হতচকিত হয়ে শ্বশুরকে দেখতে থাকে। বলে,“বাবা, আপনি এভাবে কাঁদলে আমরা কোথাও যাবো? আমার হারানো শক্তি, মনোবল কিভাবে ফিরে পাবো?”
মফিজ উদ্দিন কান্না থামিয়ে তাওহীদার মুখের সামনে খাবার ধরতেই আহসান ততক্ষণে উঠে বসে বলে,“আমাকে আগে খাইয়ে দাও তুমি!”
“উনি তোমার বাবা হয়! ” হেসে বললো তাওহীদা!
মফিজ উদ্দিন দুই ছেলে মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন। উনার চোখ বারংবার ভিজে উঠছিলো। তাওহীদা মুগ্ধ হয়ে নিজের শ্বশুরকে দেখে।
তাওহীদা এখন তেমন একটা ঘর থেকে বের হয় না। পর্দা সরানোর অপমানের পর নিজের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিবারের অশান্তি যেন থামার কোনো নাম নেই। রওশন আরা তাওহীদার প্রতি তার তিক্ততা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাকে নিয়ে নিত্য নতুন অপবাদ ছড়ায়, আর তাওহীদা চুপচাপ সহ্য করে।
এদিকে রিমি তার পরিকল্পনা শুরু করে। বাড়ির টাকা-পয়সা ও গহনা হাতানোর জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে চালাকি করে বড় ভাবি সালমা আর মেজো ভাবি পারভীনকে প্রলুব্ধ করে বলে,
“বড়ো ভাবি, মেজো ভাবি তোমরা শুনেছো তো? আজ গয়নার দোকানে বিশাল ছাড়! এত কম দামে এমন জিনিস আর পাবা না। তোমরা কি গয়না কিনবে?”
সালমা আর পারভীনের চোখ চকচকে ভাব ফুঁটে উঠলো।
সালমা খুশি মনে বলে, “চল মেজো, একসাথে গিয়ে কিছু কিনে আসি।”
সালমা আর পারভীন তো এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। রওশন আরাও তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রিমি কৌশলে তাকে বুঝিয়ে দেয়, “মা, তুমি থাকো। আমরা সামলে নিতে পারব। তুমি তো হাঁটাচলা করতে ক্লান্ত হয়ে যাও।”
সবাইকে পাঠিয়ে রিমি দ্রুত নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সে তার মাকে বলল,
“মা, একটা দুধ চা করে দাও তো। মাথাটা খুব ধরে আছে।”
রওশন আরা তেমন কিছু সন্দেহ করেনি। চায়ের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মা’কে খাইয়ে দিল রিমি। রওশন আরা কিছুক্ষণ পরেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেলেন।
এরপর রিমি বাড়ির আলমারি খুলে গয়না, টাকা-পয়সা সব ব্যাগে ভরতে শুরু করে। দ্রুততার সঙ্গে সব কিছু গুছিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
#চলবে