#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৫
#রাউফুন
তাওহীদা রিমির রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনলো কাকে যেনো বলছে,“পালানো কি মুখের কথা? তুমি বললেই কি এখন আমি পালাতে পারবো? আমি ভেবেছিলাম ভাইয়ারা আসবে, আমার জন্য দামী দামী উপহার আনবে, কিন্তু আমার দুই ভাইয়ের খাইষ্টা দুই বউ আমাকে কোনো কিছুতেই হাত লাগাতে দেয়নি। শুনো এমনি মেজাজা খারাপ আছে, এর মধ্যে তুমি পালায় পালায় করে মাথা খেয়ো না! ”
তাওহীদা না চাইতেও তার কর্ণকুহরে এই কথাগুলো এসে পৌঁছালো। ওর মাথায় শুধু এই কথাটাই বাজছে রিমি পালানোর কথা বলছে। এই বাড়ির মান সম্মান ডুববে যে এমন কিছু হলে। কারোর ঘরের সামনে আড়ি পাতাটা শোভনীয় নয়,কিন্তু সে তো ইচ্ছে করে কথা গুলো শুনে নি৷ আল্লাহ যেহেতু তাকে এই কথাটা শুনিয়েছেন নিশ্চয়ই সেটার ভালো দিক রয়েছে।
“তুই আবার পালানোর কথা বললে তোর সঙ্গে ব্রেক-আপ৷ তোর যদি এতোই শখ থাকে বিয়ে করার তবে তোর বাপ মাকে আমার বাড়িতে পাঠা, আমি আমার বাসায় ম্যানেজ করবো। না পারলে ধৈর্য্য ধর, আমি টাকা পয়সা আর গহনা যা পারি নিয়ে সুযোগ মতো কেটে পড়বো এখান থেকে!”
তাওহীদার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। সে কোনো রকমে হেঁটে গিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো সে৷ তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই সন্ধ্যায় কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিলো রিমি? এখন সে কি করবে? কাকে জানাবে? তার কথা কি বিশ্বাস করবে কেউ? শাশুড়ী মাকে জানাবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। কতক্ষণ সে ওরকম ভাবে বসে ছিলো তার ইয়ত্তা নেই। সে শুধু রিমির শোনা কথা গুলো ভুলতে পারছে না। যদি সত্যিই গহনা নিয়ে পালিয়ে যায় রিমি? কি করবে সে? এই বাড়ির মান সম্মান তো ধুলোয় মিশে যাবে। তার হুশ এলো শাশুড়ী রওশন আরার ডাকে।
“কি রে বউ? কি হইছে? ওমন তব্দা খেয়ে বসে আছো কেন? রাতের রান্দন কি রাত বারোটাই বসাইবা?”
“হাহ হাহ?” হুরমুর করে জবাব দিলো তাওহীদা। রওশন আরা খানিকটা চমকালো। বললো,
“তোমারে কি সন্ধ্যে বেলায় জ্বীনে ধরছে নাকি? কি বলি আর কি জবাব দেও? হাহ হা না করে রান্না চাপাও!”
তাওহীদা উঠে দাঁড়ালো। দোনামোনা করতে লাগলো রিমির ঘটনা টা শাশুড়ী কে বলবে কি না। তারপর কি যেনো ভেবে বিষয়টা চেপে গেলো সে।
তাওহীদা পর্দা বজায় রেখে কাজ চালিয়ে যায়। রাতে খাওয়ার সময়ও সে সামনে যায় না। বড় জা আর মেজো জা এখন বড়ো কাজ দেখাচ্ছে স্বামীর সামনে। যেখানে সব আয়োজন করেছে তাওহীদা, অথচ স্বামীর পছন্দ সই রান্না করার জন্য নিজেরা রান্নাঘরে ঢোকেনি একবারও। রাতেও খাবার ঠান্ডা বা কম মশলাদার বলে দুই ভাসুরের স্ত্রীরা অভিযোগ করলো।
সানোয়ার তিক্ত স্বরে বললো,
“মা, তোমার বউমা কি আমাদের সহ্য করতে পারছে না? এইভাবে নুনে পোড়া ডাল তারকারি কি খাওয়া যায়? এমন টা করলে কিন্তু আমরা আর থাকবো না এখানে!”
রওশন আরা হতচকিত হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। ভাতের হাত ঝেড়ে বললেন,“বিদেশ থেকে আসতে না আসতেই এসব কি কথা বাবা?”
“তো কি বলবো মা? তোমার বউমা ইচ্ছে করেই নুন ঝাল বেশি দিয়ে রান্না করেছে। বিদেশে তো আর আমরা এমন নুনে পোড়া খাবার খেতাম না।”
পারভীন সঙ্গে সঙ্গেই বললো,
“এটাই তো সে চায়। আমরা এখানে না থাকলে ওর অনেক স্বস্তি, বাবার সম্পত্তির সব ভাগ পাবে ওর স্বামী। এই জন্যই এভাবে আমাদের তাড়ানোর বন্দোবস্ত করছে। রান্নার নামে কী খাবার দিয়েছে, দেখো তো!”
আনোয়ার তেমন কিছু না বললেও সালমা বললো,“দুপুরে যে ওকে খেতে দেওয়া হয়নি সেটারই প্রতিশোধ নিলো বুঝলে মা?”
রিমি চুপচাপ খাচ্ছে। তার মনে অন্য রকম পরিকল্পনা। এদিকে চিন্তিত তাওহীদা বার বার রিমির দিকে তাকাচ্ছিলো। মনে প্রার্থনা করলো আল্লাহর কাছে, যেনো সবকিছু ঠিক থাকে। রিমি বললো,“তাওহীদা, আমাকে মাংস দাও তো! মাংস ভালো হয়েছে!”
“এই রান্না তোর কাছে ভালো লাগছে?” প্রশ্ন করলো আনোয়ার।
“হ্যাঁ লাগবে না কেন? তোমরা বিদেশ ছিলে আমি তো ছিলাম না। তোমরা বাবা মা ভাই বোনদের ভুলতেই পারো, এই ক’বছর বিদেশে থেকে বিদেশি কালচার নিজেদের মধ্যে ইনক্লুড করতেই পারো আমরা আবার বাপু ওমন না যে সব ভুলে বসবো।”
বোনের খোচা মেরে বলা কথা কারোর ই বুঝতে অসুবিধা হলো না। রিমি মাংস নিয়ে খাবার প্লেট হাতে নিজের রুমের দিকে গটগট করে হেঁটে চলে গেলো।
রওশন আরা খানিকটা বিরক্ত গলায় বললেন,”পরের বার যেনো আমাদের ছেলেদের পছন্দ সই রান্না করা হয়। তা না হলে দেখবি কি করি!”
তাওহীদা কিছু বললো না। সে জানে, এখন কিছু বললে কথা আরও বাড়বে। সবার খাওয়া শেষ হলে নিজেদের রুমে চলে গেলো। সেই সুযোগে তাওহীদা শাশুড়ীকে একা পেলো। সাহস সঞ্চার করে বললো,“ মা, রিমি আপু, টাকা পয়সা, গহনা নিয়ে কার সঙ্গে যেনো পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলো। বড়ো কোনো অঘটন ঘটার আগে আপুকে আপনি আপুর উপর নজর রাখতে থাকুন। আপনি আজ থেকে আপুর সঙ্গে ঘুমান মা! আপুর উপর নজর রাখুন!”
রওশন আরা ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। তাওহীদার গালে সপাটে চড় মেরে বললেন,
“তোর সাহস কতো বড়, তাওহীদা! আমার বাড়ির মেয়েকে তুই নিয়ে এমন নিচু মানের কথা বলিস! আজ বলেছিস, মেনে নিলাম আর যদি কখনোই এসব বলিস জবান কে’টে, মা’টিতে পুতে ফেলবো।”
তাওহীদা গালে হাত দিয়ে বললো,“আমি যে মিথ্যা কথা বলি না আপনি নিশ্চয়ই এতোদিনে তা জেনে গেছেন? আপুর খেয়াল রাখবেন মা। আমি যাচ্ছি!”
তাওহীদা রান্না ঘরে গিয়ে সব এঁটো থালাগুলো ধুয়ে মুছে রাখলো। এরপর আহসান এবং নিজের জন্য প্লেটে খাবার নিয়ে উপরে গেলো। সারাদিন থেকে পেটে দানাটিও পড়েনি। এদিকে আহসানও ঘরের অবস্থা একদম বাজে করে রেখেছে। কাগজ, কাপড় চোপড় সব এলোমেলো করে বিদিকিচ্ছির অবস্থা।
ঘরের কোথাও আহসানকে দেখতে পেলো না তাওহীদা। ভ্রুকুটি করে সারা ঘর খুঁজলো আহসানকে। বার দুই ডাকলো,“আহসান, আহসান। কোথায় তুমি?”
কোথা থেকে যেনো লাফ দিয়ে এসে তাওহীদার সামনে এসে পড়লো আহসান। স্বশ্বব্দে “হাউউউ!” বলে ভয় দেখালো তাওহীদাকে।
তাওহীদা ভয়ে কিছুটা ছিটকে সরে গেলো। ভাগ্যিস ভাতের থালাটা দুই হাতে ধরে রেখেছিলো সে। ভয়ে বুকে থুথু ছেটালো তাওহীদা।
“তুমি কি হ্যাঁ? এদিকে তোমাকে ঘরে না দেখে আমার কলিজা শুকিয়ে গেছিলো। কোথায় গেছিলে?”
আহসান আলনার দিকে আঙুলের ইশারা করে দেখালো,”ওখানে বউ!”
“ওখানে কি করছিলে?”
“ওখানে ইয়্যায়ায়া বিশাল একটা ইদুর। অনেক ইদুর। এই দেখো তোমার কাপড় কেঁ’টে’ছে, কেঁ’টে’ছে।”
তাওহীদা দেখলো তার একটা শাড়ী কে’টে কুচিকুচি করেছে। এই এখানে এমন ইদুরের উপদ্রব হলো কিভাবে? এসব ভাবনা রেখে সে আহসানকে খাটে বসালো। শান্ত স্বরে বললো,
“আচ্ছা ওটা রাখো৷ সারাদিন পেটে তো কিছু পড়েনি। আসো খাবে।”
আহসান খানিক চুপ থেকে বললো,“তুমি আগে আসো, তোমার চুলে আদর করে দিই!”
তাওহীদা অবাক হয়ে চমকে তাকালো আহসানের দিকে৷ আহসান শিশুসুলভ চোখে তাকিয়ে রইলো। সময় নিয়ে বললো,“আমি দেখেছি, বুড়িটা তোমাকে মে’রেছে!”
তাওহীদা খাটের মধ্যখানে বসলো। আহসান লক্ষী ছেলের মতো বসে রইলো। তাওহীদা ধীরে সুস্থে বললো,“তুমি যা দেখেছো, তা ভুল দেখেছো। আর যাকে তুমি বুড়ি বলছো উনি তোমার মা। মাকে কেউ বুড়ি বলে?”
“বুড়িটা তোমাকে মা”রছিলো! খুব খারাপ, খারাপ।”
তাওহীদা চোখ রাঙালো। আহসানকে খানিকটা শাসনের ভঙ্গিমায় বললো,“বলেছি না মাকে বুড়ি বলতে নেই?”
আহসান খাবার খেতে খেতে বললো,“পঁচা মা। মা পঁচা।”
“আবার আহসান? মায়েরা ভালো। মায়েরা কখনোই পঁচা হয় না!”
আহসান খাচ্ছিলো। হঠাৎই ও নিজে হাতে ভাত মেখে তাওহীদার মুখের সামনে ধরলো৷ তাওহীদা অবাক চোখে তাকালে বললো,“তুমি না রোজ আমার সঙ্গে খাও, আজ খাও না কেন? কেন?”
তাওহীদার দু চোখ ভিজে উঠলো এই সামান্য যত্ন পেয়ে। অসুস্থতা অবস্থাতেও মানুষটার কি সুন্দর সবকিছু খেয়াল থাকে, এমন একজন মানুষের কেন এমন দূর অবস্থা? তাওহীদার দুই গাল বেয়ে শীতল পানি গড়িয়ে পড়লে অসুস্থ আহসান স্বযত্নে তার দু চোখ মুছে দিলো। কে বলবে মানুষ টা অসুস্থ? এই তো কেমন সুস্থ, আর প্রানোচ্ছল লাগছে! তাওহীদা কি কখনোই সুস্থ অবস্থায় স্বামী সোহাগ পাবে? স্বামীকে একটা সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে কি সে সক্ষম হবে? সবকিছুই যে আল্লাহর হাতে। সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা যে কেউ ধরতে পারবে না কস্মিনকালেও। কারোর সেই ক্ষমতা নেই। তাই সে সবকিছুই আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলো।
#চলবে