#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৩
#রাউফুন
তাওহীদা আজকে রাতেও ঘুমাতে পারলো না। তার শরীরের আঘাত এখনো শুকাইনি। বড় জায়ের দেওয়া গরম খুন্তির ছ্যাকা আর কথার কষ্ট দুইটাই যেন তার হৃদয়ে একেকটা বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধে আছে। আহসান বাচ্চাদের মতো পাশেই ঘুমিয়ে আছে। তার সরল চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজের দুর্বল মনকে আবার শক্ত করার চেষ্টা করলো তাওহীদা। আহসান ঘুমের ঘোরে তাওহীদাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। তাওহীদার কেমন দম বন্ধ লাগছে। এক বছরের স্বামীর সত্যিকারের ভালোবাসা কি তা সে অনুভব করেনি। আহসান শুধু ঘুমের মধ্যে তাকে জাপ্টে ধরে ঘুমাই। এতেই যেনো তাওহীদার সারাদিনের সকল ক্লান্তি, গ্লানি মোচন হয়ে যায়। আহসানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাওহীদা। তার বয়স সবে আঠারো পড়েছে। সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তার। অথচ এই বয়সেই তাকে কতো কিছুই না সইতে হচ্ছে।
পরদিন সকাল থেকেই বাড়িতে অন্যরকম ব্যস্ততা। দুই ভাসুর বিদেশ থেকে আসবে। গোটা বাড়ি যেন উৎসবের আমেজে ভরে উঠেছে। রওশন আরা তাকে সকাল থেকেই নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। নির্দেশনা দিতে দিতে তাওহীদার কাজে নানান ভুল ধরতে থাকে আর এটা সেটা বলে খোচাতে থাকেন। তাওহীদা কানে তুলো গুজে রাখার মতো সারাদিন কাজ করতে থাকে। বিকেলে তার শাশুড়ী তাকে ডেকে বলেন,
“তাওহীদা, বাজারে যাও। মুরগি, মাছ, সবজি সব কিনে আনতে হবে। আমার বড়ো ছেলে আর মেজো ছেলে আসবে আজ। সব যেন একদম পারফেক্ট হয়। আর ভুল করলে এবার কিন্তু খবর আছে।”
“ মা, কি কি আনবো তার একটা ফর্দ দিয়ে দিন। আমি যাচ্ছি।”
“আমার ছেলেরা যা যা পছন্দ করে সবকিছুই এখানে লেখা আছে৷ আর এই নাও টাকা, বাজার করার জন্য রাখো। আবার লোভে পড়ে টাকা হাতিয়ে নিও না যেন!”
“তাওহীদা আর যাই হোক চোর নয় মা। এটুকু নিশ্চয়ই আপনি নিজেও বিশ্বাস করেন। অথচ আমায় কথাঘাতে কষ্ট দেওয়ার জন্য কি সুন্দর তৎপর থাকেন।”
কথাটা বলেই তাওহীদা সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। রওশন আরা সামান্য এই কথাতেই যেনো জ্বলে উঠলেন। কর্কশ গলায় বললেন,
“ছোটো বউ! মুখে লাগাম টানো। যত বড় মুখ বা তত বড়ো কথা? আমি শুধু তোমাকে কথায় শোনায়?”
“এই প্রশ্নের উত্তর টা আপনার কাছে আছে মা। যাই হোক, আমি রেডি হয়ে যাচ্ছি বাজারে।”
রওশন আরা হতভম্ব হয়ে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটা কি তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে নাকি? এভাবে চললে তো তার হাত থেকে সবকিছু বেরিয়ে যাবে। না না সবকিছু নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতে যা কিছু করার তাকে করতেই হবে। সংসারের চাবি কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না। নিজের দাপট দাপিয়ে রাখলে তাঁর নিজের মূল্যায়ন কমে যাবে। এটা তো কোনো ভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।
তাওহীদা জানে, এসবের দায়দায়িত্ব তার ওপরই পড়বে। আগে দুজন কাজের লোক ছিলো সে বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পর তাদের ছাড়িয়ে দিয়েছে। দুই জায়ের একজনও যে এখন কেউ ঘর থেকে বের হবে না সে সম্পর্কে তাওহীদা অবগত। তারা আজ নিজেদের সাজগোজ আর আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। তাওহীদা আর বলার সাহসও পেলো না তাদের কিছু বলার। সকালেই ব্যবসার কাজে তার শ্বশুর মফিজ উদ্দিন চট্টগ্রাম গেছেন। ফলে এই পরিস্থিতিতে তাকেই বাজারে যেতে হবে। তার ভাসুরেরা বাসায় আসতে আসতে রাত হবে। বাজার থেকে আসতে আসতে তার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। যাওয়ার আগে থেকে তার ভেতর টা কেমন যেনো ভয়ে তটস্থ হয়ে রইলো।
ফর্দ অনুযায়ী সবকিছুই কিনে নিলো তাওহীদা। সবকিছু আবারও একবার পর্যবেক্ষণ করে মিলিয়ে নিলো। আবার কোনো জিনিস যদি নিতে ভুল হয় তবে তা নিয়েও অনেক কথা হবে। তাই সে বার বার সবকিছু মিলিয়ে নিলো। বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে সরু গলি দিয়ে আসার সময় তাওহীদার মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে।
ক্ষনকাল যেতেই কিছু বাজে ছেলের কটূক্তি শুনে তাওহীদা দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো । কিন্তু হঠাৎ করেই একটা ছেলে লাফ দিয়ে তার সামনে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। তাওহীদা ভয়ে ছিটকে গেলো। পেছনে পিছিয়ে যেতে নিলেই মনে হলো পেছনেও কেউ আছে। সে দোয়া পড়তে শুরু করলো। বিপদের সময় ঘাবড়ে গেলে চলবে না৷ আল্লাহকে মনে প্রাণে ডাকলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে সাহায্য করবে। সে দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলো। তখনই একটা বিদঘুটে গন্ধ ওর নাকে লাগলো৷ ছেলে দুটোর মধ্যে একজন বললো,
“কি সুন্দরী! এত কাজকর্ম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছো, না? একটু আমাদের সঙ্গে চলো! আমরা আদর যত্ন করবো। আহারে ব্যাগ গুলো ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে আমাদের কাছে দাও আমরা নিয়ে যাচ্ছি। ”
তাওহীদার চোখ ব্যতীত কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ অথচ লোক গুলো তাকে কি বাজে ভাবে উত্যক্ত করছে। এই রাস্তাটা এতো সুনশান কেন? সরু চিকন গলি ধিরেই বড়ো রাস্তায় উঠতে হয়৷ এরপর রিকশা বা অটো পাওয়া যায়৷ তাওহীদা সাহস করে চিৎকার করলো, “আল্লাহর ভয় করুন! আমাকে যেতে দিন।”
তাওহীদার কথা শুনে লোক দুটো খিকখিক করে কুটিল হাসলো।
তারা আরও এগিয়ে এলো। তাওহীদা অনুনয় করে বললো,“আমি আপনাদের ছোটো বোনের মতো, আমাকে যেতে দিন ভাইয়া! দয়া করুন।”
”সুন্দরী রা থাকবে ঘরের মধ্যে, তা বাইরে কি? তোমাকে তো ছাড়া যাবে না সুন্দরী!”
“আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য করুন।”
করুণ গলায় তাওহীদা আল্লাহর কাছে পানাহ চাইলো। তাওহীদা একদম গুটিশুটি মেরে নিচে বসে পড়লো৷ একটা ছেলে তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে, এক ইঞ্চির গ্যাপ ঠিক তখনই, এক আগুন্তুক ছায়ার মতো হাজির হলো। তার গতিবিধি এমন ছিলো যেন সিনেমার কোনো মার্শাল আর্ট জানা লোক এসে ঢাম করে ছেলেটার ঘাড়ে আঘাত করলো। একে সঙ্গে দুটো ছেলেকেই মাত করে দিলো।
“কে তুই? আমাদের গায়ে হাত দিস?”
ছেলেটা বোধহয় উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। দুজনকে দুই হাতে ধরে ধুমধামে পে’টা’তে লাগলো। আর বিড়বিড় করতে লাগলো,“মেয়েদের একা পেলেই তাদের হেনস্তা করা? জীবনের মতো বিকলাঙ্গ করে দেবো আজ! সাহস দেখাবি না ইহ জীবনে কোনো মেয়েকে উত্যক্ত করার।”
আগুন্তক ইচ্ছে মতো দুজনকে আঘাত করেই যাচ্ছে। তাওহীদা অষ্টম আশ্চর্য হয়ে শুধু সামনের দৃশ্য দেখতে লাগলো। আঘাতের পর আঘাত সহ্য করতে না পেরে ছেলে দুটো ছুটে পালিয়ে গেলো। আগুন্তকও ছুটলো তাদের পিছনে তাদের ধরার জন্য। তাওহীদা যেনো নড়াচড়া করতেই ভুলে গেলো। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে এসব কি হয়ে গেলো। ঘটনা টা এতো দ্রুত ঘটলো যে তাওহীদার সবকি মাথার উপর দিয়ে গেলো।
আগুন্তক কিছুক্ষণ পর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। তাওহীদা আতঙ্ক আর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। আগুন্তুকের মুখে কালো মাস্ক। চোখ সানগ্লাস। তাওহীদার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, “ উঠে আসুন, আপনি ঠিক আছেন?”
ঘোর থেকে বেরিয়েই তাওহীদা শুকনো কণ্ঠে শুধু বললো, “শুকরিয়া।”
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দৌঁড় লাগালো আগুন্তককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। ব্যাগ হাতে দৌঁড়াতে গিয়ে তার মনে হলো, দুটো পাথর হাতে দৌঁড়াচ্ছে সে। আগুন্তক কি যেনো ভেবে নিজের রাস্তা ধরে চলে এলো। বড়ো রাস্তায় উঠে তাওহীদা মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো আল্লাহর কাছে। তার মনের মধ্যে ওই আগুন্তুকের সাহসী আচরণ যেন একটা গভীর ছাপ ফেলে গেলো। আগুন্তকের কন্ঠটা গম্ভীর আর শীতল। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দর কন্ঠঃস্বর লোকটার। তাওহীদার কানে বার বার সেই কন্ঠঃস্বরটা বাজতে লাগলো। ভয়ে এখনো তার বুকটা ধড়ফড় করছে।
তাওহীদা যখন বাড়ি ফিরলো, তখন রওশন আরা চিৎকার করে উঠলেন, “ বাড়ির বাইরে পা দিয়ে কি পাখা গঁজিয়েছে দুটো? সন্ধ্যা লাগিয়ে দিলে একটু বাজার করতে গিয়ে। কি করছিলে যে এতো দেরি হলো?”
“বাজারের ফর্দ সব মিলিয়ে দেখুন, আমি ঘর থেকে এসে রান্না চাপাবো।”
তাওহীদা বাজারের ব্যাগ রেখে চিলেকোঠার ঘরের দিকে ছুটলো৷ ঘরে ঢুকেই ধপাস করে দরজা আঁটকে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে বাজারে গেছিলো একটা মেয়ে হয়ে অথচ, তাকে একবারও জিজ্ঞেস করলো না কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। অথচ কটুবাক্য ছুড়তে ভুল হয়নি তার শাশুড়ী মায়ের। এই পর্যায়ে এসে তাওহীদা হামলে কেঁদে উঠলো। আহসান বিছানায় বসে খুটখুট করছিলো। তাওহীদার কান্নায় সে ছুটে এলো।
“কি হয়েছে বউ? কাঁদো কেন? কাঁদো কেন?”
তাওহীদা আহসানের বুকে হামলে পড়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আহসান তাওহীদার মাথায় হাত রেখে বলে,“ওরা তোমাকে আবার বকেছে?”
“নাহ!”
“আমি জানি বকেছে! আমি ওদের পি’ট্টি দিয়ে দেবো। তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার কান্না আসে! এই দেখো!”
তাওহীদা চোখ মুছলো। আহসানের চোখে সত্যিই পানি। সে ঝটপট তার চোখ মুছে দিলো। বললো,“এই দেখো আমি কাঁদছি না। সব সহ্য করতে পারবো তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারবো না৷”
“আমিও পারি না,আমিও পারি না৷ বউ তুমি কোথায় গেছিলে শুনি?”
তাওহীদা উত্তর দেওয়ার পূর্বেই নিচ থেকে শাশুড়ীর হাকডাক শুনতে পেলো।
“মহারানী কি ঘরে গিয়ে কুড়োর মতো শুয়ে পড়লো নাকি? বলি এতো সব রান্না কখন হবে শুনি?”
তাওহীদা ঘর থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত শরীরে রান্নাঘরে ঢুকলো। বাজারে যে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটা তার মন থেকে এখনো মুছে যায়নি। কিন্তু সে জানে, এই বাড়িতে এসব নিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয় না। উল্টো তিরস্কার আর অপমানের পাহাড় গড়াবে।
রওশন আরার আবার সেই কথা,
“এত সময় লাগলো কেন? এত দেরি করার মানে কী? বাজারে কি গল্প করতে গিয়েছিলে?”
তাওহীদা চুপ। কোনো উত্তর দিলো না। সে জানে, উত্তর দিলেই কথা আরও বাড়বে। তাওহীদা মাথা নিচু করে সব শুনলো। তার হাত দিয়ে রান্নার সব কাজ করছে, কিন্তু মনের ভেতর যেন কোনো একটা কিছু জ্বলছে। আজকের হেনস্তার কথা মনে পড়ছে। ওই আগুন্তুকের কথা মনে পড়ছে। যদি সে না থাকতো, তাহলে আজ কী হতো?
তাওহীদা চুপচাপ কাজ করতেই থাকে। রান্নাঘরে একা সে গোটা বাড়ির লোকের জন্য খাবার তৈরি করছে। তার এখনো থেকে থেকে শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। কিন্তু কেউ সেটি দেখতে পায় না। একবারও কেউ জানতে চায় না, কেন তার বাজার করতে এত দেরি হলো।
#চলবে