#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব২
#রাউফুন
“পাগল স্বামীরে নিয়ে এতো দেমাগ কই থেকে আসে তোর? তোর স্বামী তো কিছু করে না। দুই স্বামী বউ মিলে যে আমাদের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাচ্ছিস, লজ্জা করে না আবার আমাদেরই মুখে মুখে তর্ক করিস?”
তাওহীদা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এতক্ষণে সে একটু হলেও জবাব দিতে পারছিলো কিন্তু এই খানটাই এসে সে বারংবার আঁটকে যায়৷ করুণ চোখে শাশুড়ীর দিকে তাকালো সে। দেখলো নির্বিকার চিত্তে তার শাশুড়ী পান মুখে দিচ্ছে।
“মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো কেন ছোটো বউ? আমি করবো? আমি কি বলছিলাম তুমি বড় বউর মুখে মুখে চোপা করো?”
তাওহীদা নরম গলায় উত্তর দিলো,
“আমার স্বামী তো আপনারই ছেলে আম্মা, তাকে এভাবে পাগল বলছে আর আপনি কিছুই বলবেন না? আমার স্বামী হওয়ার আগে তো সে আপনার সন্তান।”
“কি বলবো? পোলায় তো আমার পাগলাই। যে যেমন তারে সেটা ডাকতে আবার কিসের বাঁধা।”
তাওহীদার দুই চোখ ফেঁটে কান্না আসে। এই বাড়িতে বিয়ে হওয়ার এখন এক বছর হলো অথচ বিয়ের পর দিন থেকে শুরু করে এখনো অব্দি সে একটা দিনও শান্তিতে সংসার করতে পারেনি। স্বামী মানসিক ভাবে পাগল। হাতে তুলে খেতে পর্যন্ত পারে না। ভাগ্যক্রমে তার বিয়ে হলো এই পাগলের সঙ্গে। আল্লাহ তার কপালে যা রেখেছেন তাই তো হবে। সে আফসোস করে না নিজের ভাগ্য নিয়ে। কিন্তু সব সহ্য হলেও যখন আহসানকে কেউ পাগল বলে সে কোনো ভাবেই যেনো মানতে পারে না। যে-মনই হোক, লোকটা তো তার স্বামী।
তারা তাওহীদাকে নিম্নমানের ভেবে প্রতিনিয়ত খোঁটা দেয়। আসলেই তো যার স্বামী পাগল তার আবার মুখে মুখে এতো চোপা চলে না। সে নত মস্তকে বড়ো জায়ের ফেলা ময়লা গুলো তুলে আবার ঘর মুছলো। সে ঘর মুছছিলো সেই মোছা স্থানে ইচ্ছে করে তার বড়ো জা ময়লা ফেলে। কথার মধ্যে সে শুধু বলেছিলো,
“ঘরের ময়লা গুলো এনে এখানে না ফেলে ময়লা ফেলার বাক্সে ফেলতেন ভাবি!”
সালমা তীর্যক কন্ঠে বলে,
“এখানেই ফেলবো। তোর সাহস কি করে হলো আমার ঘর না ঝাড়ু দিয়ে ঘর মুছিস? সকালে সবার ঘরই তো ঝাড়ু দিয়েছিস আমার ঘর কেন ঝাড়ু দিস নি?”
তাওহীদা উত্তর দিয়েছিলো,“ভাবি, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, তাই আর ডেকে ঘর ঝাড়ু দিই নি।”
“পরে তো উঠেছিলাম, তখন কেন দেস নি?”
“তখন তো আমি অন্য কাজ করছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সামান্য ঘরটা আপনি নিজেই ঝাড়ু দিতে পারবেন!”
পরবর্তীতে কথার পরিপ্রেক্ষিতে উপরের কথাটা তাকে খোটা দিয়ে ঠেস মেরে বলে।তাওহীদার ইচ্ছে করছিলো গলা ফাঁটিয়ে কান্না করতে। কিন্তু সে নিশ্চুপে অশ্রু আড়াল করতে ব্যস্ত হয়। অন্যের সামনে নিজের দূর্বলতা দেখানোর কোনো মানেই নেই৷ সে সব সময় চুপ থাকে তাই বলে এটা না যে সে প্রতিবাদের ভাষা জানে না।
তর্কে জিততে চাইলেও চুপ করে থাকা এবং বিনয়ী আচরণ করা সম্পর্কে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস আছে।
আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তর্কে জিতে যাওয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা ছেড়ে দেয়, আমি তার জন্য জান্নাতের প্রান্তে একটি ঘর নিশ্চিত করছি। আর যে মিথ্যা বলা ছেড়ে দেয়, যদিও তা কৌতুকের উদ্দেশ্যে হয়, আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘর নিশ্চিত করছি।”
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, অহংকার বা অন্যায় উদ্দেশ্যে তর্ক করা ইসলাম সম্মত নয়। সঠিক থাকা সত্ত্বেও বিনয় বজায় রাখা একটি মহৎ গুণ।
তাওহীদার মা অনেক নেককার মানুষ। কোর-আনে হাফেজা। তাকে স্কুলে পড়ালেও পাশাপাশি নিজেই তার মা সব কিছু তাকে শেখাতেন। সে যে পর্দা করে এটাও এই বাড়িতে কারোর সহ্য হয় না।
আজ শুক্রবার। আজকে তার শ্বশুর বাড়িতেই আছে। মফিজ উদ্দিন শুক্রবার,শনিবার কখনোই অফিসে যান না অত্যন্ত প্রয়োজনেও।
দুপুরের খাবারের পর মফিজ উদ্দিন তাওহীদাকে ডেকে নিলেন। তিনিই একমাত্র মানুষ, যিনি তাওহীদাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন না। তাওহীদা হাত মুছতে মুছতে মাথায় আচল ভালো ভাবে টেনে দিলো। নম্র গলায় শুধালো,
“বাবা ডাকছিলেন?”
“এই নে মা কিছু টাকা আছে এখানে, তোর প্রয়োজন পড়বে। আগামীকাল তোর ভাসুরেরা বিদেশ থেকে ফিরবে। আমার এতো বড়ো ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও ছেলে গুলো কেন যে বিদেশে গেলো ওরাই ভালো জানে। ওদের নাকি ব্যবসা ভালো লাগে না। ওরা আসলে তো তোর পর্দার অসুবিধা হবে। যা কিছু প্রয়োজন কিনে নিস,মা।”
তাওহীদা না চাইতেও টাকা টা নিলো। কারণ এখানে তার পর্দার ব্যাপার টা এসেছে। টাকা টা নেওয়ার পর দেখলো বেশ কিছু টাকা। সে বলে,
“বাবা এতো গুলো টাকা তো লাগবে না। এক হাজারের মধ্যেই হবে।”
“এতো কথা বলো না বাপু৷ এখানে এসেছো থেকে ক’ টাকা দিয়েছি তোমাকে? তুমি রেখে দাও, যা দিয়েছি। এখানের মার্কেটে তো যাওনি তাই জানো না জিনিস পত্রের কি দাম।”
শাশুড়ী মা নিশ্চয়ই তার ঐ ছেলের বউদের নিয়ে ব্যস্ত? কারণ উনি রুমে থাকলে তাকে তার শ্বশুর তাকে খুব একটা কাছে ডাকেন না। তাওহীদা আর কথা বাড়ালো না। আঁচলে টাকা বেঁধে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালে মফিজ উদ্দিন তাকে আবার ডাকলেন। তাওহীদার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“মা, আহসানকে নিয়ে সব সময় এতো চিন্তা করিস না। ওর যা সমস্যা, সেটা সব এই গত দুই তিন বছর ধরে। আমার ছেলেটা ভীষণ ভালো আর মেধাবী ছিলো। আল্লাহ জানেন সে কেনো এমন পাগলে পরিণত হলো। কিন্তু তুই এমন মেয়ে যে আমার ছেলেকে ঠিক সামলে নিতে পারবি। এই বাড়ির সবার কথায় কষ্ট পাবি না। আমার অলক্ষে এই বাড়িতে অনেক কিছুই হয়, ঝামেলা হবে, সেজন্য আমি কিছু বলতে পারি না। ”
তাওহীদার চোখ ভিজে গেল। শ্বশুরের এমন কথাগুলো তার শক্তি জোগায়। সে মাথা নিচু করে বলল,
“বাবা, আপনি শুধু আমাদের দোয়া করবেন। আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী সব করব।”
আহসান যে ছোটো থেকেই পাগল নয় তা প্রথমে তাওহীদা জানতো না। এখন কিছুদিন পূর্বের জেনেছে, তাই সে সবর করে আছে। সবর কারীকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা পছন্দ করেন। সে বললো,
“বাবা কোর-আনে একটি আয়াতে আছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।”
আরও একটি হাদিসে আছে, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“তুমি জেনে রাখো, ধৈর্য ধারণ করার ফলে তোমার মধ্যে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে, আর তোমার অবস্থান উঁচু হবে।” তাই আমি সম্পুর্ন ধৈর্য্য ধরে এই সংসারে পড়ে আছি। কেউ না ভালোবাসলেও আমি তো আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন বাবা। এটাই যে আমার পরম পাওয়া।”
মফিজ উদ্দিনের বড়ো মায়া হয় এই মেয়েটার জন্য। যখনই উনার খারাপ লাগে মেয়েটার সঙ্গে দুটো কথা বলে মনটা হালকা করেন। নিজের মেয়েটা তো মনের ভুলেও এসে বাবা ডাকে না। কেন যে মেয়েটা তার এমন হলো। আগে তো এমন ছিলো না। ভার্সিটির হলে উঠার পর তিনিই স্বেচ্ছায় অনেক ফোন দিয়েছে কিন্তু তার মেয়েটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে দু একটা কথার উত্তর দেয়। বুকে চাপা কষ্টের আবির্ভাব হলো মুহুর্তের মধ্যেই। তাই তাওহীদা যখন সব সময় তাকে বাবা বাবা বলে ডাকে অন্তর টা জুড়িয়ে যায়। বেশ স্নেহ জাগে ভেতর থেকে মেয়েটার জন্য। মেয়েটা এতোটাই নাজুক যে কখনোই মুখ ফুটে নিজের জন্য কিছু চাইবে না।
সারাদিন পর তাওহীদা আজ ওতো সময় পায়নি আহসানের খেয়াল রাখার। আগামীকাল তার ভাসুর দুজন আসায় অনেক ধকল গিয়েছে। আজ মানুষ টা অনাহারে। তাওহীদার আবারও বুক ফেটে কান্না এলো। সে নিজেও খাইনি কিছু। খাবার হাতে ঘরে ঢোকার সময় আহসানকে দেখলো তার সহজ সরল স্বামীটা বরাবরের মতোই খাতায় মুখ গুজে আছে। তাকে দেখা মাত্রই আহসান শিশুদের মতো হাততালি দিয়ে বলল,
“বউ, আমি আরও ছবি একেঁছি। এই দেখো, দেখো।”
পর মূহুর্তেই কিছু একটা মনে পড়তেই মুখ গোমড়া করে বললো,“আমি আজ আড়ি করেছি। কথা নাই।”
তাওহীদা পলক ঝাপটালো। চোখ মুছে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“কেন, কেন?”
“সারাদিনে এখন এসেছো উপরে?”
তাওহীদা হাসল। বলল, “কি ছবি একেঁছো দেখি?”
“দেখাবো না। আমার খিদে পেয়েছে!”
তাওহীদার দু চোখে অশ্রুরা ভীড় জমালো। তাদের ঘরটা উপরে দোতালায় চিলেকোঠায়। এত বড়ো বাড়িতে তাদের স্থান হলো চিলেকোঠার ঘুপসি দেওয়া ঘরে। অথচ এ নিয়েও কোনো অভিযোগ নেই তার মনে। তাওহীদা স্বামীর রাগ ভাঙাতে বলল, “এই যে কানে ধরেছি। আর কখনোই এমন হবে না।”
গাল ভরে হাসলো আহসান। তাওহীদাকে পাশে টেনে বসিয়ে বলল, “তুমি বলো আমি কি ছবি আঁকবো?”
“তুমি আমাদের স্বপ্নের ছবি আঁকো, আহসান। একটা এমন ঘর, যেখানে কেউ কাউকে ছোট করবে না। সবাই ভালোবাসবে। সেখানে আমরা সবাই থাকব, সুখে।”
আহসান যেন কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু বলল,
“তাই তো বলি! আমরা সুখেই তো আছি। তুমি আমার বউ, আমি তোমার স্বামী। এর চেয়ে সুখ আর কিসে?”
তাওহীদা আহসানের সরল কথায় বিস্মিত হয়ে গেল। আহসানের অসুস্থতার মধ্যেও সে তাওহীদার জন্য ভালোবাসার এক আশ্রয়।
তাওহীদা মনে মনে ভাবল, এই সরলতাই তো তার শক্তি। আল্লাহ তাকে যদি কোনো পরীক্ষার জন্যই এই সংসারে পাঠিয়ে থাকেন, তবে সে মাথা উঁচু করে সেই পরীক্ষা পার করবে। ভালোবাসা দিয়ে, ধৈর্য দিয়ে। সে আহসানকে খাওয়াচ্ছিলো সঙ্গে নিজেও খাচ্ছিলো। আহসান ছবি আকঁছে। তার হাত খুব দ্রুত চলছে।
তাওহীদা খাতার দিকে তাকিয়ে দেখল, আহসান একটা ছোট্ট ঘর এঁকেছে। ঘরটার সামনে দুজন মানুষ। একজন হাসছে, আরেকজন গাছের নিচে বসে আছে। আহসান ছবিটা দেখিয়ে বলল,
“বউ, এটা আমাদের ঘর। আমরা এখানেই থাকব, কেউ আমাদের কিছু বলবে না। তুমি খুশি থাকবে, আমিও।”
তাওহীদা কান্না চেপে হেসে বলল,
“আমাদের ঘর তো এখানেই আছে, আহসান। আমরা তো সুখেই আছি, তাই না?”
আহসান সরল মনে মাথা নেড়ে বলল,
“তাই তো! তুমি আছো, আর কি চাই!”
#চলবে
রেফারেন্স ১.) (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৪৮০০; তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ১৯৯৩)৷
রেফারেন্স ২.) (সুরা আল-বাকারা: ১৫৩)
রেফারেন্স৩.(মুসলিম শরীফ: ২৯৯৯)