#কাঁটামুকুট
পর্ব-৪
সিমরানের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে তাকে ঘরে আটকে রেখে বেরিয়ে গেলেন মা বাবা দু’জনেই। সিমরান ওদিকে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে। কিন্তু মা বাবার কানে যেন কিছুই ঢুকছে না। তারা ভেবে পাচ্ছেন না যে ভয়ানক গর্তে মেয়ে পড়ে গেছে তা থেকে কেমন করে তাকে টেনে তুলবেন। এত বড় বিপদ তাদের জীবনে ইতিপূর্বে কখনো আসেনি। এ ধরনের বিপদ আসতে পারে বলে কল্পনাও তারা কোনোদিন করেননি। মেয়েটা যদি কোনো অবিবাহিত ছেলে ছোকরার সাথে পালাত, তাহলে ধরে বিয়ে দিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু এবার যে অঘটন ঘটেছে তার কোনো সমাধান কি আদৌ হতে পারে? এসব জানাজানি হলে সমাজে মুখ দেখানো অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে তো কোনো আশাই নেই। চারদিকে যেন অন্ধকার ছেয়ে আসছে।
বাবার সবচেয়ে বেশি রাগ লাগছে ইশতিয়াকের ওপর। তার মেয়েটা তো ছোটো। ওই বুড়ো ভাম কেমন করে এইটুকু মেয়ের ওপর নজর দিতে পারল! এত কুটিল দুশ্চরিত্র লোক কেমন করে হতে পারে! একটাবার ভাবল না মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা! বোকা মেয়েটার মাথা খেয়েছে দামী দামী উপহার দিয়ে।
বাবা কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। রওনা দিলেন অফিসের উদ্দেশ্যে।
আজ অফিসে কাজ করার কোনো ইচ্ছে বা ক্ষমতা তার নেই। তিনি এসেছেন ইশতিয়াক আহমেদের সাথে কথা বলতে। ইশতিয়াকের কেবিনে তিনি যখন ঢুকলেন তখন ইশতিয়াক মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল দেখছে। অনুমতি না নিয়ে কেউ ঢুকে পড়েছে দেখে ভুরু কুঁচকে চাইতেই সিমরানের বাবার রুদ্রমূর্তি দেখে খানিকটা ভড়কে গেল ইশতিয়াক৷ তবুও গলাটা স্বাভাবিক রেখে বলল, “কোনো সমস্যা সারওয়ার সাহেব?”
সিমরানের বাবা দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করে বললেন, “আমার মেয়ের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?”
ইশতিয়াক অবাক হবার ভান করে বলল, “আপনার মেয়ে…ও সিমরান! সুইট একটা মেয়ে। কী হয়েছে ওর?”
“গতরাতে… ” বলতে বলতে থেমে যেতে হলো সারোয়ার সাহেবকে। তাদের দু’জনেরই সিনিয়র স্যার এসেছেন প্রোজেক্টের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে। সারোয়ার সাহেবকে দেখে তিনি খানিক অবাক হয়ে বললেন, “সারোয়ার সাহেব, আপনি এভাবে ক্যাজুয়াল ড্রেসে অফিসে চলে এসেছেন যে?”
সারোয়ার সাহেব খেয়াল করলেন তিনি একটা ফতুয়া আর পায়জামা পরেই চলে এসেছেন। কিন্তু এই স্যারকে তো আর কারনটা বলা যাবে না। তিনি বললেন, “স্যার, একটু তাড়াহুড়ো করে ভুলে এসব পরেই চলে এসেছি।”
“আপনাকে ঠিক সুস্থ দেখাচ্ছে না।”
ইশতিয়াক পেছন থেকে বলল, “আমারো তাই মনে হয়৷ ইদানীং উনি একটু বেশিই খাটাখাটুনি করছেন।”
স্যার বললেন, “আজকের দিনটা বরং আপনি ছুটি নিয়ে রেস্ট করুন। কাজ তো অনেকদূর এগিয়েই গেছে।”
“জি স্যার।” বলে বেরিয়ে গেলেন বাবা। তিনি তারপরেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন ইশতিয়াকের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু সুযোগ পেলেন না। ইশতিয়াকের কেবিনে সবসময়ই কেউ না কেউ আসছে, যাচ্ছে কিংবা সে ফোনে ব্যস্ত থাকছে।
অগত্যা সিমরানের বাবা বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরে দেখলেন আরেক কান্ড। সিমরানের মা অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে বসে আছেন। জানা গেল সিমরান নাকি হুমকি দিচ্ছিল দরজা খোলা না হলে সে হারপিক গ/লায় ঢা/লবে। তারপর ম/রলে ম/রবে, বাঁচলে ছাদ থেকে ঝাঁ/প দেবে। এসব হুমকিতে ভয় পেয়ে মা দরজা খুলে দিয়েছিলেন৷ সিমরান বেরিয়ে এসে বিশাল তান্ডব সৃষ্টি করে নিজের মোবাইল খুঁজে বের করেছে। মাকে যা নয় তাই বলেছে। এখন নিজের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে বসে আছে।
সব শুনে বাবা দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন সোফায়। তার এখন কী করণীয় কিছুই মাথায় ঢুকছে না৷
*******
সিমরান মোবাইল হাতে পেয়ে ইশতিয়াককে অনেকবার কল করেছে। ইশতিয়াক ধরেনি। তার ভয় হচ্ছে বাবা অফিসে গিয়ে ইশতিয়াককে কিছু বলেনি তো? নাহলে তো এরকম করার কথা না।
সন্ধ্যার দিকে মা আর বাবা দু’জনেই সিমরানের ঘরে এলেন। রাগ করে নয়, উত্তেজিত হয়ে নয়, বরং খুব সুন্দর করে বোঝালেন, সে যা করেছে বা করছে সেসব কত ভয়ঙ্কর খেলা। এর ফলাফল কতটা মারাত্মক হতে পারে।
কিন্তু সিমরানের মাথায় ঢুকল না এসব কোনো কথা। বাবা মা যতই বোঝান, সিমরান ততই যেন তার কথায় অনড় হয়ে যায়, ভাঙা রেকর্ডের মতো তার গলা থেকে একটাই গান বেজে যাচ্ছে, “আমি ইশতিয়াককে ভালোবাসি, ইশতিয়াক আমাকে ভালোবাসে। সমাজের কথা ভেবে আমরা দু’জন দুজনকে ছাড়তে পারব না। আমাদের বিয়ে দিয়ে দাও, দেখবে আমরা কত সুখে থাকি।”
অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন বোঝাতে পারলেন না তখন বাবার রাগটা আবারও জেঁকে বসল তার ওপর৷ সিমরান তখন বলে চলেছিল, “ইশতিয়াককে ছাড়া অন্য কাউকে আমি আমার লাইফে কল্পনাই করতে পারব না। তোমরাও আমাকে কোনোদিন ওর মতো করে ভালোবাসোনি।”
বাবা তখন উঠে এসে পরপর কয়েকটা চড় মারলেন ওর গালে। আরো হয়তো মারতেন মা যদি না আটকাতেন তাকে। মারা শেষে বাবা নিজেই কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন মেঝেতে। সিমরানের ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে গেছে। সে হাত দিয়ে গাল আর ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে।
মা বাবাকে টেনে নিয়ে গেলেন বাইরে। তারা বেরিয়ে যেতেই সিমরান দরজা আটকে দিল। তখনই ভিডিও কল করল ইশতিয়াককে। এতক্ষণে ইশতিয়াক কল রিসিভ করল। তখন সে অফিস সেরে বাড়ি ফিরছে। গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। হাসিমুখে কলটা রিসিভ করলেও সিমরানকে দেখে তার হাসি মুছে গেল। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সুইটি?”
সিমরানের অভিমানে ঠোঁট উল্টে এলো। ফোঁপাতে ফোপাঁতে সে আজকের ঘটনা বলল। ইশতিয়াকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে বলল, “তুমি আমার সাথে চলে আসবে সিমরান?”
“হ্যাঁ।”
“এখন তোমাকে নিতে গেলে আসবে?”
“হ্যাঁ।”
ইশতিয়াক ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি ঘোরাতে।
এবার সে সিমরানকে বলল, “তোমাকে নিয়ে আসার কোনো লিগ্যাল অধিকার আমার নেই। তাই সবার সামনে নিয়ে আসতে পারব না। তুমি কি পালিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে? আমি তোমাদের বাড়ির সামনেই থাকব।”
“পারব।”
“ওকে। রেডি হয়ে থাকো। আমি এসে তোমাকে মেসেজ করছি।”
সিমরান এক ফাঁকে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরেটা দেখে এলো। মা আর বাবা নিজেদের ঘরে বসে আছেন। ড্রইং রুমের লাইট বন্ধ। ডাইনিংয়ের আলোটা জ্বলছে। সে পানি খাবার বাহানায় ডাইনিংয়ে গিয়ে মূল দরজার ছিটকিনি খুলে রেখে এলো, যাতে সময়মতো চট করে বেরিয়ে যেতে পারে।
ইশতিয়াক এসে যখন মেসেজ করল, তখন বের হতে গিয়ে সিমরান দেখল মা ডাইনিংয়ে বসে আছেন৷ পানি খাচ্ছেন ধীরে ধীরে। সিমরানের ধৈর্যচ্যুতি হতে লাগল। একটা মানুষের এক গ্লাস পানি খেতে কতক্ষণ লাগে?
পানি খাওয়া শেষেও মায়ের কাজ শেষ হলো না। রান্নাঘরে ঢুকে খাবারের বাটি নিয়ে এসে টেবিলে সাজাতে শুরু করলেন। হয়তো সারাদিন কারো কিছু খাওয়া হয়নি বলে খাবার রেডি করছেন৷ সিমরান তক্কে তক্কে রইল। মা যেই না একবার রান্নাঘরে ঢুকলেন, তিনি বের হবার আগেই সে দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা খোলা আর আটকাবার শব্দে মা বেরিয়ে এলেন কী হয়েছে দেখতে। সিমরান প্রাণপণে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। নিচে নেমে এক দৌড়ে সে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। তাকে দেখে দরজা খুলে দিল ইশতিয়াক। সে ভেতরে ঢুকে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ি সামনের গলির মোড়ে হারিয়ে যাবার আগে কাচে প্রতিফলিত হতে দেখা গেল সিমরানের মা বাবার ছবি। তারা এসে দাঁড়িয়েছেন বাড়ির সামনে। এত দূর থেকে তাদের মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না।
******
সিমরান যখন ইশতিয়াকদের আলিশান বাড়িতে পৌঁছুল তখন অনেক রাত। সিমরানের পরনে ঘরে পরার টিশার্ট আর পায়জামা। সে কোনোদিন ভাবেনি এই বেশে ইশতিয়াকের বাড়িতে আসতে হবে তার। ইশতিয়াক তাকে যত্ন করেই বাড়িতে স্বাগত জানাল। ইশতিয়াকের মেয়ে চলে গেছে দু’দিন আগেই। বাড়িতে শুধু আছে ছেলে আর দু’জন কাজের লোক- একটা মেয়ে আর একজন প্রৌঢ়।
ইশতিয়াক কাজের লোকদুটোর সাথে সিমরানের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের ভালোভাবে বলে দিল ওর পরিচর্যা করতে। সিমরানের জামাকাপড় ছিল না। আপাতত ইশতিয়াকের মেয়ের ওয়্যারড্রোব থেকে কিছু জামাকাপড় বের করে দিতে বলল কাজের মেয়েটাকে। এখনকার মতো গেস্টরুমে থাকার বন্দোবস্ত করতে বলল সিমরানের জন্য। আর রাতের জন্য ভালো কিছু রান্না করতে বলে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
সিমরান গেস্টরুমের বাথরুমে আরাম করে গরম পানি দিয়ে গোসল করল। ইশতিয়াকের মেয়ের জামাকাপড় পরতে একটু কেমন যেন লাগছিল, তবে জামাকাপড়গুলো ভালো করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখা আর বেশ আরামদায়ক কাপড় বলে পরে ভালোই লাগল।
রাতে খেতে বসে প্রথম ইশতিয়াকের ছেলে মুশফিকের সাথে পরিচয় হলো সিমরানের। মুশফিক দারুণ স্মার্ট। বাবা বিয়ে করার জন্য একটা মেয়েকে তুলে এনেছে, ঘটনাটা তার যত আশ্চর্য আর বিরক্তিকর লেগেছে, তারচেয়েও বেশি হাস্যকর লেগেছে। সে ভেবেছিল মাঝবয়েসী কোনো মহিলা হবে হয়তো। কিন্তু খাবার টেবিলে সিমরানকে দেখে একটা ধাক্কা খেয়েছে সে। মেয়েটা রীতিমতো মাথা ধরানো সুন্দরী। সে নিজে আজ পর্যন্ত এত সুন্দর মেয়েকে ডেট করতে পারল না, আর বাবা পটিয়ে একেবারে বাড়ি নিয়ে এসেছে! খেতে খেতে আঁড়চোখে সে সিমরানকে দেখেই যেতে লাগল।
এদিকে সিমরানের বাবা গভীর রাতে থানা থেকে বাড়ি ফিরলেন। ডায়েরি করে এসেছেন ইশতিয়াকের নামে। পুলিশ আশ্বাস দিয়েছে তারা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এই দেশে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে পুলিশ এমন কী বা করতে পারে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু