কাঁটামুকুট পর্ব-০৩

0
9

#কাঁটামুকুট
পর্ব-৩

পরদিন রিসোর্টে যাবার জন্য ভোরবেলাতেই তৈরি হয়ে বসে রইল সিমরান। সে সুন্দর একটা সালোয়ার কামিজ পরে নিয়েছে। বাড়িতে বলেছে বান্ধবীর জন্মদিন উপলক্ষে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবে সবাই। রাতেও থাকতে পারে। দূরে বাড়ি বলে সকাল সকাল যেতে হচ্ছে। ব্যাগ প্যাক করে নিয়েছে সে। ব্যাগে চমৎকার একটা ওয়েস্টার্ন ড্রেস আছে। হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা কালো কুচকুচে ব্যাকলেস ড্রেসটা সে একটা অনলাইন শপ থেকে কিনেছিল। কিন্তু বাড়িতে দেখানোর বা পরার সাহস হয়নি। এই সুযোগে পরা হয়ে যাবে। অনেক কিছু প্ল্যান করে রেখেছে সে। গতরাত মাথায় পরিকল্পনার আতিশয্যে ঘুমই আসেনি। এই জামার সাথে কেমন হেয়ার স্টাইল হবে, কোন লিপস্টিক দেবে, কোন জুতো পরবে, কোন জুয়েলারি পরবে সব একটা একটা করে ঠিক করেছে সে৷ পায়ে হালকা লোম ছিল। মাঝরাতে ওয়্যাক্সিং করে তুলেছে সব। তার ধারনা তার ঠোঁট একটু পাতলা। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিল লিপ ফিলার করাবে। ইশতিয়াক জানতে পারলে নিশ্চয়ই করিয়ে দেবে। উফ! কী দারুণ হবে! একটু পরেই ইশতিয়াকের আরামদায়ক গাড়িতে লং ড্রাইভে যাওয়া হবে দূর অজানায়। সেখানে সারাদিন ঘোরাঘুরি, পছন্দের ড্রেস পরে ফটোশ্যুট, মজার সব খাবারদাবার খাওয়া… ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে সিমরানের।

কথা ছিল ইশতিয়াক অফিসে গিয়ে কাজকর্ম ম্যানেজ করে সাড়ে দশটার দিকে তাকে নিতে চলে আসবে। কিন্তু এগারোটা বেজে গেল, ইশতিয়াকের ফোন এলো না৷ সিমরান অনেকবার কল করল, কিন্তু কল রিসিভ হলো না। সিমরানের এত কান্না পেতে লাগল! অসহ্য লাগতে লাগল সবকিছু। মা খেতে ডাকায় তার সাথে দুর্ব্যবহার করল। রাগের অনেকটা ঝাড়ল মায়ের ওপর।

ইশিতয়াকের কল এলো বারোটায়৷ খুব দুঃখের স্বরে সে বলল, “মাই ডিয়ার সুইটি, আই অ্যাম সো স্যরি, অফিসে আটকে গেছি। এমনভাবে আটকেছি যে তোমাকে একটা কল করার পর্যন্ত সুযোগ পাচ্ছি না। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টের দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়েছে আচমকা। যাদের এই প্রোজেক্টে কাজ করার কথা ছিল…”

সিমরান কল কেটে দিল। আর শুনতে ইচ্ছে করছে না৷ তাকে এত আশা দিয়ে এখন উনি প্রোজেক্ট নিয়ে পড়ে আছে! এই হলো ভালোবাসার নমুনা! সিমরানের ইচ্ছে হলো ফোনটা ছুঁড়ে মারতে। বহু কষ্টে সে নিজেকে আটকালো। রাগে গা কাঁপছে তার।

মা একটু পর আবারো এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই যাবি না?”

সিমরান চিৎকার করে বলল, “তুমি চাইলে এখনই বেরিয়ে যাই? আমাকে বিদায় করার জন্য তো পাগল হয়ে গেছো!”

“তুই তো বেড়াতে যাবি বলেছিলি।”

“যাব না। তোমার কোনো সমস্যা?”

মা কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। সিমরান ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রইল। একটু পর ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

দুপুরে খেল না সে। অনেক রাতে ক্ষুধায় কাতর হয়ে খেতে গেল। বাবা দেরি করে ফিরেছেন আজ। বাবাও ওর সাথে বসলেন। খেতে খেতে সিমরান প্রশ্ন করল, “তোমাদের অফিসে কিসের প্রোজেক্ট শুরু হয়েছে?”

বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই প্রোজেক্টের কথা জানলি কেমন করে?”

সিমরান কথাটা অত ভেবে জিজ্ঞেস করেনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো বেরিয়ে গেছে। সে সামলে নেবার জন্য বলল, “এত দেরি করে ফিরলে তাই মনে হলো হয়তো নতুন কোনো প্রোজেক্ট…”

“হুম। নতুন প্রোজেক্টে কাজের একটু বেশি চাপ পড়ে গেছে।” কথাটা বলে বাবার মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সিমরানের কোনোভাবেই নতুন প্রোজেক্টের বিষয়ে জানার কথা না। সে এভাবে ইতস্তত করে কথা বলার মেয়েও না। ঘটনা কী? কিসের যেন খটকা লাগছে বুঝতে পারলেন না তিনি।

রাতে ইশতিয়াক অনেকবার কল করল। ধরল না সিমরান। পরদিনও ইশতিয়াকের সাথে যোগাযোগ করল না সে। ইশতিয়াকের কল রিসিভ বা মেসেজ সীন করারও প্রয়োজন মনে করল না। ইশতিয়াকও খুব একটা সময় পেল না। একদিকে অফিসের চাপ, আরেকদিকে মেয়ে দেশে থাকায় তার ভালোই ব্যস্ততা যাচ্ছে।

প্রায় সপ্তাহখানেক যোগাযোগ বন্ধ রইল তাদের। এরপর এক বৃহস্পতিবার রাতে সিমরানদের বাড়িতে একটা পিজ্জা পার্সেলে এলো। ডেলিভারি ম্যানকে বলে দেয়া হয়েছিল যেন সে একটা চিঠিও সাথে পৌঁছে দেয় সিমরানের হাতে। ডেলিভারি ম্যান তাই করল। মা পিজ্জা দেখলেও চিঠিটা দেখতে পেলেন না। ভাবলেন সিমরানই হয়তো অর্ডার করেছে।

চিঠি খুলল সিমরান। তাতে কয়েক লাইন লেখা-

সুইটি,
সেদিনের জন্য অনেক অনেক স্যরি। জানি তোমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করো আমাকে। আগামীকাল আমার সাথে চলো৷ তোমার জন্য গাজীপুরের বেস্ট রিসোর্ট ভাড়া করে রেখেছি৷ এত সুন্দর যে তুমি গেলে পাগল হয়ে যাবে। আমরা সেখানে ঘুরব, খাবো, সুইমিং করবো, আরো অনেক মজা করব। এবার কথার কোনো অন্যথা হবে না। তুমি সকাল আটটায় রেডি থেকো, আমি সাড়ে আটটায় আসবো। না এলে ভীষণ কষ্ট পাবো।
~ তোমার ইশতিয়াক

সিমরানেরও রাগ এতদিনে খানিক পড়ে এসেছিল। ইশতিয়াককে মিস করছিল সে। তাই ওর চিঠি পেলে এবারের মতো রাগ মুলতবি করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। সেই রাতে নিজেই ইশতিয়াককে কল করল। অনেকক্ষণ কথা হলো ওদের। সিমরান সেবার না যেতে পারায় কত কষ্ট পেয়েছে সব বলল৷ ওর ড্রেসটার কথা বলল। ইশতিয়াক কথা দিল, আর কোনোদিন এরকম ঘটনা ঘটবে না।

পরদিন কথামতো ইশতিয়াক চলে এলো। সিমরান তৈরি ছিল। রওনা হয়ে গেল ওরা সিমরানের কল্পনা করা অজানার পথে।

সিমরানকে বহুদিন পর দেখে ইশতিয়াক খুশিতে টগবগ করে ফুটছে যেন। তার চোখেমুখে আনন্দ ঝলসে উঠছে। সিমরান সেটা বুঝতে পারছে। সে একটু আধটু দুষ্টুমি করছে ইশতিয়াকের সাথে। ইশতিয়াক গাড়ি চালাচ্ছে বলে পাল্টা কিছু করতে পারছে না৷ তবে উপভোগ করছে সবটা।

রিসোর্ট দেখে সত্যিই মাথা ঘুরে গেল সিমরানের। এত সুন্দর। ওরা কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাফেরা করে রুমে ঢুকল। এরকম লাক্সারিয়াস রুমে থাকবে ভেবেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল সিমরানের। ঘরের বিশাল জানালা দিয়ে ওপাশে গাছপালা দেখা যাচ্ছে। সাদা ধবধবে বিছানাটা টানটান করে পাতা, দেয়ালের রঙ মাখনের মতো, মেঝেতে নিজের চেহারা দেখা যায়। বাথরুমটা যেন আরো সুন্দর।

ইশতিয়াক জিজ্ঞেস করল, “পছন্দ হয়েছে?”

“খুব!”

“তাহলে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে তারপর ঘুরতে বের হই কী বলো? সকালের খাবার হজম হয়ে গেছে। লাঞ্চেরও একটু দেরি আছে।”

সিমরান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ওকে!” তারপর বলল, “চলো আগে তোমার রুমটা দেখে আসি।”

ইশতিয়াক অবাক হয়ে চাইল সিমরানের দিকে। সিমরানের এই চাহনির অর্থ বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। বুঝতে পারার পর বলে ফেলল সে, “আমরা এক ঘরে থাকব?”

“অসুবিধা হবে?”

“না মানে…”

“সিমরান, ডোন্ট বি সিলি! আজকালকার মেয়ে হয়ে এসব কী বলছো? এখনো এগুলো ম্যাটার করে তোমার কাছে? দুটো মানুষ ভালোবাসলে তারা এক ঘরে থাকতে পারবে না? তাহলে ভালোবাসা কেমন করে থাকলো? তুমি কি নায়িকা শাবানার যুগে বাস করছো নাকি?”

সিমরানের এবার একটু গায়ে লাগল। “শোনো, আমি এমনি বলছিলাম। আগে বলোনি তাই। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“দ্যাটস মাই গার্ল!”

“আচ্ছা এখন সুইমিং পুলে নামা যাবে?”

“খুব যাবে! তবে আমার প্ল্যান ছিল কাল ভোরে নামব। ওই সময় লোকজন কম থাকে। লোকজনের মাঝে সাতার কাটতে ভালো লাগে না।”

“ওহ তোমার বাড়িতে তো পার্সোনাল পুল আছে। পাবলিক পুলে সাতার কাটতে কেন ভালো লাগবে?”

“সেটা কিছুদিন পর তোমারও হয়ে যাবে ডার্লিং।”

সিমরান তার ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল, “শোনো, তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবে? আমি চেঞ্জ করব আর রেডি হব। সারপ্রাইজ পেতে হলে একটু পর আসতে হবে।”

ইশতিয়াক বাধ্য ছেলের মতো বেরিয়ে গেল। সিমরান সুন্দর করে তৈরি হলো৷ ড্রেসটা প্রায় বছরখানেক হলো কিনেছে। সে এক বছরে একটু স্বাস্থ্যবতী হয়েছে৷ ড্রেসটা একেবারে ফিটিং হয়ে লেগে গেছে গায়ের সাথে। সেজন্য বুঝি একটু শর্টও লাগছে৷ হাঁটু বেরিয়ে গেছে। শরীরের প্রতিটা বাঁক স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। চিকন কয়েকটা ফিতে বাদ দিলে পিঠটা খোলা। এরকম জামাকাপড় সে আগে পরেনি। তাই বেশ লজ্জাই লাগছে। বাইরে বের হতে পারবে বলে মনে হলো না তার। চুলগুলো আর বাঁধল না। খুলে রাখল। কিন্তু চুল দিয়ে সামনের অংশ ঢেকে রাখবে নাকি পেছনে সেটা বুঝে উঠতে পারল না।

তবে মনমতো সাজল সে। ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক, চোখে গাঢ় আইশ্যাডো মাখল। দারুণ লাগছে তাকে। বিশাল আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখে নিজেরই প্রশংসা করল সে।

ইশতিয়াক কল করছে, “আসতে পারি?”

“এসো।”

দরজা খুলে দিলে ইশতিয়াক ঢুকল৷ হা হয়ে গেছে তার মুখ। চোখ সরাতে পারছে না সিমরানের দিক থেকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সে দেখে নিল মন ভরে। তারের পায়ে পায়ে সে এগিয়ে এলো সিমরানের দিকে। সিমরান বাঁধা দেবার চেষ্টা করল তাকে। “আমি ছবি তুলব। প্লিজ সাজ নষ্ট করবে না।”

ইশতিয়াক তার কথা কানে তুলল না। ওর সরু কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টানল। ইশতিয়াকের স্পর্শে ক্রমশ পাগল হয়ে যেতে থাকল সিমরান৷ অচেনা এক আনন্দ হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকল তাকে। নেশায় ডুবে গেল সে।

সিমরানের সেদিন আর ফটোশ্যুট হলো না। ঘোরা হলো অল্প একটু। বাকিটা সময় তারা ঘরেই কাটিয়ে দিল। পরদিন ভোরে সাঁতার কাটল তারা। শুধু দু’জনেই। এখানেও দারুণ আনন্দ হলো। এরপর ফিরে এলো তারা। সিমরানকে বাড়িতে দিয়ে ইশতিয়াক চলে গেল অফিসে।

সিমরান বাড়িতে ঢুকে বুঝতে পারল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। বাবা অফিসে যাননি। মায়ের মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে। নিজের ঘরে ঢুকে সে বুঝল মা ঘরে হাত দিয়েছিলেন। ঘর এলোমেলো ছিল, এখন গোছানো।

এদিকে গতকাল সিমরানের ঘর গোছাতে গিয়ে মা ইশতিয়াকের চিঠি পেয়েছেন। বাবা চিঠিটা দেখেই হাতের লেখা চিনতে পেরেছেন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে দুজনেরই। সিমরানের ফোন গতকাল থেকে সুইচড অফ। সে বলে গেছে বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে থাকবে। দু’জনের এক রাতেই চিন্তায় বয়স বেড়ে গেছে।

সিমরান ঘরে ঢোকার একটু পরেই বাবা তার ঘরে ঢুকলেন৷ কোনো কথা না বলে জীবনে প্রথমবারের মতো বাবা তার গালে প্রচন্ড এক চড় বসিয়ে দিলেন। চড় খেয়ে সিমরান জড় পদার্থের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর বাবা রাগে দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে