#কাঁটামুকুট
পর্ব-২
“তোমাকে প্রথমদিন দেখেই আমার এতটা ভালো লেগেছিল যা আমার কোনোদিন কাউকে লাগেনি৷ আমি কখনো জুনিয়রদের বাড়িতে যাই না। তবুও তোমাদের বাড়িতে গেলাম শুধু তোমার জন্য। সেদিন গোল্ডেন জামায় তোমাকে যে কী পরিমাণ সুন্দর লাগছিল তা তুমি নিজেই কল্পনা করতে পারবে না। মনে হচ্ছিল মাটির পৃথিবীতে জান্নাত থেকে একটা হুরপরী নেমে এসে ছোটাছুটি করছে৷ কিন্তু তুমি আমার থেকে এত ছোটো, কেমন করে আমাদের ভেতর কোনো সম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব? আমি ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি বিশ্বাস করো, যৌবনে আমার প্রাক্তন স্ত্রীর জন্যও আমি এতটা পাগল ছিলাম না। আমি ডেস্পারেট হয়ে তোমার ইন্সটাগ্রাম আইডি খুঁজে বের করলাম। তোমার রোজাকার আপলোড করা ছবিগুলো দেখে আমার মাথা আরো এলোমেলো হয়ে যেত। রোজ আমার সকাল শুরু হতো তোমার ছবি দেখে। আমার গ্যালারি ভর্তি তোমার ছবি৷ কিন্তু তোমাকে কোনো মেসেজ দেবার সাহস আমার হতো না।
একদিন তোমার লিপস্টিকের ছবিটা শেয়ার করতে দেখে মনে হলো একটা সুযোগ নেয়াই যায় তোমার সাথে যোগাযোগ করার। আমার কল্পনাতেও ছিল না তুমি এত দ্রুত রাজি হয়ে যাবে। বিশ্বাস করো, তুমি যখন থেকে ‘হ্যাঁ’ বলেছ তখন থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি আকাশে উড়ছি। আমার বয়স পঞ্চাশ থেকে কমে পঁচিশ হয়ে গেছে।
আমি এটাও ভেবেছি যে তুমি হয়তো আবেগে পড়ে আমার সাথে একটা নতুন সম্পর্কে এগুতে রাজি হয়েছ৷ কারন তোমার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য একত্রিশ বছর। আবারো ভালো করে ভেবে দেখো সিমরান, আমাদের এই পথটা সহজ হবে না। অনেক বাঁধা আসবে। তোমার পরিবার থেকে রাজি হবে না, হয়তো আমার পরিবার থেকেও অনেক কথা উঠবে। তুমি কি এই বয়সে আদৌ এসব সহ্য করতে পারবে?”
কথাগুলো বলে দম নিল ইশতিয়াক। সে মাথা নিচু করে রেখেছে। আজ ওরা বেশ ভালো একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে এসেছে। আংটি কেনার পর ইশতিয়াকই ধরে এনেছে সিমরানকে।
সিমরান কথাগুলোকে পাত্তা দিল না৷ হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, “যাব পেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যায়া?”
ইশতিয়াক হাসল। “এই কিশোরীর উচ্ছ্বলতা দিয়েই তুমি আমাকে মেরে দিয়েছ সিমরান। খুন করে ফেলেছ।”
সিমরান হাসতে লাগল। বলল, “তুমি এত চিন্তা করবে না তো। যা হবে দেখা যাবে। ভালোবাসলে অত ভাবতে হয় না। বরং সময়টাকে এনজয় করো। আর তোমাকে মোটেও অত বয়ষ্ক লাগে না৷ এই বয়সেও তোমার সাথে আজকালকের ছেলেরা টিকতে পারবে না৷ এত হ্যান্ডসাম আর চার্মিং হয়েও অত ভাবতে হয়?”
“তাই? আমাকে হ্যান্ডসাম লাগে?”
“লাগে মানে! তোমার কী মনে হয় আমি কেন পাগল হয়ে আছি?”
“সেটাই তো ভাবছি।”
“ভাবাভাবির কিছু নেই। যা হবার হয়ে গেছে। এখন আমি পিছিয়ে যেতেটেতে পারব না।”
“বেশ তো! কিন্তু তুমি আমার ব্যাকগ্রাউন্ড তো জানতে চাইবে তাই না?”
“জানিই তো। তোমার বিয়ে হয়েছিল, দশ বছর সংসার করার পর ডিভোর্স হয়ে গেছে। তোমার প্রাক্তন বিয়ে করে এখন ইংল্যান্ডে সেটেলড।”
“একটুকুই জানো?”
“হুম।”
“আমার ছেলেমেয়ের ব্যাপারে জানো না?”
সিমরান একটু থমকালো। এটা তো সে ভাবেনি। সে খানিক সন্দিগ্ধ গলায় বলল, “তোমার ছেলেমেয়ে তোমার সাথে থাকে?”
“ছেলে আমার সাথে থাকে। মেয়ে থাকে তার মায়ের সাথে।”
“তোমার ছেলের বয়স কত?”
“বাইশ।”
সিমরান বিষম খেতে খেতে সামলে নিল। ইশতিয়াকের ছেলে তার চেয়ে তিন বছরের বড়! ইশতিয়াক হেসে বলল, “স্বাভাবিক নিয়মে তুমি আমার পুত্রবধূ হতে পারবে!”
সিমরান কপট রাগ করে ইশতিয়াকের ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল, “এরকম কথা আর কোনোদিন বলবে না।”
ইশতিয়াক ওর হাতটা আলতো করে ধরে নিজের ঠোঁটের সাথে চেপে রাখা আঙুলটায় চুমু খেল। সিমরান কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে নিল। যদিও তার ভীষণ ভালো লেগেছে।
সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে সিমরান যেন আলাদাই একটা জগতে চলে গেল। পুরো পৃথিবী তার কাছে রঙিন মনে হতে লাগল। ইশতিয়াকের সাথে কথা হয় মেসেজে, ভিডিও কলে। এত খুনসুটি করতে পারে লোকটা! উল্টোপাল্টা ফিল্টার লাগিয়ে ভিডিও কলে আসে, জোকস বলে বলে ইচ্ছেমতো হাসায় ওকে। আর ওর বাচ্চামি তো আছেই। ইশতিয়াক ওর পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখিয়েছে সিমরানকে। ওদের পৈতৃক বাড়িটা নতুন করে ডিজাইন করে নিয়েছে ইশতিয়াক৷ চমৎকার ডুপ্লেক্স বাড়ি, সামনে লন, পেছনে সুইমিং পুল। বেডরুমটা অসাধারণ! সিমরানদের পুরো ফ্ল্যাটটা জায়গা হয়ে যাবে ওই বেডরুমের ভেতর। বাথরুমটা ওর ঘরের সমান। বিশাল বাথটাব। ইশতিয়াক বাথটাব দেখিয়ে বলেছিল ওতে একা একা গোসল করে মজা নেই। দু’জন হলে জমে যেত!
ইশতিয়াকের ছেলেকেও ছবিতে দেখেছে সিমরান। বাবার মতোই হ্যান্ডসাম। কিন্তু দেখে মনে হয় এখনো অত ম্যাচিউরিটি আসেনি।
পরের মাসে সিমরানের সাথে দেখা হলে আরেকটা গিফটের প্যাকেট ধরিয়ে দিল ইশতিয়াক। গিফট পেয়ে পেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে সিমরানের। বক্সের সাইজ দেখে সে ভেবেছে হয়তো কোনো জুয়েলারি হবে। কিন্তু বক্সটা খুলে হা হয়ে গেল সে। সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের আইফোন!
সিমরানের বিস্মিত চেহারা দেখে ইশতিয়াক হেসে বলল, “পছন্দ হয়েছে?”
“পছন্দ হয়েছে মানে?” বলে উত্তেজনায় উঠেই পড়ল সিমরান। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ইশতিয়াককে। ইশতিয়াক খানিক অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আরে আরে করো কী? এত মানুষের মাঝে!”
সিমরান তবুও তাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখে তবেই ছাড়ল। জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানলে কেমন করে আমার এটারই দরকার ছিল?”
“তোমাকে বুঝতে পারি বলে। তোমার পুরানো মোবাইলটাতে খুব ভালো ছবি ওঠে না সেটা তো দেখিই। এটুকু না দিলে অন্যায় হতো।”
সিমরান আবেগে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “থ্যাংক ইউ!”
“আই লাভ ইউ সুইটি।”
“আই লাভ ইউ টু হানি।”
সেদিন ওরা একত্রে অনেকগুলো সেলফি তুলল। ফেরার পথে গাড়িতে বসে ইশতিয়াক তার আবদারটা করে বসল, “এতদিনের রিলেশন, আজ কি আমি আমার সুইটিকে একটা কিস করতে পারি?” বলেই সম্মতির অপেক্ষা না করে জড়িয়ে ধরল সিমরানকে। সিমরানের প্রথমটায় কেমন দমবন্ধ করা বিদঘুটে একটা অনুভূতি হচ্ছিল। লোকটার মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। যতই প্রেম করুক, লোকটা তার বাবার বয়সী। তবুও সে নিজেকে ছাড়াতে পারল না৷ তার এক হাত ইশতিয়াকের চুল খামচে ধরেছে, আরেক হাতে ব্র্যান্ড নিউ আইফোন। শেষের দিকটায় অবশ্য ভালোই লাগতে শুরু করল সিমরানের। কিন্তু ততক্ষণে লোকটা তাকে ছেড়ে দিয়েছে। লম্বা চুমু খেতে গিয়ে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছে।
*******
বাড়িতে আইফোন নিয়ে একচোট ঝামেলা হয়ে গেল। মা ওকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, “কোথা থেকে পেলি এটা বল? ইদানীং খুব গিফট পাচ্ছিস, কে দেয় এসব?”
সিমরান কাঠ গলায় বলে, “বন্ধু।”
“কোন বন্ধু? কে বন্ধু? নামটাই তো জানতে চাচ্ছি।”
“আশ্চর্য! তুমি চিনবে নাকি?”
“না চিনলে না চিনব। তুই বল।”
“বলব না।”
“তোর ফোন দে আমাকে।”
“কী করবে?”
“ভাঙব।”
“এত সহজ নাকি? ধরে দেখো একবার। দেখবে আমি কী করি।”
“কী করবি তুই?”
সিমরান চিৎকার করে বলল, “আগুন লাগিয়ে দেব নিজের শরীরে। তারপর তোমরা সুখে থেকো। আমার সুখ তো তোমাদের সহ্য হয় না। আমাকে একটু ভালো দেখলে তো তোমাদের পিত্তি জ্বলে যায় তাই না?”
“একদম গলা চড়াবি না সিমরান। তোর কোন নাগর এসব দেয় তা তো আমি বের করবই।”
“করো না, করো। পারলে সব বের করো। তাও আমার কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে কান নষ্ট করে দিও না। তেমরাই আমার মানসিক শান্তি নষ্ট করে দিচ্ছো। একটু শান্তিতে বাঁচতে দেবে?”
ওর চিৎকার শুনে বাবা চলে এলেন।
“তুমি মায়ের সাথে বেয়াদবি করছ?”
“উচিত কথা বলেছি।”
“ফোন কে গিফট করেছে?”
“বলব না।”
“সিমরান! সুন্দরমতো কথার জবাব দাও।”
“আমি তোমাকে জবাব দিতে বাধ্য নই।”
“বাধ্য নও মানে? তাহলে কাকে জবাব দিতে বাধ্য তুমি? অতিরিক্ত বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো তুমি দিনদিন। কবে যে আমার হাতে মার খাবে তার ঠিক নেই।”
“শোনো বাবা, আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না তুমি। হিসেব করে কথা বলবে।”
বাবা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, “তোমার সাথে আমার হিসেব করে কথা বলতে হবে?”
“হ্যাঁ হবে।” রাগে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিল সিমরান। ইশতিয়াকের নিষেধ না থাকলে সে বলেই দিত, যে বসের আন্ডারে তুমি কাজ করো সে আমাকে মাথায় তুলে রাখে। আমার সাথে অবশ্যই হিসেব করে কথা বলতে হবে।
বাবা আর কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। মাও ওর দিকে বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। সিমরান এবার ইশতিয়াককে ফোন করে কেঁদে ফেলল। “তোমার গিফটের জন্য মা বাবা আমাকে কত কথা শোনালো জানো?”
“থাক, মন খারাপ করে না সুইটি।”
“এখানে আমার আর ভালো লাগে না৷ ওদের শাসনে দমবন্ধ হয়ে আসে।”
“তোমাকে আমি খুব দ্রুত নিয়ে আসব আমার কাছে। আর মাত্র ক’টা দিন যাক।”
“আর ক’টা দিন কেন অপেক্ষা করতে হবে? তোমার এত বড় বাড়িতে আমার একটুও জায়গা হবে না?”
“এত বড় বাড়ির পুরোটাই তোমার হবে আমার রাণী। সমস্যা হলো আমার মেয়ে দেশে এসেছে এক সপ্তাহ হলো। ও কিছুদিন থেকেই চলে যাবে। এই সময়ে এসে সে বাবার বিয়ে মানতে পারবে না। তাই ওর সামনে কিছু করতে চাচ্ছি না। ও চলে গেলে করব। সেখানে ওর মা ওকে সামলে নেবে।”
“ওকে।”
“তোমার মন ভালো করতে চাও?”
“হ্যাঁ।”
“চলো তাহলে কাল কোথাও ঘুরে আসি।”
“কোথায় নিয়ে যাবে?”
“কোনো রিসোর্টে যাই চলো?”
“সত্যিই? আমি আগে কখনো যাইনি।”
“তাহলে তো কালই যেতে হচ্ছে। তুমি এক কাজ করো। জামাকাপড় নিয়ে এসো। বেশি ভালো লাগলে রাতে থেকে যাব। তুমি বাসায় বলে দিও বান্ধবীর বাড়িতে থাকবে।”
“ওটা নিয়ে চিন্তা নেই। আমি ম্যানেজ করে নেব। তুমি ব্যবস্থা করো।”
“ওকে সুইটি। কাল তোমাকে চমৎকার কোনো ড্রেসে দেখতে চাই। যাতে আমার মাথাটা আরেকবার নষ্ট হয়ে যায়।”
“ওকে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু