#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২১]
পরেরদিন সকালবেলা_____
এখন ঘড়িতে দশটা বিশ। বাসায় পুরুষ সদস্য বলতে কাফি ছাড়া অন্য কেউ নেই। সকালের নাস্তা সেরেই যে যার কর্মে বেরিয়ে গেছেন। কাফিকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে রুদ্র গেছে জনসভায়, সেখান থেকে বেরিয়ে যাবে কমিশনারের কাছে, তারপর পার্টির ছেলেদের সঙ্গে বৈঠক আছে। তাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে প্রচারণার ব্যাপারে। আজ সারাদিন দৌড় ঝাপের উপরে থাকবে বাসায় ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। কাফি নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। অলস ভঙ্গিতে উল্টাচ্ছে নিউজ পেপারের এক একটা পৃষ্ঠা। যত্তসব অহেতুক নিউজে ঠাঁসা পেপারের পৃষ্ঠা। হঠাৎ একটা পাতায় তার নজর আঁটকালো,
‘একাধিকবার প্রতারণা করায় স্বামীর হাতে নিজের স্ত্রী খুন।’
নিউজটা দেখামাত্রই কাফি মনে মনে বলল, ‘বেশ করেছে, নিজের হাতে পাপীকে শেষ করেছে। প্রতারণা শাস্তি এমনই হওয়া উচিত। আর প্রতারণা শুধু একটা শব্দই নয়। এরমধ্যে
লুকিয়ে থাকে শতশত ব্যথা, যন্ত্রণা। এরা বেঁচে থাকা মানেই পুনরায় পাপের সৃষ্টি। কাফি নিজেকে সামলে নিয়ে পেপারটা রেখে দিলো। ততক্ষণে মরিয়ম বেগম দাদীমা, স্পর্শী,ঝটপট তৈরি হয়ে এসেছে। উনাদের দেখে কাফি আসতে বলে গাড়ি বের করে ড্রাইভিং সিটি বসে অপেক্ষা করতে থাকল। সবাই এসে বসতেই সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মূল ফটক দিয়ে।
স্পর্শী বসেছে কাফির পাশের সিটটায়, পেছন মরিয়ম বেগম এবং দাদীমা। স্পর্শী বার দু’য়ের কাফিকে আড়চোখে দেখে ফিসফিস করে বলল,
-‘ভাইয়া, রুদ্র ভাইয়া কি হসপিটালে আসবে?’
-‘জি না।’
-‘সে এখন কোথায়, সেটা জানেন?’
-‘সম্ভবত মিটিংয়ে আছে।’
-‘চলেন, আমরা সেখানে গিয়ে তাকে চমকে দেই।’
-‘না! না! একাজ করার কথা মাথাতেও আনা যাবে না। স্যার ভীষণণ রেগে যাবে। তখন আমাদের দু’জনকেই পানিশমেন্ট দিবে।’
-‘কি আর পানিশমেন্ট দিবে? এক পা তুলে দু’কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। আমরা দু’ভাইবোন কান ধরে দাঁড়িয়ে নাহয় সুখ দুঃখের আলাপ করবো। তাছাড়া,আপনার স্যার কোন সময় রাগে বুঝান আমারে?তার রাগ অলটাইম তার নাকের ডগায় নাচতেই থাকে। খারুশ একটা।’
স্পর্শীর কথা শুনে কাফি হাসছে। এরা দু’জন দু’জনকে এত ভালোবাসে অথচ কেউই ভুলেও মুখে স্বীকার করে না। অথচ একে অন্যেকে না দেখলেই, চোখে হারায়, ব্যাকুল হয়ে যায়।
মনে হয় এক জনের অনুপস্থিতিতে আরেকজন পাগল প্রায়,
উন্মাদ। তখন তাদের ছটফটানিতে স্পষ্টভাবে ধরা দেয় তারা একে অন্যের জালে ফেঁসে গেছে, এ জাল হতে মুক্তির উপায় নেই, কারণ এ জাল মায়া দিয়ে তৈরি বিশ্বাসের গাঁথুনি দিয়ে গাঁথা ভালোবাসার জাল। একে অপরকে এতটা ভালোবাসে
তবুও এদের অভিযোগের মাত্রা কমে না বরং বাড়তে থাকে। তাও যেন তেন অভিযোগ নয় অহেতুক অবান্তর অভিযোগ।
এটাও বোধহয় তাদের ভালোবাসার একাংশ। স্পর্শী তখনো ননস্টপ বকেই চলেছে তার অভিযোগের ঝুলি রুদ্রকে নিয়ে।
এই মুহূর্তে স্পর্শীর অভিযোগ হসপিটালে যাওয়া নিয়ে অথচ রুদ্রর কড়া আদেশ যেতেই হবে। সকালবেলা নাস্তার টেবিলে
রুদ্র জানিয়েছে দাদীমা আর স্পর্শীকে পুনরায় ডাক্তার দিয়ে আনতে, সে নিজে সিরিয়াল দিয়েও রেখেছে। যার যা সমস্যা হচ্ছে ডাক্তারকে খুলে বলতে, বিশেষ করে স্পর্শীকে। দাদীমা আর স্পর্শীকে মরিয়ম বেগম নিয়ে যাব, সঙ্গে কাফি থাকবে।একথা শুনে স্পর্শী কিছু বলতে গেলে রুদ্র তাকে পাত্তাই দেয় নি বরং মরিয়ম বেগমকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে কাকে কোন ডাক্তার দেখাতে হবে। ধুরর! বিয়ের পর থেকে ডাক্তার আর হসপিটালের চিপায় পড়ে জীবনটাই কয়লা হয়ে গেল।
অন্যরা বিয়ে পর হানিমুনে যায়, রোমান্সের মজে থাকে আর তার জীবনে ঝামেলায় শেষ হয় না আর রোমান্স। তারপর হসপিটালে পৌঁছে সিরিয়াল অনুযায়ী নাম ডাকার অপেক্ষা করছে। পেশেন্টে গিজগিজ করছে চারিপাশ। হঠাৎই একটা মেয়েকে দেখে স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার মাথার মধ্যে খেলে গেল অন্য ভাবনা। তার থেকে খানিকদূরেই আট কী নয় মাসের এক গর্ভবতী মহিলার পেট ধরে হাঁটছে আর কাঁদছে। তাকে বাহুডোরে আগলে রেখেছে একজন পুরুষমানুষ। সম্ভবত উনিই ওই মহিলার হাজবেন্ড।
হয়তো লেবার পেইনের জন্য এভাবে হাঁটানো হচ্ছে। মেয়েটা
কাঁদছে দেখে পাশের মানুষ বারবার চোখ মুছে দিচ্ছে কীসব বলে বোঝাচ্ছে। মনে হচ্ছে বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে উনিও এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। কী সুন্দর সেই দৃশ্য! একেই বলে দায়িত্ববান পুরুষ মানুষ। আচ্ছা ওই মেয়েটার জায়গায় সে আর পুরুষ টার জায়গায় রুদ্র থাকলে কেমন হতো? তাকেও কী এমন করে আগলে রাখতো? তাদের জীবনেও এমন একটা দিন
অবশ্যই আসবে, সেও মা হবে আর রুদ্র হবে বাবা। বাবা-মা হওয়ার অনুভূতিটা কেমন হবে? এখনকার মতো তখনো কী
রুদ্র কাজের বেড়াজালেই বন্দী থাকবে নাকি তাদেরও সময় দিবে, আগলে রাখবে? হসপিটালের দেখা এই দৃশ্যটুকু কেন জানি তার মনে গেঁথে গেল। মাথাতে কিলবিল করতে থাকল নিজের পরিকল্পনা।
এদিকে মরিয়ম বেগমের চিন্তার শেষ নেই। দাদীমার সমস্যা নাহলেও সবার চিন্তা স্পর্শীকে ঘিরেই। কারণ তার তলপেটে চিনচিনে ব্যথা কমছেই না জোরে হাঁটতে গেলেই ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে। আর একটা মেয়ের শরীরে সেনসেটিভ জায়গা তার তলপেট। যেখানে পিরিয়ড হলেই বলা হয় ভারী জিনিসপত্র না তুলতে, কারণ এই সময়ে পেটে আঘাত পেলে ভবিষ্যতেও
এর প্রভাব পড়ে। আর স্পর্শী তো এত এত আঘাত পেয়েছে,
আল্লাহ না করুক ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে গেছে কী হবে মেয়েটার? মায়ের মন, মেয়েকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই।কাফি
উনাদেরকে ডাক্তারের চেম্বারের কাছে বসিয়ে রিসিপশনের পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। রুদ্র কল করেছে তাকেই বোধহয় কিছু বলছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে স্পর্শীকে ডাকা হলো। মরিয়ম বেগম মেয়েকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন।
মহিলা ডাক্তার স্পর্শীর মুখে হিস্ট্রি শুনে চেকআপ করে দুটো
টেস্ট করতে বলে রিপোর্ট দেখাতে বললেন। রিপোর্টটা দেখে তারপর মেডিসিন সাজেস্ট করবেন। তারপর স্পর্শীর টেস্ট করিয়ে দাদীমাকে ডাক্তার দেখানো হলো। রিপোর্ট দিবে কাল সকাল দশটায়। তারপর কাজ সেরে তারা বাসার পথে রওনা হলো। মাঝপথে এসে কাফিকে গাড়ি থামাতে হলো সামনেই বড় মিছিল একটা আসছে। শতশত পুরুষের মুখে জয়ধ্বনি হচ্ছে রুদ্রের নাম। মিছিলের সামনে এসে সাংবাদিকরা ছবি তুলছে, লাইভ দেখাচ্ছে। শতশত পুলিশ দেখা যাচ্ছে রাস্তার এপাশে-ওপাশে। তবে রুদ্র উপস্থিত নেই ভোটের প্রচার শুরু হয়ে গেছে আজকে থেকেই। স্পর্শী জানালা খুলে মাথা বের করে মিছিল দেখতে চাইলে কাফি নিষেধ করলো। কোথায় কে ঘাপটি মেরে আছে বলা যায় না। বিরোধীপক্ষ কেউ চিনে ফেলে পেট্রোল বোমা জানালা বরাবর ছুঁড়তেও পারে নতুবা টিয়ারসেল গ্যাস। জেনে শুনে এমন বোকামি করা যাবে না।
আজ থেকে পুরোদমে ভোটের প্রচার শুরু সেই সাথে বাড়তি সর্তকতাও। তাছাড়া রুদ্র বারংবার বলেও দিয়েছে মাঝপথে যেন গাড়ি না থামায়,এমনকি কেউ যেন জানালাও না খুলে।
রুদ্রর কথায় সে অক্ষর অক্ষরে পালন করছে। কিন্তু তাতে স্পর্শী বিরক্ত হয়ে উঠল ভোঁতা মুখে বসে রইল, জানালা বন্ধ থাকায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ওদিকে মরিয়ম বেগমের
কোনো হেলদোল নেই উনি নিজের ভাবনায় মশগুল। পাশের সিটে বসে দাদীমা মনের সুখের পান চিবিয়ে যাচ্ছেন।উনাকে
পান খেতে দেখে ডাক্তার অনেক উপদেশও দিয়েছেন। জর্দ্দা টর্দ্দা খাওয়া নিয়ে দুটো হাদীস শুনিয়েছেন। ডাক্তারের বলা কথাগুলো উনি মনযোগ দিয়ে শুনে মাথা নাড়িয়েছেন। যার অর্থ সবকথা সুস্পষ্টভাবে বুঝছেন। তারপর ডাক্তার দেখিয়ে
বাইরে এসে আঁচলে বাঁধা পান মুখে পুরে তখন থেকে আপন মনে চিবিয়েই যাচ্ছেন। মুখে সুখী সুখী ভাব। এত সুন্দর করে বোঝানোর পরেও উনাকে পান খেতে দেখে মরিয়ম বেগম কিছু বলার আগে দাদীমাই জবাব দিলেন,
-”শুনো মেজো বউ শ্যাষ বয়সে এই পানই জান, পানই মান, পানিবিহীন টিকে না পরাণ। উঠতে, বসতে, খাইতে, শুঁইতে এই পানই আমাগো সঙ্গী। তাছাড়া ওই ডাক্তরডা বেশি বুঝে, অতিরিক্ত কথা কওনের ডাক্তর (ডাক্তার) পছন্দ না আমার।
আমার রোগ শোক না পাইয়া হুদাই বকা শুরু করছে।’
-‘ মানবেনই না যখন তখন ডাক্তারের কথা শুনে বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়াচ্ছিলেন কেন?’
-‘খাইয়া আমার কাম নাই হের আজাইরা বকবক শুনতে যাব। তহন আমি পানি চিবুচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম এতো তাড়াহুড়া কইরা পান বানানোর পরেও সুপারি, জর্দ্দা, খইর, চুন, দারুণচিনি সব ঠিকঠাকই দিসি। এর লাইগা পান এত সুধাদের (স্বাদ) হইছে।’
-‘ডাক্তার কিন্তু ঠিকই বলেছে আম্মা জর্দ্দা খাওয়া ঠিক না।’
-‘ওই পাগল ডাক্তরের কথা বাদ দাও। যারা ডাক্তরের কথা শুইন্না চলে তারাই কিন্তু আগে মরে। ডাক্তারের কওনে কথা কইছে আমার শুননের কথা এক কান দিয়া শুনছি আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দিসি। ব্যস,হিসাব ঢিশমিশ। ওই কফি কুদ্দুসের দুকানের সামনে গাড়ি থামাবি আমি হাকিম জর্দ্দার কিনুম। ‘
দাদীমার কথা শুনে কাফি আর স্পর্শী মিটিমিটি হাসছে। এই
জর্দ্দা খাওয়া নিয়ে রুদ্রর সঙ্গেও উনার ঝগড়া লাগে। তখন তাদের ঝগড়া দেখে পেট ফেটে হাসি আসলেও কেউ হাসতে পারে না। তাছাড়া দাদীমা শুরু থেকেই কাফিকে কফি ডাকে তাই সেও কিছু মনে করে না, বরং ভালোবেসে মাঝেমধ্যেই রুদ্রর চোখ ফাঁকি দিয়ে পান, সুপারি, জর্দ্দা এনে দেয়। উনি আবার যা তা জর্দ্দা খান না, উনার হাকিম জর্দ্দায় চাই, প্রতি পিচ মাত্র পনেরো টাকা, এটা খেলে নাকি দেহ ঠান্ডা। কাফি সত্যি সত্যি কুদ্দুসের দোকান থেকে জর্দ্দা আর স্পর্শীর জন্য তিনটে আইসক্রিম কিনে আনলো। মরিয়ম বেগম খাবে না তাই স্পর্শী গাড়িতে বসেই মনের সুখে আইসক্রিম খাওয়া অবস্থায় ডজন খানিক সেলফি তুলল। তারপর কিছু ভেবে
রুদ্রর হটস্ এ্যাপে পাঠিয়ে দিলো। সেই সঙ্গে একটা মেসেজ করলো, ‘যার যেখানে শান্তি মেলে তার সেখানে মিলুক ঠাঁই।’
(বি:দ্র:- গল্প না পেয়ে যারা অভিশাপ দিচ্ছেন তাদের বলছি,
আমিও কারো সন্তান, আপনার মতো আমিও খুব আদরের।
তাছাড়া আমি সুস্থ নেই, বিগত তিনদিন ধরে বিছানা থেকে উঠতে পারি নি, চোখ আর মাথা ব্যথায় কাহিল আমি। ৪০ মিনিটের বেশি ফোনের দিকে তাকানো নিষেধ আমার।অথচ একটা পার্ট লিখতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লেগে যায়। এজন্য ভেবেছি আমিই লেখালেখি ছেড়ে দিবো, তবে চিন্তা নেই এই গল্প শেষ করে তবেই ছাড়বো। শুধু এইটুকু বলবো ততক্ষণ অবধি অভিশাপ দিবেন না প্লিজ, সেসব দেখে কষ্ট লাগে।)
To be continue………!!