কুয়াশার আড়ালে সূর্য
৯.
আজ দুপুরেও ফিরবে না বলে যায় সূর্য। অহনা কুয়াশাকে ছাদে নিয়ে এসেছে। দু’জনে একত্রে বেশকিছুক্ষণ সেখানে বসে গল্পগুজব করে।
‘ভাবি তুমি বাবার বাড়িতে যাও না কেন?’
‘যাই তো। তবে আগের মতো যাওয়া হয় না। কেননা বাবা-মা নেই তো তাই। ভাইয়া ভাবিদের কাছে থেকে নিজেকে বোজা ভাবতে চাই না।’
‘আমি জানতাম না তারা নেই।’ মৃদুস্বরে বলল।
‘আরে মন খারাপ কোরো না।’
কুয়াশা হাসার চেষ্টা করে। বলে,
‘তুমি খুব ভালো। আমি ভাবিনি এ বাড়িতে তোমার মতো একজনকে পাব।’
অহনা কুয়াশার কথায় মুচকি হাসি প্রধান করে। বলে,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি।’
‘করো।’
‘সূর্যকে আপন করে নেও। জানি আমি তোমাদের মাঝে এখনো দূরত্ব।’
‘ভাবি তোমার দেবর ভীষণ ভালো। আমি ভাবিনি তার মতো ভালো মানুষের সঙ্গে আমার ভাগ্য জুড়ে যাবে।’
‘এটা তোমার প্রাপ্ত।’
কুয়াশা ম্লান হাসে। সে আরো বলে,
‘আমার কথাটা রেখো। দূরত্ব গুচিয়ে ফেলো।’
কুয়াশা এবারও কিছু বলে না। প্রতিত্তোরে মুচকি হাসে।
‘শুধু শুধু হেসো না তো।’ মেকি রাগ নিয়ে বলল অহনা।
এবার কুয়াশার ঠোঁটের হাসি আরো চওড়া হয়। অহনা আর কিছু বলল না।
__
আকাশ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এজন্য সূর্য তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বাকি কাজগুলো সে নিজেই সামলে নেয়। শফিকুল ইসলাম বারে বারে এসে সব নজর রাখছিল।
তিনি অবসর নিয়েছেন ঠিকিই। তবে বাড়িতে বসে বিরক্ত অনুভব করেন বিধায় এখানে আসেন। সূর্য প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছে এক বারে এত কাজ সামলাতে। লাঞ্চ টাইমে খাবার সুযোগ হয়ে উঠে না। এক ফাঁকে কোনোমতে খেয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কুয়াশার সাথে কথা বলার ফুরসতও মিলে না। সন্ধ্যার দিকে চাপ কমে আসে। নয়টার দিকে বাড়ি ফিরার সময়ে আব্দুল আহাদের সাথে দেখা হয়। সূর্য বাড়িতে নামিয়ে দেবার কথা বললে না করে সে। চলে আসে বাড়িতে। ড্রইংরুমে অহনা ও কুয়াশা বসেছি। অপর পাশের সোফায় বসে মাথায় হাত রেখে বলল,
‘প্রচুর যন্ত্রণা করছে মাথা। কফি খাওয়াবে ভাবি?’
কুয়াশা চটপট বলল,
‘আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।’
‘তুমি ওর পাশে বোসে মাথা টি’পে দেও। আমি যাচ্ছি।’
বলতে বলতে কিচেনে এলো অহনা। সূর্য ব্যথায় কিছুটা কাতর কণ্ঠে বলল,
‘কুয়াশা মাথাটা একটু টি’পে দিবে।’ নরমভাবে বলাতে কুয়াশা দ্রুত উঠে এসে সূর্যের পাশাপাশি বসে মাথায় হাত রাখল। ওমনি সূর্য তার হাতটি নিয়ে বক্ষে রেখে বলল,
‘এখানের জ্বালা কমিয়ে দেও।’
কুয়াশার তার কথার ধরন উপলব্ধি করতে পারে। হাত সরাতে চাইলে আরেকটু জোরে চেপে ধরে সূর্য। বলল,
‘তুমি কেন কিছু বোঝো না? ভাবিবে পাঠালাম তোমাকে একা পাবো ভেবে।’
কিঞ্চিৎ লজ্জায় কুয়াশা আরো দ্রুত হাত ছাড়ার চেষ্টা করছে। সূর্য মৃদু হেসে আরো শক্তভাবে ধরে রাখলো। অহনা কিচেন থেকে আসার পূর্বেই হাত ছেড়ে দেয় সূর্য। কফি এগিয়ে দিতেই কুয়াশা প্রস্থান করল। এক চুমুক বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ভাইয়ার এখন কী অবস্থা?’
‘হ্যাঁ। এখন একটু সুস্থ।’
‘তোমরা কী খেয়েছো?’
‘পাস্তা রান্না করেছি। আমি ও কুয়াশা এত বেশি খেয়েছি, ভাত খাবার ইচ্ছে নেই। তোমাকে দিবো একটু?’
‘নাহ। আমি খেয়ে এসেছি। আব্বাকে ডেকে খাবারও দিও।’ বলতে বলতে কফির মগ নিয়ে উপরে চলে এলো। কুয়াশা বিছানা ঠিক করছে। পেছন থেকে সে বলল,
‘এত তাড়াতাড়ি ঘুমাবে?’
‘না, গুছাচ্ছি ।’
‘আমাকে একটু গুছিয়ে দেও না।’ ছোট্টদের মতো আবদার তার। কুয়াশা সরু চোখে তাকিয়ে পুনরায় বালিশ গুছিয়ে রাখে। সূর্য মুচকি হেসে কফি খেয়ে কয়েক মিনিট পর গোসল করে বের হয়। ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসতে চাইলে সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে নিদ্রা ভর করে। এজন্য কাজগুলো আলামিনকে সঁপে দিয়ে বিছানায় এসে শোয়। কুয়াশা পাশেই ছিল শুয়ে। টেবিল লাইট অফ করে হাতটা ধরে কুয়াশার। কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে নিদ্রায় তলিয়ে যায়।
সকালে।
আকাশ অসুস্থতার কারণে বাড়িতেই সময় অতিবাহিত করছে। সূর্য একাই সব কাজ সামলে হাঁপিয়ে উঠছে প্রায়। তবুও দায়িত্ব পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা তার। কাজের ফাঁকে হঠাৎ কুয়াশার কল আসায় ব্লুটুথের সাথে কানেন্ট করে রিসিভ করে।
‘বলো কুয়াশা।’
‘আলিফ এসেছে। আপনি কী আজ দুপুরে আসতে পারবেন?’
‘একদম না। প্রচুর চাপ। বিকেলে বায়ার আসবে বাহির থেকে। তাদের সাথে মিটিং আছে।’ অতিদ্রুত জবাব দিলো।
‘ওহ।’
‘তুমি প্লিজ আলিফকে রেখে দিও। রাতে এক সাথে খাব আমরা।’
‘আচ্ছা।’
‘প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড কুইন।’
কুয়াশা মৃদু হেসে ফোন রেখে দেয়। সূর্য আলামিনের সাথে কথপোকথনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
সকাল থেকে দুপুরে হয়ে এলো। কুয়াশা খাবার খেয়েছে কি-না সূর্যকে মেসেজ করে। ‘খেয়েছি, খেয়ে নিও’ এতটুকু বার্তা তার নিকট থেকে আসে। ভাইকে নিয়ে এক সাথে খাবার খেয়ে নেয়। রাত দশটার দিকে ফিরে সূর্য। শফিকুল ইসলাম আরো আগেই ফিরেছে বাড়িতে। ছোট শা’লা’র সাথে গল্পসল্প করে রাতের আহার সারে। ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে সূর্য আকাশের সাথে দেখা করতে আসে।
‘ভাইয়া আসবো?’
‘আয়।’
‘এখন কী অবস্থা তোমার। এলার্জি কমেছে?’
‘কমেছে, তবে পুরোপুরি নয়।’ উঠে বসে বলল সে।
‘আরো ক’দিন বেড রেস্ট নেও।’
‘তুই একা পারছিস তো?’
‘হ্যাঁ, সমস্যা নেই।’ মুচকি হাসি প্রধান করে বলল।
‘নতুন যে-ই কাপড় তৈরী হয়েছে। সেটা তাদের পছন্দ হয়েছে?’
‘তারা পছন্দ করেছে বেশ। কাল ডেলিভারি দিবো।’
‘গুড। হানিমুনে যাবি না? অহনা বলল তুই হানিমুনে যেতে চাস। তা কোথায় যাবি ঠিক করলি?’
‘এখনো ঠিক করিনি। আগে তুমি সুস্থ হও। তারপর এ নিয়ে ভাবা যাবে।’
‘যাবার ব্যবস্থা আমিই করে দিবো। কুয়াশাকে জিজ্ঞেস করিস কোথায় যেতে চায়। দেশের বাহিরে হলে আগেভাগে জানিয়ে দিস। পাসপোর্ট, ভিসা এগুলো তো ব্যবস্থা করতে হবে।’
‘এত টেনশন নিও না। তুমি সুস্থ হও। গেলাম। ঘুমাও।’
‘আচ্ছা।’
সূর্য ভাইয়ের গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আকাশ ম্লান হাসলো। আজকাল ভাই ভাইদের মাঝে কতোই না দ্বন্দ্ব। সম্পর্কের বনিবনা প্রায় বিরল। সেদিকে তাদের মাঝে সম্পর্ক কতোই না চমৎকার। অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ। আকাশ এসব ভেবে মৃদু হাসলো। অহনা রুমে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করল,
‘কী ব্যাপার একা একা হাসছো যে?’
‘এমনি।’
‘এমনি এমনি হাসতে জানো তুমি?’
‘না জানার কি আছে?’
‘এতদিন তো দেখলাম না। কারো প্রেমে পড়লে না তো?’
‘তোমরা মেয়েরা শুধুই জানো আমাদের দোষারোপ করতে।’
‘শুধু শুধু তো আর করি না।’
‘তোমাকে ক্ষেপানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’
‘তাহলে অল্পতেই হার মেনে নিলে।’
‘না নিলে ছেড়ে দিবে বুঝি।’ মুখ বাঁকিয়ে বলল আকাশ।
অহনা হেসে ফেলে স্বামীর কিঞ্চিৎ অভিমান দেখে।
‘প্রচণ্ড টায়ার্ড লাগছে কুয়াশা।’ ঘুম জড়িত কণ্ঠে বলল সূর্য।
‘আপনি ঘুমান। এমনিতেও আপনার ওপর প্রচুর চাপ যাচ্ছে।’
বাকি কথা বলার আগেই সূর্য ঘুমিয়ে যায়। কুয়াশা পেছনে ফিরে পানে সূর্যের পানে মুগ্ধ নয়নে তাকায়। লোকটা কতোই না যত্নশীল সবার প্রতি। বাহিরের রূপ ভেতরের থেকেও সুন্দর।
না চাইতেও সূর্যের ভালোবাসায় ডুব দিতে চায় তার হৃদয়।
চলবে?
®সুমাইয়া মনি