#মৌনতা
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
‘মেহরাব রেহমান’ পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত নাম। নামের কী বাহার! রেহমান আবার কী? রহমান হলেও একটা কথা ছিল। যেমন তার ব্যবহার, আচার-আচরণ; তেমন তার নাম। যে মানুষটাই কুৎসিত তার নাম আবার সুন্দর হবে কী করে?
“তোরে না ডাক্তার ফ্রিজের পানি খেতে বারণ করছে?”
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বোতলটা টেবিলে রাখলাম। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে অবশিষ্ট পানিটুকুও ঢকঢক করে পান করে ফেললাম। হাতের উলটোপিঠে মুখ মুছে বললাম,
“বারণ করেছে বলেই খাচ্ছি।”
“দিনদিন ফাজিলের চূড়ান্ত হচ্ছিস। আমাদের কোনো কথাই তো শুনিস না। এখন ডাক্তারের কথাও শুনছিস না। সমস্যা কী তোর? এত অবাধ্য কেন তুই?”
“সমস্যা হচ্ছে ডাক্তার মেহরাব রেহমান। অন্য কোনো ডাক্তার হলে নিশ্চয়ই নিষেধ শুনতাম। তোমরা আমাকে কেন তার কাছে নিয়ে গেছ?”
“পরিচিত ডাক্তার থাকতে অন্য কারও কাছে যাব কেন?”
“না গেলে নাই। আমার যা ইচ্ছে তাই করব।”
“কর। যা ইচ্ছে কর। আমি আর কিচ্ছু বলব না।”
মা রাগ করে প্রস্থান করলেন। আমার বড়ো আপু পড়ছিল। ওর মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। তাই বাবু নিয়ে চলে এসেছে এখানে। আপু বই বন্ধ করে শুধাল,
“মেহরাব ভাইয়ার ওপর তোর এত রাগ কেন?”
“লোকটা ভীষণ অসভ্য আপু। সর্বদা মেয়ে মানুষের সাথে লটকে থাকে।”
“কই? আমি তো কখনো দেখলাম না।”
“দেখবে কী করে? তোমার দু’নয়নে তো শুধু দুলাভাইয়ের বসবাস। তার মধ্যে তোমার আছে একটা ক্যাসেট। ক্যাসেটই সামলাবে নাকি কে কার সাথে লটকে থাকে সেসব দেখবে? যদি কোনো বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে যাই, সেখানে সেই মহান ব্যক্তি থাকবেই। আর তিনি থাকবেন মানেই চতুর্দিকে মেয়েদের আনাগোনা। দেখলে মনে হবে, সে মিষ্টি আর চারপাশে মাছি ভোঁভোঁ করছে।”
“এখানে ওর দোষটা কোথায়? ওর চারপাশে মেয়েরা থাকে। ও তো মেয়েদের পেছন ঘোরে না।”
“এখানেই তো তার দোষ আপু। সে কি পারে না সেখান থেকে সরে যেতে? আবার, প্রতি শুক্রবারে দেখি মাঠে ফুটবল খেলে, ক্রিকেট খেলে। মেয়েরা হাঁটতে বের হলে হা করে তাকিয়ে থাকে। তখন কি সে পারে না খেলা বাদ দিয়ে বাড়িতে চলে আসতে? ছয়টাদিন টানা হাসপাতালে ডিউটি করিস। একটা দিন তো রেস্টেরও দরকার আছে? কিন্তু না। বান্দা রেস্ট নেবে না! আর রেস্ট নিলে মেয়েদেরই বা দেখবে কীভাবে? একটু আগে তার কাছ থেকে এলাম। কী হয়েছে জানো? একজন নার্স পারে না শুধু তার কোলে গিয়ে বসে। তখন সে একদম চুপ। কেন তখন কি সে পারত না নার্সকে ধমক দিতে? অথচ তাকে ধমক না দিয়ে কাকে ধমক দিল জানো? আমাকে। মাকে বলে, আমি নাকি বেশি বেশি আইসক্রিম, কোক আর ঠান্ডা পানি খেয়ে ঠান্ডা লাগিয়েছি। আমার ঠান্ডা লাগুক, ঠান্ডার চৌদ্দগোষ্ঠী লাগুক তাতে ঐ ডাক্তার ব্যাটার কী? আমি কী খাব, কী খাব না সেগুলোর মেন্যু ঠিক করে দেওয়ার সে কে?”
“পুষ্পিতা থাম! তুই যেটা করছিস সেটা বাড়াবাড়ি। সবসময় সিচুয়েশন এক রকম থাকে না। তাছাড়া সে আমাদের প্রতিবেশী। বড়ো ভাইয়ের মতো। সে কী করে করুক তাতে আমাদের কী? তুই কেন রাগ করে নিজের ক্ষতি করবি? ফ্রিজের পানি এত খাস না।”
“ভাইয়ের মতো না ছাইয়ের মতো। সে ছাইয়ের মতোও না। ছাই উড়ালেও তো অমূল্য রতন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভাবসম্প্রসারণ পড়োনি, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ কিন্তু তারে উড়াইলে আর ফিরেই পাব না। মেয়েদের নিয়ে গুম হয়ে যাবে। আই জাস্ট হেইট হিম! আমি তাকে একদম পছন্দ করি না।”
“তাতে তার কী? তোর পছন্দ করা না করায় তার কিছু যায় আসবে না।”
“রাইট। তেমনই তার বারণ করাতেও আমার কিছু যায় আসবে না। আমার যা ইচ্ছে তাই করব। মা-ও তো পারমিশন দিয়ে গেল! সূতরাং তুমি এখন আমায় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে পড়া শুরু করো। একটু পরই তোমার ক্যাসেট ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে।”
আপু রেগে আগুন গরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তোর মতো ঘাড়ত্যাড়া যার কপালে জুটবে তার জীবন শেষ!”
আমি আপুর কথায় পাত্তা দিলাম না। ফ্রিজ থেকে কোকের বোতল নিয়ে বারান্দায় চলে গেলাম। রাগে পুরো শরীর আমার রিরি করছে। ব্যাটা ডাক্তার গুনে গুনে আমার চেয়ে আট বছরের বড়ো। কিন্তু দেখলে মনে হয় বিশ বছরের টগবগে যুবক। যেমন তার কণ্ঠস্বর, তেমন তার সৌন্দর্য। একটা ছেলেকে আল্লাহ্ এত কেন সুন্দর বানাবেন?
বিকেলে মেহরাব ভাইয়ের ভাতিজি টুম্পা আমার কাছে পড়তে এলো। ওর হাতে অনেকগুলো চকোলেট। কিছু চকোলেট আমাকে দিয়ে বলল,
“আন্টি, এগুলো চাচ্চু তোমাকে দিয়েছে।”
আমি যত্ন করে নখে নেলপলিশ পড়ছিলাম। টুম্পার কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমার জন্য চকোলেট?”
টুম্পা ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। আমি গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বললাম,
“ঐ লটকা-লটকি লোককে বলে দেবে, আমি কোনো বাচ্চা নই। আমার জন্য যেন আর কখনো চকোলেট না পাঠায়।”
আমি যেন ভুল কিছু ভেবেছি কিংবা ভুল কিছু বলেছি এবং সেটা সংশোধন করার দায়ে টুম্পা তড়িঘড়ি করে বলল,
“লতকা-লতি কে আন্টি? চকোলেট তো আমার চাচ্চু পাঠিয়েছে।”
আমি ভ্রু কুঞ্চন করে বললাম,
“লতকা-লতি না। কথাটা হবে লটকা-লটকি। আর কথাটি তোমার চাচ্চুকেই বলেছি।”
“আমার চাচ্চুর নাম তো মেহরাব।”
“তোমার চাচ্চু যখন হয়েছিল তখন তো আর তোমার দাদা-দাদি জানতেন না যে, ভবিষ্যতে তোমার চাচ্চুর লটকা-লটকির স্বভাব হবে।”
টুম্পা মুখটা গোবেচারা করে বলল,
“এটার মানে কী আন্টি?”
আমি একটুখানি চুপ করে থেকে বললাম,
“এটার মানে হচ্ছে মহৎ লোক, ভালো লোক। এখন তাড়াতাড়ি অংক বই বের করো। কালকে যে ল.সা.গু, গ.সা.গু করতে দিয়েছিলাম। করেছ? খাতা বের করো দেখি।”
ঘণ্টাখানেক পড়িয়ে টুম্পাকে ছেড়ে দিলাম। তার মিনিট দুয়েকের মাঝেই লটকা-লটকি সাহেব আমাদের বাড়িতে এলেন। চোখে-মুখে দূর্দান্ত রাগ। ঘটনা কী এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। তিনি গম্ভীর হয়ে আমাকে বললেন,
“ছাদে এসো তো। কথা আছে।”
ঠান্ডায় আমার অবস্থা নাজেহাল। আমি তার দিক ফিরেই হাঁচি দিয়ে বললাম,
“এখানেই বলুন।”
তিনি নাক-মুখ কুঁচকে বললেন,
“দেখে হাঁচি দিতে পারো না নাকি? আর এখানে বললে তোমারই সমস্যা হবে।”
আমি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ঘটনা কী! পরক্ষণে বললাম,
“ঠিক আছে। আপনি যান। আমি আসছি।”
“জলদি। আমার হাতে বেশি সময় নেই।”
বলে তিনি ধুপধাপ সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেলেন। আমার মেজাজ চটে গেল তার কথার ধরণে। ভাবখানা এমন যেন তিনি দেশের প্রাইম মিনিস্টার! হাতে সময় কম তো অমন নষ্ট ঘড়ি পরে এখানে আসা কেন? সময় বেশি আছে এমন ঘড়ি ব্যবহার করা যায় না? আমি বিড়বিড় করতে করতে ফ্রিজের কাছে গেলাম। এক হাতে পানির বোতল আর অন্য হাতে কোকের বোতল নিয়ে ফ্রিজ আটকানোর সময় পাশ থেকে আপু বলল,
“একটু আগেই এতগুলা ঠান্ডা পানি আর কোক খেলি। এখন আবার এগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
“একজন বিশেষ লোককে জ্বা-লি-য়ে, পু’ড়ি’য়ে ভষ্ম করতে।”
আমি কোক খেতে খেতে ছাদে গেলাম। মেহরাব ভাইয়ের পরনে ধবধবে সাদা রঙের শার্ট। দেখতে সুন্দর লাগছে। এমন ভাবনা মনে আসতেই মনকে কড়া শাসন করতে লাগলাম। তিনি আমাকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে বললেন,
“এসব কী?”
“চোখে সমস্যা নাকি? দেখেন না পানি আর কোক।”
“ঠান্ডায় গলার অবস্থা কী হয়েছে খেয়াল করেছ? এরমধ্যে আবার কোক, ঠান্ডা পানি খাচ্ছ?”
“হ্যাঁ, খাচ্ছি। আমাকে নিয়ে এত মাথাব্যথা করা লাগবে না আপনার। কেন ডেকেছেন সেটা বলেন।”
তিনি সম্ভবত রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“তুমি টুম্পাকে কী বলেছ?”
“কী বলেছি?”
“সেটাই তো তোমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি।”
“কত কথাই তো বলেছি। আপনি কোন কথা শুনতে চাচ্ছেন?”
“তুমি ওকে বলেছ আমি লটকা-লটকি লোক? এগুলো কেমন ধরণের শব্দ? একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এমন কথা তুমি বলো কী করে?”
“সত্যি কথা বলতে শিক্ষিত আর মূর্খ আছে নাকি? সত্যি কথা সবাই বলতে পারে।”
“এটা সত্যি কথা? এই ওয়ার্ড দ্বারা কী বোঝাতে চাও?”
“আপনি যে সবসময় মেয়েদের সাথে লটকে থাকেন এটাই বোঝাতে চাই।”
রাগে-দুঃখে তিনি বোধ হয় কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছেন। এমনভাবে হা করে তাকিয়ে আছেন! আমি যেন সেসব থোড়াই পরোয়া করি। আমাদের নিরবতা কাটল টুম্পার ডাকে। আমাদের পাশের বাড়িতেই তারা থাকেন। টুম্পা ছাদ থেকে জোরে চেঁচিয়ে বলছে,
“লটকা চাচ্চু, দাদু ডাকে তোমায়।”
টুম্পার সাথে ছাদে আরও বাচ্চারা ছিল। ওরাও নতুন নাম শুনে বেজায় আনন্দিত। এমন নাম ইতোপূর্বে কখনো শোনেনি বলে কথা! ওরাও সমস্বরে ‘লটকা চাচ্চু’ বলে ডাকছে। ‘লটকা-লটকি’ নামটা বোধ হয় বেশি বড়ো যায়। তাই শুধু লটকা নামটাকে বেছে নিয়েছে। এদিকে ওদের ডাক শুনে আমার এত হাসি পেল যে, হাসতে গিয়ে আমি হাঁচি দিয়ে ফেলেছি। তিনি পারছেন না শুধু আমাকে গিলে খেতে। শুধু যাওয়ার পূর্বে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে গেলেন,
“আমার মান-সম্মানের কিছুই বাকি রাখলে না তুমি। তোমার মতো সঙ্গী যেন শত্রুরও না হয়।”
চলবে…