#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি
পর্ব:১৬(শেষ)
‘ইফাত ভাইয়া আপু সুইসাইড করতে গিয়েছিল এখন হাসপাতালে ভর্তি,অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
– কি বলছো এসব? যত দ্রুত সম্ভব আমি আসছি তুমি পায়রাকে দেখে রেখো।
ফোনে সাবিহার কাছ থেকে এমন একটা কথা শুনে ইফাত যেন দিশেহারা হয়ে গেছে মাথা কাজ করছে না চেঁচিয়ে আরাফকে ডাকলো।আরাফ ঘরে আসতেই ইফাত বলল,
– আরাফ আমি বাংলাদেশে যাব আজই টিকিটের ব্যবস্থা করো।
– এত তাড়াতাড়ি কিভাবে?
– এতকিছু জানি না যা বলেছি তাই করো।
আরাফ মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল, ইতি বেগম সবটা শুনেছেন ভেতরে এসে,
– পাগল হয়েছিস এখন বাংলাদেশে কেন যাবি?
– মা যেতেই হবে।
– এখন কোথাও যাওয়া হবে না বিয়ের কাজ শেষ হোক তারপর।
– তোমার কথা রাখতে পারলাম না মা আমার যেতেই হবে।
গতকাল পায়রা আর সাবিহা বাড়িতে পৌঁছেছে। বাড়িতে এসেই পায়রা নিজের ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি।সাবিহা সবাইকে সব বলে দিয়েছে পায়রাকে ডাকাডাকির পরেও পায়রা দরজা খুলেনি প্রথমে সবাই ভেবেছিল পরে হয়তো দরজা খুলবে কিন্তু সকাল হওয়ার পরেও দরজা খুলেনি সবার ডাকাডাকির শব্দেও কোনো সাড়াশব্দ করেনি অতঃপর দরজা ভেঙে ফেলে পলাশ শেখ ঘরে গিয়ে খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে বারান্দায় গিয়েই সবাই চমকে যায়। পায়রার নিথর দেহ বারান্দায় পড়ে ছিল হাত কাঁটা অনেক রক্ত বের হয়েছে।পলাশ শেখ আর তাই ভাই মিলে পায়রাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
সুইসাইড কেস বলে প্রথমে ডাক্তার ভর্তি করতে চায়নি। পলাশ শেখ তার পরিচিত বড় ডাক্তারকে ফোন করে সবটা বলতেই তিনি হাসপাতালের কাউন্টারে কথা বলেন আর তারপর পায়রাকে ভর্তি করে নেয়। অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে যার জন্য পায়রাকে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে।
পলাশ শেখ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আসমা বেগমকে আনা হয়নি। মেয়ের এমন অবস্থা দেখেই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন সাবিহার মা উনার সঙ্গে বাড়িতেই থেকে গেছেন।
সাবিহাও কান্না করছে কেউই ভাবতে পারছে না পায়রা এমন একটা কাজ করেছে। ডাক্তারকে দেখেই পলাশ শেখ এগিয়ে গিয়ে,
– আমার মেয়ে কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে? একবার দেখা করতে দিন।
ডাক্তার গম্ভীর মুখে,
– আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু করার করেছি এখন আল্লাহ ভরসা পেশেন্ট কোনো রেসপন্স করছে না তবে এখনও শরীরে রক্ত চলাচল করছে, শ্বাসও আছে।
বলেই ডাক্তার চলে গেলেন। পলাশ শেখ একবার পায়রাকে দূর থেকে দেখে এসেছেন ডাক্তার কাছে যেতে দেননি।
______________
রাত একটায় বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে ইফাত এবং আরাফ। ইফাত একাই আসতে চেয়েছিল কিন্তু আরাফ জোর করেই তার সঙ্গে এসেছে। সাবিহার কাছ থেকে আগেই হাসপাতালের ঠিকানা নিয়েছে। বাড়ির সবাই অমত করেছিল ইফাত কারো কথার তোয়াক্কা না করেই চলে এসেছে।
পলাশ শেখ চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন।সাবিহা জাগ্ৰত, ইফাত হাসপাতালে পৌঁছে গেছে কাউন্টার থেকে জেনে পায়রার কেবিনের সামনে চলে এসেছে সাবিহা ইফাতকে দেখেই এগিয়ে গেল। ইফাত সাবিহাকে দেখতে পেয়ে,
– পায়রার কি অবস্থা জ্ঞান ফিরেছে?
– এখনও ফিরেনি।
– ডাক্তার কি বললো?
– জ্ঞান কখন ফিরবে জানে না অবস্থা তেমন ভালো না।
– ও যে এমন একটা কাজ করবে ভাবতেও পারিনি।
– আপুকে কি একটু বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললেন না ভাইয়া?
– কষ্ট কি আমি কম পেয়েছি তবে আমি ভাবতেই পারিনি শেষ পর্যন্ত পায়রা এমন কিছু করবে।
– গত তিন বছর ধরে আপনার অপেক্ষা করলো অথচ আজ ম’রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
পলাশ শেখের কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল তিনি ইফাতকে দেখে,
– ইফাত তুমি?
ইফাত পলাশ শেখকে সৌজন্যতা দেখিয়ে,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুমুসসালাম, সাবিহার কাছে শুনলাম তুমি আমেরিকা ছিলে এখন এখানে?
– এমন একটা খবর শুনে কি ওখানে থাকা যায়।
পলাশ শেখ আর কিছু বললেন না রাগারাগীও করলেন না কারণ তার মেয়েটা তো ইফাতকেই চায়।
মির্জা পরিবারের সবাই পায়রার ঘটনা জেনে গেছে ইনান তাদেরকে সবটা বলেছে তাই ইফাতের উপর থেকে সব রাগ ঝেড়ে ফেলে তারাও দেশে আসবেন বলে ঠিক করেছেন, তুবার রাগ বেড়েই যাচ্ছে সে ভাবতেই পারছে না ইফাত পায়রার জন্য এভাবে চলে আসলো।
_______________
পুরো একটা দিন কেটে গেল, কিছুক্ষণ আগেই পায়রার জ্ঞান ফিরেছে পায়রার বাড়ির সবাই একেক করে পায়রার সঙ্গে দেখা করে এসেছে পায়রা কারোর সঙ্গেই কথা বলেনি। পায়রার মা পায়রাকে অনেক বকাঝকা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি পায়রা চুপচাপ শুধু শুনেই গেছে কেন জানি নিজেকে অনুভূতি শূন্য মানুষ মনে হচ্ছে।কারোর কথায় কিছুই আসে যায় না তার।
সবাই বের হতেই ইফাত পায়রার বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। পায়রা হাতের ব্যান্ডেজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইফাত এসে পায়রার পাশে বসতেই পায়রা কিছুটা ভরকে গেল। ইফাতকে দেখেই ক্ষতটা ভেতরে আবারো জাগ্ৰত হয়ে গেছে, পায়রার এক হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেলো তারপর পায়রার হাত ছেড়ে তার গালে হাত রেখে,
– এমন পাগলামি কেউ করে? যদি কিছু হয়ে যেত তখন আমার কি হতো?
ইফাতের আগের ভালোবাসা,মায়া দেখতে পাচ্ছে পায়রা এতে রাগটা অভিমানে রূপ নিলো,
– কেন আপনার তুবা আছে না এখন তো সে আপনার বউ,বউকে রেখে এখানে কেন এসেছেন।
– এদিকে আরেক বউ এমন একটা কাজ করলে কি বাড়িতে বসে থাকা যায়?
পায়রা তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে ইফাতের দিকে তাকিয়ে,
– আরেক বউ মানে? কয়টা বউ আপনার? আপনি অনেক বদলে গেছেন খারাপ হয়ে গেছেন।
– আপাতত একটাই বউ তবে এখনও তাকে বিয়ে করাই হয়নি।
– তাহলে তুবা কে? সবার সামনে কিসে সাইন করলেন?
পায়রার ঠোঁটে আঙুল রেখে,
– হুশ এখন আর এসব কথা শুনতে চাই না তুমি সুস্থ হয়ে যাও তারপর বাকি কথা।
পায়রা চুপ করে গেল। মির্জা পরিবার বাংলাদেশে চলে এসেছে নিজেদের বাড়িতেই উঠেছে ইফাতকেও জানিয়েছে। তুবা হাসপাতালেই যেতে চেয়েছিল কিন্তু ইতি বেগম তাকে বাঁধা দিয়েছেন।
পায়রাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে পায়রার সঙ্গে দেখা করে ইফাত বাড়িতে চলে এসেছে। ইফাত বাড়িতে প্রবেশ করতেই তুবা ন্যাকা কান্না করে ইফাতকে ধরতে গেল ইফাত সাথে সাথে সরে গিয়ে,
– বলেছি না যখন তখন আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না।
– কিন্তু এখন তো আমি তোমার বউ।
– রিয়েলি! তোমার বউ হওয়া আমি বের করছি।
বলেই বাঁকা হাসলো ইফাত। ইতি বেগম জুস নিয়ে এসে ইফাতের হাতে দিলো ইফাত সোফায় গিয়ে বসল। ইতি বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
– এখন কেমন আছে পায়রা?
– ভালো।
– মেয়েটাকে না কিছুতেই বুঝতে পারি না নিজে বিয়ে ভাঙলো তারপর তিন বছর পর আবার ওর সঙ্গে দেখা দেশে ফিরে কি ভয়ংকর একটা কাজ করলো।
– আসলে ও নিজেই তো এখনও নিজেকে বুঝে না তাই হুটহাট কিসব করে ফেলে পরে নিজেই কষ্ট পায়।
তুবা রাগ দেখিয়ে উপরে চলে গেল। ইফাতও ঘরে চলে গেল এখন তার ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজন।
_______________
চারদিন পার হয়ে গেল, এখন পায়রা পুরোপুরি সুস্থ হাতে এখনও ব্যান্ডেজ করা। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসার পর আর ইফাতের দেখা পায়নি। ইফাতের পরিবারের সবাই যে বাংলাদেশে এসেছে পায়রা জেনে গেছে নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছে ইফাত তাকে সহানুভূতি দেখাতে এসেছে এখন নিজের বউ চলে আসতেই তাকে ভুলে গেছে।
দুপুরের খাবার খাওয়ার পর পলাশ শেখ পায়রাকে তৈরি হতে বলে গেছেন কোথাও নাকি তারা বের হবে পায়রা অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেনি বাধ্য মেয়ের মতো সবার কথা শুনছে।
শেখ পরিবারের সবাই গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছে কিন্তু কোথায় যাচ্ছে পলাশ শেখ ছাড়া কেউই জানে না। পায়রা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে এবার রাস্তাটা চেনাচেনা লাগছে বাবার দিকে তাকিয়ে,
– আমরা কি বাগান বাড়িতে যাচ্ছি বাবা?
– হুম
– কেন?
– গেলেই দেখতে পাবি।
নির্দিষ্ট গন্তব্যের পর গাড়ি থামলো বাগান বাড়িতে। সবাই ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকে গেল মির্জা পরিবারের সবাইকে দেখে,তারাও যে অবাক হয়েছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। অনেকদিন পর দুই পরিবার আবারো মুখোমুখি, এনায়েত মির্জা এগিয়ে এসে,
– পলাশ তোমরা?
– ইফাত আসতে বললো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখাবে বলে।
– আমাদেরও তো বললো কিন্তু এসে দেখি ইফাত নেই।
ইতি বেগম বললেন,
– চারদিন ধরে বাড়িতেও আসলো না কোথায় যে গেছে কে জানে।
পায়রা সবার কথা শুনছে তুবাও এখানে আছে সোফায় বসে আছে আর চোখ দিয়ে যেন পায়রাকে ভৎস করে দিচ্ছে।
সবাই ধৈর্য নিয়ে বসে আছে ইফাতের অপেক্ষায়,দশ মিনিট পরেই ইফাত সবার সামনে চলে আসলো। ইতি বেগম চোখ রাঙিয়ে,
– কোথায় ছিলি কি এমন বলবি যে সবাইকে এখানে ডাকলি।
– ধীরে মা বলার জন্যই তো ডেকেছি বসো।
সবার দৃষ্টি ইফাতের দিকে। ইফাত একবার পায়রার দিকে তাকালো তারপর দৃষ্টি সরিয়ে তুবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো যা পায়রার চোখ এড়ায়নি।
ইফাত তার বাবার দিকে তাকিয়ে,
– আচ্ছা বাবা তোমার তোফায়েল আহমেদের কথা মনে আছে?
নামটা শুনে এনায়েত মির্জার কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে চিন্তিত কন্ঠে,
– কোন তোফায়েল?
– তুমি যে তোফায়েলকে চেনো।
– কিন্তু সে তো অনেক বছর আগে মা’রা গেছে একটা এক্সিডেন্টে তখন তোরা দুই ভাই ছোট ছিলি ওর নাম কেন এখানে আসলো তুই বা চিনলি কিভাবে?
– তোফায়েল আহমেদ মা’রা যায়নি মা’রা যাওয়ার নাটক সাজিয়েছে।
– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
– এখনও তো বুঝানোই শুরু করিনি বুঝবে কিভাবে।
ইফাত আরাফকে ডাক দিতেই আরাফ এসে,
– ইনান স্যার উনাকে আনছে।
কেউ বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তারপরেও ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে কিছুক্ষণ পরেই ইফাত একটা লোককে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এনায়েত মির্জা লোকটাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন বিষ্ময় নিয়ে বললেন,
– তোফায়েল!!
– এবার চিনতে পেরেছো বাবা?
– হুম কিন্তু ও মা’রা যাওয়ার নাটক কেন করলো?
ইফাত বলা শুরু করলো,
– আমাদের পারিবারিক বিজনেসটা যখন অনেক বড় হয় তখন তুমি তোফায়েল আহমেদকে পার্টনার করে নিয়েছিলে তারপর ইনি তোমার অনেক বিশ্বাস যোগ্য হয়ে গিয়েছিল কিন্তু লোভে পড়ে একসময় তোমার সঙ্গেই বিশ্বাস ঘাতকতা করে ফেললো কোম্পানির অনেক টাকা চুরি করেছে।ধরা খাওয়ার পর অনেক মাফ চাওয়ার পরেও তুমি তাকে পুলিশে দিলে বড় একটা সাজা হয়েছিল কিন্তু কোর্ট থেকে যখন তাকে নিয়ে ফিরছিল তখনি পালিয়ে যায় এবং এক্সিডেন্টের নাটক সাজায়।
– পুলিশ যেই লাশ পেয়েছিল?
– ওইটাও সাজানো আসলে লাশটা মর্গ থেকে আনা হয়েছিল এতে তাকে সাহায্য করেছিল তার এক বন্ধু।
ইফাত এবার একটু থেমে,
– আমার আর পায়রার এনগেজমেন্টের দিনের কথা মনে আছে?
সবাই এবার মনোযোগ সহকারে তাকালো পায়রাও বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। ইফাত সবার চাহনি দেখে আবারো বলতে লাগলো,
– পায়রা যেই ছবিগুলো দেখিয়েছিল তখনি বলেছিলাম ওগুলো এডিট কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি তবে আমার মতো পায়রাও জানতো সত্যিই ওগুলো এডিট।
শেখ পরিবারের সবাইকেই পায়রা বিষয়টা আগেই বলেছে তাই তারা সবটা জানে। ইতি বেগম প্রশ্ন করলেন,
– জেনেও কেন এমনটা করলে পায়রা?
পায়রা কিছু বললো না মাথা নিচু করে রেখেছে ভেতরে অপরাধ বোধ কাজ করছে।ইফাত বললো,
– আমি বলছি।
সবটা ইফাত বলতেই সবাই আরো বিষ্মত হলো। সাথে ফোনালাপের সব রেকর্ডিং ও শুনিয়েছে, পলাশ শেখ বললেন,
– এগুলো কে করেছে এটাই তো এখনও জানা হলো না।
– এই যে দাঁড়িয়ে আছে তোফায়েল আহমেদ ইনিই করিয়েছেন।
– তোফায়েল করিয়েছে!(এনায়েত মির্জা)
– হুম বাবা।
– এতে ওর লাভ কি?
– লাভ ছাড়া কেউ কিছু করে না উনারও লাভ আছে, ওই যে সম্পত্তির প্রতি লোভ। সম্পত্তির প্রতি লোভ আর তোমার উপর ক্ষোভ থেকে এসব করেছে তুমি তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ায় আমাদের পরিবারের উপর উনার সব থেকে রাগ, অনেক বুদ্ধি করেই এতদিন কাজ করে গেছেন এমনকি আমার এক্সিডেন্ট তোফায়েল আহমেদ করিয়েছেন।
এনায়েত মির্জা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তোফায়েল আহমেদ মাথা নিচু করে আছে সে তো ধরা পড়ে গেছে। এনায়েত মির্জা তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে,
– আমার সঙ্গে শত্রুতা করার কারণ আছে বুঝলাম কিন্তু আমার ছেলেকে কেন মা’র’তে চাইলে?
– উওরটা আমিই দেই বাবা। বিজনেসের দায়িত্ব আমাকে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে ছিলে তোমার দুর্বলতা আমি আর ইনান। সেই জন্যই আমার সব খবরাখবর নিয়ে যখন জানতে পারে আমি পায়রাকে ভালোবাসি সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে পায়রাকে ব্লাকমেইল করেছে আর তারপর আমাকে মা’রা’র চেষ্টা করেছে অতঃপর সব প্লান ভেস্তে যাওয়ার পর নিজের মেয়েকে আমার পেছনে লাগিয়ে দিলো তোমরাও বোকার মতো মিষ্টি মিষ্টি কথায় গলে গেলে।
সবাই সম্মোলিত ভাবে,
– তোফায়েলের মেয়ে?
তুবা ঘামছে আর ছটফট করছে,ইফাত তুবার দিকে তাকিয়ে,
– এত ঘেমে লাভ নেই তুবা,তোমার ব্যাপারে সবটাই আমার আগে থেকেই জানা যাই হোক সবাইকে বলে রাখি তুবা হচ্ছে তোফায়েল আহমেদের মেয়ে।
– কি বলছিস! তুবা না বললো ওর বাবা-মা মা’রা গেছে?(ইতি বেগম)
– সব মিথ্যে বলেছে। আরাফকে বলেছিলাম যাতে পায়রা এবং আবরারের সব কল রেকর্ড বের করে, আবরারকে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল তারপর সবটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়।
– এত কিছু হয়ে গেল কিন্তু তোর সঙ্গে তুবার বিয়ে হলে ওদের কি লাভ?
– ভেবেছিল একবার বিয়ে হয়ে গেলে সহজেই সব সম্পত্তি পেয়ে যাবে আর আমাকে মা’রতেও সুবিধা হবে।
তুবা বিষ্মিত হয়ে,
– এগুলো তো কারো জানার কথা নয় তুমি জানলে কিভাবে?
– যেদিন তুমি তোমার অসহায়ত্বের গল্প নিয়ে আমার মায়ের সামনে আসলে তোমাকে সন্দেহ হয়েছিল তাই ইনানকে সবটা বললাম তারপর ওই তোমার সব খবর এনে দিলো।
তুবা দাঁড়িয়ে গেল হুংকার দিয়ে,
– শুনো ইফাত তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আইনত আমরা স্বামী-স্ত্রী এছাড়া তোমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই তাই তুমি কিছু করতে পারবে না।
– আমাকে তোমার এত বোকা মনে হয়? কি যেন বললে আমরা স্বামী-স্ত্রী আচ্ছা সাইন করার আগে পেপারটা একবারও দেখেছিলে?
– মানে? পেপার তো বিয়ের ছিল।
ইফাত ইনানকে ইশারা করতেই ইনান একটা পেপার এগিয়ে দিলো তুবার দিকে।তুবা ভালো করে পেপারটা দেখছে। ইফাত বলল,
– আমাদের বাংলাদেশের যেই কোম্পানিটা আছে বাবার নামে,তুবা বাবাকে ভুলিয়ে নিজের নামে কোম্পানিটা লিখিয়ে নেয় তাই আমিও ওর পদ্ধতি অবলম্বন করে বিয়ের নাটক করে প্রোপাটি ফিরিয়ে এনেছি।
তুবা চেঁচিয়ে,
– তুমি আমার সঙ্গে চিট করেছে ইফাত তোমাকে আমি ছাড়বো না।
– আগে নিজেকে ছাড়াও।
কয়েকজন পুলিশ এসে তুবা এবং তোফায়েল আহমেদকে ধরে নিয়ে গেল। ইফাত আগেই পুলিশদের সঙ্গে কথা বলে এমন ব্যবস্থা করেছে যে এ জীবনে আর তারা ছাড়া পাবে না। এনায়েত মির্জা হাফ ছেড়ে,
– আগে যদি সবটা বলতি তাহলে আজ এমন দিন দেখতে হতো না।
– আমি যখন জেনেছি তখন তো তোমরা মিথ্যে বলে বিদেশেই নিয়ে চলে গেলে এছাড়া প্রমাণ যোগাড় করতে সময় লেগেছে তবে আরাফ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
– সত্যিই আরাফ আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে।
আরাফ মৃদু হেসে,
– এটা আমার কর্তব্য স্যার।
– হুম এবার সব ঠিক হয়ে গেলেই ভালো,পলাশ এবারো কি আমার ছেলেকে তোমার মেয়ের জামাই করতে আপত্তি আছে?(এনায়েত মির্জা)
– আর লজ্জা দিও না এনায়েত যেদিন পায়রার কাছ থেকে সবটা জানতে পেরেছিলাম সেদিন নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি বুক থেকে বড় একটা বোঝা নামলো।
– তাহলে বিয়ের দিন তারিখ আজই ঠিক করে ফেলি?
– অবশ্যই।
ইফাত সবাইকে থামিয়ে দিয়ে,
– দিন তারিখ ঠিক করার দরকার নেই।
– কেন?(ইতি বেগম)
– তোমরা দিন তারিখ ঠিক করতে করতে আমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে এর থেকে আজ সবাই এখানে আছে তাই বিয়ে আজ হবে।
– আমার ছেলেটা বিয়ে পাগল হয়ে গেছে।(ইতি
বেগম)
সবাই হেসে দিলো ইফাত এখন আর কোনো কথা গায়ে মাখছে না।ইনান কাজী নিয়ে আসলো ইফাত আগে থেকেই সব প্লান করে রেখেছে। ইফাত পায়রার কাছে বসে,
– এবার কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো মন পায়রা?
পায়রা চোখ পাকিয়ে ইফাতের দিকে তাকাতেই ইফাত মৃদু হাসলো। সবার উপস্থিতিতে পায়রা এবং ইফাতের বিয়ে হয়ে গেল। দুই পরিবার নিজেদের মধ্যে আবারও নতুন সম্পর্ক গড়ে তুললো।
– আমার আরেকটা কথা আছে?
– আবার কি কথা?(এনায়েত মির্জা)
– এখনও আরেকটা বিয়ে বাকি আছে আমার ইচ্ছে আজই বিয়েটা হয়ে যাক।
– কার বিয়ে?( ইতি বেগম)
– ইনান আর সাবিহার।
ইনান আর সাবিহা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো ওরা ভাবতেও পারেনি ইফাত এভাবে সবার সামনে বাঁশ দিবে। সবাই অবাক হয়ে ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে ইফাত বলল,
– ওরা দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসে তোমাদের বলার মতো সাহস ওদের নেই তাই আমিই বলে দিলাম কেউ অমত করো না।
সবাই তাদের দিকে তাকালো।ওরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইফাত সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ইনান আর সাবিহার বিয়ে দিয়ে দিলো। এক দিনেই দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। মির্জা পরিবারে আজ অনেক আনন্দ একসঙ্গে দু’জন নতুন সদস্য তাদের বাড়িতে এসেছে দুই ছেলের বউ।
এনায়েত মির্জা পলাশ শেখের হাত ধরে,
– আজ আমার দুই মেয়েকে কিন্তু আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।
– অবশ্যই কিন্তু একটাই আফসোস ধুমধাম করে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হলো না।
– তাতে কি হয়েছে বড় করে না হয় একটা অনুষ্ঠান করবো।
– হুম।
আরাফ এসে,
– আজ স্যাররা বাড়িতে যেতে পারবে না উনাদের জন্য আমি আগে থেকেই বাসর ঘর সাজিয়ে রেখেছি।
– আচ্ছা আচ্ছা তাহলে আমরাই যাই কাল সবাই বাড়িতে চলে আসবে।
______________
সবাই বাড়িতে চলে গেছে পায়রা আর সাবিহা যে যার যার ঘরে বসে আছে। ইনান ঘরে এসে দরজা আটকে দিলো, সাবিহার কাছে যেতেই সাবিহা চেঁচিয়ে,
– একদম কাছে আসবে না।
– কেন?
– দেশে ফেরার পর একদিনও আমার সঙ্গে দেখা করনি কেন?
– ভাইয়ার কাজ করছিলাম।
– আজও তাই করো।
– ভাইয়া তো ভাবীর কাছে এখন।
– তাহলে আর কি যাও গিয়ে মেঝেতে ঘুমাও এটাই তোমার শাস্তি।
– এমন করে না বউ।
– ন্যাকামো না করে যাও এখান থেকে।
বলেই সাবিহা ইনানের দিকে বালিশ ছুঁড়ে দিলো। বেচারা ইনান উপায় না পেয়ে অধীর কষ্টে নিচে গিয়ে শুয়ে রইল।
ইফাত পায়রার পাশে বসে আছে আর পায়রা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে, সে ঠিক করেছে ইফাতের সঙ্গে এখন কথা বলবে না। ইফাত টেনে পায়রাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে,
– কি কারণে এত রাগ জানতে পারি?
পায়রা নিশ্চুপ। ইফাত পায়রার থুতনি ধরে,
– এত বাঁধা পেরিয়ে এতদিন পর আজ আমরা এক হলাম আর তুমি কিনা এভাবে চুপ করে আছো মন পায়রা?
– আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমার উপর অভিমান করে আমার থেকে দূরে ছিলেন কিন্তু আপনি সব জানতেন তারপরেও কেন এমন করলেন ? একদিন আমায় না দেখে থাকতে পারতেন না তাহলে তিনটা বছর কিভাবে পারলেন এই আপনার ভালোবাসা?
– আমার ভালোবাসা যদি এখনও না বুঝতে পারো তাহলে কিছু বলার নেই তবে এটা বলবো তুমি কখন কি করেছ, কোথায় গিয়েছ এবং কি পোশাক পরিধান করেছ সব খবর কিন্তু আমি রাখতাম তুমি আমায় না দেখলেও আমি রোজ তোমায় দেখতাম।
– আপনি তো আমেরিকা ছিলেন!
– দূর বোকা মেয়ে, হাতের মুঠোয় মোবাইল থাকতে কাউকে দেখার জন্য কষ্ট করতে হয় নাকি?
– কিছু বুঝলাম না।
– রোজ একবার হলেও সাবিহা ভিডিও কল দিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলার বাহানা দিয়ে যখন তোমার কাছে যেত তখনি তোমাকে দেখতাম।
পায়রা চমকে,
– সাবিহা সব জানতো?
– হুম।
– তবে সাবিহা যে বলেছিল
– ওইসব আমি বলতে বলেছিলাম তাই বলেছে আর ইনানের সঙ্গে সাবিহার সম্পর্কটা ছিল ইনান অনেকবার বাংলাদেশে এসে সাবিহার সঙ্গে দেখা করে গেছে।
– ওহ সবাই সব জানতো শুধু আমিই জানতাম না তিনটা বছর শুধু আমি কষ্ট পেলাম।
– কষ্ট কি আমি কম পেয়েছি? তোমাকে ভালোবাসি বলার পর থেকে কম কষ্ট দিয়েছ আমায়? সবসময় অপমান করেছ তারপরেও ভালোবেসে গেছি যখন সবার সামনে অপমান করেছিলে থাপ্পড় মেরেছিলে আবরারের হাত থেকে আংটি পড়েছিলে তখন আমার ভেতরে কি চলছিল আমিই জানি।
ইফাত থেমে আবার বলল,
– যখন সুস্থ হয়ে গেছিলাম বাবা-মা বললো কিছুদিনের জন্য আমেরিকা থেকে ঘুরতে যাবো সবাই তারপর চলে আসব আমিও রাজি হয়েছিলাম কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর এমনভাবে আটকে দিলো আর ফিরতেই পারলাম না তাই বলে তোমার প্রতি ভালোবাসা কিন্তু কমেনি।
– একবার বলতে পারতেন।
– চাইনি বলতে, একটা সময় আমার মনে হয়েছিল জোর করে ভালোবাসা হয় না তাই এত দূর ছিলাম তোমার থেকে। যারা মন থেকে ভালোবাসে তারা কখনও প্রিয় মানুষটির উপর বেশিদিন অভিমান করে থাকতে পারে না আমিও পারিনি, তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম হয়তো আমিও এটাই করতাম কারণ কথায় আছে না বিপদের সময় কখনও মাথায় বুদ্ধি আসে না। আমি চাইলেই তোমাকে নিজের করে পেতে পারতাম কিন্তু এতে কি কোনো লাভ হতো তুমি কি আদৌ আমাকে আমার মতো ভালোবাসতে পারতে আমার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারতে? না বরং তুমি খুব সহজেই আমায় পেয়ে যেতে হয়তো একটা সময় গিয়ে সম্পর্কে সমস্যা হতো তাই তোমার থেকে দূরে ছিলাম বুঝতাম তুমি কষ্ট পাচ্ছো তবুও কিছু করার ছিল না আমি চেয়েছি তুমি মন থেকে আমায় চাও,যখন মনে হয়েছে সত্যি তুমি আমায় ভালোবাসো আমিও তোমায় দেখা দিলাম।
– ওই ডিল আমেরিকা যাওয়া ওগুলো সব!
– আমারই কাজ আমি তোমাকে আমি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলাম অনেক মাথা খাটিয়ে।
– আমার ভুলের জন্য এতদিন আমাদের দু’জনকে কষ্ট পেতে হয়েছে।
– মাঝে মাঝে কম বেশি সবার ভুল হয় আর ভালোবাসার মানুষের ছোট খাটো ভুল ক্ষমা করে দিতে হয় প্রথমে অনেক রাগ হয়েছিল কিন্তু যখন তোমার জায়গায় নিজেকে রেখে ভেবেছিলাম তখন সব রাগ চলে গিয়েছিল।
পায়রা কেঁদে দিলো ঝাঁপিয়ে পড়লো ইফাতের বুকে। ইফাত বাঁধা দিলো না সেও শক্ত করে পায়রাকে ধরলো। পায়রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে,
– আর কখনও এমন ভুল করবো না ভালোবাসি ইফাত কথা দিন সবসময় আমার পাশে থাকবেন।
– কথা দিলাম কখনও আমার মন পায়রার থেকে দূরে যাবো না কষ্ট দিবো না।
(~সমাপ্ত~)